Wednesday, November 27, 2013

পুঁজিবাদী এজেণ্ডা সম্পর্কে সাবধানতা চাই

আবুল মোমেন


আমাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অবশ্যই ভালো নয়। একদিকে অনিশ্চয়তা আর অন্যদিকে চরম সংঘাতের সম্ভাবনা। জনগণের উদ্বেগ ও আতঙ্কের পারদ কেবল চড়ছে। কিন্তু এর মধ্যেও দুটি কথা ভুললে চলবে না।
প্রথমত, বাংলাদেশে আর্থিক ও সামাজিক পরিবর্তন থেমে নেই - মানুষের প্রাপ্তির বিচারে সূচকগুলো এর মধ্যেও ঊর্ধগামী। একে উপেক্ষা বা নষ্ট করা ঠিক হবে না। দ্বিতীয়ত, দেশের এই সংকটজনক অবস্থার মধ্যেও পশ্চিমের মুরুব্বিয়ানার নেতিবাচক দিকগুলো সম্পর্কে সজাগ থাকা দরকার। ইদানীং ওদের ওপর অর্থনীতির নির্ভরশীলতা কমে এলেও আমাদের এবং ওদের মনস্তাত্ত্বিক অভ্যাসের কারণে এই নির্ভরশীলতা বা মুখাপেক্ষিতা বেশ জোরদারভাবেই উপস্থিত।
এটি বারবার এবং দেশের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে পশ্চিম অনুসৃত পুঁজিবাদী অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যই হল সারা বিশ্ব থেকে যেকোনোভাবে মুনাফা অর্জন (আদতে লুণ্ঠন)। এই এজেণ্ডা বাস্তবায়নে তারা পথের সব বাধা দূর করবেই - প্রয়োজনে এর রক্ষক রাষ্ট্রগুলো একজোট হয়ে সর্বোচ্চ হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক পথের আশ্রয় নিতে একটুও কার্পণ্য করে না। তারা অবলীলায় একই বিষয়ে ডবল স্ট্যাণ্ডার্ড চালিয়ে যায়। ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের জন্যে যদি এক মানদণ্ড হয় তো সৌদি আরবের জন্যে অন্য মানদণ্ড। তারা এক মানদণ্ডে বিচার করে নি লিবিয়া ও কুয়েতকে। তার কারণ একটাই সাদ্দাম আরব বিশ্বে স্বাধীন অবস্থান তৈরি করেছিলেন, যদিও ইসলামি বিপ্লবোত্তর ইরানকে ঠেকানোর জন্যে তারাই এক সময় সাদ্দামকে তৈরি করেছিল। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে কীভাবে ব্যবহৃত তুচ্ছ আবর্জনার মত ফেলে দেয় তা বারবার তারা দেখিয়েছে। তারাই তালেবানদের অস্ত্রসজ্জিত করে জঙ্গিতে রূপান্তর করে যুদ্ধে ঠেলে দিয়েছিল। তাদের জন্যে ইসলামের আবরণ তৈরি করে যুদ্ধের সহযোগী হয়ে ধন্য হয়েছে সৌদি আরবের বশংবদ বাদশাহরা। তারাই আলকায়দা ও বিন লাদেনের স্রষ্টা। তারাই তাদের ভক্ষক হয়েছে পরে সর্বোচ্চ নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার মাধ্যমে।
পশ্চিমের রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি উদার মানবিক রূপও আছে, যদিও তা আসলে মূল রাষ্ট্রযন্ত্রেরই যন্ত্রাংশ মাত্র। এটি সারা বিশ্বে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের শান্তিজল ছিটানোর দায়িত্ব নিয়ে শান্তির অবতারের ভূমিকায় সোচ্চার ও সক্রিয় ভূমিকা নেয়। পুঁজিবাদের এই যন্ত্রাংশটি বস্তুত দ্বিমুখী ধারালো ছুরির মত কার্যকর - একদিকে রাজনীতিবিদ ও উচ্চাভিলাষী ধনিকদের মধ্যে যেমন কার্যকর তেমনি অন্যদিকে নাগরিকসমাজের সংবেদনশীল মানুষদের মধ্যেও ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারে।
কিন্তু খুব খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এভাবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের ন্যায্য মানবিক ছাতাটি খুলে ধরে তারা আদতে আমাদের গ্রাম্য মেয়েদের মত আড়াল তৈরি করে নিজেদের স্বার্থের অনুকূল অর্থনৈতিক ও প্রভুত্ব রক্ষার এজেণ্ডাগুলো ঠিকই পালন ও পূরণ করে যাচ্ছে। সাদ্দাম-উত্তর ইরাকে চলমান ভ্রাতৃঘাতি সংঘাত তাদের মানবাধিকার ও আইনের শাসনের চেতনাকে বিচলিত করে না। এ পরিণতির দায় কার এ নিয়ে ভাববার কোনো প্রয়োজন তারা বোধ করে না। মনে করুন, ইরাকের দখল সম্পন্ন হওয়ার পরপর তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন তাঁর দেশের মন্দা অর্থনীতিতে চিন্তিত ব্যবসায়ীদের বলেছিলেন ব্যাগ গুছিয়ে জলদি ইরাকে যাও, ওখানে এখন পুর্ননির্মাণের বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হবে। আর তার মানে প্রচুর ব্যবসা, প্রচুর মুনাফা।
পশ্চিম থেকেই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসনের অনুকূলে নানা এজেণ্ডা বিশ্বময় প্রচার করা হয়। এমনকি প্রতি বছর তারাই শান্তির নোবেল লরিয়েট তৈরি করে বিশ্বশান্তির নতুন নতুন বার্তাবাহক প্রস্তুত করে থাকে। এর বিপরীতে দুটি ছোট্ট সরল প্রশ্ন কি তাদেরকে করার সময় আজও আসেনি? এ দুটি প্রশ্ন তোলা কি বিশ্বশান্তি, গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যেই তোলা অত্যন্ত ন্যায্য নয়?
প্রথম প্রশ্ন : যদি এতই তারা বোঝেন যুদ্ধ, সংঘাত হানাহানি ওপরে বর্ণিত তাদেরই প্রদত্ত অত্যন্ত ইতিবাচক এজেণ্ডাগুলো বাস্তবায়নে পথের বাধা তবে তারা কেন এ পরিস্থিতি তৈরির রসদটা জোগান দিয়ে যাচ্ছে? আমরা বলছি পুঁজিবাদী অর্থনীতির আজকের মেরুদণ্ড অস্ত্র তৈরি ও অস্ত্র ব্যবসার কথা। আমরা জানি তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় নিরস্ত্রিকরণের জন্যে, পারমানবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ করার জন্যে চমৎকার সব সংগঠন ও সংলাপের ব্যবস্থা আছে। কিন্তু নিত্য যেসব সংঘাত-হানাহানিতে পৃথিবী ডুবে আছে, যেসব ‘ছোটখাট’ যুদ্ধ-সংঘাতে মহাযুদ্ধের চেয়েও বেশি প্রাণহানি ও বেশি অঙ্গহানি ঘটেছ ও ঘটে চলেছে তাতে পারমাণবিক নয় মারাত্মক সব প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ব্যবসার সবটাই তাদের হাতে, তারাই সরবরাহকারী, তারাই প্রয়োজনে, অর্থাৎ ব্যবসার মন্দা দেখা দিলে, যুদ্ধবাজ নেতা তৈরি করে নেয় - তাদের কেউ ক্ষমতার গদি আঁকড়ে থাকতে কেউ তা দখল করার সংগ্রামে এসব ব্যবহার করে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের মধ্যে এ মনোভাব তৈরি করার জন্যেও পুঁজিবাদের এজেন্টরা অনেক আগে থেকেই কাজ করে গেছে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য হল রুয়াণ্ডার হুটু ও তুৎসিরা মিলেমিশে বসবাস করে এসেছে চিরকাল। শ্বেতাঙ্গ দখলদাররা এসে হুটুদের বলল তোমাদের নাক খাড়া তাই তোমরা উচ্চ জাতি, থ্যাবড়া নাকের তুৎসিরা তুলনায় তুচ্ছ। শক্তিমানের প্রশয় কে না গ্রহণ করে? ওদের মধ্যে উচ্চমন্যতা বোধ করার মানুষ তৈরি হল, বিরোধের বীজ রোপিত হল, চারা গজাল ও তাতে হাওয়া দেওয়া চলল, ধীরে ধীরে বিষবৃক্ষ হয়ে তা বড় হয়েছে। তারপর ওদের অস্ত্র সজ্জিতও করা হয়েছে। শক্তিক্ষয় হয়ে যাওয়ার পরে তারাই আবার পুনর্গঠনের কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। তাদের তৈরি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে শোরগোল তুলতে কসুর করবে না।
দ্বিতীয় প্রশ্নটি আরও সরল। প্রশ্নটা পশ্চিমের পালের গোদা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রথম করতে হবে, যদিও তাতে পুরো ইউরোপ যুক্ত, কারণ তারাই তো এলডোরাডোর সন্ধানে দলে দলে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে দেশটি ‘তৈরি’ করে নিয়েছে। প্রশ্নটা হল - আজ যে দেশটি তোমাদের বলছ, তার আদিবাসিন্দারা কোথায়? তাদের ঠাণ্ডামাথায় ঝাড়ে-বংশে খুন করে ‘নতুন দেশ’ পত্তন করেছ, তারপর এই বিশাল ভূখণ্ড জুড়ে কৃষির বিস্তার ঘটাতে ফাঁদ-পাতলে আফ্রিকায়, বর্বরতম ও নিষ্ঠুরতম পথে তাদের ধরে এনে দাসত্বের শৃঙ্খল পরিয়েছে, আজও, হ্যাঁ আজও, তাদের গ্লানির জীবনের অবসান হয় নি। হতে দাও নি তোমাদের মানসিকতার কারণে। এসব প্রশ্ন কি ন্যায্য নয়?
বাংলা প্রবচন বলে - আপনি আচরি পরেরে শিখাও। যার নিজের ইতিহাস জঘন্য অমানবিকতায় ভরা, যাদের বর্তমান মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে শত প্রশ্নে বিদ্ধ করা যায় তাদের উপদেশ দেওয়া আমাদের সাজে, তাদের নয় আমাদের। কেননা আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি ঢের পুরোনো, এর রয়েছে ধারাবাহিকতা, এবং মৌলিকভাবে এটি অনেক বেশি মানবিক। সমস্যা তৈরি করেছে ঔপনিবেশিক শক্তি - সেটা যেন না ভুলি।
আমি এর মধ্যেও কিন্তু ভুলে যাই নি কী আনন্দে আমি এখনও শেক্সপিয়র পড়ি, রাসেল পড়ে বরাবর চিন্তার খোরাক পাই, রেনেসাঁস ও আলোকনের ইতিহাসে প্রেরণা পাই, বিজ্ঞান আর আবিষ্কারের ঘটনাগুলোয় রোমাঞ্চিত শিহরিত হই। পশ্চিমাসভ্যতা আমার অনেক অনেক নায়কের আধার। এমনকি সেসব দেশে নাগরিকজীবনের সৌন্দর্য-সার্থকতায় আরাম বোধ করি, ঈর্ষা করি। তারপরেও আমাকে তো খুঁজে নিতে হবে আমার দেশের বিকাশের সঠিক পথটি। এই পথের যে কোন বাধাকেই সরাতে হবে। ভুললে কি চলবে দেশের স্বাধীনতা কীভাবে এসেছে? তার অন্তর্নিহিত আকাক্সক্ষাকে অস্বীকার করার অর্থ তো স্বাধীনতাকেই অস্বীকার করা। এটি ধর্মভিত্তিক-জাতীয়তার বিপরীতে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তার ধারণাকে সামনে নিয়ে এসেছিল - এটি যেহেতু সম্প্রদায় নিরপেক্ষ (ক্ষুদ্র জাতিকেও নিতে সক্ষম) তাই অধিকতর গণতান্ত্রিক, তাই এরই পক্ষে সম্ভব একটি আধুনিক রাষ্ট্র নির্মাণ। এটিকে আমাদেরই এজেণ্ডা হিসেবে জানতে হবে।
আমরা জানি বেলায় বেলায় কেবল নদীখাতেই অনেক পানি ও পলি প্রবাহিত হয় নি, রাজনৈতিক অঙ্গনেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। দেশের পশ্চাৎগামী রাজনীতির প্রবল জোয়ারে প্রগতির রাজনীতি স্তিমিত হয়েছে। এর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মধ্যপন্থী রাজনীতি সবচেয়ে বেশি পিছু হটে গেছে। আওয়ামী লীগ আগের অবস্থানে নেই, তার ওপর টেণ্ডারবাজী দখলদারিতে মেতেছে ক্যাডাররা, ক্ষমতার ভাগ কায়েম রাখতে কালোটাকার ব্যবসায়ীরা দলের দখল নিয়ে নিচ্ছে। আর বিএনপি? ধর্মান্ধ রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতা কি ছেড়েছে? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান অবস্থায়ও কি জামায়াতকে ছেড়েছে? তারা কি তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ সম্পর্কে অবস্থান পরিষ্কার করেছে?
আমাদের তো নিজেদের বাস্তবতার মধ্যেই পথ তৈরি করতে হবে। সে কাজে যদি রুচি না হয়, অনীহা তৈরি হয় তবে মনে রাখতে হবে পুঁজিবাদের কোনকিছুতেই অরুচি নেই, তারা যা পরে বমি করে বের করে দেবে তা প্রয়োজনে সময়মত হাসিমুখে গলাধকরণ করবে। বুশ ও বিন লাদেনের গলায় গলায় ভাবের ছবি পশ্চিমেরই পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সাদ্দামের অস্ত্র ভাণ্ডার তাদেরই তৈরি, ফলে পরে যে অজুহাত খাড়া করে তারা ইরাকে আক্রমণ করছিল তা যে মিথ্যা সেটা তাদের চেয়ে আর কেউ ভালো জানত না। তারা প্রয়োজনে মিথ্যাকে সত্যের চমৎকার আবরণে সাজাতে জানে।
আমাদের বাস্তবতা হল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় আপাতত হাতে নেই। কী চমৎকার হত যদি এই দুটি দল কতকগুলো জাতীয় বিষয়ে সহমত থাকত, তাদের বিরোধ থাকত যদি উন্নয়নের নীতি-কৌশলে, পরিকল্পনা প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে দক্ষতা নিয়ে। কিন্তু বিরোধ আরও মৌলিক  - মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, সংবিধান, গণতন্ত্র নিয়ে।
ফলে এই অবস্থায় নাগরিকসমাজ একটি অবস্থান নিতে পারেন। তাঁরা বিএনপির ওপর চাপ তৈরি করতে পারেন যাতে তারা যুদ্ধাপরাধের দায়ে, আইন ও ইতিহাস, স্বাধীনতা ও জাতির কাছে অপরাধী সেই দলের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেন, ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদী যে কোনো দলের আনুকূল্য লাভের চেষ্টায় বিরত হয়ে নিজেদের স্বাধীন অবস্থানেই জোট নিয়ে নির্বাচনে আসে। আওয়ামী লীগের ওপর চাপ সৃষ্টি  করা হোক যাতে তারা ক্ষমতার মোহে একক নির্বাচনের কৌশল বাদ দেয় এবং কালোটাকা ও অবৈধ ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিদের সংসদে না পাঠায়, টেণ্ডারবাজ-দখলদারদের খপ্পর থেকে দলকে মুক্ত করে। আর দুই জোটের বাইরে প্রগতিশীল দলগুলোকে বড় দুই দলের ওপর একইভাবে চাপ সৃষ্টির জন্যে অনুরোধ করব। তাঁদের স্বাধীন অবস্থান বজায় রাখা জরুরি, কিন্তু তাদের ভূমিকা আরও সক্রিয় ও কার্যকর করে তুলতে হবে। রাজনৈতিক অঙ্গনে যুদ্ধাপরাধী, ধর্মান্ধ শক্তি, লুটেরা গোষ্ঠী এবং বেপরোয়া ক্ষমতার দাপটকারী শক্তি যাতে দুর্বল হয় সেই দায় নাগরিক সমাজকেও নিতে হবে।
জানি, হাতে সময় কম, নাগরিকসমাজও দুর্বল, ফলে দুই বড় দলের কৌশলি যুদ্ধ আসন্ন নির্বাচনের আগে থামিয়ে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের গ্রন্থি মোচন করা কতটুকু সম্ভব তা বেশ অনিশ্চিত। পরিস্থিতি যদি সেই অনাকাক্সিক্ষত সংঘাতের দিকেই যায় তবে তুলনামূলক ভাবে কম মন্দকে বাছাই করা ছাড়া বিকল্প পথ কি থাকবে?

Sunday, November 10, 2013

দুই নেত্রীর ফোনালাপ কি অচলাবস্থাই বাড়াল?

আবুল মোমেন

কথা ছিল প্রধানমন্ত্রী ফোনে বিরোধী নেত্রীকে সংলাপের আমন্ত্রণ জানাবেন। এর আগে ঢাকায় ১৮ দলীয় জোটের জনসভায় খালেদা জিয়া ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সংলাপের জন্যে যোগাযোগের সময় বেধে দিয়ে ২৭-২৮-২৯ অক্টোবর ৬০ ঘণ্টার হরতালের ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন। স্বভাবতই মানুষ প্রধানমন্ত্রীর ফোন এবং তার ফলাফল নিয়ে উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা থেকে বেরুবার আশায় বসেছিল।
শেখ হাসিনা সময় পেরুনোর আগেই ২৬ তারিখ সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ ফোন করেছিলেন। দুই নেত্রীর ফোনালাপ চলেছে ৩৭ মিনিট ধরে!
বুঝতে অসুবিধা নেই, এ আলাপ আমন্ত্রণ এবং তা গ্রহণ বা প্রত্যখ্যানের মধ্যে শেষ হতে পারে নি। দেশের দুই শীর্ষ নেত্রীর ফোনালাপ সেদিন রাতেই নেটে ছড়িয়ে পড়ে। পরের দিন কিছু কিছু বৈদ্যুতিন টিভি চ্যানেল সম্পূর্ণটা প্রচার করে। আর ২৮ তারিখ প্রায় সব পত্রিকাতেই আলাপের পুরোটাই ছাপিয়ে দেওয়া হয়।
শুনে-পড়ে বলতে হয়, আলাপ তো নয় বাদানুবাদ হয়েছে। তাতে বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা প্রথমে বিব্রত বোধ করেছিলেন মনে হয়, কারণ দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব কাজটাকে শিষ্টাচার বহির্ভূত আখ্যা দিয়েছেন। তাঁদের আপত্তিটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, কারণ বিবাদে জড়িয়ে তাঁর নেত্রী প্রতিপক্ষকে অভিযোগের বাণে লাগাতার চাপে রাখতে গিয়ে শিষ্টাচার লঙ্ঘনে অনেক এগিয়ে ছিলেন। শব্দালঙ্কার নিয়ে যারা কাজ করেন তারা এ বাদানুবাদের মধ্যে ব্যঙ্গ, বিদ্রƒপ, শ্লেষ, পরিহাস, টিপ্পনি ইত্যাদির ভিয়েন খুঁজে পাবেন, তবে সব ছাপিয়ে বোঝা যাচ্ছিল খালেদার উষ্মা, মেজাজ তাঁর একেবারে তেতে ছিল। হাসিনা এই তপ্ত বর্ষণের ফাঁকে ফাঁকে যেটুকু বলার সুযোগ পেয়েছেন তা প্রতিপক্ষকে শান্ত বা আশ্বস্ত করার কাজ করে নি - আগুনে জ্বালানিই পড়েছে।
বিবাদে জড়িয়ে গেলে সময় কোন দিকে বয়ে যায় তা খেয়াল থাকে না। ফোনে তো দু’মাথায় দু’জন মানুষই কথা বলছেন, তা-ও দুই দলের এমন দুই শীর্ষ নেতা যাঁদের ওপর কিছু বলার রেওয়াজ বা অধিকার কোনো দলে কারুরই নেই। ফলে মধ্যস্ততার কোনো সুযোগই ছিল না। শেষে ক্লান্ত প্রধানমন্ত্রী জরুরি সভার কথা টেনে বহু প্রতিক্ষিত সংলাপের ইতি টানেন। ফোন-রঙ্গ শেষে বা ফোন-রণাঙ্গণ থেকে ফিরে বিরোধী নেত্রী প্রতীক্ষারত সহকর্মীদের কাছে মেয়েলি উদযাপন করে হয়ত বলতে পারেন - কষে উচিত কথা শুনিয়ে দিয়েছি! হতে পারে, কারণ দু’দিন পরে সেই সিনিয়র নেতারা বলছেন বাগযুদ্ধে তাদের নেত্রীর কাছে প্রধানমন্ত্রী পাত্তা পান নি।
কিন্তু জনগণের কি এ আলাপকে যথোচিত মনে হয়েছে? বড় অংশ হতাশ হয়েছে, কেবল সংলাপের দ্বার খুলল না বলেই নয়, এর বিষয় ও ধরণটাও হতাশার কারণ। একজন বিশ্লেষকের এ বিষয়ে লেখার শিরোনাম তাই ‘এ সংলাপ না হলেই ভালো ছিল’ ; এক টিভি চ্যানেলের টক-শোর নাম রাখা হল ‘সম্ভাবনা না সম্ভব না?’
কিন্তু জীবন তো থেমে থাকতে পারে না, অচলাবস্থাও আসলে থেমে থাকে না। প্রতিদিনই অচলাবস্থার ধরনের কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটে চলেছে।
যেদেশে গণমাধ্যম-বাতিক সংক্রামকভাবে বর্ধিষ্ণু আর টিভি চ্যানেলে বিস্ময়করভাবে গান-নাটকের চেয়ে খবর ও টক-শো বেশি জনপ্রিয় সেখানে এ ধরনের ঘটনা তো মহার্ঘ সওদা। টক-শো, কলাম এবং খবরে মতামত দিতে দিতে দেশের বিশিষ্টজনরা ব্যস্ত দিন এবং রাত কাটাচ্ছেন। রাতও কাটাতে হয় কারণ সবচেয়ে জনপ্রিয় টক-শোগুলো নাকি অধিক রাতেই জমে। বিশুদ্ধ নিরপেক্ষতা এক্ষেত্রে একেবারে নিরামিষ ব্যাপার, তর্ক জমে আলোচকরা পক্ষ নিয়ে ভাগ হয়ে গেলে।
বার বার মুখ পুড়লেও আশায় বুক বাঁধতে বাংলাদেশের মানুষের জুড়ি নেই। মনে হয় বিএনপি এখন দু’ভাবে সংলাপের দরজা খোলার কথা ভাবছে - একদিকে রাজপথের  আন্দোলনকে আরও জোরদার করবে তারা আর অন্যদিকে বিদেশি কূটনীতিকদের দূতিয়ালিতে লাগাবে। আওয়ামী লীগের চিন্তা আপাতত একটিই - গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখা।
ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনের মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার ঘটনা বাংলাদেশে আগে ঘটে নি। প্রথমবার ক্ষমতার মেয়াদ পূরণ করে আত্মবিশ্বাসী হাসিনা সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচনে নেমেছিলেন। এই একবার ছাড়া গণতান্ত্রিক আমলেও কখনওই শান্তিপূর্ণভাবে এক সরকার থেকে পরবর্তী সরকারে ক্ষমতা হস্তান্তর হয় নি। বিস্তর জলঘোলা করে ধ্বংসাত্মক রাজনীতির পথ বেয়েই নির্বাচন হয়েছে। ২০০১ এর অভিজ্ঞতা এবং গত ৬ মাসের মধ্যে অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বেশ বড় ব্যবধানে হারার কারণে এবারে হাসিনা স্বভাবতই খুব সতর্ক হয়ে পা ফেলছেন।
আমাদের অনেকেরই ধারণা ছিল সাম্প্রতিক এই বিজয়গুলোকে আগামী নির্বাচনেও বিজয়ের ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিয়ে বিএনপি মোটামুটি একটা মুখ বাঁচানো সংলাপ সেরে দ্রুত নির্বাচনেই যেতে চাইবে। এখন মনে হচ্ছে বেগম জিয়ার আরও কিছু হিসেব আছে। হতে পারে পুত্রদের মামলামুক্ত হয়ে দেশে ফেরার ব্যবস্থা, হতে পারে জোটের গুরুত্বপূর্ণ শরিক জামায়াতের অনুকূলে কিছু ছাড় আদায় বা হতে পারে নির্বাচনে যাওয়ার আগে তিনি রাজপথের আন্দোলন থেকে সুস্পষ্ট বিজয় পেতে চান। সম্ভবত তারই প্রভাব পড়েছে তাঁর ফোনালাপে - তিনি কথার লড়াইয়ে জিততে চেয়েছেন।
এসবের মধ্যেও আসল কথা হল, বাংলাদেশ এবার সত্যিই কঠিন রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যেই পড়েছে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেছেন ইতিহাসের বেশ কিছু বকেয়া দায় মেটানোর প্রতিশ্র“তি দিয়ে। তার প্রধান হল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধের আলোকে স্কুলের পাঠ্যবই পরিমার্জন, গণমাধ্যমসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমন ইত্যাদিও এ দায়ের অংশ। সেই সাথে একবিংশ শতাব্দীর ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নও দেখিয়েছিলেন তিনি। তাতে অন্তত দুই দশক পরে নবপ্রজন্মের তরুণদের ভোট টানতে পেরেছিল আওয়ামী লীগ। লীগের বড় জয়ের পিছনে এটাই ছিল মুখ্য। শেষের বিষয়টি ছাড়া বাকি সব বিষয়ে জামায়াত ও ধর্মান্ধ দলগুলো সরাসরি বিপক্ষে, বিএনপি তাদের অভিভাবক হিসেবে কথার মারপ্যাঁচ চালিয়ে শেষ পর্যন্ত একই অবস্থান ধরে রাখছে।
এখানে বাংলাদেশের রাজনীতির একটা বিষয় বুঝে নেওয়া দরকার। একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়, যে-দুটি মূলধারায় রাজনীতি চলছে দেশে তার বিপরীতমুখিতার ভিত্তি হল আওয়ামী লীগ ও এন্টি আওয়ামী লীগ রাজনীতি। পঁচাত্তরের পর থেকেই এটিই বাস্তবতা। এর মধ্যে ১৯৯০ পর্যন্ত সামরিক ও ছদ্ম সামরিক-গণতন্ত্রের মধ্যে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় ফেরার সুযোগ ছিল না। ১৯৯৬-এ প্রথমবার ক্ষমতায় এসে হাসিনা বিরোধীদে সাথে মোটামুটি আপস-সমঝেতা করেই চলেছেন। কিন্তু এবারে ক্ষমতায় এসে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, পাঠ্যবই পরিমার্জনসহ ইতিহাসের বকেয়া দায় মেটানো ও ইতিহাস-শুদ্ধিকরণের কাজে হাত দিয়েছেন। পাশাপাশি জঙ্গি দমনেও আন্তরিক ছিলেন। এর ফলে দেশে প্রায় একাত্তরের অবস্থা তৈরি হয়েছে। কারণ দুটি ক্ষেত্রেই জামায়াত-বিএনপি অভিযুক্ত হয়েছে। ফলে যা ১৯৯০ থেকে এযাবৎ কেবল দুটি ক্ষমতালিপ্সু দলের মধ্যেকার সেয়ানে সেয়ানে মোকাবিলার বাইরে যায় নি তা আকস্মিকভাবে দু’পক্ষের ইতিহাস ও আদর্শের ভিন্নতা খুলে ধরেছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এলে এবং বিএনপি জামায়াত ও ধর্মান্ধদের না ছাড়লে তাদের অবস্থা খুব সঙ্গীন হবে।
তাই এক দলকে এই ধারা ধরে রাখতে এবং অন্য দলকে এর থেকে বেরুতে হলে ক্ষমতায় যেতে হবে। এ কারণেই আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে কোনো পক্ষই এতটুকু ছাড় দিতে চাইছে না। বরং বলা যায় স্ব স্ব  অবস্থানে থেকে দুই দলই পরাজয়ে অপারগ এবং তাই ছাড় দিতে অক্ষম।
বিএনপির জন্যে সমীকরণ আরও জটিল কারণ ক্ষমতায় বসে ক্ষমতার জন্য তৈরি দলকে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে সচল রাখা মুশকিল। অতীতে মুসলিম লীগের পরিণতি আমরা দেখেছি। অবশ্য তা বলে বিএনপি দুর্বল হয়ে গেলেও এন্টি আওয়ামী লীগ রাজনীতির অবসান হবে না। জামায়াত রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থাকলেও তারা এবং নানান ধারার ধর্মীয় গোষ্ঠী সমাজে উত্তরোত্তর শক্তিশালী হয়েছে। তারা সমাজে সেক্যুলার গণতান্ত্রিক রাজনীতির জোরালো প্রতিপক্ষ দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। মুসলিম সমাজে আলোকন-নবায়নের কাজ খুব ফলপ্রসূভাবে না হওয়া পর্যন্ত অবস্থার উন্নতি হবে বলে মনে হয় না।
মুশকিল হল নানা কারণে আমজনগণ ও ছাত্রতরুণরা প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আর আগ্রহী নয়। জ্বলন্ত চুলা আর তপ্ত কড়াইয়ের এই ফাঁড়া থেকে তারা বেরুতে চায়। দুই পক্ষের কারও ওপর তাদের আস্থা নেই, কেউই তাদের দলে টানতে পারছে না। তাতে অবশ্য মন্দের ভালো হিসেবে হয়ত গৃহযুদ্ধের আশংকা দূর হয়। কিন্তু আপাতত রাজনৈতিক অঙ্গনের ঈশানে থমথমে মেঘের আনাগোনা বাড়তে থাকবে বলেই মনে হয়।