Saturday, January 18, 2014

সাম্প্রদায়িকতা : মুসলমানকেই দায়িত্বশীল দূরদর্শী ভূমিকা নিতে হবে



দেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ মনে করেন বাংলাদেশে কোনো সাম্প্রদায়িকতা নেই। দৃষ্টান্ত দিয়ে তাঁরা প্রতিবেশী ভারতের চিত্র তুলে ধরেন-সেখানে ১৯৪৭-এ দেশ ভাগের পর অসংখ্যবার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছে এবং বহু প্রাণহানি ঘটেছে। বলাবাহুল্য নিহত বেশির ভাগ সে দেশের সংখ্যালঘু অর্থাৎ মুসলমান। কিন্তু সে তুলনায় বাংলাদেশে রক্তপাতের ঘটনা কম। কথাটা সত্য।
কিন্তু এতে আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাস্তবতার পুরো ও প্রকৃত চিত্র ধরা পড়ে না। ফলে মূল্যায়ন যথার্থ হয় না। যথার্থ মূল্যায়নে কী চিত্র উঠে আসে তা জানা দরকার।
সবাই জানি সাতচল্লিশে দেশভাগ হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে, তবে এর ফলে পাকিস্তানই ধর্মভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র হতে চেয়েছে, ভারত চেয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে। দেশভাগে মূলত বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ হয়েছে, এবং তা হয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলার জনসংখ্যার ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে। তবে বাংলার যেসব জেলা পাকিস্তানে পড়েছে তার মধ্যে কোনো কোনোটিতে হিন্দু-মুসলিম অনুপাত খুবই কাছাকাছি ছিল, যেমন খুলনা, ফরিদপুর প্রভৃতি। আর সামগ্রিকভাবে হিন্দু-মুসলিম অনুপাত ছিল ৩০:৬৫। বাকি ৫ ভাগ বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্র্মাবলম্বী।
ৎআর ৬০ বছর পরে হিন্দু জনসংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে গেছে, তা নেমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৯ ভাগে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছাড়া এত হিন্দু কেন দেশত্যাগ করল, সেটা বোঝা দরকার।
বাংলার কলকাতা-কেন্দ্রিকতা : সোয়া তিনশ বছর আগে জব চার্নক কলকাতা শহরের পত্তন করার পর থেকে এ শহর বাংলার বাণিজ্যকেন্দ্র, শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র এবং বাংলা ও ভারতবর্ষের প্রশাসনিককেন্দ্র হিসেবে ক্ষমতা ও সম্পদের মূল ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। ফলে বাংলার বর্ধিষ্ণু এবং উচ্চাভিলাষী মানুষ এ শহরেই বসতি করেছেন। কলকাতার প্রয়োজন ও আকর্ষণ হিন্দু-মুসলিম কেউই ছাড়তে পারেন নি। তাই হিন্দুদের মধ্যে বিত্তবান ও শিক্ষিত পরিবারগুলো বেশির ভাগই দেশভাগের সময় ভারতে বসবাসের অপশন দিয়েছিলেন। তাতে দেশভাগকে কেন্দ্র করে বর্ধিষ্ণু হিন্দুর ব্যাপক দেশত্যাগ ঘটে। ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম জনজরিপে দেখা যায় হিন্দু জনসংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ২২ ভাগে।
শূন্যতা ও সুযোগ : সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (১৭৯২) পর থেকে বাংলায় হিন্দুদের হাতেই ছিল বেশির ভাগ জমিদারি তথা জমি। সাদা চোখে দেখেই বলা যায় ঐ সময় ৩৫ ভাগ হিন্দুর হাতে ৬০ ভাগ মুসলমানের চেয়েও বেশি স্থাবর-সম্পদ ছিল।
জমিদারি আর বিত্তের জোরে অধিকাংশ জমির মালিক ছিলেন এরা। দীর্ঘকাল তাদের শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়েছে কৃষক মুসলমান এবং নিম্নবর্ণের তপশিলি হিন্দুসম্প্রদায়। মূলত এই শোষণ থেকে মুক্তির জন্য এরা পাকিস্তান সমর্থন করেছিল।
পাকিস্তানের জন্ম আকস্মিকভাবে তাদের কেবল মুক্তি দেয় নি, একটু বেপরোয়া উচ্চাভিলাষীদের জন্য জোর খাটিয়ে বা পানির দামে স্থাবর সম্পত্তির মালিক হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছিল। এ কাজে সরকারের সহায়তা ছিল এবং ১৯৬৫’র পাক-ভারত যুদ্ধের পর ‘শত্রুসম্পত্তি আইন’ চালু করে সরকার প্রায় জবরদখল ও লুণ্ঠনের সুযোগ করে দিয়েছিল।
ফলে পাকিস্তানের শেষ পর্যায়ে হিন্দু জনসংখ্যা শতকরা ১৫ ভাগের নিচে নেমে যায়। বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য পাক সরকারের নীতি একটু আলোচিত হওয়া দরকার।
পাক-সরকারের সাম্প্রদায়িক নীতি : পাকিস্তানের স্রষ্টা জিন্নাহ দেশটিকে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে চাইলেও তাঁর সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি মূলত তাঁর অকাল-মৃত্যু এবং পাঞ্জাবি-চক্রের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে যাওয়ায়। এই চক্র পাকিস্তানকে ধর্মীয় ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে চাইল। রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা খাড়া করল ভারত ও হিন্দুকে। ফলে পাকিস্তানে হিন্দু সম্প্রদায় বরাবর সন্দেহভাজন নাগরিক হিসেবে গণ্য হয়েছে।
চাকুরিতে তাদের পদোন্নতি সীমিত রাখা হল যাতে কোনো দপ্তরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার দায়িত্ব তাদের হাতে না যায়। যেমন হিন্দু সামরিক বাহিনীতে মেজরের ওপরে যাবে না, প্রকৌশলী হলে নির্বাহী পর্যন্ত গেলেও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হতে পারবে না। কলেজে অধ্যক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, জেলা প্রশাসক, পুলিশের সুপার হতে পারবে না, প্রশাসনে উপসচিবের উপরে যাবে না ইত্যাদি। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ ছিল। এভাবে চাকুরে এবং ব্যবসায়ী হিন্দু উভয়ের জন্যই উন্নতি ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে দিয়েছিল পাকিস্তান।
রাষ্ট্র স্বয়ং সাম্প্রদায়িক নীতিতে পরিচালিত হলে যে পক্ষপাত সৃষ্টি হয় তাতে এর নিজস্ব প্রক্রিয়াতেই সমাজে শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। উন্নতি ও ভবিষ্যতের পথ রুদ্ধ হলে মানুষের নৈতিক বল ভেঙে যায়। একে অসম শক্তি, তার ওপরে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষপাত, ফলে হিন্দুর পক্ষে পক্ষপাতপুষ্ট সংখ্যাগুরুর সাথে পাল্লা দেওয়ার কোনো বাস্তবতা ছিল না।
দুর্ভাগ্যের বিষয় স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ধর্মীয় পক্ষপাত থেকে মুক্ত হবে বলে ভাবা হলেও ’৭৫-এর পর জিয়ার নেতৃত্বে ফের পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় নীতিই এদেশে চালু হয়। তার ওপর রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও সমাজনীতি জোরদার হতে থাকে। এই ধারা ১৯৯৬ পর্যন্ত চলেছে অর্থাৎ ’৪৭-এর পর বিগত ৬৪ বছরের মধ্যে ৪৪ বছরই (১৯৪৭ থেকে ১৯৭১= ২৪+১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫=২০ বছর) পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ধারায় দেশ চলেছে। এর ফল হিসেবে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হ্রাসসহ সংখ্যালঘুসমাজের ক্রমাগত অবক্ষয় ঘটেছে। ১৯৭৪ সনের প্রথম জনজরিপে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ১৩.৫ ভাগ যা এখন ৯ ভাগের নিচে নেমে গেছে।
দুই সম্প্রদায়ের মনোজগৎ : বাইরের ঘটনাবলী মানুষের সামাজিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, যার সবটারই প্রভাব পড়ে মনে। যে প্রক্রিয়ায় বিত্তবান হিন্দু সম্পদ হারিয়েছে তা কেবল রাষ্ট্রীয় জবরদস্তির ফল নয়, সাধারণত স্থানীয়ভাবে কোনো উদ্যোগী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জবরদস্তির মাঠপর্যায়ের তৎপরতায়। এই জবরদস্তিতে ত্রাস সৃষ্টি বড় উপাদান, যার জন্য অগ্নিসংযোগ, ডাকাতি এবং অবশ্যই নারী নির্যাতন, মিথ্যা মামলা ও অন্যায়ভাবে হয়রানি ও অবমাননা অন্তর্ভুক্ত। এভাবে দিনের পর দিন একতরফা নির্যাতনের শিকার হয়ে কোনো জনগোষ্ঠী ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরে থাকতে পারে না।
মানুষ অতীতের কথা ভেবে তার বর্তমানকে বিপদগ্রস্ত করে রাখতে ও ভবিষ্যতকে জলাঞ্জলি দিতে পারে না। সন্তানের ভবিষ্যৎ, নারীর সম্ভ্রম, পৈত্রিক সম্পদ রক্ষায় অপারগ হলে, অন্যায় অবিচারের প্রতিকার না পেলে, রাষ্ট্রযন্ত্র স্পষ্টভাবে নিরপেক্ষ না হলে চোখের জল মুছে তাকে জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটি নিতে হয়। তার পরেও প্রধানত নিরাপত্তা ও শেষ দেখার আশা থেকে তারা প্রথমে গ্রাম ছেড়ে শহরে আস্তানা গাড়ে, তারপর সন্তানদের নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর করে, এরপর পরিবারকে দেশান্তরে পাঠায়, শেষে উপায়ন্তর না দেখে লোলুপ প্রতিবেশী বা কোনো শঠব্যক্তির কাছে পানির দামে সম্পদ ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস চেপে চোখের জল ফেলতে ফেলতে চৌদ্দপুরুষের ভিটেমাটি জন্মভূমির মায়া ছাড়তে বাধ্য হয়। এটা ঠিক, পাশেই ভারতবর্ষ, বিশেষত বাঙালি অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ থাকায় তাদের জন্য দেশত্যাগ কিছুটা সহজ হয়েছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হল সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগোষ্ঠীই সুবিধাভোগী সম্প্রদায় হিসেবে সংখ্যালঘুর এই নীরব দেশত্যাগ ও রক্তপাতহীন সাম্প্রদায়িকতার শিকার হওয়ার জন্য দায়ী হলেও তাদের মধ্যে সচেতন বলে পরিচিত অংশও এ ব্যাপারে সচেতনও নন, সংবেদনশীল তো ননই। বরং অন্যায়ে ভুক্তভোগীর কাটা ঘায়ে নূনের ছিটার মত প্রকাশ্যে দোষারোপ করে বলতে থাকে-দাদাদের এক পা তো ভারতে। জ্ঞানের পরিচয় দিতে অনেকে উচ্চকণ্ঠে বলেন, হিন্দুরা হাজার কোটি টাকার পুঁজি পাচার করে চলেছে ইত্যাদি।
কিন্তু এ সমালোচনা যে-ভয়ঙ্কর অন্যায়, মারাত্মক অবিচার, ক্ষমার অযোগ্য পাপের ওপর নির্মিত হচ্ছে সে বিবেচনা আমাদের থাকছে না। সংখ্যাগুরুর যথাযথ উপলব্ধি ছাড়া রক্তপাতহীন নীরব সাম্প্রদায়িকতা ক্রমেই সহিংস, ব্যাপক হয়ে উঠবে, এমনকি রক্তপাতও ঘটবে যাতে বাকি ৯ ভাগ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। ২০০১ বা ২০১৪ সালের সাম্প্রদায়িক হিংসাত্মক ঘটনাবলী এরই আলামত। এর পেছনে কতটা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, কতটা সম্পদের লোভ আর কতটা রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষপাত তার চুলচেরা হিসেব ততটা প্রয়োজনীয় নয়, কারণ এ তিনের যোগফলই বর্তমান সহিংস সাম্প্রদায়িকতার মূলে কাজ করছে।
আর আক্রমণকারীদের দলগত পরিচয় খুঁজলে দেখা যাবে ধর্মীয় উপাদানের জোগান আসে জামায়াত ও এ ধরনের হিংসাত্মক ধর্মবাদী দলের কাছ থেকে, আর দখলের বিচারে এক সময় মুসলিম লীগের আধিপত্য থাকলেও পরে আওয়ামী লীগ শূন্যস্থান পূরণ করেছে, আর এখন বিএনপিও পিছিয়ে নেই।
এর মূলোৎপাটন করার কাজটি একেবারেই একতরফা সংখ্যাগুরুর দায়িত্ব, সেকথা আমাদের বুঝতে হবে। ষাট বছরের অন্যায়, অবিচার ও অমানবিকতার কী মূল্য সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় এবং এ দেশ দিচ্ছে সে হিসেব আরেক দিন হবে। কিন্তু দেশকে সঠিক পথে আনতে হলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে উদ্যোগী হতে হবে। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সমাজ সংগঠনে নামতে হবে, আর সমাজের সংবেদনশীল শিক্ষিতজনদের সরব ও সক্রিয় হতে হবে। তাঁরা কেবল সহিংসতার বিস্ফোরণের প্রতিধ্বনির ভূমিকা নিলে হবে না। নিজেদের ধ্বনিটিকে উদার মানবতার বাণীর রূপ দিয়ে সমাজে প্রভাব বিস্তারের মত দক্ষতায় বরাবর বজায় রাখতে হবে।
মনে রাখতে হবে ১-২ নয় ৬০ বছরের ভেঙে-যাওয়া মন জোড়া লাগানো সহজ কাজ নয়। হারানো আশা, লুপ্ত আস্থা ফিরে পাওয়া নির্ভর করবে সংখ্যাগুরু সে কাজে কতটা আন্তরিক হবেন, কতটা ধৈর্য ধরবেন, কতটা উদার হবেন তার ওপর এ হবে মনুষ্যত্বের পথে সংখ্যাগুরুর বিনীত দায়িত্বশীল দূরদর্শী এক অভিযাত্রা। সে অভিযাত্রায় সকলকে আহ্বান জানাই।