Monday, December 23, 2013

বেহাল দেশে হাল ধরতে হবে নাগরিকদেরই

আবুল মোমেন
 
বাংলাদেশের ইতিহাসে গভীরতম সংকটকাল শুরু হল মনে হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন গণহত্যা চলছিল তখনও মানুষ জানতো তার মূলধারা কোনটি এবং এও জানতো রাজনৈতিক অঙ্গনেও সেটি মূলধারা। স্বাধীনতার পর স্বৈরাচারের ও ধর্মান্ধতার নানা রূপ দেখেছে জাতি। কিন্তু বরাবর তার হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক মানবতার ধারা ও গণতন্ত্রের অভিযাত্রা মূলধারার রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণ করেছে। আজকে পরিস্থিতি ভিন্নরূপ নিয়েছে। গণতন্ত্র ও জাতির মানবিক বিকাশের পথে রাজনীতি থেকেই তিনটি বড় সংকট তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়।
প্রথমত, বর্তমান নির্বাচন ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক আন্দোলনের ঠেলায় বিএনপি নিজের মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক দলের চেহারা ও অবস্থান হারিয়ে ফেলেছে। বরাবর দলটির একটি অংশের টান ছিল ধর্মান্ধ রাজনীতির প্রতি, সেই সূত্রে জামায়াত ও অন্যান্য পাকিস্তানপন্থী ও যুদ্ধাপরাধী দল এবং ব্যক্তির প্রতিও এ দলের সহমর্মিতা বোঝা যেত। ক্ষমতাসীন দল এবং নাগরিক সমাজের কিছু অংশ এবার বাগে পেয়ে বিএনপির ‘মুখোশ’ উন্মোচন করতে চেয়েছে এবং দলটি যে জামায়াতের দোসর তা প্রমাণের সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি। মুশকিল হল, সব জরিপ ও পূর্বাভাসে যে-কোনও পরিস্থিতিতে নির্বাচনে বিজয়ের প্রায় নিশ্চয়তা থাকা সত্ত্বেও বিএনপি জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি পক্ষপাত ‘প্রমাণেই’ উৎসাহিত হল।
পরিস্থিতি আগে কখনও এমন হয়নি যে, বিএনপির ভিতরকার মধ্যপন্থি গণতান্ত্রিক শক্তি বিবদমান অবস্থার মধ্যে চরম কোন অবস্থানে না গিয়ে গণতন্ত্রের সমঝোতা সমন্বয়ের পথটি খোলা রাখার জন্য কাজ করবে না বা করতে চেষ্টা করতে পারবে না। সরকার এই ধাক্কায় বিএনপিকে ‘সাইজ’ করার কৌশল নিয়ে এ দলের মধ্যধারার নেতা-কর্মীদের প্রতিও চরমধারার ব্যক্তিদের মতোই আচরণ করেছে। এ অনেকটা একাত্তরের পাক-সরকারের মতো, দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে সব বাঙালিকে এককাতারে ফেলে দেওয়ার ত্রুটির পুনরাবৃত্তি ঘটল। মনে রাখতে হবে রাজনীতিতে জেদ-ক্ষোভের স্থান নেই, নীতি-আদর্শ-কর্মসূচি ছাড়া কৌশল-কূটকৌশলেরই মূল্য আছে। সময়োচিত কৌশলী পদক্ষেপ নিতে না পারলে ক্ষমতার রাজনীতিতে বড় বিয়োগান্তক পরিণতি ঠেকানো যায় না। এই হুঁশ সব পক্ষের থাকা দরকার।
দ্বিতীয় সংকটটি ঘটেছে আওয়ামী লীগকে ঘিরে। বাংলাদেশের রাজনীতির উত্থান-পতনের বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে এখন মাঠে সক্রিয় মূল দলগুলোর মধ্যে বিএনপি, জাপা বা জামায়াতের গায়ে বৈধ-অবৈধতার চিহ্ন এবং তাদের ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। এদিক থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে একমাত্র ‘পরিচ্ছন্ন’ দল ছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু এবারে ২০১৪ সালের নির্বাচনটি করে স্বেচ্ছায় দলটি তার গায়ে কলঙ্ক মেখে নিতে যাচ্ছে। এ ঘটনা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি সংকট সৃষ্টি করবে বলে মনে হয়।
আমি কখনও সক্রিয় রাজনীতি না করলেও দেশের রাজনীতির একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে বরাবর মনে করে এসেছি যে, এদেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারাটি এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এ দলটি কেন্দ্রিয় ভূমিকা পালন করে এসেছে। সমাজে মুক্তচিন্তা ও মানবিক চেতনা লালনের যে ধারাগুলো আছে তা অনুশীলন ও বিকাশে এ দল কখনও প্রত্যক্ষ, কখনও পরোক্ষভাবে মূল ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু এবারে ‘বর্বর’ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও আওয়ামী লীগ ধীরে ধীরে তার পঁচাত্তর পরবর্তী প্রধান দুই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি ও জাপার অনুসরণে একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করল।
যে দলের মূল শক্তি ছিল সারা দেশে ছড়ানো তার স্থানীয় নেতা-কর্মীর সমন্বয়ে শক্তিশালী সক্রিয় সংগঠন; তা হয়ে পড়ল নেত্রীকেন্দ্রিক এ ক্ষমতাকেন্দ্রিক এক জড়ভরত প্রতিষ্ঠানে। ক্ষমতার ব্যবহার-অপব্যবহার ছাড়া নেতাকর্মীদের আর কিছু করণীয় থাকল না। যে সংগঠন আইয়ুব-ইয়াহিয়া এবং জিয়া-এরশাদ দুই আমলে দুই জোড়া সেনাশাসকের নির্যাতন-বঞ্চনা সামলে নিয়ে দল ও দেশকে এগিয়ে নিয়েছে মূলত দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা নেতাকর্মীদের সক্রিয়তা ও ত্যাগে সে সংগঠনে এখন এসবের কোনও দাম নেই, ভূমিকা নেই।
ফলে আওয়ামী লীগের সরকারও যে-কোনও স্বৈরাচারী সরকারের মতোই রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রতিপক্ষদের সামলানোর জন্যে সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সরকারের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর। জানিনা সামরিক স্বৈরাচারদের মতো শেখ হাসিনাও আজ দলীয় নেতাকর্মী ও নীতিনির্ধারকদের সাক্ষীগোপাল বানিয়ে রাজনৈতিক দিকনির্দেশনার জন্য গোয়েন্দাদের ওপরই নির্ভর করছেন কিনা।
তৃতীয় সংকট জামায়াত ও অন্যান্য ধর্মান্ধ দলগুলোকে নিয়ে তৈরি হয়েছে। মূলত মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার কারণে স্বাধীনতার পর সরকারি নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে এ দলগুলোকে রাজনীতির মাঠ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া এবং ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীদের ঠেকানোর লক্ষ্যে জিয়ার এদের উত্থান ও প্রতিষ্ঠায় সহায়তাদান, দুদিক থেকেই দূরদর্শী বিবেচনার প্রমাণ দেয়নি। কারণ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দমানো যায় কিন্তু নেতৃত্ব সচেতন না হলে এতে ধর্মান্ধতার (ধর্মবিশ্বাস নয়) বৃত্ত ভাঙার জন্য এ বিষয়ে সামাজিক আলোচনা ও সমঝোতার পথগুলো ব্যবহার করার সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। ওই সময়ে নিষেধাজ্ঞার চেয়েও জরুরি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের শনাক্ত করা ও বিচারের আওতায় এনে বিষয়টি বকেয়া ফেলে না রেখে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা। আবার ক্ষমতার প্রশ্রয়ে এমন অন্ধ শক্তিকে একসময় বাড়তে দিলে পরে গণতন্ত্রের স্বার্থে তাকে সামলানোর পথও থাকে না।
ফলে জামায়াত এখন বিএনপির কাঁধে চেপেছে আর বিএনপির জামায়াতিকরণ সম্পন্ন করছে। তাছাড়া এদেশের সনাতন ইসলামি শিক্ষার যে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা ও স্থবিরতা চলছিল তার পরিণতি এবং তাদের মধ্যে অচলায়তন ও বিচ্ছিন্নতা থেকে বেরিয়ে আসার সচেতনতা ও তাগিদ সৃষ্টির বিষয়ে কোনও কাজ হয়নি। এর উপায় নিয়ে নিজেদের মধ্যেও কখনও ভাবনা-চিন্তা করা হয়নি। পাশাপাশি রয়েছে বৈশ্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তন যা মুসলিম মৌলবাদ উত্থানের প্ররোচনা ও প্রণোদনা তৈরি করে চলেছে। এখানে সম্পদেরও সমাহার ঘটেছে, তাদের শক্তিবৃদ্ধিতে যা সহায়ক হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের মতো বিপুলভাবে মুসলিমপ্রধান একটি দেশে গণতন্ত্রের রাজনীতিকে কীভাবে চরমপন্থার চোরাবালিতে পথ হারাতে না দিয়ে, সংঘাতে জড়িয়ে পড়তে না দিয়ে আগলে রাখা যায় সেটুকু ভাবার মতো দূরদর্শিতার খুবই প্রয়োজন ছিল। জামায়াত পাকিস্তানি যোগাযোগ ছিন্ন করে ও একাত্তরের ভুল স্বীকার করে বাংলাদেশের বাস্তবতানুযায়ী রাজনীতির রাজপথে আসার সুযোগ গ্রহণ করেনি- এর পেছনে বিএনপির একটা অংশের ভূমিকা থাকা অস্বাভাবিক নয়। এতে দলটির সংকট কাটেনি, যার প্রভাব পড়েছে দেশের রাজনীতিতে।
সংকট তিনটি ধারায় তৈরি হলেও যে-কোনও সংঘাত-সংঘর্ষের নিয়ামানুযায়ী তা রণাঙ্গনে আপাতত দ্বি-ধারায় বিভক্ত হয়েছে। উভয়পক্ষে চরম মতাবলম্বীরা এখনও ঘটনা প্রভাবিত করে চলেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সাধারণত লাগাম ক্রমেই হাতছাড়া হতে থাকে। এখানেও তাই ঘটছে। এ রকম পরিস্থিতি সাধারণ জনগণের জন্য দুটি বাস্তবতা তৈরি করে- একদিকে তাকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়, অন্যদিকে সে ক্রমেই তার জৈবিক তাড়নার বাইরে অন্যান্য আগ্রহ, বিশেষভাবে রাজনৈতিক উৎসাহ, হারিয়ে ফেলতে থাকে। তার ওপর দুই বড় দলের নেত্রীকেন্দ্রিক সংগঠনে হুকুমের রাজনীতির দাপটে জনগণের বিরাজনীতিকরণের ষোলোকলা পূর্ণ হতে চলেছে। জনগণ প্রচলিত রাজনীতিতে আস্থা ও উৎসাহ হারিয়ে ফেললে আমাদের পরিচিত তৃতীয় শক্তির আগমন সহজ হয়। অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, জনগণ প্রাথমিকভাবে অন্তত তাকে স্বাগতও জানাবে। কারণ তার এখন মোটামুটি ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা।
জনগণকে যখন রাজনৈতিক নেতৃত্ব পথের দিশা দিতে পারে না, কোথাও মানুষের সৃজনশীল চিন্তার পরিচয় পাওয়া যায় না তখন সম্ভবত সচেতন বিবেকবান ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নিজের ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে হলেও শেষ রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যান। এরকমই একটি ডাক আমরা দেশের সব্যসাচী লেখক কবি সৈয়দ শামসুল হকের কাছ থেকে সম্প্রতি পেলাম। তিনি আকুতি জানিয়েছেন বিজয়ী বাংলাদেশকে রক্ষায় আমরা যেন এগিয়ে আসি। কবি সত্যদ্রষ্টা বটে, সমাজের আপামর মানুষের মধ্যেও এই কবিসত্তা বিরাজ করে। দুঃসময়ে নিজের সত্যবোধকে জাগ্রত করে সমাজের বিচ্ছিন্নতা ও বিবাদ ঘোচানো আজ তাই সবার জন্যে সবচেয়ে বড় কাজ। যারা বিবেকবান তারাই প্রকৃত ধার্মিক, তারাই সমাজে গণতান্ত্রিক আবহের শিখাটি সব ঝড়ঝাপ্টার মধ্যেও বাঁচিয়ে রাখেন। রুখে দাঁড়াও বাংলাদেশ- এরকমই একটি প্রয়াস। সমাজে নানা জায়গায় শুভবুদ্ধির মানুষ এরকম মুক্ত মানবিক মঞ্চ তৈরির কথা ভাবছেন, চেষ্টা করে চলেছেন। এবার যেন এই ফেনিল তরঙ্গ ঠেলে বাংলাদেশ-তরণীকে রক্ষা করা ও এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব সচেতন বিবেকবান মানুষকেই নিতে হবে। কারণ, যেসব লক্ষণ সমাজে ফুটে উঠছে তাতে বোঝা যায় প্রচলিত রাজনীতি আদতে অথৈ জলে হাল ধরতে পারছে না অথবা হাল ছেড়েই দিয়েছে। তাই দেশের এই বেহাল অবস্থা।
আসুন, মানবতার নামে, গণতন্ত্রের নামে, মুক্তিযুদ্ধের নামে আপনার মন্যুষ্যত্বের দায় থেকে ভূমিকা নিন, দেশপ্রেমের পরিচয় দিন, নাগরিক দায়িত্ব পালন করুন।