Monday, February 6, 2017

সার্চ কমিটি, নির্বাচন কমিশন, অথ:কিম

আবুল মোমেন

১.
এখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ছাপিয়ে জাতীয় পর্যায়ে প্রধান আলোচ্য বিষয় নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন। রাষ্ট্রপতিই এটি গঠন করবেন যদিও আমরা জানি রাজনৈতিকভাবে এবং সাংবিধানিক নিয়মে তাঁর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অভিমত উপেক্ষা করা কঠিন। রাষ্ট্রপতি যদিও আর কোনো দলের সদস্য নেই তবুও তিনি তো আদতে সর্বতোভাবে এমন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যিনি আজীবন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বিশ্বস্ত থেকেছেন। তবে বিশ্বস্ত থেকেও রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাঁর ব্যক্তিগত সততা ও নৈতিকতার কারণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। এমন একজন নেতাকে রাষ্ট্রপতির পদের উপযুক্ত ভাবাই স্বাভাবিক। তিনিও সেই জনমতের মর্যাদা রক্ষা করেছেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের পূর্বসুরীর মনোনীত নির্বাচন কমিশন তার পূর্বসূরী কমিশনের মানদ- বজায় রাখতে পারে নি, তাতে বিরোধী দল ও সচেতন নাগরিকগণ তো বটেই, সাধারণ মানুষও হতাশ হয়েছেন।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি আগের ধারা অনুসরণ করে অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের একটি ধাপ তৈরি করে দিয়েছেন। আশার কথা প্রথম পর্যায়ে এটি নিয়ে কিছু কথাবার্তা উঠলেও কমিটি এ পর্যন্ত ভালোভাবেই কাজ এগিয়ে নিচ্ছে। শোনা যাচ্ছে অনুসন্ধান কমিটি দশ জনের তালিকা দেবেন রাষ্ট্রপতিকে ৮ ফেব্রুয়ারির সময়সীমার মধ্যেই। রাষ্ট্রপতি অবশ্য তাঁদের তালিকা মানতে বাধ্য নন, তবুও সচেতন মানুষের আস্থা এবং প্রধান বিরোধী দলের অনুমোদন পাওয়া একটি কমিটির সুপারিশ রক্ষার একটা চাপ তাঁর ওপর থাকবে বৈকি।
সবচেয়ে ফাঁপরে আছে বিএনপি। ২০১৪-র ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ঘিরে সরকারবিরোধী আন্দোলনের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর এখন তাদের সামনে নির্বাচনই অবশিষ্ট আছে সরকারের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়ানোর কার্যকর মাধ্যম হিসেবে।
তারা এই প্রক্রিয়াটার পথ বন্ধ করতে চায় না, আবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের ওপর সম্পূর্ণ আস্থাও রাখতে পারছে না। তাই মহাসচিব মীর্জা ফখরুলের নেতৃত্বে একপক্ষ অনুসন্ধান কমিটি নিয়ে দলের সংশয় প্রকাশ করে রাখলেও স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আশাবাদ জিইয়ে রাখেন। বিএনপি এবং জাতির জন্যে নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে উৎকণ্ঠা অবশ্য শেষ হবে না ৮ তারিখ অনুসন্ধান কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে নাম জমা দেওয়ার সাথে সাথে। রাষ্ট্রপতি কমিশনের চূড়ান্ত ঘোষণা দিতে নিশ্চয় কয়েকদিন সময় নেবেন।
সাংবিধানিক নিয়মে তাঁর পরামর্শ নেওয়ার কথা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা পরিহার করাই হবে শ্রেয়, যদিও প্রধানমন্ত্রীর অভিমত পরোক্ষ এবং নানা উপায়েও তাঁর কাছে পৌঁছুতে পারে এবং তাই স্বাভাবিক।
২.
গণমাধ্যম এবং সক্রিয় নাগরিক গোষ্ঠীগুলো জনমতকে প্রায় একটি নিরপেক্ষ আস্থাভাজন কমিশন গঠন এবং ২০১৯ সনে একটি স্বচ্ছ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে আনতে পেরেছে - যদিও পরমতসহিষ্ণু গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক মানবিক চেতনার পরিপন্থী ঘটমান নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তত কার্যকর ভূমিকা নিতে তাঁদের দেখা যাচ্ছে না।
এদিকে সকলেই স্বীকার করবেন অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে দেশে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের সংকট শক্তিশালী হয়েছে। এটাও অস্পষ্ট নয় যে এদের পেছনে ইসলামের নাম ব্যবহার করে নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক দল ও সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। এ কাজে সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পর্যন্ত নতুন নতুন উৎসের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এ বাস্তবতায় যখন নাগরিকসমাজ সুষ্ঠু নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিয়ে সমাজপ্রগতির প্রশ্নকে গৌণ করে রাখে তখন আওয়ামী লীগও নির্বাচনের হিসেব মাথায় নিয়ে এগুবে এটাই স্বাভাবিক।
এদিকে সমাজে ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল ধারার অবক্ষয় ঘটেই চলেছে। সে কারণেই কি আওয়ামী লীগ ধর্মবাদী শক্তির সাথে সমঝোতার পথ ধরছে? বোঝা যাচ্ছে আগামী নির্বাচনকে মাথায় রেখেই আওয়ামী লীগ জামায়াতবিরোধী হেফাজতে ইসলামকে পাশে রাখতে চাইছে। তাদের সাথে পাঠ্যবই নিয়ে যে সমঝোতা হয়েছে তার সর্বনাশা দিকটা নাগরিকসমাজের ক্ষুদ্র অংশের বাইরে তেমনভাবে আলোচিত হচ্ছে না। অথচ এর সাথে ভবিষ্যতের নাগরিকদের যথার্থ বাঙালি এবং আদর্শ মুসলমান হওয়ার সংকট গভীরভাবে সম্পর্কিত। কেননা সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধতা বাঙালি ঐতিহ্য এবং ইসলামের মূলশিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শুধু এমন সর্বনাশ ঘটবে তা নয়, অন্যান্য মুসলিম দেশের - যারা হয় পশ্চিমের লেজুড়বৃত্তি করে নয়ত স্বৈরাচারী শাসনের জাঁতাকলে থাকে - মত আমাদের দেশও অগণতান্ত্রিক অমানবিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হওয়ার আশংকায় থাকবে।
আমরা এখনো আশা করতে পারি না যে দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সরকারের এ আপসকামিতার বিরোধিতা করবে, কারণ তারা তো জামায়াতেরই বিরোধিতা করে না, যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেয় না, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধেও কোনো কার্যকর ভূমিকা নেয় না। তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসের কোনো বিশ্বাসযোগ্য দৃষ্টান্তও রাখে না। বিএনপির আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতি আওয়ামী লীগের চেয়ে চিন্তা-চেতনায় এগিয়ে থাকার রাজনীতি না হয়ে দুর্ভাগ্যবশত পিছিয়ে থাকা স্বাধীনতাপূর্ব পাকিস্তানি ধারার মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনীতিতে ঘুরপাক খাচ্ছে (মনে রাখতে হবে গয়েশ্বরচন্দ্রের পক্ষেও নির্বাচনে দলের কাছ থেকে তাঁর কিংবা মেয়ের জন্যে মনোনয়ন আদায় সম্ভব হয়নি।)
৩.
ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে র‌্যাব-পুলিশের অভিযান বর্তমানে জোরালোভাবেই চলছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনি তো হত্যা, জখম, আক্রমণ ও অন্যান্য সুনির্দিষ্ট অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরেই কাজ করতে পারে। তার আগে তো প্রয়োজন এমন অপরাধের মনোবৃত্তি সমাজে যাতে তৈরি না হয় সে কাজ করা। সরকার নানাভাবে সে কাজ করার চেষ্টা করছেন। ইমামদের সাথে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জঙ্গিবাদবিরোধী সভা হচ্ছে। এর মধ্যে লক্ষাধিক আলেমের জঙ্গিবাদবিরোধী ফতোয়াটিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া র‌্যাব-পুলিশকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ ও সজাগ রাখার কাজও চলছে। কিন্তু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে এসব সত্ত্বেও সমাজে ধর্মীয় রক্ষণশীলতা বাড়ছে, রাজনীতি ক্রমেই ধর্মীয় সংস্কৃতি ধারণ করছে যা প্রকৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সৃষ্টির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সমাজে উগ্রবাদী ধর্মীয় প্রচারণা এবং বাজার অর্থনীতির প্রভাবে স্বাভাবিক সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার ধারা ক্ষীয়মান। বস্তুতপক্ষে রাজধানীর বাইরে সারাদেশের শহরে-গ্রামে সর্বত্র আজ সংস্কৃতির ধারা ম্রিয়মান, নিষ্প্রাণ এবং ক্ষয়িষ্ণু। আর শিক্ষাব্যবস্থা পরীক্ষার জাঁতকল সৃষ্টি করে শৈশব থেকেই জাতির সংস্কৃতি চর্চার সক্ষমতা ছেঁটে দিচ্ছে।
দেশপ্রেমিক রাজনীতির বোধ তৈরিতে সংস্কৃতি-চেতনা বিশেষ ভূমিকা রাখে। এখন তরুণরা আত্মকেন্দ্রিক, দেশ ও মানব বিচ্ছিন্ন হচ্ছে, ভোগবাদ ও অন্ধবিশ্বাসের খপ্পরে পড়ছে, হতাশা ও মাদকের দিকে ঝুঁকছে। এ বাস্তবতায় সুস্থ গণতান্ত্রিক রাজনীতি কীভাবে বিকশিত হবে?
আমরা বরং দেখছি দিনে দিনে দেশে মুক্ত চিন্তার সংকট বাড়ছে, প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি সংকুচিত হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নেহায়েৎ মুখের বুলিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। সাধারণের রাজনৈতিক চেতনার স্তর যদি এ পর্যায়ে থাকে তাহলে ভোটের ফলাফলে তার প্রভাব তো পড়বেই। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, এমনকি সরাসরি যুদ্ধের বিরোধিতাকারী যুদ্ধাপরাধীরাও ক্ষমতায় এসেছে, ক্ষমতার প্রশ্রয় পেয়েছে। আমরা কি সেই ন্যাড়া যে বেলতলায় আবার যেতে চাইবে?
৪.
নাগরিক সমাজ এবং রাজনৈতিক দল নিশ্চয়ই শক্তিশালী স্বাধীন নিরপেক্ষ একটি নির্বাচন কমিশন চাইবে, তার জন্যে গঠিত সার্চ কমিটি এবং এর চূড়ান্ত রূপ প্রদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির কাছ থেকেও একই রকম প্রত্যাশা করতেই পারেন। কিন্তু সমাজকে প্রকৃত গণতন্ত্রে জন্যে প্রস্তুত করার দায়িত্বটি আরব্ধ রেখে বা পালন না করে যে কোনো পরিণতিই কি আমাদের কাম্য? এটা কি সচেতন নাগরিকের কাজ? অর্থাৎ সচেতনতা কেবল নির্বাচন কমিশন বা নির্বাচন নিয়েই থাকবে কিন্তু তার পরিণতি নিয়ে থাকবে না, এটা কি প্রকৃত পরিণত চেতনার লক্ষণ?
গত শতকের পাঁচ ও ছয়ের দশকে জাতি ও দেশ যেমন এক মহৎ সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছিল তেমনি গত দীর্ঘ চার দশকে এবং বিশেষভাবে গত পঁচিশ বছরে ধীরে ধীরে দেশ ও জাতি গভীর সংকটের দিকে এগিয়েছে। স্থাপনাগত দৃশ্যমান উন্নয়ন কিংবা সামাজিক সূচকসমূহে চমকপ্রদ অগ্রগতি সত্ত্বেও বলব মানবিক অবক্ষয়ের কথা। এতে সমাজে গণতান্ত্রিক মানবিক মূল্যবোধের চর্চা ব্যাহত হয়। এই উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়েই ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে, সর্বস্তরে শিক্ষার মান কমছে, সংস্কৃতিচর্চায় ভাঁটা চলছে, সমাজে মূল্যবোধ ও নৈতিকতার সংকট বাড়ছে, আইন ভাঙার ও অপরাধের প্রবণতা বাড়ছে, নিষ্ঠুরতা ও নারী নির্যাতন বেড়ে চলেছে, দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমকে ছাপিয়ে উঠেছে আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতা। দলাদলি, হানাহানি তথা হিংসা ছাপিয়ে যাচ্ছে প্রীতি, বন্ধুত্ব ও সহমর্মিতাকে। সমাজের এই রূপান্তরের সামনে দাঁড়িয়ে সার্চ কমিটির কাছে কি প্রত্যাশা করব? সৎ নিরপেক্ষ দক্ষ নির্বাচন কমিশন কোন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবেন? হ্যাঁ পরিবর্তনের সুযোগ তাঁরা তৈরি করে দিতে পারেন। কিন্তু তাতেই যে দেশেরও মঙ্গল নিহিত, এমনকি তাতে যে দেশ ও মানুষের জন্যে চরম কোনো অমঙ্গল বয়ে আসবে না তারই বা কি গ্যারান্টি?
নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই সৎ দক্ষ ও নিরপেক্ষ হতেই হবে, এটা তার ধর্ম। কিন্তু সমাজকে তো অন্ধশক্তির বিকারের বিরুদ্ধে চেতনার সলতে জ্বালিয়ে আলোর পথ রচনা করতে হবে। তাকে তো অন্ধকার ও আলোর মধ্যে ভাগ  করতে হবে, আলোকেই - বাস্তবতার নিরিখে অন্ধকারে বিপরীতে স্বল্পালোককেও - অন্ধকার বা প্রায়ান্ধকার থেকে আলাদা করে বাছাই করে নিতে হবে। তার একটা পক্ষপাত থাকতেই হবে। সমাজের পাশে রাষ্ট্রযন্ত্র থাকলে তবেই রূপান্তর সহজতর হয়, নয়ত কোনো দেশে অন্ধকার যুগ নেমেও আসতে পারে, ঘটতে পারে ধারাবাহিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের দিশাহীন দীর্ঘ রক্তপাত যা পরিণামে অন্ধকারকেই অনিবার্য করে তোলে।

***