Saturday, April 11, 2015

ফাঁসি, চিঠি ও জামায়াতের রাজনীতি

আবুল মোমেন

জামায়াত নেতা কাদের মোল্লা রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চান নি। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত কামারুজ্জামান চাইবেন কিনা তা নিয়ে অনেক পানি গড়াল। অবশেষে তিনি চান নি। সেটাই স্বাভাবিক।
দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা যদি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন তাহলে আবেদনপত্রে তাঁকে অপরাধ স্বীকার করতে হবে। জামায়াত দল হিসেবে এখনও তা করে নি। ফলে একজন শীর্ষ ও পরিচিত নেতা ক্ষমা চাইলে দলের নীতি বিরুদ্ধ কাজ হবে।
পাঠক এ লেখা যখন পড়বেন হয়ত তখন কামারুজ্জামানের দণ্ডাদেশ কার্যকর হয়ে গেছে। আর না হলে কবে হবে তা সরকারই ভালো জানেন। অযথা জল্পনা করে আমাদের লাভ নেই। বরং আলোচনা হওয়া উচিত দলের নেতাদের উদ্দেশ্যে জেল থেকে লেখা তাঁর সাড়ে চার বছর আগের চিঠিটি নিয়ে। ২৬ নভেম্বর ২০১০ সনে লেখা সেই চিঠিতে কামারুজ্জামান একাত্তরের ভূমিকার কারণে দল হিসেবে জামায়াতের গায়ে ও বর্তমান নেতাদের গায়ে অপরাধের দাগ বহন করতে হচ্ছে বলে তাঁদের বাদ দিয়ে নতুন নেতৃত্বকে সামনে আনতে বলেছেন; পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে দলের সাংগঠনিক রূপ ও রাজনীতির সামঞ্জস্য সাধনের কথাও বলেছেন। একাত্তরের ভূমিকার জন্যে সরাসরি ভুল স্বীকার না করলেও তিনি লিখেছিলেন - ‘একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরোধিতা জামায়াতের গ্রহণযোগ্যতার পথে বড় বাধা।’ প্রায় পাঁচ বছরের ব্যবধানে আজকের বাস্তবতায় বলতে হবে যে তাঁর মূল্যায়ন ঠিকই ছিল,  দল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বানী অনেকটাই ফলেছে। তাঁর চিঠির সাথে সহমত হয়ে তখন জামায়াত নেতা ব্যারিষ্টার আবদুর রাজ্জাক পত্রিকায় কলামও লিখেছিলেন। এরপরেই কিনা জানি না, তিনি এখন নিষ্ক্রিয়। দলীয় নেতাদের চূড়ান্ত আইনি লড়াইয়ের কঠিন সময়ে এই অভিজ্ঞ আইনজীবী অনুপস্থিত রয়েছেন।
পত্রিকার খবরে জানা যাচ্ছে তখন জামায়াত ও ছাত্র শিবিরের নেতাদের মধ্যে কামারুজ্জামানের পরামর্শ নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছে এবং অনেকেই তাঁর মতামতকে গুরুত্ব দিতে বলেছিলেন।
একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় জামায়াত নেতৃত্ব ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যেমন তেমনি স্বাধীনতা পরবর্তী কালেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা অনুধাবনে ভুল করেছেন। একাত্তরের পরাজয়কে তাঁরা সাময়িক পরাজয় মনে করেছিলেন এবং সে কারণে প্রাক ’৭৫ পর্বে দেশের অভ্যন্তরে নানা কৌশলে আত্মরক্ষার ও দেশের বাইরে পাকিস্তানের সহযোগিতায় মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে একাত্তরের ভূমিকার সম্প্রসারণ করে যাচ্ছিলেন। এর পরপরই পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনে তাঁদের জন্যে সত্যিই সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়। নিজের ক্ষমতা সংহত করতে গিয়ে জেনারেল জিয়া নির্ভরযোগ্য সাংগঠনিক সমর্থন পেয়েছেন জামায়াতের কাছ থেকে। এর চার বছর পরে ১৯৭৯ সনে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সফল হওয়ার পর দলের নেতা-কর্মী ও ছাত্র-তরুণদের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দেশেও অনুরূপ ইসলামি বিপ্লব ঘটানোর স্বপ্ন দেখাতে পেরেছিলেন জামায়াত নেতৃত্ব। আবার ঐ একই সময়ে পেট্রোডলারের জোয়ারে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল।
জামায়াত নেতারা এসব দেশের শাসকদের বোঝাতে সক্ষম হয়েছিল যে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ভারতের সাহায্যে এবং ভারত প্রভাবাধীন দেশটিতে এখন ইসলাম ও ইসলামি শক্তি বিপন্ন, দুর্বল। একে সচল করার জন্যে কাজ করতে হবে। তারা এই দেনদরবারে সফল হয়েছিলেন। প্রচুর অর্থ তারা তখন নিয়মিত পেয়েছেন। কিন্তু বড় কথা হল জামায়াত নেতারা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য ও বিদেশি পৃষ্ঠপোষকতাকে সাংগঠনিক শক্তিবৃদ্ধির কাজে লাগাতে পেরেছে, তারা মনোযোগ দিয়েছিল ছাত্র সংগঠনকে শক্তিশালী করা, প্রাপ্ত অর্থের ব্যবসায়িক বিনিয়োগ এবং সমাজব্যাপী ইসলামি সংস্কৃতির প্রভাব বৃদ্ধির দিকে। মানতেই হবে তাদের সেসব লক্ষ্য পূরণে তারা বহুলাংশে সফল হয়েছে। আজকে জামায়াত হয়ত রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে বিতাড়িত, কিন্তু সমাজে তাদের সাংস্কৃতিক প্রভাব এখন যেন তাদেরও ডিঙিয়ে চরম রূপ ধারণ করছে। যে কারণে ইসলামি রাজনীতিতে এখন সহজেই জামায়াতকে ছাপিয়ে জঙ্গি মনোভাবের দলগুলো মাথাচাড়া দিচ্ছে।
জামায়াতের এই সাফল্য মেনে নিয়েও বলতে হবে দলটি দেশের ও জাতির নিয়তি সম্পূর্ণ ধরতে পারে নি। যে কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করতে পারবে না। করবে না। এটা তার ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়। এর সাথে অধিকাংশ পরিবারের আত্মিক ও প্রত্যক্ষ যোগ আছে। সে সংযোগের সাথে রয়েছে বীরত্ব ও সর্বোচ্চ ত্যাগের ব্যঞ্জনা। আর স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা এবং গৌরব কে ম্লান করতে চাইবে? বিষয়টি ঠিক এভাবে ব্যাখ্যা না করলেও কামারুজ্জামান সমস্যাটা ঠিকই ধরেছিলেন। তিনি লিখেছেন তাঁরা ভেবেছিলেন একসময় ‘মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি মিটমাট হয়ে যাবে।’ উল্লিখিত চিঠিতে স্বীকারও করেছেন যে তাঁরা তা করতে পারেন নি।
১৯৭১ সনে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধতা করেছিল তারা সেদিন ইসলাম ও পাকিস্তানকে এক করে দেখার চোখ দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধকেও দেখেছিলেন এবং তাই ইসলাম ও বাংলাদেশকে পরস্পর বিরুদ্ধ হিসেবেই বিচার করেছেন। স্বাধীনতার পরের ঘটনাবলিতে, অন্তত ১৯৭৬ সন পর্যন্ত, তারা ইসলামি রাষ্ট্র কায়েমের স্বপ্ন দেখে গেছে। জানি না, হয়ত আজও অনেকেই দেখছেন।
বর্তমান সংবিধানের আলোকে কেউ যদি বাংলাদেশকে ইসলামি রাষ্ট্র আখ্যা দেন তাহলে তাঁকে ভুল বলার দায় নিতে হবে কি? সংবিধানে গণতন্ত্রের কথা থাকলেও তা তো ধর্মনিরপেক্ষ নয়। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম তো আছেই, আবার সংবিধানের শীর্ষে বিসমিল্লাহও রয়েছে। কিন্তু কথা হল, যে নামেই ডাকা হোক বাংলাদেশ তো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ফসল। জামায়াতে ইসলামি তো মুসলিম লীগ বা কৃষক শ্রমিক পার্টির মত কেবল পাকিস্তানকে সমর্থন দেওয়া আর মন্ত্রিসভায় অংশ নেওয়ার মধ্যে তাদের তৎপরতা সীমাবদ্ধ রাখে নি। তারাই আলবদর, আলশামসের মত ঘাতক বাহিনীগুলো গঠন ও পরিচালনা করেছিল। এ বাহিনীগুলো তো সত্যিই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল একাত্তরে। সে-ও তো একটি-দুটি, একশ-দু’শ নয় - ত্রিশ লক্ষ। এ ইতিহাস জামায়াত মুছবে কি করে? জনাব মতিউর রহমান নিজামি যে আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন বা কামারুজ্জামান এবং অন্যান্য নেতারা বিভিন্ন পদে থেকে স্বাধীনতা বিরোধী কাজ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অংশ নিয়েছেন সে কথা অস্বীকার করবেন কী করে? বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের তথা স্বাধীনতা যুদ্ধের অধ্যায়টি এড়িয়ে তো বাংলাদেশের ইতিহাস হবে না।
স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামির অর্জন কম হয় নি। সেটা রাষ্ট্রে ও সমাজে অনুভূত হয়, দৃশ্যমান। কিন্তু আমার বিবেচনায় এক অবস্থানে গোঁ ধরে থেকে এর বেশি অর্জন একাত্তরের ফসল বাংলাদেশ আর সম্ভব নয়। যদি নেতৃত্ব অহং নিয়ে ভোগেন, পুরোনো চিন্তা আঁকড়ে থাকেন তবে এবার থেকে জামায়াত পিছিয়ে পড়তে থাকবে। সেটা বিপুল অর্থ ও সাংগঠনিক শক্তিও ঠেকাতে পারবে না। কারণ আজ বিশ্বায়ন, প্রযুক্তিবিপ্লব, বাজার অর্থনীতি মিলে সারা বিশ্বের মত বাংলাদেশও এক কালান্তরের সম্মুখীন। কালান্তরের এই বাণী বিএনপিও ঠিক ধরতে পারে নি বলে মনে হয়। প্রচণ্ড কর্তৃত্ববাদী শাসন সত্ত্বেও শেখ হাসিনা তা অনুধাবন করেছেন বলে মনে হয়। জনপ্রিয়তার মানদণ্ডে না হলেও ক্ষমতার মানদণ্ডে তিনি যদি এ পরীক্ষায় উৎরে যেতে পারেন তবে বিএনপি-জামায়াত ও এই ধারার সবার রাজনীতিই তামাদি হওয়ার আশংকায় পড়বে।

***