Sunday, November 20, 2016

গণতন্ত্র: আদর্শহীন ব্যবস্থা?

আবুল মোমেন

গণতন্ত্র আদর্শ হিসেবে হোঁচট খেয়েছে আর ব্যবস্থা হিসেবে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মানছি যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় এ ভাবনাগুলোকে হালনাগাদ করে দিয়েছে; তবে ভারতে নরেন্দ্র মোদীর বিজয় বা তুরস্কে এরদোয়ানের জুলাইয়ের ব্যর্থ অভ্যুত্থান-পরবর্তী কার্যকলাপ আগেই গণতন্ত্রকে কাঠগড়ায় তুলেছিল।
গণতন্ত্রের বাঁধা বুলি আমরা পাকিস্তান আমল থেকেই শুনে এসেছি। সত্যিই পাকিস্তান শাসিত হয়েছে স্বৈরাচারী কায়দায় - কখনো সরাসরি সাময়িক কর্তৃত্বে কখনো বেসামরিক ছদ্মবেশে। গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যূত্থানকে শেষ পর্যন্ত রণাঙ্গন অবধি টেনে আনতে হয়েছে সেই জগদ্দল ভাঙবার জন্যে। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা এনেছি - মূল লক্ষ্য ছিল গণতন্ত্র ও অধিকারহীন পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশে বসবাস।
পাকিস্তান আমল আর নেই, সেকালের চেয়ে অনেক ভালো আছি তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু আমাদের চলমান গণতন্ত্রে আদর্শ গুরুত্ব হারিয়েছে, এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যথেষ্ট ঘাটতির মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশ্ন হল, এর চেয়ে ভালো বিকল্প কি বর্তমান ব্যবস্থায় পাওয়া সম্ভব? যদি না হয়, তাহলে ব্যবস্থা পাল্টানোর প্রশ্ন উঠবে।
সেই প্রশ্নটা মাথায় রেখে আমরা যে তিন নেতার কথা গোড়ায় বলেছি তাদের প্রসঙ্গে একবার আসি। ট্রাম্প বিজয়ের জন্যে আমেরিকাকে আবার মহান বানানোর যে স্বপ্ন দেখিয়েছেন তাতে আফ্রিকান-আমেরিকান, হিস্পানিক জনগোষ্ঠী, এশীয় এবং মুসলিম অভিবাসীদের প্রতিপক্ষ দাঁড় করিয়ে বস্তুত জনসংখ্যার ৭০ ভাগ শ্বেতাঙ্গ-মার্কিনিদেরই তাঁর পক্ষভুক্ত করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ অভিবাসী-নির্ভর দেশটি যে ঐতিহ্যগতভাবে সব ধর্মবর্ণের মিলনপাত্র হয়েই মহান হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে তাকেই জবাব দিয়ে অর্থাৎ বিদায় করেই ট্রাম্পের মহান রাষ্ট্র তৈরি হবে! নরেন্দ্র মোদী ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলেই বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। এরদোয়ান তুরস্কের প্রশাসন ও জনজীবনে আধুনিক প্রগতিশীল অংশকে দুর্বল - সম্ভব হলে ধ্বংস - করে দেওয়ার জন্যে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সুযোগটাকে যে কোনোভাবে সর্বোচ্চ কাজে লাগাচ্ছেন।
এঁরা তিনজনই গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন - ট্রাম্পকে যদিও আরো দুমাস অপেক্ষা করতে হবে ক্ষমতা ভোগ করার আগে। ট্রাম্প মোদী এরদোয়ান নির্বাচিত হয়েছেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, ভোটারদের রায়ে, কিন্তু সে রায় পক্ষে পেতে তাঁরা প্রচারণায় যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছেন তা কি গণতান্ত্রিক আদর্শের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ?
বিষয়টা দাঁড়ালো এই যে, আদর্শের কোনো প্রয়োজন নেই, ব্যবস্থার ফায়দা যেভাবে আদায় করা যায় সেভাবেই করো। ফলে প্রচারণায় রাজনৈতিক আদর্শের কথা মূল্যহীন,. আক্রমণের বিষয় হতে পারে, ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায়। এতকাল এসব ছিল অজুহাতের মত, কোনো ঘটনার প্রেক্ষাপটে আলোচিত বিষয়, যেমন টুইন টাওয়ারে হামলার জন্যে কতিপয় সন্ত্রাসী দায়ী যারা মুসলিম এবং মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ। ট্রাম্প কথার মারপ্যাঁচে যান নি, সরাসরি প্রতিপক্ষ কারা চিনিয়ে দিয়েছেন। এরদোয়ানও প্রতিপক্ষ ঘায়েল করতে গিয়ে নিজের স্বরূপও খুলে ধরেছেন। মোদী অত্যন্ত সুকৌশলে তাঁর গোপন এজেণ্ডা হিন্দুত্ববাদকে এখনো গণতন্ত্রের আবরণে ঢেকে চলেছেন। যদিও বলা যায় রাষ্ট্রে তাঁর কর্তৃত্ববাদী চেহারা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে।
প্রশ্ন হল ব্যবস্থার ন্যায্যতার কী মূল্য যদি আদর্শের (এবং মূল্যবোধের) ন্যায্যতা টিকতে না পারে? আদর্শের অনুপস্থিতি কার্যত মূল্যবোধের অবক্ষয় ডেকে আনে। আর মূল্যবোধের ক্ষয় পাওয়ার অর্থ মনুষ্যত্বের গভীর সংকট সৃষ্টি হওয়া। সমাজে সেই সংকট নানাভাবে ফুটে উঠছে, কেবল আমাদের দেশে নয়, বিশ্বব্যাপীই তা চলছে।
দেখুন, আমরা আলোচনার নিজস্ব গতি ও পরিণতিতে কোথায় এসে পৌঁছেছি। কবুল করতে হচ্ছে যে গণতন্ত্র চলছে তাতে তো মনুষ্যত্বের সংকট তৈরি হচ্ছে। ভোটের মূল্যেই মানুষের মূল্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে যে রাজনীতি তার নিজের কোনো মূল্যবোধ নেই।
এই রাজনীতি আদতে দেশ ও মানুষের সেবার অধিকারের সাথে কর্তৃত্বের চাবিকাঠিও বিজয়ীর হাতে তুলে দেয়। সেবা একটি মূল্যবোধ, তাই এর কেতাবী কিংবা আলংকারিক মূল্য আছে, কিন্তু প্রকৃত মূল্য হল ক্ষমতার এবং তা খাটানোর অধিকার কতটা ভোগ করা যাচ্ছে তার। তাই সব বিজয়ীই চায় প্রশ্নাতীত ক্ষমতা ও অবস্থান, অর্থাৎ জবাবদিহিতা-মুক্ত স্বাধীন অধিকার।
ট্রাম্পের পক্ষে মোদি বা এরদোয়ানের মত বেপরোয়া হওয়া সম্ভব হবে না বলেই ভাবতে চাই। কারণ প্রায় সোয়া দুশ বছরের আমেরিকান গণতন্ত্র অনেকগুলো সফল প্রতিষ্ঠান গড়েছে এবং সেই সাথে অনেক সচল প্রাতিষ্ঠানিক মূল্যবোধও তৈরি করেছে। সমাজে এসবের শিকড় যথেষ্ট গভীর, একজন ট্রাম্প একটি নির্বাচনে জয়ী হয়ে তা উপড়াতে পারবে বলে বিশ্বাস হয় না। ভারতেও মোদীকে অনেক ক্ষেত্রে আপস কিংবা গতি শ্লথ করতে হয়েছে, কারণ তাদের সামাজিক প্রতষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের সবটা আপসকামী নয়, স্বাধীন অবস্থান রক্ষায় ও আদর্শিক লড়াইয়ে অনেকেই প্রস্তুত এবং তাতে শামিল হচ্ছেন।
তুর্কিরা পুরোনো যোদ্ধা জাতি, আবার তেমনি সমাজ সুপ্রাচীন সুফি-আধ্যাত্মিকতার ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। সেখানে কট্টরপন্থীদের ওপর অতিনির্ভরতার ফলাফল কী দাঁড়াবে বলা মুশকিল। তবে তাদের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য বেশ বিবর্ণ, আতাতুর্ক চেয়েছিলেন রাতারাতি আধুনিক ইউরোপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। জবরদস্তি ছাড়া তা সম্ভব ছিল না। আর তাই তুরস্কের গণতন্ত্রের খুঁটি ছিল সামরিক বাহিনি, বা জেনারেলদের ইচ্ছাধীন!
এবার বোধহয় বাংলাদেশের দিকে চোখ ফেরাতে পারি। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার প্রয়াস হোঁচট খায় দুই তরফে - দলীয় লোকজনের ব্যক্তিস্বার্থে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং জাসদের হঠকারী অতি বা প্রতি বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে তাঁকে, অনিচ্ছায় হলেও, বিশেষ ক্ষমতা আইনপ্রয়োগ করে কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকেই যেতে হল। এখন সব ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত, সরকার ও দলের অন্যদের ক্ষমতা-যোগ্যতার চেয়েও আনুগত্যের গুরুত্ব যে বেশি, তা স্পষ্টই বোঝা যায়। তদুপরি তাঁর জীবনও নিরাপদ নয়, তাঁকে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনির বেষ্টনিতেই চলাচল করতে হয়। এ বাস্তবতায় আদর্শগত বিচারে নিশ্চয় গণতন্ত্রের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে।
শেখ হাসিনার দেশপ্রেম তর্কাতীত, মানুষের জন্যে ভালোবাসা নিয়েও কোনো প্রশ্ন নেই, হয়ত গণতান্ত্রিক আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতি তাঁর অন্তরের শ্রদ্ধাবোধেও কমতি নেই।
যদি গণতন্ত্রকেই সাক্ষী মেনে প্রশ্ন করা যায় এ মুহূর্তে বাংলাদেশে তাঁর বিকল্প কে আছেন? না, অনেকের মনে যে নামটি রয়েছে সেই খালেদা জিয়াকে বলা যাবে না, ঠিক যেভাবে শেখ মুজিবের বিকল্প হতে পারেন না জিয়া - এও এখন সেরকমই। কারণ বাংলাদেশের নিয়তি পাকিস্তান হওয়া নয়, তাকে বাংলাদেশই হতে হবে। আমরা স্বপ্ন দেখি আমাদের বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠবে। তবে তারও চেয়ে জরুরি হল বাংলাদেশের স্বতন্ত্র স্বকীয় দর্শনটি স্পষ্ট করা যতে এদেশে রাজনীতির ভিত্তিরেখাটি স্পষ্টভাবে দাঁড় করানো যায়। কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা একাত্তরের ইতিহাস স্বয়ংক্রিয়ভাবে এ কাজ করে দেবে না।
তবে তার আগে স্বীকার করতে হবে যে দেশ এবং বিশ্ব বর্তমানে এমন একটা ঘূর্ণিপাকের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে যখন গণতন্ত্রের আব্রূটুকু বাঁচানোকেই নেতারা যথেষ্ট ভাবছেন, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের কথা আপাতত তুলে রাখছেন। এ নিয়ে স্বভাবতই অনেকেরই অভিযোগের কমতি নেই। ঠিক আছে, কিন্তু সত্যিই যে ঘূর্ণিপাকে জেরবার হওয়া যুগান্তরেই আছি আমরা তা তো অস্বীকার করা যাবে না।  ঘূর্ণিস্রোতে বেসামাল তরণীতে একনায়কের উত্থান ঘটা অস্বাভাবিক নয়।
তাহলে, আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে এটা সত্যিই গণতন্ত্রের আকাল। আকালের গণতন্ত্র তার বৈভব দেখাতে চাইছে বৈষয়িক চাকচিক্যে, তারই বহর ও নহর দেখছি আমরা। এর প্রবাহে সারা দেশে গণতন্ত্রের ক্ষুদে ক্ষুদে অতন্দ্র প্রহরীরা যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে দখল বুঝে নিচ্ছে। গণতন্ত্রের আব্রূ রক্ষা হচ্ছে কিনা জানি না। কিন্তু বুঝি যে, জিয়াউর রহমানের ফর্মুলাই জয়ী হচ্ছে, রাজনীতি-রাজনীতিকদের জন্যে কঠিন হয়ে পড়েছে, প্রক্রিয়ার মধ্যে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে বণিকদের রাজনীতিক জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন নয়ত নিজেরা বণিক হয়ে টিকে থাকার লড়াই করছেন।
অবশ্য গণতন্ত্র আদতে ক্ষমতার রাজনীতি নয়, অধিকারের রাজনীতি। সবার, বিশেষত দুর্বল ও প্রান্তিকজনের, আজকের দিনে গাছপালা, পশুপাখি, মাছ, কীটপতঙ্গ, এমনকি নদী-পাহাড়-জলাশয়ের অধিকার রক্ষার জন্যেও শর্ত আরোপ হতে পারে, কারো ক্ষমতার জন্যে নয়। এ অর্থে রাজনীতি ও গণতন্ত্রের পরিসর বাড়ছে।
আসুন, আমরা কথা ও কাজে এক হয়ে সবার অধিকার আদায়ের কথা ও কাজে নেমে পড়ি। সেটাই গণতন্ত্রের দাবি আমাদের কাছে।


                                                                          *****

Sunday, November 13, 2016

সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নিয়ে আগাম ভাবনা

আবুল মোমেন

চট্টগ্রাম শহরের জনসংখ্যার হিসেব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এক মত হতে দেখা যায়  না - ৪৫ থেকে ৬০ লাখ পর্যন্ত শোনা যায়। আমরা ধরে নিতে পারি ৫০ লাখ। একটা তথ্য দিয়ে কথাটা শুরু করি।
দু’মাস আগে গিয়েছিলাম পাশের ভারতীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায়। জনসংখ্যা ৬ লাখ। আমরা চট্টগ্রামের সঙ্গীত সংগঠন রক্তকরবীর অনুষ্ঠান করলাম রবীন্দ্রভবনের দুই নম্বর মিলনায়তনে। এই আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে আসনসংখ্যা ৬শর বেশি। ভবনের প্রধান হলের ধারণ ক্ষমতা এগারশর বেশি। রাস্তার বিপরীত দিকে আছে সুকান্ত একাডেমি। তাতে ৩৫০ আসনের আধুনিক মিলনায়তন ছাড়াও লাইব্রেরি, গ্যালারি রয়েছে। পাঁচ বছর আগে ওখানে সেমিনার করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবাষির্কী উপলক্ষে। এর বাইরে আছে নজরুল কলাক্ষেত্র - এই আধুনিক মিলনায়তনটিতে আসন সংখ্যা নয়শ। টাউন হলও বেশ ভালো। পুরোনো রাজবাড়িতে জাদুঘরের পাশাপাশি সংস্কার করে আধুনিক মিলনায়তনও তৈরি হয়েছে।
একটি শহরের নাগরিক জীবনে সুস্থ আনন্দ ও বিনোদনের জন্যে আধুনিক মিলনায়তন অপরিহার্য। মিলনায়তনের সংখ্যা, সুযোগ-সুবিধা ও তার মান দেখে বোঝা যায় নগরটি সাংস্কৃতিকভাবে অত্যন্ত জীবন্ত।
আগরতলার চেয়ে জনসংখ্যার বিচারে প্রায় আট গুণ বড় চট্টগ্রাম শহরে একটি মাত্র আধুনিক মিলনায়তন আছে, থিয়েটার ইন্সটিটিউট, যার আসনসংখ্যা মাত্র ২৮০। এছাড়া শিল্পকলা একাডেমির কিছু সংস্কার ও আধুনিকায়ন হয়েছে। কিন্তু আসন সংখ্যা সেই ৩০০-৩৫০।
এককালে যখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মিলনায়তনের রেওয়াজ ছিল না তখন চট্টগ্রামে অন্তত ৪টি মিলনায়তন বেশ চালু ছিল - মুসলিম হল, ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউট, ওয়াপদা মিলনায়তন, জেমসেন হল। এছাড়া সেন্ট প্লাসিডস্ ও সেন্ট মেরিজ স্কুলের মিলনায়তনও বিভিন্ন সময়ে নাটকসহ সাংস্কৃতিক কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এসব মিলনায়তনে তখন নিয়মিত নাটক ও বিচিত্রানুষ্ঠান হত। বর্তমানে দুটি মাত্র মিলনায়তন চালু থাকলেও তাতে কিন্তু প্রতি সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান থাকে না। অন্যান্য হল, মুসলিম হল, জেমসেন হল, ওয়াজিউল্লাহ ইন্সটিটিউটের ব্যবহার আর তেমন হয় না। বলা যায় নগরে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে ভাঁটা চলছে। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মিলনায়তনগুলোতেও আগের মত সাংস্কৃতিক কার্যক্রম হয় না। শুনেছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মোজাম্মেল স্মৃতি মিলনায়তনটি অব্যবহার্য পড়ে থাকতে থাকতে তার মেঝেতে ঘাস গজিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত হলটি পরিত্যক্তই হয়েছে কি?
সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের এই ভাঁটার কালে এখানকার ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোও ধুঁকে ধুঁকে চলছে। অধিকাংশ নাটকের দল নামসর্বস্ব - কালেভদ্রে মঞ্চে নাটক করে।
চট্টগ্রাম বেতার ও টেলিভিশনও মান বজায় রেখে চলতে পারছে না। এই বাস্তবতায় মেধাবী তরুণ শিল্পীরা সকলেই ঢাকামুখী হয়ে পড়েছে। এর ফলে ঢাকার বাইরে সারাদেশের সবকটি জেলা শহরই সাংস্কৃতিকভাবে ক্ষয়িষ্ণু, প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। চট্টগ্রাম দেশের প্রধান বন্দর নগরী হিসেবে গড়পড়তা সবার মধ্যে থাকার কথা নয়, এটা চট্টগ্রামের দুর্ভাগ্য।
আজকে জঙ্গিবাদের উত্থানের ফলে সকলেই উপলব্ধি করছেন যে দেশের সব জেলায় সর্বত্র সাংস্কৃতিক উজ্জীবন প্রয়োজন। সে হিসেবে দেশের দ্বিতীয় প্রধান নগরী ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের দিকে সবার মনোযোগ দেওয়া দরকার।
আশার কথা সরকার অর্থাৎ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় মুসলিম হল ও শহীদ মিনারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স হলে ভালো হয়। এখানে একটি অন্তত হাজার আসনের মূল মিলনায়তন, একটি চারশ আসনের নিরীক্ষামূলক নাটকের হল, একটি তিনশ আসনের সেমিনার হল, একটি একশ আসনের লেকচার হল, একটি প্রদর্শনী কক্ষ, একটি নগর জাদুঘর, একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনী কক্ষ, একটি সংস্কৃতি বিষয়ক লাইব্রেরি এবং একটি সাংস্কৃতিক আর্কাইভ থাকলে ভালো হয়। তাছাড়া বেশ কিছু মহড়া কক্ষ, সভাকক্ষ থাকতে পারে। সম্ভব হলে জনা বিশেকের সাংস্কৃতিক দল থাকার উপযোগী ডরমিটরি, চারজন বিশিষ্ট ব্যক্তি থাকার মত অতিথি কক্ষ থাকা দরকার। আর থাকবে ভালো মানের কেন্টিন।
আমরা আশা করব চট্টগ্রামকে বুঝ দেওয়ার মত কোনো সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স-এর কথা সরকার ভাবছেন না। একটি বিকাশমান আধুনিক নগরীর চাহিদা বিবেচনা করেই এটি তৈরি হওয়া দরকার।
প্রধান মিলনায়তন ও নাট্য মিলনায়তন এমনভাবে হওয়া উচিত যাতে ব্যালে নৃত্যসহ বিদেশি সাংস্কৃতিক দলের অনুষ্ঠান ও অত্যাধুনিক নিরীক্ষামূলক নাটক এতে মঞ্চায়ন করা সম্ভব হয়।
এটিকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম যেন সাংস্কৃতিকভাবে জেগে ওঠে সেটাই চট্টগ্রামের মানুষের মাথায় রাখা দরকার। কেবল স্থাপনা বা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কিছুই হবে না যদি না স্থানীয় মানুষ মানসম্পন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে কমপ্লেক্সকে চাঙ্গা রাখতে পারেন, নাগরিকদের সুস্থ বিনোদন দিতে পারেন।
এটি পরকিল্পনার জন্যে যোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিতে হবে। মূল একজন পরিচালক ছাড়াও নাটক ও সঙ্গীত বিভাগের দু’জন উপ-পরিচালক থাকতে পারেন। এছাড়া প্রয়োজনীয় অফিস স্টাফ তো থাকবেনই। 
শেষ কথা হল কেবল ভবন তৈরি করলে চলবে না, এখানে বছরব্যাপী কার্যক্রম পরিচালনার জন্যে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দও থাকতে হবে। নয়ত অনেক অর্থের বিনিয়োগ অনর্থক হয়ে যাবে। কারণ নিজস্ব আয় দিয়ে উন্নত মানের সংস্কৃতি চর্চা সম্ভব নয়। পৃথিবীর কোনো দেশেই তা হয় না এর জন্য সবসময়ই ভর্তুকির প্রয়োজন হয়। এ বিষয়টি অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে।

****


Wednesday, November 9, 2016

শিক্ষাকে বলি দিয়ে শিক্ষার বিস্তার?

আবুল মোমেন

প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা থাকছে - শিক্ষামন্ত্রীর কথায় অন্তত তাই মনে হচ্ছে। শিক্ষাবিদদের চাপাচাপিতে সরকার  একবার এ পরীক্ষাটি বন্ধ করার কথা বলেও আবার মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে তা বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বছরের জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা মাত্রই শেষ হয়েছে। এর পরে নিশ্চয় উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
সরকারকে শিক্ষায় ধনী-মধ্যবিত্ত-দরিদ্র, মহানগর-মফস্বল-গ্রাম-চরাঞ্চল-পার্বত্য এলাকাবাসী ইত্যাদি সকল পর্যায়ের নাগরিকের অন্তর্ভুক্তির বিষয় মাথায় রাখতে হয়। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় একবার আমাকে বলেছিলেন পরীক্ষাকে সরকার একটি উৎসবে রূপ দিতে পেরেছে এবং  দেখা যায় গ্রামাঞ্চল-চরাঞ্চলের শিশুরাও অভিভবকদের সাথে হেঁটে, ভ্যান বা রিকশায় দল বেঁধে সেজেগুজে পরীক্ষার হলে যায়। এই উৎসবের আমেজ তাদের উৎসাহ বাড়ায়, ভয় দূর করে এবং সব মিলে শিক্ষা বিস্তারে সহায়ক হয়। তাছাড়া এখনও অনেক ছেলেমেয়ে, বিশেষত মেয়েশিশু, প্রাথমিকেই ঝরে যায়। পরীক্ষা এবং সনদপত্র তাদের অন্তত এটুকু পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রমে ধরে রাখতে সহায়ক হবে।
তাঁর কথায় যে সত্যতা নেই তা নয়। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পরিবর্তে তারা একটি পাব্লিক পরীক্ষা দিচ্ছে এবং সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলের চেষ্টায় তাতে উৎসবমুখর পরিবেশও সৃষ্টি করা গেছে। তাহলে অসুবিধাটা কোথায়?
শিক্ষায় সনদপত্র একটি নগদপ্রাপ্তি, এর কিছু মূল্য হয়ত জীবনে কখনও মিলতেও পারে - যদিও ইদানীং কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চাকুরি কেবল প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা পাশের সনদ দিয়ে জোটে না। তার জন্যে নিদেনপক্ষে জেএসসি সনদপত্র  লাগবে। দিনে দিনে সেটারও মূল্য থাকবে না। বাস্তবতা হল এখন ডিগ্রি পাস করেও অনেকে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকুরি করছেন। চাকুরির বাজার সম্প্রসারিত হলেও বাস্তবতা এরকমই থাকবে।
শিক্ষার মূল কাজ তো সনদপত্র অর্জন নয়, প্রাথমিক বা নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে তা তো নয়ই। এমনিতেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বড় দুর্বলতা হল এর পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা। পরীক্ষাকে ঘিরেই পড়াশুনার আয়োজন চলতে থাকায় ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক ত্রয়ী মিলে পরীক্ষা-উপযোগী বা পরীক্ষাবান্ধব একটা ব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছে। পিএসসি ও জেএসসি এই প্রবণতাকে জোরদার করেছে।
পরীক্ষার ভিত্তিতে পড়াশুনা চলতে থাকলে তার ফলাফল কী হয় সেটা আমরা বাস্তবেই হাতে হাতে পাচ্ছি। আমি দেশের বিভিন্ন পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান ভর্তি পরীক্ষার ভয়াবহ ফলের ওপর জোর দেব না। এটি একটি  চরম বাণিজ্যিক এবং অমানবিক ব্যবস্থা, এটি ভর্তিচ্ছুক ছাত্রের  মেধা ও যোগ্যতা যাচাইয়ের কার্যকর মাধ্যম নয়। এতে গোড়া থেকেই বাদ দেওয়ার কৌশল গুরুত্ব পায়, অবজেক্টিভ প্রশ্নের এক ঘণ্টার পরীক্ষায় উচ্চ শিক্ষার প্রস্তুতি বোঝাও মুশকিল।
তবে মাঠ পর্যায়ে জরীপের মাধ্যমে প্রাথমিকের অর্জন মান যাচাইয়ের যে কাজ ক্যাম্পে ও সরকারের উদ্যোগে হয়েছে তার ওপর নির্ভর করা যায়। এতে দেখা গেছে অর্জন মান সন্তোষজনক, ছাত্রদের বড় অংশ - শতকরা ২৫ ভাগ থেকে ৫০ ভাগ - মাতৃভাষা ও গণিতে দুর্বল, ইংরেজিতে তো বটেই। আমরা বাস্তবক্ষেত্রে পরীক্ষা করে দেখেছি সরকারি প্রাথমিকে অর্জন মানের অবস্থা শোচনীয় - ভাষা, গণিত এবং সাধারণ জ্ঞানে বয়সের তুলনায় মান অনেক কম।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করার মত। ইদানীং দেশের শিল্প ও বাণিজ্যিক উদ্যোক্তারা বিশেষজ্ঞ ছাড়াও ব্যবস্থাপক, তত্ত্বাবধায়ক হিসাবরক্ষকের মত মাঝারি স্তরে বিদেশিদের নিয়োগের দিকে ঝুঁকেছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, এমনকি পাকিস্তান থেকেও অনেকেই এ ধরনের চাকুরিতে আসছেন। অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার বাড়ছে।
শিক্ষার মান আসলেই যে কমেছে তা বোঝা যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানের অবনতিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের উচ্চ শিক্ষার মুখ্য প্রতিষ্ঠান। বিশ্বে এর অবস্থান পাঁচশ-র মধ্যেও নেই। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা - সম্ভবত একমাত্র বুয়েট ব্যতীত - আরও তলানিতে রয়েছে। গবেষণার সংখ্যা ও মান, গবেষণা পত্রিকার স্বীকৃতি ধরলেও আশাব্যঞ্জক কিছু পাওয়া যায় না।
এসব তথ্য ও বক্তব্যের অর্থ অবশ্য এ নয় যে আমাদের ছাত্রদের মেধা ও মান খারাপ। না তা নয়। তা যে নয় তার প্রমাণ আমাদের তরুণরা দেশে ও বিদেশে অহরহ দিচ্ছে। কিন্তু দেশের প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ক্রমেই সেই সুযোগ কমে আসছে।
মূলধারার উচ্চ শিক্ষা যেভাবে চলছে তাতে ছাত্রদের বড় অংশ নিজের পছন্দের বিষয় পড়ার সুযোগ পায় না। ফলে তারা গোড়া থেকেই অনিচ্ছুক ও উদাসীন ছাত্র। তাদের একমাত্র লক্ষ্য থাকে কোনোভাবে এম. এ. পাশ করে সর্বোচ্চ ডিগ্রির সনদ অর্জন। তাদের লেখাপড়া সীমাবদ্ধ থাকে আসন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য পাঁচ-ছটি প্রশ্ন জানা, তার উত্তর মুখস্থ করার মধ্যে। এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে উচ্চ শিক্ষার যে উদ্দেশ্য - পুঙ্খানুপুঙ্খ জানা, বিশ্লেষণ করতে শেখা এবং নতুন ধারণা ও ভাবনা উপস্থাপন - তার কোনো অবকাশ এখানে থাকে না। পরীক্ষার বাইরে ছাত্রের তেমন কিছু করার নেই, জ্ঞান বা মনন চর্চার বিভিন্ন উপায়ের সাথে তাদের পরিচয় ঘটে না। ফলে আড্ডা, নেশা, অপরাজনীতি, মেয়েদের পেছেনে লাগা ইত্যাদি বিচিত্র ক্ষয়িষ্ণু কাজে তাদের তরুণ্য বয়ে যায়। এটি জাতীয় অপচয়।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয় - যা তিনি নিজের শিক্ষা সম্পর্কে বলেছিলেন - আমাদের শিক্ষার প্রায় সবটাই লোকসানি মাল। সরকার এবং বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ বিদেশি অনেক সংস্থা শিক্ষাখাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে বেশ অনেক বছর ধরে। তাতে স্কুলের ঘরবাড়ির উন্নতি হয়েছে, বিনামূল্যে উন্নত মুদ্রণের ভালো বই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে, ছাত্রীদের উপবৃত্তি  ও স্কুল পোশাক দেওয়া হচ্ছে, সীমিত আকারে দুপুরের খাবার চালু হয়েছে, বাথরুম-পানি সরবরাহের উন্নতি হচ্ছে, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত আগের চেয়ে ভালো, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও বেড়েছে। কিন্তু এসব উন্নয়নের ফলাফল শিক্ষায় দৃশ্যমান হচ্ছেনা। আমি বলব, নিচের পর্যায় থেকেই শিক্ষাকে পরীক্ষা-কেন্দ্রিক করে রাখার ফলেই এই বিপুল আয়োজন, শ্রম  এবং ব্যয়ের যথার্থ সুফল আমরা পাচ্ছি না।
পরীক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে যে ব্যবস্থা তা চালু রেখে শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোর প্রবণতা, কোচিং সেন্টারের দৌরাত্ম্য এবং নোটবইয়ের রমরমা ব্যবসা বন্ধ করা যাবে না। কারণ ছাত্রদের অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার দায়িত্ব নেন না, হয়ত বাস্তব কারণ আছে তার। প্রথমত, আমাদের প্রাথমিকের ছাত্রদের বড় অংশই শিক্ষাবঞ্চিত বা স্বল্পশিক্ষিত বাবা-মায়ের সন্তান যারা সন্তানের শিক্ষার প্রস্তুতিতে সাহায্য করতে পারেন না। তদুপরি শিক্ষিত-শিক্ষা বঞ্চিত সকল বাবা-মা বাড়তি উপার্জনের চাপে থাকেন নয়ত কর্মক্লান্ত হয়ে ফিরে আর সন্তানকে সময় দিতে চান না। গৃহ-শিক্ষক বা কোচ নিজের কৃতিত্ব প্রকাশের একমাত্র উপায় হিসেবে পান পরীক্ষার ফলাফলকে যা তাঁর যোগ্যতা-দক্ষতার জ্বলজ্বলে প্রমাণ হাজির করতে পারে। এ প্রক্রিয়া একদম প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু হয়ে উচ্চতর স্তরেও চলতে থাকে।
এটি বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এভাবে ছাত্রদের মৌলিক চিন্তার ক্ষমতা, সবরকম সৃজনশীলতা নষ্ট তো হয়ই উপরন্তু তাদের আত্মবিশ্বাস, যোগ্যতা দক্ষতারও ঘাটতি থেকে যায়।
কেন ঘাটতি থাকে তা বোঝাও কঠিন নয়। পরীক্ষার পড়া হয় প্রশ্নের ভিত্তিতে - সম্পূর্ণ একটি গল্প, অধ্যায় বা ধারণার সাথে পরিচয় এতে গুরুত্ব পায় না, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ঐ পরীক্ষাটিতে নির্দিষ্ট গল্প বা অধ্যায় থেকে কোন প্রশ্নটি আসতে পারে সেটি। দক্ষ কোচরা বিভিন্ন বছরের প্রশ্ন ঘেঁটে সেটি বের করেন এবং সেই প্রশ্নের তাঁদের তৈরি উত্তরটি ছাত্রকে শেখান। পরীক্ষার ভালো ফলেই যেহেতু মোক্ষ তাই এ ধরনের সফল শিক্ষক ও কোচিং সেন্টারের ওপর অভিভাবকদের আস্থা বাড়ছে এবং তা এখন স্কুলের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকরাও এতে আর্থিকভাবে লাভবান হন, ফলে তাঁরাও তাই চান। শিক্ষা বলতে ক্রমে পরীক্ষাই একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠেছে - কোচিং সেন্টারগুলো এবং তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে সফল স্কুলগুলোও অনবরত বছর জুড়ে মডেল টেস্ট নিতে থাকে। এভাবে ছাত্ররা পরীক্ষা-দক্ষ হয়ে ওঠে।  যত অন্ধ আনুগত্যে ছাত্ররা এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে ততই তারা নিজের, বাবা-মার, স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে। যদিও - আবারও রবীন্দ্রনাথের ভাষায় - শিক্ষার হদ্দমুদ্দ সারা হয় ততদিনে।
পরীক্ষাকে যতই উৎসবের রূপ দেওয়া হোক না কেন নিরন্তর পরীক্ষার ড্রিলের ভিতর দিয়ে জীবনের প্রস্তুতিপর্ব পার করে একজন তরুণ শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে - সে শৈশব থেকেই একজন পরীক্ষার্থী, শিক্ষার্থী নয়। বরং যখন তার শিক্ষাজীবন শেষ হয় তখন দেখা যায় তার জ্ঞান ভাণ্ডারে তেমন সঞ্চয় জমে নি। কারণ চাপের মধ্যে সে মুখস্থ বা বারংবার অভ্যাস করে যে বিদ্যা আয়ত্ব করেছে তার সাথে আত্মবিকাশ-আত্মপ্রকাশের তেমন সম্পর্ক না হওয়ায় পরীক্ষার পর শেখা বিষয়গুলো তাদের কিছুই মনে থাকে না। আজকাল দেখা যায় প্রথম শ্রেণির পড়া দ্বিতীয় শ্রেণিতে আসতে আসতে অনেকটাই ভুলে যায় শিশুরা। জ্ঞান যে একদিকে পুঞ্জিভূত হয় আর অন্যদিকে তার ব্যবহারে জানা-বোঝা তথা আলোকনের একটি প্রক্রিয়ায় মানুষটা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে তা আর হতে পারে না। ছাত্রদের থুড়ি পরীক্ষার্থীদের জানার, পড়ার, বোঝার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়, ফলে অধিকাংশ মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরে কোনো বই পড়ার তাগিদ বোধ করেন না। অনেকে দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না, অনেকে আবার বিষয়, ভাবনা বা ধারণার জটিলতায় খেই হারান, বিশ্লেষণের ঘূর্ণিপাকে অনেকেরই পড়ার আগ্রহ তলিয়ে যায়। আমাদের শিক্ষা তার ব্যবস্থার গুণে ছাত্রের পড়ার আগ্রহ অংকুরেই নষ্ট করে দেয়।
এভাবে সরকারের ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মেধাভিত্তিক সমাজ তৈরি করা সম্ভব হবে না। এভাবে বিপুল অর্থ এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের শৈশব থেকে তারুণ্য এবং প্রতিভা ও মেধার অপচয় হতে দেওয়া কি ঠিক? শিক্ষার বিস্তার চলছে ঠিকই, তবে তার মূল্য শুধছি শিক্ষাকেই বলি দিয়ে।


****

Thursday, November 3, 2016

জেলহত্যার প্রেক্ষাপটে

আবুল মোমেন


কাল সারাদেশে জেলহত্যা দিবস পালিত হবে। এদিন বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের হাতে জেলে বন্দী চার জাতীয় নেতা নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। এক রাতে একই বর্বর আক্রমণের শিকার তাঁরা। মৃত্যুর এই ঘটনা যেন তাঁদের এক সূত্রে গেঁথে দিয়েছে। তাঁরা চারজনই বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ও সহকর্মী, জীবনের শেষপর্বে খুনী মোশতাকের সকল হুমকি অগ্রাহ্য করায় তাঁরা খুনীদের কাছ থেকে একই রকম ঘৃণা ও ভীতি অর্জন করেছিলেন। আর তাদের হাতে একই ভাগ্য তাঁরা অর্জন করেছিলেন। ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির পর যখন অনেক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মোশতাকের সহকর্মী হয়েছেন তখন তাঁরা কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মর্যাদা রক্ষা করেছেন। যারা আপোস করেননি তাদের নেতা হিসেবে এই চারজন খুনীদের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হলেন। এটা বীরত্ব ও ত্যাগের মহান উদাহরণ। সেদিক থেকে সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনুসর আলী ও কামরুজ্জামান আমাদের জাতীয় নেতাই শুধু নন, জাতীয় ইতিহাসের চার নায়কও বটে। বঙ্গবন্ধু যদি মহানায়ক হয়ে থাকেন তাহলে এঁরা নায়ক।
’৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন ও সেই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় আদর্শের পরিবর্তন হলেও দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা নিশ্চিহ্ন করা যায় নি। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক অঙ্গনে বরাবর সক্রিয় ছিল, ‘৮১ তে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা দলের হাল ধরার পর ধীরে ধীরে এই রাজনীতি তার ভিত্তি ফিরে পেতে থাকে। সেই সঙ্গে পেশাজীবী এবং শিল্প-বুদ্ধিজীবীগণ একযোগে মাঠে নামার পর পরিস্থিতি পুনরায় অনুকূল হয়। আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে। এ সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যেমন হয়েছে তেমনি জেলহত্যার বিচারও কাম্য। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারও সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। এটা খুবই আশার কথা।
দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর দলের নেতৃত্ব দিয়ে আর তিন দফা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে শেখ হাসিনা আজ অনেক পরিণত, আত্মবিশ্বাসী। তিনি যেমন একদিকে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন তেমনি অন্যদিকে ইতিহাসের যাত্রাপথ কলঙ্ক মুক্তও করে চলেছেন। ফলে জাতি তাঁর কাছ থেকে রাষ্ট্রনেতা হিসেবে অনেক চমকপ্রদ সাহসী ভূমিকার পাশাপাশি ঐতিহাসিক ভূমিকা প্রত্যাশা করে।
আইনগত বিচারের পাশাপাশি এই ঘটনা ও এতে শহীদ চার নেতার রাজনৈতিক মূল্যায়নও একান্ত প্রয়োজনীয়। ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবসটি মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বদানকারী চার নেতার মৃত্যু দিবস হিসেবে জাতীয়ভাবে পালিত হওয়া উচিত। বস্তুতপক্ষে সাত নভেম্বর নয় ৩ নভেম্বরই ছুটি থাকা উচিত, এবং দিনটি জাতীয় নেতা হত্যার দিবস হিসাবে পালিত হওয়া উচিত। সাতই নভেম্বর বরং মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস হিসেবে পালিত হতে পারে আলোচনা সভা, সেমিনার ইত্যাদির মাধ্যমে।
১৯৭১-এর দিনগুলোর কথা স্মরণ করে আমরা প্রবাসী সরকারের প্রাণপুরুষ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা জানাব।
সেই সঙ্গে বলবো, বিশাল ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের জন্যে তাজউদ্দিন আহমেদ বিশেষভাবে স্মরণীয় ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও অনুপস্থিত থেকেও তাঁর দৃঢ়তা, সাহস ও ত্যাগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, আর তাজউদ্দিন আহমদ আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের রূপকার। এই মেধাবী সাহসী স্থিতধী দেশপ্রেমিকের আরো ব্যাপক মূল্যায়ন ও স্পষ্ট স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল। এ কথা দূর থেকে বলা ঠিক হবে কিনা জানি না, কিন্তু তবু মনে হয়, দীর্ঘদিন খুব কাছাকাছি থেকে দেখার ফলে মনে হয় যে, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী স্তরেও বিষয়টি যেন পরিষ্কার নয়। তাজউদ্দিন আহমেদের নাম আওয়ামী লীগ অঙ্গনে সাধারণত জেলহত্যা প্রসঙ্গেই উঠে থাকে ও আলোচিত হয়। চার জাতীয় নেতার কাউকে ছোট না করেও বলব কেবলমাত্র তাঁদের একজন হিসেবেই তাজউদ্দিনের নাম উচ্চারিত হলে তাঁর প্রতি সুবিচার হয় না। এখন মৃত্যুর প্রসঙ্গেই যেন তিনি একমাত্র স্মরণীয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কথা ভেবে আমরা কি বলবো না মৃত্যুর চেয়ে তাঁর জীবন অনেক বড়ো ও সার্থক। যে মানুষটা প্রায় এককভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের, তাঁর সে মূল্যায়ন আজও বাকি রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের তরফ থেকে কিছু কিছু কাজ যে একদম হয়নি তা নয়, কিন্তু আওয়ামী লীগকেও তো নেতৃবৃন্দের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। স্থানান্তরের পর আজ ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা স্মরণে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সেই কক্ষকে জাতীয় স্মারক হিসেবে গণ্য করে রক্ষাণাবেক্ষণ করার ব্যবস্থা হয়েছে। তবে এর বাইরে জেলহত্যায় নিহত নেতাদের স্মরণে একটি স্মৃতি স্তম্ভ হতে পারে ঢাকার কোথাও। আর মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্বদানের জন্য তাজউদ্দিনের নামে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান ও কোনো স্মারক নির্মিত হতে পারে। 
আরেকটি কথা এই প্রসঙ্গে বলতে চাই বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর নামে বিশ্বশান্তি ও সমঝোতার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য একটি দ্বিবার্ষিক আন্তর্জাতিক পদক প্রবর্তন করতে পারেন। সেই সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমেদের নামে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিসংগ্রামে অবদানের জন্য সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে একটি আঞ্চলিক পদক প্রবর্তন করা যায়।
আর, সকল রকম ধোঁয়াটে অবস্থা ও বিভ্রান্তি থেকে সকলের ভাবমূর্তি, বিশেষত তাজউদ্দিন আহমেদের ভাবমূর্তি, স্পষ্ট করে তোলা দরকার - যে কাজ আওয়াগী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করলে ভালো হয়।


***

Tuesday, November 1, 2016

চরিত্রহীন সমাজের বিকৃতি

আবুল মোমেন


দিনাজপুরের নিতান্ত শিশু পাঁচ বছরের পূজার ওপর যে বর্বর অত্যাচার হয়েছে তা যে কোনো বিবেকবান মানুষকেই ঘা দিয়েছে। এক নিষ্পাপ শিশুর ওপর এমন মর্মান্তিক আঘাত এদেশে আরও অনেক হয়েছে। প্রতিবারই সচেতন মানুষ শিহরিত হয়েছেন, এবং দোষী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন। তবে সময় সবকিছুকেই ভুলিয়ে দেয়, আর আমাদের মত সমস্যাসঙ্কুল সমাজে মানুষের স্মৃতি, বিবেক, দায়িত্ববোধ সবই সংকট ও সময়ের প্রহারে প্রখরতা হারিয়ে দ্রুত অসাড় হয়ে যায়। আবার কোনো বীভৎস ক্রুঢ়তা তাকে জাগিয়ে তোলে। বলা বাহুল্য সেও অল্প সময়ের জন্যে, কিংবা বলা যায় নতুনভাবে ঘুমিয়ে পড়াতেই এই জেগে ওঠার একমাত্র সার্থকতা।
শিশুটির ওপর বিকৃত যৌন আক্রমনের জন্যে অভিযুক্ত ব্যক্তি সাইফুল ইসলাম তাদের প্রতিবেশী, তিন সন্তানের জনক যাদের দুজন কন্যা সন্তান এবং তাকে অবোধ শিশুটি নিশ্চিন্তে বড় আব্বু বলে সম্বোধন করত। এ ঘটনায় নাড়া খেয়ে আমাদের দায়িত্ব সচেতনতা যদি কেবল দোষীদের পাকড়াও করার, কঠোর শাস্তি প্রদানের দাবি আর সাধারণভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয়, তারুণ্যের দিশাহীনতা, সামাজিক অস্থিরতা ইত্যাদি লক্ষ্যহীন অসার বুলিতে শেষ হয় তবে সমাজের অবক্ষয় ও অসাড়তারই প্রমাণ মেলে।
এই অবস্থার জন্যে ঢালাওভাবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অবক্ষয়, শিক্ষা-সংস্কৃতির ব্যর্থতাকে দায়ী করা যায়। কিন্তু এতো শ্লোগান বিশেষ, যা সবাই বলছে, এবং শিখে নিয়ে সবাই বলতে সক্ষম। যে অপরাধকে পৃষ্ঠপোষকতা করে, যে স্বয়ং অপরাধকর্মে লিপ্ত হয় সকলেই এসব শ্লোগান রপ্ত করে নিয়ে এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নষ্ট করে দেয়। এভাবে অসচেতন ও সংবেদনাহীন সমাজ মূল্য ও নৈতিকতা-নিরপেক্ষ তথা চরিত্রহীন হয়ে পড়ে।
একটা বীভৎস অপরাধের পরিচয় পেয়ে শিউরে উঠেও এ সংকটকে গভীরভাবে বুঝে নিতে হয়। সংকটটা এখানেই যে ব্যক্তির পতন ঠেকানোর জন্যে এখানে কোনো সামাজিক প্রতিরোধ নেই। যেসব প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে সামাজিক প্রতিরোধ দানা বাঁধতে পারত, যেমন প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, সংবাদপত্র, রাজনৈতিক সংগঠন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ইত্যাদি সকলই যে ভিতরে ভিতরে চরিত্রহীন হয়ে পড়েছে। সবার ওপরে কি থাকবে রাষ্ট্রযন্ত্রের গভীরে বাসা-বাঁধা দুর্নীতিগ্রস্ততা? কিন্তু কথা হল এই দূষিত বাস্তবতা আপনা আপনি আমাদের কল্পনার অভীষ্ট আদর্শ অবস্থায় তো আর পৌঁছাবে না, এর জন্যে সমস্যাকে অনুধাবন ও বিশ্লেষণ করাই প্রাথমিক দায়িত্ব। তবেই নিরাময়ের উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব। সে কাজ ক্ষুদ্র পরিসরেও শুরু হতে পারে। কিন্তু শুরু হওয়াটা জরুরি।
আমাদের সমাজে দুর্বল স্থান অনেক। দারিদ্র বা অশিক্ষা হয়ত কমবে। কিন্তু সাংস্কৃতিকভাবে প্রধান তিনটি দুর্বলতা সহজে কাটবে বলে মনে হয় না। প্রথমত এ সমাজ নৈতিকভাবে দুর্বল ও আপসপ্রবণ, দ্বিতীয়ত এ সমাজ আইন ও নিয়মের প্রতি কেবল উদাসীন নয় তা অমান্য করার মধ্যে গৌরব বোধ করে এবং তৃতীয়ত এ সমাজে সুস্থ স্বাভাবিক যৌন চেতনা, রুচি ও জীবনের চর্চা হয় নি। সে অর্থে সমাজ ভিতরে ভিতরে চরিত্রহীন হয়ে পড়েছে।
এই চরিত্র-খোয়ানো সমাজ স্বাভবতই দিনকে দিন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে - অপরাধীকে লালন করে এবং অপরাধ দমন ও নির্মূলের সকল উদ্যাগকে অকেজো করে দিয়ে। এই অবস্থায় পুরুষশাসিত সমাজে অপ্রতিহত হয়েছে পুরুষের প্রাধান্য, কোণঠাসা হয়েছে নারী। সংখ্যালঘু নারী আর কন্যাশিশু এ সমাজে খুবই দুর্বল। তাহলে সংখ্যালঘু সমাজের কন্যাশিশুর অবস্থান সমাজে সবচেয়ে দুর্বল। ইসলামে নারীর সমানাধিকার স্বীকৃত এ নিয়ে বাদানুবাদে না গিয়েও সহজেই দেখিয়ে দেখা যায় এ সমাজে কীভাবে ধর্মের নামে এবং ঐতিহাসিক প্রথার দোহাই দিয়ে পুরুষই সমাজের একচ্ছত্র কর্তা হয়ে বসেছে। আইনের বিধানকে কাজে লাগিয়ে লড়াই করার সুযোগও কম, কারণ পুরুষতন্ত্র নারীকে দমনে সর্বশক্তি কাজে লাগাবে। তার হাতে ধর্ষণ ছাড়াও আরও অত্যাচারের শক্তি মওজুদ আছে।
কিন্তু দিনাজপুরের বড় আব্বুর কীর্তি কোনো ব্যাখ্যাতেই মেলানো যায় না। পাঁচ বছরের শিশুকে ধর্ষণ - কোন পর্যায়ের অপরাধ তা এ সমাজকেই বুঝতে হবে। কিন্তু এমন ঘটনা নতুনও  তো নয়। শিশুদের ধর্ষণ ও তারপরে হত্যার ঘটনা বহু বহু ঘটেছে এদেশে। এটা বিকৃতি, চরম বিকৃতি এবং মানুষের নৃশংস পশু হয়ে ওঠার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
মানতেই হবে এ সমাজমানস গভীরভাবে রোগাক্রান্ত, এটি অসুস্থ সমাজ। যে সমাজে অবোধ কন্যাশিশুও নিরাপদ নয় সেটি কীভাবে মানুষের সমাজ বলে দাবি করবে? এটি নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এ ঘটনা এ সমাজের পুরুষতন্ত্রের বিকৃত যৌনক্ষুধার গভীরতাকেই তুলে ধরে। এমন সমাজের বৈষয়িক উন্নতি হলেও মানবিক অধ:পতন ঠেকানো মুশকিল হবে।
আমরা আবারো বলব, সঠিক শিক্ষা চাই, সামাজিক শিষ্টাচারসহ সুস্থ সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও পরিবেশ চাই। মানবিক সমাজের সুস্থ সংস্কৃতির ধারায় শিশু পরম আদরের পাত্রী। তার অবমাননা, নিষ্ঠুর পীড়ন আমাদের সকল উচ্চাভিলাষী কথা আর উন্নয়নের বুলিকে উপহাস করে। অহঙ্কারী আহাম্মক সমাজকে চপেটাঘাত বসিয়ে দেয়। বোধোদয় হবে কি আমাদের?

***