Friday, March 21, 2014

নির্বাচন নয়, স্থিতিশীলতার জন্য রাষ্ট্রদর্শনে ঐকমত্যই জরুরি

আবুল মোমেন
অনেকেই আজকাল বলছেন, একটি অংশগ্রহণমূলক শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলে দেশে স্থিতিশীলতা আসবে। এ কথা সবাই জানি, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার পথে একটি প্রধান অন্তরায় হল স্থিতিশীলতার অভাব। মোটামুটি স্বাধীনতার পর থেকেই শাসনব্যবস্থার কিছু দুর্বলতা, দুর্নীতি এবং বিরুদ্ধ রাজনৈতিক দলের তত্পরতা মিলে দেশটি কখনও শান্তিতে শাসন করা সম্ভব হয়নি। পরে জেনারেল জিয়া দেশের যাত্রাপথই ঘুরিয়ে দিলেন। স্থিতিশীলতাও থেকে গেছে অধরা।
বাংলাদেশের ’৯১-পরবর্তী গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায়ও অস্থিতিশীলতার ধারাবাহিকতাই অব্যাহত থেকেছে। অথচ এ সময় নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অন্তত চারটি শান্তিপূর্ণ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে তাতেও স্থিতিশীলতা আসেনি। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে গৌরব করতে পারি, কিন্তু দুর্নীতিমুক্ত সুশাসন, জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রকাঠামো, জবাবদিহিমূলক স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং সেই বহু কাঙ্ক্ষিত সোনার হরিণ স্থিতিশীলতার লক্ষ্য কি পূরণ হয়েছিল? হয়নি।
এটা মানতেই হবে স্থিতিশীলতা ছাড়া দেশ এগোতে পারবে না। এ বিষয়ে যদি চিন্তাবিদরা সঠিক পথের দিশা দিতে না পারেন তবে স্থিতিশীলতা সোনার হরিণ হয়ে অধরাই থেকে যাবে। আমার ধারণা শাসনব্যবস্থা বা সরকারপদ্ধতি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও রাষ্ট্রের ঐক্য ও স্থিতির মূল অবলম্বন হচ্ছে তার দর্শন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদর্শন কী তা তার জন্মকাহিনিতেই বর্ণিত আছে। কারণ তা ইতিহাসের যাত্রাপথে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত এবং জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে ছিল সঙ্গতিপূর্ণ। বিপরীতে জন্ম থেকে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি যে সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খেয়ে স্বাধীনতার প্রায় সত্তর বছর পরও অস্থিতিশীল হয়ে আছে তার মূল কারণ তারা সঠিক রাষ্ট্রদর্শনের সন্ধান পায়নি। যে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রদর্শন তারা তৈরি করতে চেয়েছে তা স্বাভাবিক ও ধারাবাহিকতায় সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না, এটি ছিল আরোপিত। তাই সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা এড়ানো যায়নি, যাচ্ছে না।
এ দেশের জনগণ এই আরোপিত কৃত্রিম রাষ্ট্রদর্শনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, আন্দোলন চালিয়েছে, সংগ্রাম গড়ে তুলেছে এবং অবশেষে পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ে গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করেছে। প্রায় দুই দশকের দীর্ঘ সংগ্রামে জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক আকাঙ্ক্ষাগুলোর প্রকাশ ঘটেছে এবং এসব বিষয়ে একটি ঐকমত্যও তৈরি হয়েছিল। এখানেই নিহিত আছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদর্শন।
কী সেই রাষ্ট্রদর্শন? বাহাত্তরের সংবিধানের মূলনীতিতে সেটি যথার্থভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। দেশটি হবে সব ধর্মের মানুষের আবাসভূমি, বাঙালির যে ভাষা-সংস্কৃতির গৌরবময় মানবতাবাদী ঐতিহ্য তাকে লালন করবে, ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ঘুচিয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা বহাল থাকবে।
সেই জাতি তার রাষ্ট্রদর্শনকে শক্তিশালী করে এগিয়ে নিতে পারে, যারা তাদের ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়গুলোকে শনাক্ত ও তার মর্যাদা লালন করে এবং ইতিহাসের কীর্তিমান নায়কদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় বাংলাদেশে জাতির ঐক্য ও সংহতির এই উত্স ও ক্ষেত্রগুলো অস্বীকার করার, এ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টির, এমনকী নতুন প্রজন্মকে এক বিস্মৃতির গহ্বরে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। সবাই জানি এই প্রয়াস রাষ্ট্রীয়ভাবে, রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ প্রয়াসে শুরু করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি এ কাজে নির্ভর করলেন স্বাধীনতাবিরোধী ব্যক্তি ও দলের ওপর। যারা ছিল পরাজিত শক্তি, জাতি ও রাষ্ট্রের কাছে অপরাধী, অনেকেই সুনির্দিষ্ট অভিযোগে অভিযুক্ত আসামি, পলাতক, লোকসমাজের আড়ালে তিনি তাদের খুঁজে নিলেন, বৈধতা দিলেন, শক্তি জোগালেন এবং রাষ্ট্রীয় কাজে যুক্ত করলেন। এভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রদর্শনের সংকটের সূচনা হয়েছে। এরপর থেকে অস্থিতিশীলতা আমাদের পিছু ছাড়েনি।
পাকিস্তানসহ একই সময়ে ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল উপমহাদেশের তিনটি দেশ। অপর দুটি দেশ হল ভারত ও শ্রীলংকা। দুটি দেশই দারিদ্র্যসহ নানা সমস্যার ভেতর দিয়ে গেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদের সংকট, এমনকী সশস্ত্র যুদ্ধ দুুদেশই সামলেছে। দুুদেশেই মার্কসবাদী-মাওবাদীদের বিপ্লবী তত্পরতাও চলেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও শাসনকর্মে স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়নি, দেশগুলো এগিয়ে গেছে। এর কারণ ইতিহাস ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে জাতির মূল স্রোতে বিভক্তি, বিভেদ চর্চা হয়নি। সংকটের সময় তারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আমাদের কাছে ভারত অনেক পরিচিত, তাই সেখানকার দৃষ্টান্ত সবার বুঝে নিতে সুবিধা হবে। ভারতবর্ষের যে-কোনও ধর্মাবলম্বী মানুষ— হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, প্রকৃতি পূজারি ইত্যাদি সবাই ভারতীয়ত্বের গর্বে একইভাবে অনুপ্রাণিত বোধ করেন। পাঞ্জাবি, বাঙালি, তামিল, বিহারি, উড়িয়া, অহোম বিচিত্র এসব জাতির সবারই মধ্যে এই ভারতীয়ত্ব আমরা দেখি। চীন-ভারত এবং পাক-ভারত যুদ্ধ বা অন্য যে-কোনও সংকটে তারা দলীয় বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করেছে। রাষ্ট্রের তথা সরকারের দুর্বল মুহূর্তে তাকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করে না। সবাই এক হয়ে কাজ করে।
এই যে ভারতীয়ত্বের গৌরববোধ এটা আসে অতীত ঐতিহ্য ও ইতিহাস থেকে। তাদের ইতিহাসের নিদর্শন, যেমন মুসলিম স্থাপত্য তাজমহল, হিন্দু স্থাপত্য কোনার্কের মন্দির কিংবা বৌদ্ধ স্থাপনা সারনাথ প্রভৃতিকে ধর্মনির্বিশেষে তারা মর্যাদা দেয়। ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ শাসক হিসেবে হিন্দু চন্দ্রগুপ্ত, বৌদ্ধ অশোক বা মুসলিম আকবরের প্রতি শ্রদ্ধা এবং এদের জীবন ও কর্মের চর্চায় কোনও বিভাজন করে না। স্বাধীনতার ইতিহাসের নায়ক হিসেবে গান্ধি-নেহরুর সঙ্গে মৌলানা আজাদ-গাফফার খানরাও মর্যাদায় অভিষিক্ত হন। মহাত্মা গান্ধির লবণ সত্যাগ্রহ যদি গুরুত্বপূর্ণ হয় তো মাস্টারদা সূর্যসেনের চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের গুরুত্বকেও খাটো করা হয় না। এভাবে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পারম্পর্য ও ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়।
উল্টোদিকে পাকিস্তান চালিয়েছিল সাম্প্রদায়িক নীতি। বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতিসহ রাজনৈতিক অধিকারের যে-কোনও আন্দোলনকেই তারা ষড়যন্ত্র হিসেবে গণ্য করেছে, আন্দোলনকারীদের ভারতপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে এবং নানাভাবে দাবিয়ে রেখে শোষণ চালিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের কৌশল। সেদিন কেন আমরা এই শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে গেছি, কেন আমরা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছি? প্রথমত, আমাদের রাষ্ট্রদর্শনের সঙ্গে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদর্শনের মিল হয়নি। তাদের রাষ্ট্রদর্শন মেনে নিলে বাঙালি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব থাকত না, আমাদের বিকাশ ঘটত না। দ্বিতীয়ত, কেন আমরা শত নির্যাতন সত্ত্বেও এসব আন্দোলনে সফল হয়েছি, কেনই বা মুক্তিযুদ্ধে এত ত্যাগ স্বীকার করে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে বিজয়ী হতে পেরেছি? কারণ একটি রাষ্ট্রদর্শনে সেদিন আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছিলাম। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ এর বিরোধিতা করে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল মাত্র। এই সংগ্রামের পুরোধা এবং ঐক্যের কারিগর ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের মহানায়ক, জাতির পিতা, রাষ্ট্রের স্থপতি। তার স্থান সবার চেয়ে আলাদা, স্বতন্ত্র, সবার ঊর্ধ্বে।
কিন্তু তাকে হত্যা করার পর থেকে জেনারেল জিয়া এ জাতিকে ইতিহাস বিকৃতির পথে টানতে চেয়েছিলেন। তিনি রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদর্শন অনুসরণ করে দেশ পরিচালনা করেছেন। এ দেশের মানুষ তা মানেনি। তার বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু টানা দীর্ঘ কুড়ি বছর এ ধারায় দেশ শাসিত হওয়ায় গণমাধ্যমে তারই প্রতিফলন ঘটেছে এবং এতে বড় ক্ষতি হয়ে গেছে দেশের। এ দুই দশকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে, দুটি প্রজন্ম এ সম্পর্কে অনবহিত থেকে বড় হয়েছে। ফলে জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে। তারই খেসারত দিয়ে চলেছি আমরা।
এই গুরুত্বপূর্ণ কাজ অসমাপ্ত রেখে কেবল অংশগ্রহণমূলক সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করে দেশে স্থিতিশীলতা আনা যাবে না। তা যে যায় না তা তো আমরা ভুক্তভোগী জাতি হিসেবে ভালোভাবেই জানি। গত ২৪ বছরে চারটি সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করেও স্থিতিশীলতা পাইনি, কার্যকর গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পাইনি। কীভাবে এই স্থিতিশীলতা অর্জিত হবে? যদি আমরা এ কাজে সফল দেশের দৃষ্টান্ত টানি তাহলে দেখব নির্বাচন নয়, স্থিতিশীল সরকারই এ ফল এনে দিয়েছে। চারটি দেশের দৃষ্টান্ত আমরা অহরহ টানি, যেমন মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, থাইল্যান্ড। তাদের রূপান্তরের কারিগররা হলেন মাহাথির মোহাম্মদ, লি কিউ ইয়ান, পার্ক চুংহি এবং নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের সামরিক শাসকরা। এরা সবাই কর্তৃত্বপরায়ণ শাসক ছিলেন, নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের মাধ্যমে চরম বিপক্ষ মতকে দমিয়ে রেখেছিলেন। আর ভারতবর্ষের ইতিহাসে দেখি সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্যেই আধুনিক ভারতের রূপকার জওহরলাল নেহরু আমৃত্যু টানা সুদীর্ঘ ১৭ বছর দেশ শাসন করেছেন। এ সময়ে তিনি দেশের শিল্পায়নের ভিত্তি তৈরি করে দেন। এর পরও কংগ্রেস দলই দেশ শাসন করে, একটি দল টানা ৩০ বছর ক্ষমতায় ছিল। এ রকম দীর্ঘ  শাসনের দৃষ্টান্ত আরও দেওয়া যাবে। গণতন্ত্রেই নিকট-অতীতে ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচার ও টনি ব্লেয়ার প্রত্যেকে টানা ১২ বছর করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে একজন রাষ্ট্রপতি পর-পর দুবারের বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন না। ইতিহাসে দেখা যায় অল্প কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া সব রাষ্ট্রপতিই দুই মেয়াদে ৮ বছর করে দেশ শাসন করে গেছেন। বর্তমানে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল সম্প্রতি তৃতীয় মেয়াদের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন।
একটি পরিণত জাতি স্থিতিশীলতা তথা উন্নয়নের জন্য যেমন ত্যাগ স্বীকার করে তেমনি ধৈর্যও ধরে। আমাদের ইতিহাসের পরীক্ষিত দৃষ্টান্তগুলো থেকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকারের মেয়াদ দীর্ঘ হলে দুর্নীতি কমানো, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং সুশাসনের পথে এগোনো সম্ভব হবে। কিন্তু কোনও অবস্থায়ই দেশের রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে ছেলে খেলা করতে দেওয়া যাবে না। কারণ তাতে জাতি তার গৌরবের অধ্যায়, অক্ষয় কীর্তি, ইতিহাসের নায়কদের সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। দেশের মানুষ যদি ভাষা আন্দোলন, গণ-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গর্ববোধ না করে, যদি ভাষাশহীদ ও ভাষাসৈনিক, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয়; যদি বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাঙালির শিল্প ও সংস্কৃতি, বাঙালির রাজনৈতিক কীর্তি সম্পর্কে গৌরববোধ না জন্মায়; যদি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-জসীমউদ্দীনসহ সাহিত্যশিল্পী, লালন-আব্বাসউদ্দিন, জয়নুলসহ শিল্পীবৃন্দ, যদি শেরেবাংলা-বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীনের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে শ্রদ্ধা না থাকে তাহলে কীভাবে রাষ্ট্রদর্শন তৈরি হবে? কীভাবেই বা জাতীয় ঐক্য ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে?
আমাদের রূপান্তর ও উত্তরণের কাণ্ডারি কে হবেন? কোন রাজনৈতিক শক্তিকে আমরা দীর্ঘমেয়াদে দেশ শাসনের জন্য, জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দেব সে বিষয়টি ঠিক করতে হবে। দ্বিপক্ষীয় তর্ক চালিয়ে গেলে কেবল বিভ্রান্তি ছড়াবে, তর্কের খাতিরে তর্কই চলবে, যা আজকের টকশো-মহামারীতে ঘটছে। আমাদের গভীর চিন্তা, যুক্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে একটি প্রজ্ঞাবান সিদ্ধান্তে আসতে হবে। আমার মনে হয় ইতোমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে, এ ব্যাপারে আর দেরি করা ঠিক হবে না।

Tuesday, March 4, 2014

গ্রামপতনের শব্দ আর কত শুনব?

আবুল মোমেন


১৯৭১-এ আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। ১৯৯১ তে গণতন্ত্র। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র এ দুটিই তো ছিল জাতির স্বপ্ন। দুটিই অর্জিত হয়েছে। প্রথমটির পরে ৪৩ বছর অতিবাহিত হল আর দ্বিতীয়টি অর্জনের পরে কেটে গেছে ২২টি বছর। মধ্যে দু’বছরের অনির্বাচিত সরকারকে হিসেব থেকে বাদ দিলেও দুই দশক তো পার হয়েছে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে। কিন্তু মানুষ কি স্বাধীনতা পেয়েছে? গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, যেখানে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দায় থাকে? যেখানে বিরোধী দল সংসদে,গণমাধ্যমে ও সমাজে গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে দায়িত্বশীল ভূমিকা নেয়? যেখানে ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিক তার অধিকার ভোগ ও প্রয়োগ করতে পারে?
এসব প্রশ্নের জবাব শিক্ষিত-শিক্ষাবঞ্চিত ধনী-নির্ধন নারী-পুরুষ সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু বড়-ছোট সকল নাগরিক মনে মনে বা প্রকাশ্যে বারবার যে ভাষায় উচ্চারণ করে তা বেশির ভাগ সময় প্রশ্নমুখর - নানা কেনর সমাহারে সে প্রশ্নমালা তৈরি হয়। এবং শেষে উচ্চারিত হয় অসহায় কাতরধ্বনিতে পাল্টা প্রশ্ন - কেন আমরা বারবার ব্যর্থ হচ্ছি? নাগরিকদের অনেকে কোনো কোনো সময়, আর কেউ কেউ স্থায়ীভাবেই হতাশ ও ক্ষুব্ধ। তাঁরা দেশ, রাজনীতি, প্রশাসন, ভবিষ্যতসহ সবতাতেই আস্থা হারিয়েছেন।
কিন্তু আমাদের শিক্ষিত শহুরে মানুষ সরকারের মুখাপেক্ষী হলেও সাধারণ মানুষ আবহমান কাল ধরেই কারও ভরসায় বসে না থেকে নিজের চেষ্টায় জীবনধারণ করে চলেছে। তাদের চাহিদা সামান্য, তারা শেখে দ্রুত, প্রয়োগে সফল। দেখা যায় মানুষের যেগুলো ন্যূনতম বস্তুগত চাহিদা সেগুলো অর্জনে আমাদের দেশ সফল। প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তার, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, জাতীয় টিকা কর্মসূচী সম্প্রসারণ, মাতৃস্বাস্থ্য, নারীর উপার্জন, দারিদ্র দূরীকরণ ইত্যাদিতে আমাদের সাফল্য প্রায়ই বিশেষজ্ঞদের চমকে দিয়ে থাকে। জনসংখ্যার গড় আয়ুও তারাই বাড়াতে পেরেছে। কিন্তু যেসব জায়গায় উন্নতি করা দরকার ছিল, যেসব জায়গায় অবস্থার গুণগত পরিবর্তন না হলে কোনো উন্নতিরই চূড়ান্ত ফল লাভ ও তা টেকসই করা সম্ভব নয় তার দায়িত্ব পড়েছে শিক্ষিত শহুরেদের ওপর। সেখানেই আমরা বরাবর হোঁচট খাচ্ছি, আর তাতে তলায় যে অগ্রগতি হচ্ছে তার চূড়ান্ত টেকসই ফল অধরা থেকে যাচ্ছে। সে কাজগুলো হল, যেমনÑশিক্ষার মানোন্নয়ন, পুষ্টি ও রোগ পরিচর্যা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন, নারীর প্রকৃত সমানাধিকার ও ক্ষমতায়ন, কৃষিজাতপণ্যের বাজারজাতকরণ ও বিপণন, জীবন মানের উন্নয়ন, যোগাযোগে সড়ক ও গণ পরিবহনের উন্নয়ন ইত্যাদি। এসব কাজের দায়িত্ব রয়েছে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের ওপর। এরাই অদক্ষতা, দুর্নীতি, হীনম্মন্যতা, কোন্দলপ্রবণতা ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজের নিচের তলার মানুষের কঠিন পরিশ্রম ও বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সাফল্যকে ব্যক্তিস্বার্থের ভোগে লাগায় ও নষ্ট করে।
তাহলে একথা কি স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে না যে এ দেশে একদল খেটে খুটে সমাজ ও অর্থনীতির চাকা চালু রেখেছে আর আরেক দল বসে বসে তা ধ্বংস করছে? হয়ত এরকম সরলভাবে জাতিকে বিভক্ত করা উচিত নয়, আমার উদ্দেশ্যও তা নয়। মূল গোলমালটা বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের অসফলতা নামক রোগের মূল কারণ নির্ণয় করাই আমাদের লক্ষ্য। সবাই জানতে চান বারবার এগিয়ে আবার মুখ থুবড়ে পড়ার কারণটা কি? জাতি যদি একটি দেহ হয় তো মানবদেহের মতই তার মৌল উপাদান হাড়, কোষ, পেশি, রক্তনালী ইত্যাদি সবই সচল রয়েছে শ্রমজীবীদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফলে। কিন্তু এসব থেকে যথার্থ ফল লাভ ব্যাহত হচ্ছে। এসবই ঘটছে পরিচালনা ও রক্ষাণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত অংশের গাফিলতিতে। এরা শিক্ষিত সুবিধাভোগী শ্রেণি। কী কারণে এরা মাঠের মানুষদের শ্রমের উপার্জন ব্যর্থ করে দিচ্ছে? এদের এ অবস্থানে আসার পেছনে দায়ী যা তার নাম শিক্ষা। হ্যাঁ অপরাধীর নাম শিক্ষা। দেশে ও সমাজে গোলমালটা পাকাচ্ছে, ঘটাচ্ছে, জিইয়ে রাখছে শিক্ষিতরাই। শিক্ষার মূল ক্ষেত্র অবশ্যই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান - আপাতত আমরা স্কুল পর্যন্ত ধরেই  কথা বলব। কারণ এটুকুতেও যদি মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা যেত তাহলেই একটা যথার্থ শিক্ষিত জাতি আমরা পেতাম। তাহলে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ, নৈতিক বিবেচনা শক্তি এবং সৃজনশীল ক্ষমতা এমন পর্যায়ে অর্জিত হতে পারত যা তাকে দুটি সম্পদে যথার্থ মানুষ ও দায়িত্বশীল নাগরিক হতে সাহায্য করত। সে দুটি সম্পদ হচ্ছে আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদাবোধ। হ্যাঁ স্কুলের পাশাপাশি পরিবার, ধর্ম, রাজনীতি, গণমাধ্যমও জনশিক্ষার প্রসার ও জনমানস গঠনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পরিবার ছাড়া উল্লিখিত সব প্রতিষ্ঠানই শিক্ষিত মানুষদের হাতেই রয়েছে। ফলে ভ্রান্ত ও অসম্পূর্ণ শিক্ষার দায় আমরা এড়াতে পারি না।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক জরীপে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুলে অন্তর্ভুক্তির পরিমাণ ছেলেমেয়ে মিলেই প্রায় শতভাগ হলেও অর্জন-লক্ষ্য পূরণে সাফল্য কেবল হতাশাজনক নয়, রীতিমত চমকে দেওয়ার মত দু:খজনক। গণিতে নির্ধারিত মান অর্জন করে মাত্র ৩০ ভাগ ছাত্র আর মাতৃভাষা বাংলায় তা শোচনীয়ভাবে ২৬ শতাংশ! অর্থাৎ অধিকাংশ শিশুর ৫/৬ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা বিশেষ কোনো কাজে আসছে না। বর্তমান সরকার সংখ্যাগত সাফল্যের ওপর জোর দিতে গিয়ে পরীক্ষা বাড়িয়ে দেওয়ায় ফলাফল সর্বস্ব হয়ে পড়ছে শিক্ষা, বাড়ছে মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরতা যার ফলে শিক্ষা গুটিকয়েক প্রশ্নের উত্তর শেখার    নামান্তর হয়ে পড়েছে। ধর্ম চর্চার বিষয়টি দখল করে নিয়েছে ধর্মব্যবসায়ী, ধর্ম নিয়ে রাজনীতিবাজ এবং প্রাচীনপন্থী কট্টরপন্থীরা। এরা একটি মানবিক গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের মত পরিবেশ বিঘিœত করেই ক্ষান্ত হয় না, পাশাপাশি ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা ও মূল্যবোধ সঞ্চারে ব্যর্থ হয়ে ও মৌলবাদ-জঙ্গিবাদকে উস্কে দিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করছে। রাজনীতিবিদরা আপাতত গালভরা বুলির মুখোশ পরে ক্ষমতার মধু লুটে আখের গুছাতেই ব্যস্ত রয়েছেন। গণমাধ্যমে বৈদ্যুতিক চ্যানেলগুলো সঠিক চিন্তা, যোগ্য সৃজনশীলতা ও প্রজ্ঞার অভাবে বোকার বাক্সের অধিক কিছু হতে পারছে না। মুদ্রণ মাধ্যমে অস্বাভাবিক, অস্বাস্থ্যকর বিষ্ফোরণ ঘটে এখন বিকার ও বিভ্রান্তি চলছে, কেউবা বাণিজ্যিক সাফল্য নিয়েই মরিয়া। পরিবার প্রধানরা ভোগবাদিতার বাজারে নানামুখী চাপের মধ্যে পড়ে প্রকৃত অভিভাবকত্ব দিতে অক্ষম। কোনো সূত্র থেকেই জনশিক্ষা ও জনরুচি তথা সুস্থ জনমানস গঠনের কোনো উপাদান, আহার্য মিলছে না। ফলে সমাজের নিচের তলার মানুষ দিনরাত খেটে কোনো মতে কায়ক্লেশে বেঁচে আছে। আমরা তাদের উৎপাদন ব্যয় না মিটিয়ে উৎপাদনের সাফল্যের ভাগ লুটে নিচ্ছি। শিক্ষার নামে তাদের সাথে পরিহাস করছি, ধর্মের নামে তার সুস্থ বিনোদনের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাকে নিক্ষেপ করছি অসুস্থ অন্ধকার জীবেনর দিকে। সাংবাদিক-শিক্ষক-চিকিৎসক-রাজনীতিবিদ, এমন কি জনসেবকের ভূমিকায় অভিনয় করে তাদের শ্রমের মূল্য না চুকিয়ে আখের গুছাচ্ছি।
এভাবে চলতে থাকলে দেশের সিংহভাগ মানুষের স্বাধীনতা আসবে কোত্থেকে? গণতন্ত্রে তাদের স্বার্থ কীভাবে রক্ষিত হবে?
আমাদের গণতন্ত্রের মানসকন্যারা অস্ত্রধারীদের বেষ্টনিতে বন্দিত্বের নিরাপত্তায় বাস করেন। আমাদের সবধরনের নেতারা-রাজনীতিক সাংবাদিক শিক্ষক চিকিৎসক প্রকৌশলী আইনজীবী সকল ক্ষেত্রে নেতারাই বিত্ত-ক্ষমতার বা নেতৃত্ব-তোষামুদির বৃত্তে বাঁধা পড়েছেন। শিক্ষিত বিবেকবান উন্নত চরিত্রের মুক্ত মানুষ কোথায়?
যে সমাজে এ ধরনের মুক্ত মানুষ বেশি থাকবেন কেবলমাত্র সেই সমাজই এগিয়ে যেতে পারবে। আমরা দূর থেকে হতাশা, বেদনা ও আক্ষেপ নিয়ে তাকিয়ে দেখি কীভাবে প্রতিনিয়ত আমাদের ভরসাস্থলগুলো উন্মত্ত ভয়ঙ্কর ঘোলাস্রোতে তলিয়ে যাচ্ছে। কবি জীবনানন্দের ভাষায় চারদিক থেকে প্রতিনিয়ত ‘গ্রামপতনের শব্দ শোনা যায়।’
আর কত জনপদ লোকালয় ভাঙলে বোধোদয় হবে আমাদের?