Sunday, June 16, 2013

পেশাদারী জীবনে বরাবর কলাম লিখে এসেছি। চাকুরি ছাড়ার পর ভাবছি কলাম নিয়ে প্রথাগত পথেই চলব নাকি প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে নতুন পথে এগুব। ভাবতে ভাবতেই অভ্যাসবশত সমকালীন প্রসঙ্গ নিয়ে এই লেখা। আপাতত ফাঁকা সময়ে প্রযুক্তির দারস্থ হলাম। দেখা যাক, পাঠকের কাছে পৌঁছানো যায় কিনা।

তবে জানিয়ে রাখি নানা বয়সের আগ্রহীদের জন্যে বিচিত্র বিষয় নিয়ে একটু শিক্ষামূলক একটা ব্লগ চালু করতে যাচ্ছি, বিশ্ববিদ্যা চর্চা প্রকল্প নামে। তাতে আমার সাথে যোগ্যতর আরও কেউ কেউ থাকবেন। সেটি এই বুধবার থেকে চালু হবে। আগ্রহী সকলকে আমন্ত্রণ।

আশরাফুল প্রসঙ্গ প্রতিভার পরিচর্যা

আশরাফুল প্রসঙ্গ
প্রতিভার পরিচর্যা
আবুল মোমেন

আশরাফুল প্রসঙ্গ আপাতত চাপা আছে। আকসু প্রতিবেদন বিসিবির হাতে এলে তা আবার আলোচনায় উঠে আসবে। ক’দিন ধরে পত্রপত্রিকায় আশরাফুলের স্বীকারোক্তি, ক্ষমা প্রার্থনা এবং বিভিন্ন জনের প্রতিক্রিয়া অনেকেই পড়েছি। নায়কের আসন থেকে তার ছিটকে পড়ার দৃশ্য কারুর ভালোলাগার কথা নয়। আশরাফুলও বুঝতে পেরেছেন কাজটা তিনি ঠিক করেন নি, ভুল এবং অন্যায় হয়েছে। ভুল ও অপরাধের উপলব্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ন্যায়ের ঝাণ্ডা ওড়াতে গিয়ে এসব বিবেচ্য বিষয় সংশ্লিষ্টদের মনে যেন থাকে।
এই দুঃখজনক ঘটনার সূত্র ধরে চলে আসে আরও কয়েকটি বিষয়। প্রতিভার পরিচর্যা করার দায়িত্ব সমাজের। মানবসমাজে বিরল প্রতিভাধর কেউ কেউ কিছু বিধিদত্ত বিস্ময়কর ক্ষমতা ও পারদর্শিতা নিয়েই জন্মান। যথাযথ পরিচর্যার অভাবে অনেক সময় সেসব ভালোভাবে বিকশিত হয় না। আবার প্রাথমিক বিকাশের পর প্রচার, জনপ্রিয়তা, প্রতিষ্ঠা, বিত্ত মিলিয়ে যে জটিল কিন্তু পিচ্ছিল বৃহত্তর জগতে তাদের পদার্পণ করতে হয় তাতে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার তথা এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা পাওয়া জরুরি। নয়ত নক্ষত্রের পতন ঠেকানো যায় না। কেউ অল্প মাশুল গুণে ভুল উপলব্ধি করেন, নিজেকে শোধরানোর সুযোগ পান, অনেকে বড় মাশুল চুকিয়ে হারিয়ে যান। গুণি প্রতিভাধর মানুষের এরকম পরিণতি সমাজের জন্যে ভয়ানক ক্ষতিকর। ফলে গুণির ও প্রতিভাবানের পরিচর্যায় সমাজের দায়িত্বের কথা ভুলে গেলে চলবে না।
সমাজ কথাটা একটু অস্পষ্ট থেকে গেল, এটা স্পষ্ট করা দরকার। নানা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ব পালিত হয়। এর মধ্যে প্রাথমিক দায়িত্ব হল পরিবারের, তারপর স্কুলের। সবার জন্যে এ দুটি সত্য। তারপর ক্ষেত্রবিশেষে দায়িত্ব ভাগ হয়ে যাবে। আশরাফুলের ক্ষেত্রে এ দায়িত্ব পড়বে তাঁর উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপির ওপর। তারপর এদেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা বিসিবি, তাঁর ক্লাব ও জেলার ব্যবস্থাপনা কমিটি, যে অসংখ্য ট্যুরে তিনি গেছেন তার কোচ ও ব্যবস্থাপকবৃন্দ ইত্যাদি। আশরাফুলের পরিণতির দায় এঁরা এড়াতে পারেন না।
আমরা জানি আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় ব্যাধির নাম দুর্নীতি। আর সাধারণভাবে এ সমাজের মানুষের দুর্বল জায়গা হল নৈতিকতার মান। এটা বেশ খারাপ বলেই দুর্নীতি এ সমাজের গভীরে বাসা বেঁধেছে। ব্রিটিশ আমল থেকেই সমাজের সর্বক্ষেত্রে এর চর্চা চলছে। আরেকটা সমস্যা হল, দীর্ঘ দুইশত বছরের বেশি (১৭৫৭-১৯৭১) উপনিবেশ হিসেবে পদানত থাকায় শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও আত্মসম্মান ও মর্যাদাবোধে ঘাটতি থেকে গেছে। এরকম সমাজের নৈতিকতার মানদণ্ড খুবই নড়বড়ে হয়। মানুষ অনৈতিকতার সাথে আপোস করে চলে। আবার সমাজের নানা বৈষম্য দিনে দিনে বাড়তে থাকায় বঞ্চিত মানুষ কেবল অস্থির হচ্ছে না, বেঁচে থাকার কৌশল হিসেবেও দুর্নীতির পথে পা বাড়াচ্ছে। বঞ্চিত মানুষ দরিদ্রও বটে, কথাটা বিপরীতভাবেও সত্য। দুটোর যোগফল দুর্নীতি ও নৈতিকতার গভীর সংকট। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, দুর্নীতির রয়েছে বৈষম্য হ্রাসের ক্ষমতা। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, এ সমাজে পরিচিতকে নিয়ম ভেঙে খাতির করার রেওয়াজ চালু আছে। ফলে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ ক্লিনিকে, রেল স্টেশনে, চাকুরির বাজারে একজন সুবিধাভোগী পরিবারের সন্তানের চেয়ে পিছিয়ে থাকেন। তখন এই ঘাটতি পুষিয়ে সম অবস্থানে এসে অন্তত কিছুটা সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্যে তাকে দুর্নীতির পথ ধরতে হয়। আবার খ্যাতি-প্রতিষ্ঠা দরিদ্র বঞ্চিত জনের জন্যে নিয়ম-ভাঙার ও ভেঙে আয়বৃদ্ধির সুযোগ খুলে দেয়। অনেকে সেই ফাঁদে পা দেন। আশরাফুলের ক্ষেত্রে এরকম কিছু ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে অপরাধের সামাজিক প্রেক্ষাপটও বিবেচনায় আনা উচিত - বিচ্ছিন্নভাবে কেবল ব্যক্তির নৈতিকতার মানদণ্ড প্রয়োগে সুবিচার পাওয়া যাবে না। বৈষম্য-বঞ্চনা-দারিদ্র পীড়িত সমাজে দুর্নীতি লালিত হয় আর তাতে ভিতরে ভিতরে সমাজের নৈতিকতার ভিত্ নড়বড়ে হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ চমৎকারভাবে কবিতায় প্রসঙ্গটি তুলে ধরেছেন - যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে, / পশ্চাতে রেখেছে যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
যে সমাজে অন্যকে অন্যায়ভাবে পিছনে ঠেলে দেওয়ার কাণ্ড নিয়মিত ব্যাপার সে সমাজের পিছিয়ে থাকাই স্বাভাবিক। আমরা দেখছি আমাদের সমাজ কেবল নৈতিকভাবে দুর্বল তা নয়, এটি অপরাধপ্রবণ সমাজ, অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ও দিয়ে থাকে। সবকিছুর নিয়ামক হল ব্যক্তিগত পরিচয় আর ব্যক্তি-স্বার্থ। এর ফলে এ সমাজ প্রায় সবসময় পক্ষপাতদুষ্ট এবং কখনও নিরপেক্ষ হতে পারে না। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধের কোন সুষ্ঠু বিচার হয় না, অপরাধী পার পেয়ে যায়। আবার কখনও কখনও পক্ষপাত ও স্বার্থের বিবেচনা থেকেই ন্যায়বিচার ক্ষুণœ হয়।
এ অবস্থায় সাধারণভাবে সমাজের সত্য-মিথ্যা ন্যায়-অন্যায় পাপ-পুণ্যের ধারণাগুলো বেশ অস্পষ্ট, আত্মপক্ষ জোরদার করার জন্যে এখানে কুতর্ক কুযুক্তির অবতারণা খুবই সাধারণ ব্যাপার। ভয়ঙ্কর সব অপরাধেও আপোসের জন্যে চাপ তৈরি করতে পারেন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিও। আর একটি অপরাধকে ঢাকতে বা সে অপরাধের শাস্তি ঠেকাতে উত্তরোত্তর আরও গুরুতর অপরাধ ঘটাতে বাধে না কারো। এরকম একটি বিষচক্রের ভয়ঙ্কর বাস্তবতায় বাস করছি আমরা।
আমরা সকলেই চাইব একটি স্বচ্ছ, স্পষ্ট ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক, যেটা আইন, নিয়ম, বিধিবিধানকে মান্য করে চলবে। সেটা রাতারাতি হবে না, কিন্তু সেভাবেই পথচলা শুরু করা দরকার। সেদিক থেকে আশরাফুলের ভুল বা অপরাধের শাস্তি হবে সেটা স্বাভাবিক। তবে প্রথমত ব্যক্তি আশরাফুলের বেড়ে ওঠার সঙ্গে যুক্ত সকল প্রতিষ্ঠানের দায়ের কথা মাথায় রাখা উচিত এবং দ্বিতীয়ত তিনি যে সমাজে বেড়ে উঠেছেন তার নীতিনৈতিকতার বাস্তবতাও বিবেচনায় নিতে হবে। তাদের সামনে অহরহ যেসব সফল মানুষের দৃষ্টান্ত এ সমাজ তুলে ধরেছে তারা উন্নত নৈতিকতার কোন মানদণ্ড তুলে ধরেন নি। চারিদিকে ওরা দুর্নীতি, স্বজনতোষণ ও পক্ষপাত, চরম অবিচার ঘটে যেতে দেখেছে। আর বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদতেও দেখেছে তারা। অর্থাৎ সমাজ সবসময় ভুল বারতা দিয়েছে।
একই রকমের ইতিহাসের অংশীদার উপমহাদেশের অপর দুই দেশ পাকিস্তান ও ভারতের ক্রিকেটের দুর্নীতির চিত্র আরও ভয়াবহ। পাকিস্তানের তিন ক্রিকেটার সরাসরি আইসিসির মাধ্যমে ইংল্যাণ্ডে বিচার প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হওয়ায় কারাভোগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তার আগে তাদের একজন অধিনায়কও স্বদেশে জেল খেটেছেন, আজীবন নিষিদ্ধ হয়েছেন। ভারত-পাকিস্তানে বেশ কিছু খেলোয়াড় নানা মাত্রায় নিষিদ্ধ হওয়ার মত শাস্তি পেয়েছেন। কিন্তু তাতেও তাদের ক্রিকেটাঙ্গন পুরোপুরি অপরাধমুক্ত হতে পারে নি। ফলে বিচারের আওতায় খেলোয়াড় ছাড়াও সংগঠক, মালিক, বুকি, রেফারিসহ অনেকেই আসছেন।
সব সমাজেই অপরাধীরা ছিল, এখনও আছে। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে ক্রীড়াজগতকে ঘিরে বিপুল অর্থের বাণিজ্য হয়। এর সাথে যুক্ত হয় ব্যক্তি খেলোয়াড়ের সাফল্য, গণমাধ্যমে তার ভাবমূর্তি, সামাজিক প্রতিষ্ঠা এবং অর্থবিত্তের বিষয়গুলো। অপরাধ জগতের ব্যক্তিদের কাছে সমাজের সফল মানুষদের আলাদা মূল্য আছে। তবে অন্যদের চাইতে খেলায়োড় ও চলচ্চিত্র জগতের নায়কদের (এবং নায়িকাদেরও) জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। আর তাৎক্ষণিক ফলাফল-নির্ভর বলে খেলাধূলায় জুয়া খেলার সুযোগটা বেশি। কোন কোন খেলায় কিছু মাত্রায় জুয়া বোধহয় সবসময় ছিল, ক্রিকেটে তা মাত্রা ছাড়িয়েছে ওয়ানডে আসার পর, আর তা মহামারীর রূপ নিয়েছে টিটুয়েন্টি টুর্নামেন্ট চালু হওয়ার পর থেকে।
টিটুয়েন্টি চালু রাখতে হলে আইসিসিকে সদস্য সংস্থাগুলোকে নিয়ে কঠোর বিধান তৈরি করতে হবে। খেলোয়াড়দের নীলাম বন্ধ করে পূর্ববর্তী বছরের পারফর্মেন্সের ওপর মূল্য নির্ধারিত হলেও টাকার পিছনে ছোটার প্রবণতা কিছু কমবে কারণ পারফর্মেন্স ঠিক থাকলেই মূল্য তথা অর্থপ্রাপ্তি ঠিক থাকবে। এছাড়া প্রত্যেক জাতীয় খেলোয়াড়ের দেখভাল করার জন্যে স্ব স্ব দেশের ক্রিকেট সংস্থাকে দায়িত্ব নিতে হবে।
তবে শিক্ষা, আর্থিক উন্নতি, প্রকৃত গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার নিশ্চিত করে যদি সমাজের সাধারণ নৈতিকতার মান উন্নত করা না যায় তবে বিচ্ছিন্নভাবে কোন একটি ক্ষেত্রে পরিস্থিতির চমকপ্রদ উন্নয়ন ঘটানো দুষ্কর হবে। ব্যক্তি অপরাধীর বিচার করা কঠিন নয়, কিন্তু সমাজকে ঠিক না করে তার সুবিচার করা বেশ মুষ্কিল। কারণ মানুষ তো সমাজেরই ফসল, সমাজের দোষক্রুটির বাহক সে। তাকে অপরাধপ্রবণ বাস্তবতায় রেখে সর্বোচ্চ নৈতিকতা আশা করা যায় না। তবে হ্যাঁ ব্যক্তির সমন্বয়েই গড়ে ওঠে সমাজ। তাই ব্যক্তিকে শুদ্ধ করার মাধ্যমেই সমাজকে রোগমুক্ত করতে হবে। তাতে ব্যাপকভিত্তিতে ফল পেতে চাইলে পরিবারে, শিক্ষায় এবং সকল প্রতিষ্ঠানে ও সংস্থায় প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সঠিক শিক্ষার সাথে সাথে দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
আশরাফুল একজন ব্যক্তি, পরিণত বুদ্ধির মানুষ হওয়ার আগেই অপরিণত বয়সে খ্যাতিপ্রতিপত্তির জগতে এসেছেন। ক্রিকেটপাগল জাতির প্রথম নায়ক। তার খলনায়কোচিত কাজের আর্থসামাজিক যেসব কারণ আছে সেসব থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা ঠিক হবে না। যেসব কারণে আশরাফুল খলনায়ক হয়েছেন তা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে সম্ভবত এই পরিচয়ে আচ্ছন্ন না হয়ে তার ভিতরকার হারিয়ে যেতে-বসা নায়ককেও খুঁজে পাওয়া যাবে। তার পক্ষে জোরালো প্রমাণ হবে তার সরল স্বীকারোক্তির সাহস। এতে সে নিশ্চয় সততা ও নৈতিকতা অনেকখানি ফিরে পেয়েছে। বাকিটুকু রয়েছে তার এককালের ভক্ত গুণগ্রাহীদের হাতে। তাঁরা এ ব্যাপারে মানবিক ও উদার হবেন নাকি কঠোর নৈতিকতার মানদণ্ড নিয়ে অনড় থাকবেন তার ওপর অনেকটা নির্ভর করছে আশরাফুলের ভবিষ্যত।