Wednesday, April 26, 2017

অস্বীকৃতি বা আপসে সমস্যার সমাধান মিলবে কি?

আবুল মোমেন

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন সভায় দাঁড়িয়ে কওমি মাদ্রাসার জঙ্গি-সম্পৃক্ততার অভিযোগ খারিজ করে সাফাই বক্তব্য দেন তখন সরকারি মনোভাবের বার্তা পাওয়া যায়। তাঁর ভাষণের দুদিন আগেই যাঁকে সবচেয়ে দূর্ধষ জঙ্গি নেতা হিসেবে ফাঁসি দেওয়া হল তিনি দেশে আলিয়া মাদ্রাসায় পড়লেও উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন কওমি মাদ্রাসার পীঠস্থান দেওবন্দে। পরবর্তীকালে জঙ্গি হামলায় ও জঙ্গি আস্তানায় নিহত কয়েকজনেরও কওমি মাদ্রাসার ছাত্র/সাবেক ছাত্র পরিচয় উঠে এসেছিল। এদের গ্রেফতার, নিহত হওয়া, বিচার সব কাজেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্ত ছিল।
কেউ বলে না যে কওমি মাদ্রাসামাত্রই জঙ্গি তৈরির আস্তানা। কিন্তু সুস্থ সংস্কৃতিচর্চাবিহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইংরেজিমাধ্যম স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতই মাদ্রাসাগুলো ধর্মীয় জঙ্গিবাদ চর্চার ক্ষেত্র হয়ে পড়ার শংকাই বেশি। ইদানীং মূলধারার বাংলামাধ্যম স্কুলেও পরীক্ষা ও মুখস্থবিদ্যাকেন্দ্রিক শিক্ষার দাপটে সহশিক্ষামূলক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখান থেকেও বিভ্রান্ত তরুণ তৈরি হতে পারে যাদের কেউ কেউ জঙ্গিবাদে দীক্ষা নিচ্ছে না তা-ও নয়।
সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শূন্য-সহিষ্ণুতা বা জিরো টলারেন্স নীতি পালনের অঙ্গীকার করেছে। কিছু জঙ্গি বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি পেয়েছে, বেশ কিছু জঙ্গি আইনশৃঙ্খলা বাহিনির অভিযানে প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার আলোকে বলা যায় তাতে জঙ্গি হয়ে ওঠার প্রবণতা বন্ধ হয় নি। গত দুমাসে দেশের আনাচে-কানাচে অনেক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেছে, সকল জঙ্গি নির্মূল হয় নি, ধরা পড়ে নি। বোঝা যায় দেশের ভিতরে সক্রিয় রয়েছে এক বা একাধিক জঙ্গি গোষ্ঠী। এক দল তরুণ বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী, বিশেষত আইএসের সাথে যুক্ত হতে চাইছে।
সরকার জঙ্গি দমনে কড়া লাইনে থাকলেও দেশে জঙ্গি সৃষ্টির বাস্তবতা মোকাবেলায় দুএকটি ভালো উদ্যোগ নিলেও তা ছিল সীমিত এবং সাময়িক। লক্ষাধিক মওলানার জঙ্গি-বিরোধী ফতোয়া বা শুক্রবারে সব মসজিদে ধর্মের উদার মানবিক সম্প্রীতির বাণী তুলে ধরে খুৎবা পাঠের উদ্যোগ ভালোই ছিল। কিন্তু তা যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয়নি, অব্যাহত থাকে নি। তাছাড়া এও এক ধরনের নিবারণমূলক কাজ - পরোক্ষ বুদ্ধিবৃত্তিক এ বারতার গুরুত্ব স্বীকার করেও বলতে হবে যে-তরুণরা জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হচ্ছে এটুকু তাদের আত্মঘাতী ধ্বংসাত্মক পথ থেকে নিবৃত্ত করার জন্যে যথেষ্ট নয়।
আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে এবং কখন কেউ চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এমন নয় যে আমাদের দেশে চরমপন্থীদের জঙ্গি তৎপরতা আগেও ঘটে নি। কট্টর বাম রাজনৈতিক দর্শন থেকে সৃষ্ট এসব জঙ্গিবাদ কখনো উপদলীয় কোন্দলে এবং বেশির ভাগ সময় সরকারি বাহিনির নিষ্ঠুর দমনপীড়নে এক পর্যায়ে নি:শেষিত হয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় জঙ্গিবাদ তা নয়, এর ভিত্তি যে বিশ্বাস তাতে আল্লাহ ও নবীকে টানা যায়, পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অনুমোদন দেখানো যায়, ইসলামের ইতিহাস থেকে দৃষ্টান্ত নেওয়া যায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পুঁজিবাদী (খ্রিস্টান) পশ্চিমের ভূমিকার (মূলত মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে) দোহাই দেওয়া যায়, বর্তমান কালের ভোগবাদিতার যে উৎকট রূপ মানুষের জীবনকে অমানবিক করে তুলছে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর যাথার্থ্যও তুলে ধরা যায়, তদুপরি এ ভূমিকা ইহকাল ছাপিয়ে পরকাল অবধি বিস্তৃত - পৃথিবী ছাড়িয়ে বেহেস্ত পর্যন্ত। ফলে কেবল তাদের কৃতকর্ম - মানুষ খুন করা - বা অপরাধের গণ্ডিতে  ও মানদণ্ডে এদের বিচার করলেই হবে না। এভাবে ঘটনা ঘটানোর পরে অর্থাৎ অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরে কাউকে কাউকে ধরা যাবে বা নির্মূল করা হবে। কিন্তু এতে এসব তরুণদের - তাদের মত আরো লাখো তরুণের - মনের ক্ষোভ, ক্রোধ, প্রতিজ্ঞা, প্রত্যয়, অভীপ্সা অর্থাৎ দেশের বিরাট তরুণমানসের একটি বড় ধারাকে বোঝার এবং তাদের সন্তুষ্ট করার জরুরি কাজটা আরব্ধ থেকে যাবে। পুলিশি ব্যবস্থা, আইনি প্রক্রিয়া বা নিছক অস্বীকৃতি এ ইস্যুটি মোকাবিলার মূল পথ নয়।
আমরা দেখছি সমাজের অনেকের কাছেই এটি ধর্মীয় ইস্যু, অনেকেই ভাবছেন সাংস্কৃতিক ইস্যু, কেউ কেউ গণ্য করছেন রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে। ইস্যুটি জটিল, কারণ এটি উপরে উল্লিখিত সব বিষয়েরই সমাহার। ধর্ম যদি হয় এর উৎস, তবে রাজনীতি প্রায়োগিক অবলম্বন, আর সংস্কৃতি সঠিকভাবে চর্চা না হলে এই মানসের আদলেই রূপান্তরিত হবে। বাঙালি সমাজে কোনো ধর্মই শাস্ত্রীয় রক্ষণশীলতার ধারায় বিকশিত হয় নি, যে কারণে দুশত বছরের বেশি চর্চা সত্ত্বেও ওয়াহাবি পন্থা, কওমি মাদ্রাসার প্রভাব সমাজে ব্যাপক বিস্তৃতি পায় নি। হিন্দু সমাজেও ব্রাহ্মণ্যবাদের চেয়ে  গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধারার প্রেম ও ভক্তিবাদের প্রভাব হয়েছে  বেশি।
এ বাস্তবতায় ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র বাংলার মানুষকে টানে নি, ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান ভেঙে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটেছিল। গত চার দশকে দেশে এবং বিদেশে অনেক পরিবর্তন হয়েছে - তা হয়েছে ধর্মীয় চেতনায়, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও কৌশলে এবং শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চা ও এর সমঝদারিতে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকেই পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্বের জড়বাদী বা বস্তুবাদী সমাজে মতাদর্শের অবসান হয়। তারা সব ধরনের মতাদর্শিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যেন বস্তুবাদ-ভোগবাদের বিশ্বায়ন ঘটিয়েছে। এর প্রথম প্রকাশ ঘটে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পরপর কট্টরপন্থী সুন্নিদের দিয়ে একদিকে শিয়া ইসলামের বিপ্লবযাত্রা রুদ্ধ করা এবং সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার প্রয়াসে - ইরানে তাদের প্রয়াস ব্যর্থ হলেও আফগানিস্তানে সফল হয়েছে। সামরিক-রাজনৈতিক তথা জঙ্গি কূটনীতির মাধ্যমে তারা আফগানিস্তান থেকে  পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত মুসলিমপ্রধান দেশগুলিতে কট্টরপন্থীদের উত্থানে অস্ত্র-অর্থ দিয়ে সহায়তা করে এমন এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যাতে এসব দেশের তরুণরা বিভ্রান্তির মধ্যে থাকে। বিভ্রান্তির ক্ষোভ কট্টর জঙ্গিবাদে মুক্তি খোঁজে, আর তখন তাদের থেকে সৃষ্ট জঙ্গি যোদ্ধাদের তাদেরই প্রথম স্রষ্টা ও মদতদাতা পশ্চিম প্রকাশ্যে হত্যা করতে পারে।
পশ্চিমের দ্বিতীয় আগ্রাসনের পথ হল অর্থনীতি। বিশ্ব অর্থনীতির কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্যে তারা যে কোনো ছলের আশ্রয় নিতে পারে। বাজার অর্থনীতি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নতুন কানুন, বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের চাতুরিপূর্ণ ভূমিকা - যা কিছুটা পদ্মাসেতুর সূত্রে সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে - এবং ভোগবাদিতা, পণ্যাসক্তি ও কাম-ক্রোধ-সন্ত্রাস-নির্ভর এক বিনোদন-বাণিজ্যের পসরা সাজিয়ে এ যেন গ্রিক পুরানের কুহকিনী সার্সির বিস্তৃত জাল। সবই এর মধ্যে ধরা পড়েছে। আগেই উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশের সাধারণের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভ, ক্ষুধা, কামনা, ক্রোধ, লোভের তাড়নার পারদ চড়ানো হয়েছে। এদের অনেকেই জঙ্গিবাদের আশ্রয় নিচ্ছে, কেউ নেশার ফাঁদে পা দিচ্ছে, কারো কাছে নিজ ধর্ম পালনের চেয়ে বিধর্মী’ নিধন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কেউ স্থূল ভোগে তলিয়ে যাচ্ছে । এটা স্বাভাবিক মানুষের কাজ নয়।
হ্যাঁ, আমাদের সমস্যাগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে হবে, চিন্তা বিনিময় করতে হবে এবং সবশেষে সবদিক বিবেচনায় নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
প্রথমেই আমাদের মানতে হবে সমাজমানসে, বিশেষত তরুণদের মানসে নানা বিষয়ে ক্ষোভ, কিছু ক্রোধ ও হতাশা এবং অনেক বিষয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। এর পেছনে মূল দায়ি হল বর্তমান  শিক্ষাব্যবস্থা আর আদর্শ ও নীতিহীন রাজনীতি।
কিশোর-তরুণদের মূল ভূমিকা শিক্ষার্থীর। সেই শিশু-কিশোর-তরুণের জীবনের মূল প্রবণতা হল সক্রিয়তা - মস্তিষ্কে ও শরীরে - যা ঘটে অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে উদ্ভাবনে, সৃজনে, উপভোগের আনন্দে। আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের জন্যে বরাদ্দ হলে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা, তারা কেবল অন্যের লেখা (সৃজন করা) উত্তর মুখস্থ করবে, অন্যের প্রশ্নের জবাব হিসেবে তা লিখবে এবং জিপিএ৫ পাবে। এটা মোটেও সৃজনশীল আনন্দময় প্রক্রিয়া নয়। শিশু-কিশোরদের সাফল্য উদযাপনে বড়রা যে উৎসব ও আনন্দের আবহ তৈরি করেছেন তাতে শিশু-কিশোর-তরুণরাও অংশ নেয়। কিন্তু এ হল সাফল্যের নেশা, কারণ প্রকৃত সাফল্য আসে নিজের কল্পনা, পরিশ্রম, কর্ম সম্পাদনের অভিজ্ঞতা থেকে। তার সুযোগ এ ব্যবস্থায় নেই। শিক্ষা কেবল টেক্সটবইয়ে আবদ্ধ থাকলেও চলবে না, একজন ছাত্রকে তার নানামুখী প্রবণতা ও সম্ভাবনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, সেগুলো চর্চা করার সামর্থ্য সম্পর্কে তাকে আত্মবিশ্বাসী করা এবং তারপর এই সাফল্যের মূল্যায়ন ও উদযাপন তাকে আনন্দের মাধ্যমে এক টেকসই ইতিবাচক ও বহুমুখী মানসের সন্ধান দেবে। ব্যক্তিমানসের সংকোচনে ব্যবহার করলে ধর্মের প্রতিও অবিচার করা হয়। ব্যক্তিমানসকে উন্মোচন, সৃজনশীল, আনন্দময় ও ইতিবাচক করে তোলা ধর্মেরও কাজ। ধর্মের নামে অনেকেই মানুষের এই সার্বিক বিকাশের পথ রোধ করে দাঁড়াতে চান। অবদমন মানুষের জন্যে মনস্তাত্ত্বিক সংকট তৈরি করে থাকে। তাতে সমাজে অতৃপ্ত বাসনা ও নানা রূপ অবদমনজাত বিকারের প্রকাশ দেখা যায়। আজ রাজনীতি ধর্মকে ব্যবহার করছে আবার কেবলমাত্র জাগতিক তথা সংকীর্ণ স্বার্থেই রাজনীতির ব্যবহার ঘটছে। তাতে সমাজমানসে সত্য ও অসত্যের ধারণা, ভালো ও মন্দ মানুষের ফারাক, পাপ ও পুণ্যের চেতনা অস্পষ্ট হয়ে পড়ছে। সমাজ দিব্যি অপরাধের সাথে আপস করছে, অপরাধীকে নিয়ে বসবাস করছে। এমন বিভ্রান্ত মানুষের সমাজে রাজনীতি যেমন তেমনি ধর্মও  নানা ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যবহৃত হতে থাকে।
সংস্কৃতি শব্দটা নিয়ে আমাদের মনে ব্যাপক বিভ্রান্তি আছে। সংস্কৃতি আমাদের জীবনযাপন প্রণালীর সাথেই সম্পৃক্ত - পোশাক-খাবার-ভাষা-আচরণ-অনুষ্ঠান সবকিছু নিয়েই সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এসবই ঠিকভাবে শিখতে হয়। সবসময় বলে বলে হয় না, নিজে করে গড়ে আয়ত্ব করলে তা-ই হয় টেকসই। বাসায় জীবনযাপনের মাঝে ব্যক্তিসত্তা আর স্কুলে অনেকের সাথে মিলে সামাজিক সত্তা তৈরি হবে সংস্কৃতিবোধে ও রুচিতে সম্পন্ন হয়ে। বাসায় জীবনযাপনের সৌন্দর্য তৈরি হবে, স্কুলে জীবন উদযাপনের দক্ষতা আয়ত্ব হবে। এ বিষয়টা আরেকটু বিস্তারে লিখতে হবে স্বতন্ত্র একটি লেখায়।


***

Thursday, April 20, 2017

অনেক ধোঁয়াশা থেকে গেল


আবুল মোমেন

হেফাজতে ইসলামের মূল ঘাঁটি চট্টগ্রাম। তাদের বিরোধী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতেরও শক্ত অবস্থান চট্টগ্রামে। চার বছর আগের প্রতিকূল অবস্থা কাটিয়ে হেফাজত এখন সরকারের, অন্তত সরকার প্রধান ও তাঁর কোনো কোনো ঘনিষ্ঠ নেতাদের আস্থায় রয়েছে। কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে সাধারণ ধারার সর্বোচ্চ অর্থাৎ - স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সমমানের বলে স্বীকৃতি দিতে সম্মত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তড়িঘড়ি করে এ বিষয়ে সরকারি প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রির এই স্বীকৃতি দিতে সম্মত হয়েছিল। সে সময় তারা অবশ্য প্রয়োজনীয় দাপ্তরিক ও আইনগত কাজ সম্পন্ন করতে পারে নি। তবে বোঝা যাচ্ছে দেশের প্রধান দুই দলই এ বিষয়ে একমত।
আমরা জানি বাংলাদেশে শিক্ষায় সর্বোচ্চ স্নাতকোত্তর এবং এর ওপরের (যেমন পিএইচডি) ডিগ্রি দেওয়ার বৈধ প্রতিষ্ঠান হল বিশ্ববিদ্যালয় অন্তত এতকাল তাই ছিল। পুরোনো পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে চলে, তাদের স্বায়ত্বশাসনের অধিকার থাকলেও কিছু নিযন্ত্রণ আছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু কওমি মাদ্রাসাকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির ব্যবস্থা ছাড়া। পত্রিকা মারফৎ জানা গেছে বিভিন্ন ধারার কওমি মাদ্রাসাগুলো মিলে তড়িঘড়ি করে একটি বোর্ড গঠন করেছে যেটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রির পরীক্ষা গ্রহণ করবে ও সনদপত্র দেবে।
সরকারের সাথে সমঝোতার ফলে উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানের জন্যে গঠিত এই বোর্ডের ক্ষমতায়ন করবে সরকার। কিন্তু যথাযথ অ্যাকাডেমিক ও মানবসম্পদের ব্যবস্থাপনা ছাড়া এর মর্যাদা ও কার্যকারিতা কি প্রশ্নসাপেক্ষ থাকবে না? বোর্ডকে পরীক্ষা দেওয়ার মত ক্ষমতাও না হয় সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করে দিতে পারবে, কিন্তু উচ্চতর ডিগ্রির সাথে জ্ঞানচর্চার যে উচ্চতা, তার জন্যে যে আয়োজন ও সক্ষম ব্যক্তিবর্গের প্রয়োজন তা কখন কীভাবে পূরণ হবে এসব বিষয় ধোঁয়াশায় থেকে গেল। কওমি ধারার মাদ্রাসাগুলো যেহেতু সরকারের কোনো রূপ তদারকি বা হস্তক্ষেপ ছাড়া নিজস্ব নিয়মে ও আওতায় চলছে তাই এ সংক্রান্ত তথ্যগুলো সাধারণভাবে মানুষের জানা নেই। তাদের শিক্ষার মান, শিক্ষকবৃন্দের যোগ্যতা ইত্যাদিও কোনো পাব্লিক বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের তদারকিতে নেই।
কিন্তু নতুন ব্যবস্থায় তারা যতই সরকারে প্রতিনিধিত্ব, তদারকি মুক্ত থাকতে চান না কেন ডিগ্রিটি যেহেতু প্রকাশ্যে দেওয়া হবে, এই ডিগ্রিপ্রাপ্তরা সমমানের ডিগ্রিপ্রাপ্তদের সাথে চাকুরির দৌড়ে থাকবেন তাই এসব আর আড়াল বা নিরঙ্কুশভাবে তাঁদের আওতায় থাকবে না। সনদপ্রাপ্ত ছাত্ররা চাকুরিপ্রার্থী হলে তাঁদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার মান এবং সেই সূত্রে ব্যবস্থাপনার তথ্যাদি জনগণের যাচাইয়ের মুখোমুখি হবে। তাঁদের নিজস্ব বোর্ডের স্বীকৃত  এই ডিগ্রি সরকার মানবেন, কিন্তু এর বাইরে - দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান, আন্তর্জাতিক মহল? সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের সব স্তরের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সরকার জাতিসঙ্ঘের সহ¯্রাব্দ লক্ষ্য পূরণে সফল হয়েছে কিন্তু টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য বা এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে বেশ সমস্যায় রয়েছে। কারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে মান অর্জনই মূল লক্ষ্য তথা মূল চ্যালেঞ্জ। আমাদের প্রাথমিক থেকে এম. এ. পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই মানের সংকট চলছে। দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই আন্তর্জাতিক রেটিঙে পাঁচশর মধ্যেও নেই। আমাদের গবেষণায় বিশ্বমানের অর্জন বিশেষ নেই। ইসলামি ধারাতেও নেই। এখন দরকার শিক্ষাকে গোড়া থেকে গুছিয়ে নেওয়া, সব ধারার শিক্ষার বুনিয়াদ শক্তিশালী করা, প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রন্থাগার, লাইব্রেরিসহ সবরকম সুযোগসুবিধা বাড়ানো ও এগুলোর ব্যবহার নিশ্চিত করা, শিক্ষকদের উপযুক্ত শিক্ষা ডিগ্রি প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা। এসব বিষয় উপেক্ষা করা হলে আখেরে লাভ বিশেষ হবে না।
শিক্ষার মূল কাজ জ্ঞানার্জন, ডিগ্রি ও সনদপত্র অর্জন নয়। এ ডিগ্রি ও সনদ হল জ্ঞানার্জনের ফলাফল। কিন্তু আমাদের সমাজে প্রকৃত জ্ঞানার্জন ও জ্ঞানচর্চা ভীষণভাবে উপেক্ষিত আজ। ব্রিটিশ আমলে মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত এক কমিটির একজন সদস্য দু:খ করে বলেছিলেন, আমাদের মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার আধেয় ও ব্যবস্থা বাদশাহ আলমগীরের আমলে পড়ে আছে। তাঁর কথা সেদিন শোনা হয় নি। তবে বিভিন্ন সময়ে আলিয়া ও সাধারণ মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার হয়েছে। এ ধারার অধিকাংশ মাদ্রাসায় গ্রন্থাগার ও বিজ্ঞান গবেষণাগার, কম্প্যুটার ল্যাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যদিও সব ধারার প্রতিষ্ঠানের মতই এখানেও এসবের ব্যবহার সীমিত এবং ডিগ্রিসনদ ও মুখস্থবিদ্যার বাইরে সত্যিকারের জ্ঞানচর্চা হচ্ছে না। ফলে সেদিক থেকে হয়ত বলা সম্ভব অন্য দশটা ধারার মতই ওরাও চলবে।
তাতেও অবশ্য সমস্যা মেটে না। কারণ ইতোমধ্যে সংবাদপত্রে যেসব তথ্য বেরিয়েছে তাতে দেখা যায় জঙ্গিদের একটি বড় অংশ কওমি মাদ্রাসা থেকে এসেছে। এরকম অভিযোগ বাড়তে থাকলে সরকার কতদিন চুপ করে থাকতে পারবে? যে কোনো সরকারের বড় দায় হল  দেশে আইনশৃঙ্খলা ঠিক রাখা, শান্তি বজায় রাখা। বর্তমান সরকারের একটি ঘোষিত নীতি হল জঙ্গিবাদের ব্যাপারে  শূন্য সহিষ্ণুতা বা জিরো টলারেন্স। এ অবস্থান দেখিয়েই পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্বের সমর্থন আদায় করছে সরকার। ফলে এ ক্ষেত্রে সবটাই যে সরকারের হাতে আছে তা-ও নয়।
কিন্তু মোদ্দা যে কথাটা ধোঁয়াশা হিসেবে থেকে গেল তা হল তাড়াহুড়ার মধ্যে গঠিত বোর্ডই কি স্নাতকোত্তর ডিগ্রিটা দিচ্ছে?
এতকাল ডিগ্রি ও  স্নাতকোত্তর ডিগ্রি কোনো স্বীকৃতি বিশ্ববিদ্যায় থেকেই নেওয়া যেত, বোর্ড  স্নাতকের নিচের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাব্লিক পরীক্ষার সনদ দিতে পারত। এই যে কওমি মাদ্রাসার উদ্যোগে গঠিত বোর্ড ডিগ্রি ও সনদ দেবে তার স্বীকৃতি তারা দেবে, কিন্তু অন্যরা কেন দেবে সেটা পরিস্কার নয়। আদতে এম. এ. ডিগ্রির স্বীকৃতি ও মর্যাদা আদায় করতে হলে কওমি মাদ্রাসাকে কিছু চাহিদা পূরণ করতে হবে। শিক্ষকদের স্বীকৃত এম. এ. ডিগ্রির প্রশ্ন উঠবে, শিক্ষকদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা ও গবেষণালব্ধ ডিগ্রির প্রশ্ন উঠবে, প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত পাঠাগার, গবেষণাগার থাকা দরকার, নিয়মিত সেমিনার-সিম্পোজিয়াম হওয়া প্রয়োজন। জ্ঞানের আদান-প্রদানের ব্যবস্থা থাকা চাই। এসব তো একলা চলো রে কিংবা আলাদা চলার নীতিতে অটল থাকলে করা সম্ভব হবে না। ডিগ্রি যেহেতু প্রকাশ্যেই দিতে হবে, এর প্রক্রিয়াটিও প্রকাশ্যই হতে হবে এবং এ নিয়ে নানা মহলের মূল্যায়ন, আলোচনা, সমালোচনাও শুনতে হবে। গঠনমূলক আলোচনা সমালোচনাকে স্বাগতও জানাতে হবে। তবে সবকিছুর আগে দশ লক্ষ ছাত্রকে যে স্বপ্ন দেখানো হচ্ছে তার মর্যাদা ও বৈধতার প্রশ্নটি ভালোভাবে সমাধান করতে হবে। প্রশ্নবিদ্ধ ডিগি, কিংবা নিজস্ব একটি সনদপত্রের মূল্য সমাজে বা আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিষ্ঠিত হবে না।
ধোঁয়াশামুক্ত হয়ে পুরো বিষয়টি বোঝার জন্যে ভবিষ্যতের দিকেই তাকাতে হবে আমাদের।


***

Saturday, April 15, 2017

আপসের পথে কি সমাধান মিলবে?

আবুল মোমেন

স্বাধীনতার কিছু আগে থেকে, বিশেষত ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পরের দুবছরে, আওয়ামী লীগের যে রূপান্তর ঘটেছিল তার গুরুত্ব স্বাধীনতার পরেও বিবেচিত হলে ভালো হত। অর্থাৎ তখন সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার লক্ষ্যাদর্শে সিপিবি ও ন্যাপসহ আরো প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী দলের সাথে আওয়ামী লীগের যে রাজনৈতিক-আদর্শিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা স্বাধীনতার পরেও ধরে রাখা উচিত ছিল। এসময়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগকে ঘিরে বাঙালি জাতীয়তাবাদী বামপ্রগতিশীল চেতনার যে প্লাটফর্ম গড়ে উঠেছিল তা আরো পোক্ত হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরে আওয়ামী লীগ এককভাবে ক্ষমতাসীন দলে পরিণত হল। তৎকালীন সোভিয়েত-বলয়ের শক্তিশালী দল হিসেবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিতে গিয়ে সিপিবি ও ন্যাপ (মোজাফ্ফর) বি টিমে পরিণত হল। এ পরিণতি পরবর্তীকালে এদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির জন্যে ক্ষতির কারণ হয়েছিল। কেবল দেশের নয় খোদ আওয়ামী লীগের রাজনীতিও যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা এখনকার বাস্তবতায় ভালোই বোঝা যাচ্ছে।
তরুণদের তো চাহিদা থাকেই আদর্শের রাজনীতির। তারুণ্য সবসময়ই নিজের ক্ষুদ্র গণ্ডিকে ছাপিয়ে গিয়ে বৃহৎ ও মহৎ কিছু অর্জনে শরিক হতে চায়।  এদিক থেকে দেশ ও মানুষের কল্যাণে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম তাকে টানে। আর তাই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এদেশের তরুণরা দলমত-নির্বিশেষে অকুতোভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বীরের সর্বশ্রেষ্ঠ ভূমিকা হল আত্মত্যাগের মাধ্যমে বিজয় অর্জন। তারই স্বীকৃতি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে এমন বিজয়ী শহীদদের আমরা বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দিয়েছি।
মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ই ছাত্রলীগের মধ্যে আদর্শিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। স্বাধীনতার পরে এই অর্জনকে আরো বড় ও মহৎ অর্জনে রূপান্তরের স্বপ্ন থেকে ছাত্রলীগ থেকে অসংখ্য মেধাবী তরুণ বেরিয়ে এসে জাসদ ছাত্রলীগে যোগ দিয়েছিল। স্বাধীনতার পরপর এটিই ছিল আদর্শের টানে তরুণদের নিজেকে ছাপিয়ে ওঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের বড় প্লাটফর্ম। আমরা জানি, নেতৃত্বের ভুল ও দুর্বলতায় তরুণদের এ অভিযান সফল হয় নি, অসংখ্য তরুণ এর বলি হয়েছে। স্বাধীনতার পরে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন আর কখনো তরুণদের কাছে আদর্শিক রাজনীতির প্লাটফর্মের মর্যাদা বা আকর্ষণ ফিরে পায় নি। গত শতকের আশির দশকে, বিশেষত ইরানের ইসলামি বিপ্লবের (১৯৭৯) পরে, বাংলাদেশেও এরকম বিপ্লবের স্বপ্ন দ্যাখানো সম্ভব হয়েছিল। এতে তরুণদের একাংশ আকৃষ্ট হয়েছিল। তবে বাংলাদেশের আবহমানকালের সমাজসংস্কৃতি ঠিক গোঁড়া ধর্মান্ধ রাজনীতির জন্যে প্রস্তুত ছিল না।
সমাজসংস্কৃতির এই অসাম্প্রদায়িক মানবিক বুননে একটা রূপান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনি অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি ধারার ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের রাজনীতি চালু করলেন। এ সময় বোঝা গেল বাঙালিসমাজ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বামপ্রগতিশীল ধারার রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক চিন্তাচেতনাকে এগিয়ে নিলেও ইসলাম নিয়ে তার ধ্যানধারণা বিশ্বাসের গ-ি ছাপিয়ে মননশীল আলোচনার উপযুক্ত ছিল না - মুসলিম সমাজের সংস্কৃতির স্বরূপ কি, কোনটি মুসলমানের করণীয়, করণী নয় ইত্যাদি নিয়ে তার মনে নানা বিভ্রান্তি-সংশয় এবং চিন্তার জড়তা ও ভীরুতা কাজ করে। এই বাস্তবতায় নির্বাচনী রাজনীতিতে এ ধরনের ভোটারদের মন পেতে রাজনৈতিক দলের জন্যে ইসলাম ধর্ম একটি বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াল। স্বভাবতই আওয়ামী লীগ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশে মুসলিম সংখ্যগরিষ্ঠ মানুষের দল হিসেবেই ভূমিকা পালন করতে চাইল। সম্ভবত  সেটা পেরেও গেল।
খানিকটা বিভ্রান্তিকর মনে হলেও এ কথা এখনো সত্য এদেশে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতি ও আধুনিক শিক্ষা-সংস্কৃতির যে চর্চা রয়েছে তা সম্ভব হচ্ছে দেশে আওয়ামী লীগ দলটি এখনো বড় দল হিসেবে সক্রিয় রয়েছে বলেই। কিন্তু গভীর আশংকার সাথে যে প্রশ্নটি ওঠে তা হল আওয়ামী লীগ যে আপসের রাজনীতির পথে চলেছে তাতে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মধ্যে যে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের উপাদান রয়েছে তার ভারসাম্য রক্ষা করা কি সম্ভব? আগুন নিয়ে খেলার পরিণতিই ডেকে আনবে কিনা সে শংকা থেকেই যায়। হেফাজত ও কওমি মাদ্রাসার প্রতি যে ধরনের ঔদার্য দেখানো হচ্ছে তার সুদূরপ্রসারী পরিণতি কী হবে তা দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংকট থেকেই বোঝা যাবে।
ধর্ম নিয়ে আলোচনার ভিত্তি হল  বিশ্বাস - সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আচার অনুষ্ঠান ও অন্যান্য সামাজিক সাংস্কৃতিক রেওয়াজ-চর্চা নিয়ে আলোচনা, বিতর্কের পথও বন্ধ করে রাখা হয়েছে যদিও মুসলিমসমাজের মধ্যেই এসব বিষয়ে অনেক বিভেদ ও বিবাদ বর্তমান। বিপরীতে চিরায়ত বাঙালি সংস্কৃতি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অহরহ সমালোচিত ও বিতর্কিত হচ্ছে। আশির দশক থেকে কখনো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কখনো সামাজিক ঔদার্যে-প্রশ্রয়ে বাঙালিসমাজকে একটি নিরেট মুসলিমসমাজে রূপান্তরিত করার সাংস্কৃতিক অভিযান চলেছে। একটি দৃষ্টান্ত দেব। এমন অভিযানের ফলেই বাংলাদেশের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রিকসা-বাস-ট্রাক বা গণপরিবহন পেইন্টিঙের ঐতিহ্যবাহী ধারাটির অবসান হয়েছে। একে ধর্মবাদীদের এক নীরব বিপ্লব বলা যেতে পারে। বাঙালি রমণী, এমনকি গ্রামীণ নারীও যে ক্রমে শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার-কামিজে অভ্যস্ত হচ্ছে তার পেছনে কাজকর্মের সুবিধার যুক্তির সাথে ধর্মীয়প্রচারণাও কাজ করছে।
পঞ্চাশ ও ষাটের এবং সত্তরের দশকের সাথে আজকের সমাজচিত্রের তুলনা করলে এই পরিবর্তনগুলো বোঝা যাবে।
আবার এই বাস্তবতাটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে পঞ্চাশ, ষাট এবং সত্তরের দশকেও আমাদের নাগরিকজীবন কেটেছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের বামপ্রগতিশীল প্রতিবাদী রাজনীতির বাতাবরণে। প্রতিবাদী রাজনীতিতে আদর্শ ও ইতিহাসের দায় এবং নৈতিকতা ও ত্যাগের ভূমিকা থাকে। কিন্তু একথা ঠিক আজ পৃথিবী জুড়ে ধর্মীয় ও জাতিগত চেতনার দাপট বাড়ছে। প্রতিবেশী ভারতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ক্রমেই সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে। তার প্রতিক্রিয়া এদেশে দেখা দেবে তা-ই স্বাভাবিক। আবার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ মিলে যে শক্তিশালী পশ্চিমা বিশ্ব সেখানেও উগ্র জাতীয়তাবাদের সাথে - কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইসলামের বিরুদ্ধে - ধর্মীয় জোশের উপাদান জোরদার হয়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আধিপত্যবাদী পদক্ষেপের ফলে তাদের ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী একটা রূপ দাঁড়িয়েছে। যতই সৌদি আরব, কুয়েত, আমিরাত, জর্ডান, তুরস্কের সরকার এদের পক্ষাবলম্বন করুক না কেন আজ যে মুসলিম তরুণরা জঙ্গিবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে তার কারণ পশ্চিমের এই ভূরাজনৈতিক ভূমিকা এবং উপরোল্লিখিত মুসলিম দেশের পশ্চিমা তোষণ নীতি। এই বাস্তবতার আলোকে তাদের মধ্যে মুসলিমসমাজের পক্ষে ও ইসলামের মর্যাদার প্রশ্নে ন্যায়যুদ্ধের তাগিদ তৈরি হচ্ছে।
সরকার একদিকে পুলিশি (অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন) ব্যবস্থার মাধ্যমে জঙ্গিদের দমন করতে আর অন্যদিকে ইসলামি মতাদর্শের সংগঠন গোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে ইসলামের জঙ্গিবাদ বিরোধী রূপটি তুলে ধরে জঙ্গিলাইনে তরুণদের মগজধোলাই বন্ধ করতে চাইছেন। এই পথে কত দূর যাওয়া যাবে সে প্রশ্ন উঠবেই। জঙ্গি দমনের পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াত জোটকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার যে এজেণ্ডা সরকারের রয়েছে এ পথে তা পূরণ হলেও সরকার, ক্ষমতাসীন জোট এবং শিক্ষাসহ সামাজিক বিকাশের অন্যান্য উপাদানগুলো ক্রমেই তার অসাম্প্রদায়িক রূপ হারাতে থাকবে। বাঙালির চিরায়ত মানবিক সংস্কৃতির ঐতিহ্য ভীষণভাবে চাপে পড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, ধর্মভিত্তিক যেসব সংগঠনের সাথে সরকার ও আওয়ামী লীগ সখ্য করছে তারা রাজনৈতিকভাবে জামায়াতের মত সংগঠিত না হলেও ধর্মীয় চিন্তার দিক থেকে একইভাবে গোঁড়া ও ধর্মান্ধ। ইতোমধ্যে তারা নিজেদের শক্তিরও পরিচয় দিয়েছে পাঠ্যবইয়ে সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় রদবদল ঘটাতে সরকারকে বাধ্য করে। এবার তারা পয়লা বৈশাখ ও মঙ্গলশোভাযাত্রার বিরুদ্ধে নেমেছে। অন্যদিকে সরকার তাদের সাথে আপস করে চলতে গিয়ে উচ্চতর ডিগ্রির ন্যূনতম চাহিদার বিষয়টি বিচারে না নিয়েই কওমি ধারার সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে স্বীকৃতি দিয়ে একটা গোঁজামিল দিয়ে ভোটের উপকার করছেন, না ইসলামের নাকি দেশের?
এ প্রেক্ষাপটে কিছু সোজাসাপ্টা কথা বলা যায়। আমাদের যে উন্নতি হচ্ছে, গড় আয়ু বৃদ্ধি, মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পাওয়া, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, ডিজিটাল প্রযুক্তির কল্যাণে যোগাযোগ ও ব্যবসায়ের বিকাশ, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে মূল চালিকাশক্তি হল বিজ্ঞান।
কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা যথার্থ বিজ্ঞান চর্চায় মনোযোগী নয়। মূল কারণ সমাজমানসই বিশুদ্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অনুকূল নয়। আদতে সমাজে আমরা ভোগের চাহিদা তৈরি করতে পারলেও জ্ঞানের চাহিদা তৈরি করতে পারি নি। ইসলামে যদিও  জ্ঞানচর্চার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তা সত্ত্বেও না-সরকারের আনুকূল্যপ্রাপ্ত না-সরকারের প্রতিকূলতার সম্মুখীন ধর্মীয় দলের কোনটিই প্রকৃত জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় আগ্রহী নয়। জ্ঞানচর্চার যথার্থ পরিসর তৈরি কোনো ক্ষেত্রেই আমরা করতে পারি নি - বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, মাদ্রাসায় তো নয়ই। সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে ডিগ্রির স্বীকৃতি থেকে কি সুফল শিক্ষার্থী পাবে!
বাংলাদেশের উন্নতিকে টেকসই করার লক্ষ্য (এসডিজি) পূরণ করতে হলে ধর্ম নিয়ে যারা রাজনৈতিক ফায়দা উশুল করতে চায় তাদের সাথে আপস করে পথ চলে লাভ হবে না। তাতে ইসলামচর্চারও কাক্সিক্ষত উন্নতি অর্জিত হবে না।
গোড়ার কথায় ফিরে গিয়ে বলতে হবে গোটা বিশ্ব আজ যে কালান্তরের সম্মুখীন তা দীর্ঘদিনের আদর্শহীন ক্ষমতার রাজনীতির মাধ্যমে মোকাবিলা করা যাবে না। আদর্শের এই শূন্যতায় মুসলিম দেশের তরুণদের একটি অংশ বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকছে।
তারাও তরুণ এবং তারাও তো নিজের চেয়ে বড় ও মহৎ কাজে যুক্ত হতে চায়, তাদের সামনে গণতান্ত্রিক রাজনীতি তেমন কিছু দাঁড় করতে পারে নি। এই ব্যর্থতার খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের এবং সারা বিশ্বের দেশে দেশে। আমরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে তারুণ্যের অপচয় প্রত্যক্ষ করেছি একবার। আজ প্রায় চার দশক পরে ইসলামের নামে আরেকবার একই ধরনের ট্র্যাজেডি ঘটতে দেখছি। এমনটা কি আমরা ঘটতে দিতে পারি?
গোঁজামিল দিয়ে এ সমস্যার সমাধান হবে না, জঙ্গি মেরে এই প্রবণতা শেষ করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশ হল মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী দেশ। এখানকার মানুষ ধর্মভীরু, ধর্মচর্চায় উৎসাহী, আবার চিরায়ত মানবতাবাদী ঐতিহ্যের প্রতিও আগ্রহী। এ মানুষের পক্ষে সংকটাপন্ন বিশ্বে মানবতার পক্ষে নতুন বাণী হাজির করা সম্ভব যা সকল অমানবিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তরুণদের উদ্দীপ্ত করতে পারে। মূলধারার রাজনীতিকে নানা কৌশল ও আপসের চিন্তা বাদ দিয়ে স্পষ্টভাবে মানবিক মহৎ আদর্শের গণতান্ত্রিক রাজনীতির কথা ভাবতে হবে।


***