Sunday, July 12, 2015

ঈদ-রোজার বিবর্তন ও বাজার অর্থনীতি

আবুল মোমেন

টিভি প্রতিবেদক যখন জিজ্ঞেস করল - কেমন ছিল ছোটবেলার ঈদ, আর এখনই বা কেমন দেখছেন উৎসব?
ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই ওর সামনে বসেছিলাম। কিন্তু ওর প্রশ্নটা ধাক্কা দিল মনের জানালায় - খুলে গেল স্মৃতির ঝাঁপি। আর সেসব তুলে আনতে গিয়ে একালের পরিবর্তন আর তার কার্যকারণ, ধরণ ইত্যাদি চিন্তার জটিল গ্রন্থিও খুলতে থাকল। সেসবই পাঠকের সাথে ভাগ করে নেওয়া যায়।
সেকালে, অর্থাৎ প্রায় অর্ধশতকেরও বেশি আগেকার কথা, রোজা ছিল ঘরোয়া পরিসরে পালনের বিষয়। তাই ইফতার হত বাড়িতে বাড়িতে। ইফতার পার্টির কোনো স্মৃতি আমার মনে পড়ে না। বাবা তো শহরের গণমান্য ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর সূত্রে অন্তত জানতে পারতাম। না, তেমন কিছু ছিল না। কালেভদ্রে সরকারি কোনো আয়োজন হয়ত হত, তার সাথে সংসারের মানুষের কোনো যোগ ছিল না।
সেকালেও ইফতারে ছোলা-পেঁয়াজি-বেগুনি ছিল, কোনো দোকানের জিলাপির সুনাম থাকলে সেটি হয়ত আসত। তবে বয়েসি খানদানি রোজদারদের পছন্দ ছিল চিড়া-কলা-দই মাখা। একটু ঠাণ্ড হলে ভালো। সেহেরিতে একটা মূল পদ আর সাথে ডালের বেশি নয়। মূল পদটি প্রায়ই কখনও মাংস কখনও ডিম। কেউ কেউ অবশ্য দুধভাত খেতেন, তাতে প্রায়ই কলা থাকত, তবে আমের দিনে আমই কলার জায়গা নিত।
প্রতিবেশী আর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের সাথে ইফতারের আদানপ্রদানটুকু ছিল ঘরের বাইরে রোজার সংযোগ। মাঝে মধ্যে আত্মীয়-বন্ধু দু’চারজনকে ইফতারের আমন্ত্রণ জানানো হত। তাদেরই ডাকা হত যারা এলে ঘরোয়া আমেজ ক্ষুণ্ন হয় না। সবাই জানত রোজায় আড়ম্বর মানায় না। প্রায়ই পরিচিত গরীব আর ভিখিরিদের ডেকে ইফতার দেওয়া হত। এসব ও যাকাত দেয়া হত নীরবে, নিবৃত্তে। বিবাহিত কন্যা ও বৈবাহিকদের বাড়িতে ইফতারের তত্ত্ব পাঠানো হত।
ঈদ ছিল সামাজিক উৎসব। ছোটদের মধ্যে নতুন জামা নিয়ে চাঞ্চল্য ছিল, বেড়ানোর উৎসাহ আর পরিকল্পনা তাতে উত্তেজনা ছড়াত। কিন্তু তা কখনও ঘরের বা বৃহত্তর স্বজনের পরিধি ছাপিয়ে যেত না। সচরাচর একজনের একটার বেশি জামা হত না, ছোটদের আর মেয়েদেরগুলো বাড়ির সেলাইয়ে-পাকা বুবু-খালা-চাচিরাই তৈরি করে দিতেন। ছোটদের কাজ ছিল তাদের কাছে ঘুরঘুর করা, হাবভাবে তাগাদার আর্জি ফুটিয়ে তোলা। ছেলেরা আর বড়রা যেত পাড়ার দর্জির কাছে। ঈদের সকালে প্রতিবেশীদের সাথে সেমাই বিনিময় হত, আমরা প্রতিবেশী ও আত্মীয়বাড়ি বেড়াতাম, আর দুপুরে নিজের বাসায় ভালো খেতাম। পোলাও-মুরগিই হত মূল পদ। তখন খাবারে বা পোশাকে বাড়াবাড়ি মানুষ তেমন জানতই না। পোশাক বা খাবারের জলুসে নয়, বিচার যদি হত তা হত আতিথ্যের, আন্তরিকতার। কাজীবাড়ির চাচি কেমন মায়া করে খাওয়াতেন সে গল্প বাড়ি এসে মাকে বলতাম। স্বাদু খাবারের স্বাদ বাড়ত ছোটনানির স্বতস্ফূর্ত স্নেহের ফল্গুতে।
আমি গৎ বাঁধা ভাবনার মানুষ নই। সেকাল ভালো আর একাল খারাপ - এমন ভাবতে এবং ফতোয়া দিতে অভ্যস্ত নই। জানি যার যার শৈশব-স্মৃতি তার কাছে মধু-মাখা, ভোলার নয়, সেইসব স্মৃতি সততই সুখের। এও আমরা জানি কালে-কালে মানবজীবনে পরিবর্তন ঘটবেই। কথা হল তার কতটা ভালো হচ্ছে, কতটা কীভাবে আমরা নিজেদের মত করে সংস্কার করে নিতে পারতাম। সেদিক থেকে একটু তুলনা এবং ভাবনা চলতে পারে বলেই মনে হয়।
এখন বাজার অর্থনীতির রমরমা, বাজার মানুষের ব্যক্তিগত, এমনকি পবিত্রতম জায়গাতেও ঢুকে পড়ছে। বাজারের সহযোগীর বা উপজাতের ভূমিকা নিচ্ছে গণমাধ্যম। রোজা এলে এখন উপবাসের গুরুত্ব ছাপিয়ে ইফতারের প্রলোভনের পসরা সবটা জাঁকিয়ে বসে। এমনিতেই গণমাধ্যমে ইদানীং জনপ্রিয়তায় শীর্ষ অনুষ্ঠানের একটি হল রান্না অর্থাৎ মুখরোচক খাবার। রসনা ও ভোজনবিলাস মানুষের আদিম রিপু। তবে রোজার নৈতিক অবস্থান হল মানুষের অসংযত রিপুকে সংযত করা। কিন্তু বাজার ও গণমাধ্যমের যোগসাজশে রমজানের সারাটা মাস জুড়ে চেষ্টা চলে মানুষের ভোগের রিপুকে অসংযত করে তোলার - পত্রিকায় প্রতিদিন আর ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে বিপুল আয়োজনে প্রায় সারাক্ষণ এই চেষ্টাই চলতে থাকে।
একজন মানুষ কত খেতে পারে, আর তার কতটা খাওয়া উচিত তার একটা সীমা নিশ্চয় আছে, থাকা উচিত। সারাদিনের উপবাসের পরে কোন ধরনের খাবার খাওয়া উচিত এসব যদি বিবেচনায় আসেও তা আসে কিন্তু প্রলোভনের ফাঁদটা ঢাকার জন্যে, কারণ মূল বিবেচ্য বিষয় কী করে মানুষকে বেশি বেশি খেতে প্রলুব্ধ করা যায়। কাউকে প্রলোভন দেখানো - বিশেষত সংযম শিক্ষা ও পালনের মাসে - উচিত কিনা তা একবার ভেবে দেখা যায় না?
দেখা যাচ্ছে মানুষ নিজের মান রক্ষার মানদ- হিসেবে ধরে নেয় ইফতার আইটেমের সংখ্যা এবং দামের ওপর, ফলে প্রায়ই দেখতে পাই - মাসটা উপবাস ও সংযমের হলেও এটি কাটাতে বাড়তি বাজেট লাগে। ইদানীং ঢাকায় রোস্তোরায় সেহেরি খাওয়ারও ফ্যাশান চালু হয়েছে। মাঝরাতে বা শেষরাতে অভিজাত পাড়ার ছেলেমেয়েরা সেহেরি অভিযানে বেরুচ্ছে। বৈচিত্রের সাথে একটু বাড়তি রোমাঞ্চও যোগ হল, অবশ্যই উচ্চ মূল্যে এবং মাত্রাতিরিক্ত ক্যালরি অর্জনের বিনিময়ে - খারাপ কী!
আজকাল ঈদের কেনাকাটা রোজার অনেক আগে থেকেই শুরু করে মানুষ। বাজারই রুচি, ফ্যাশন তথা কেনাকাটার নির্ধারক। বাড়িতে আবার কেউ জামা সেলাই করে নাকি? সেসবে পারদর্শী বুবু-খালা-চাচিরা বর্তমানে বিলুপ্ত প্রজাতি। অথবা তাঁরাই হয়ত এখন একালের বুটিক মালিক-কাম-ডিজাইনার। এখনকার নীতিকথাও গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপনই নির্ধারণ করে দিয়েছে - আগে ছিলাম বোকা এখন হইছি বুদ্ধিমান। বৈষয়িক উন্নতির পিছনে নিরন্তর বুদ্ধি খাটাতে থাকলে তাতে নিশ্চয় শান পড়ে, এবং বাজারের আঁটঘাঁট বোঝা হয়ে যায়। বুদ্ধির প্যাঁচ এবং চালাকির মারে কেউই পিছিয়ে থাকে না আর। কিন্তু এভাবে চললে বুদ্ধিরই বাড়বাড়ন্ত হবে, আর তার জের ধরে মানুষটার চাতুর্য, শঠতাও বাড়বেই। বিপরীতে কোন জিনিসটা পিছিয়ে যাবে? পিছিয়ে পড়বে বিবেচনা, প্রকৃত বুদ্ধি, যা শুধু ব্যবসাকে নয়, তার পেছনের মানুষটাকেও সমৃদ্ধ করে। কিন্তু বাজারের খপ্পরে পড়ে মূলধন তথা বিনিয়োগের সর্বোচ্চ মুনাফা আদায়ের মন্ত্রে মশগুল মানুষ চালাক-চতুর হওয়ার দৌড়েই এগুতে চায়। সেদিন কোনো চ্যানেলের ঈদ-বাজার পরিক্রমার বিশেষ অনুষ্ঠানে একজন সবাইকে টেক্কা দিলেন দামে, তাঁর দোকানের শাড়ির সর্বনিম্ন মূল্য দেড়লক্ষ টাকা, আর পাঞ্জাবির তিন কি চার হাজার টাকা!
ফলে টিভি প্রতিবেদক যখন আমাকে প্রশ্ন করল আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য কিছু দেখেন কিনা ঈদের আয়োজনে, তখন প্রথমে একটু তাত্ত্বিক কথা বলে পরে আসল কথাটা পাড়লাম। তাত্ত্বিক কথাটা সামান্য। একালে যোগাযোগে সত্যিই একটা বিপ্লব ঘটেছে - তা সড়কে-উড়ালে যেমন তেমনি তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণেও, মানুষের চলাচলও অনেক বেড়ে গেছে। বললাম শিল্প বিপ্লবোত্তর আধুনিকতার একটি বৈশিষ্ট্য হল সর্বজনীনতা (universality) এবং সামান্যিকরণ (generalisation)- অর্থাৎ সবকিছু সবার কাছে পৌঁছায় আর সবার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাযুজ্য তৈরি হওয়ার প্রবণতা জোরদার হতে থাকে। এটা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র এবং বৈশিষ্ট্য রক্ষার ক্ষেত্রে হুমকি স্বরূপ। কিন্তু এটাই ট্রেণ্ড বা চলতি-হাওয়া। ব্যক্তিগত  অভিজ্ঞতা আর গণমাধ্যমের প্রচারণায় মানুষের খাদ্যাভ্যাসের বিশেষত্বেও পরিবর্তন ঘটছে। ফলে ঈদের আয়োজনে বা ইফতারের আয়োজনে সবাই কাছাকাছি চলে আসছে, ব্যক্তির বিশেষত্ব কমছে। মূল কারণ বাজারের কেন্দ্রীয় ভূমিকা। আদতে বাজারই বলে দিচ্ছে এ বছরের ঈদের আয়োজনে কোন কোন আইটেমের কদর বাড়বে। একই কথা খাটে ইফতারের ক্ষেত্রেও। তাই প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে জানাতে হল - এখন পার্থক্য ঘটে ট্যাঁকের শক্তির ওপর। নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের অধিকাংশ মানুষের ঈদ শপিং-এর ঠিকানা ঢাকায় গাউছিয়া আর চট্টগ্রামে টেরিবাজার, রেয়াজুদ্দিন বাজার। যেগুলো নিয়ে গণমাধ্যম ও মিডিয়া ব্যক্তিরা চেঁচিয়ে মরেন সেখানে হাত দেওয়ার সাধ্যি নেই তাদের। আর দেশে এখনও সংখ্যায় কম নয় দরিদ্র মানুষ - জনসংখ্যার ৩০ ভাগ - যারা নিজের উপার্জনে রোজা বা ঈদের বিশেষ সংস্থান করতে পারে না। তাদেরই ২৭ জন এবারে প্রাণ দিলেন জর্দা-খেকোদের কল্যাণে হঠাৎ-নবাবের বাড়ির দরজায় তাঁরই বড়লোকি অবিমৃষ্যকারিতায়।
শেষ কথা : উপলক্ষের মূল শিক্ষা আর মৌলিক মানবিক নীতিবোধ বাদ দিয়ে কোনো উৎসব, ব্যবসা, উপলক্ষকে মানবিক রাখা মুশকিল। মনে মনে জানি, মুশকিল বললে কম বলা হয়, আদতে অসম্ভব।

***




Saturday, July 11, 2015

দুই প্রজন্মের আওয়ামী লীগ

আবুল মোমেন
১.
আওয়ামী লীগের জন্ম ১৯৪৯ সনে। মাত্র দু’বছর আগে জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগ সব স্তরের বাঙালি মুসলিমকে পরাধীনতা আর সামাজিক পশ্চাৎপদতার গ্লানি থেকে মুক্তির স্বপ্নে বিভোর করেই ধর্মীয় জাতীয়তার রাজনীতিতে টেনে পাকিস্তান এনেছিলেন। তরুণ শেখ মুজিবও ছিলেন মুসলিম লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী। কিন্তু বাস্তবে পাকিস্তান বাঙালির জন্যে নতুন পরাধীনতা ও নতুনতর পশ্চাৎপদতা সৃষ্টি করেছিল। প্রাচীনকাল থেকেই উত্তর-পশ্চিমের দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণের জাতগুলো অপেক্ষাকৃত কৃশকায় শ্যামবর্ণের বাঙালিকে - কি মুসলমান, কি হিন্দু-হীন জাতি হিসেবে অবজ্ঞা করে এসেছে। তাছাড়া উপমহাদেশে ইসলামের অ্যাকাডেমিক চর্চা হয়েছে উর্দুতে এবং ব্রিটিশ শাসকেরা উত্তর-পূর্বের মুসলিমপ্রধান অঞ্চলের শিক্ষার মাধ্যম করে দিয়েছিল উর্দুভাষা। ফলে মুসলমানদের জন্যে সৃষ্ট দেশের শ্রেয়তর নাগরিকের দাবিতে মুসলিম লীগের অবাঙালি প্রভাবাধীন নেতৃত্ব বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ববঙ্গকে উপনিবেশের দৃষ্টিতেই দেখেছে। তাদের জন্যে কাজটা সহজ হয়েছে বাঙালি অভিজাতদের মজ্জাগত হীনম্মন্যতা ও পরশ্রীকাতরতার কল্যাণে। হীনম্মন্য অভিজাতরা ক্ষমতাধরদের তোষামোদ ও চাটুকারিতায় ভোলাতে চেয়েছেন, এবং আত্মসম্মানের বিনিময়ে নিজেদের জন্যে ক্ষমতার কিছু প্রসাদ জুটিয়ে নিয়েছেন। আবার মজ্জাগত পরশ্রীকাতরতার কারণে তারা পরস্পর কলহে লিপ্ত থেকেছেন, ফলে এই ক্ষয়িষ্ণু বাঙালি নেতারা কেন্দ্রে কখনও ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারেন নি।
আমরা জানি ঐতিহাসিক কাল থেকেই বাংলার নিম্নবর্গের মানুষ বারবার বিদ্রোহ করেছে, রাজা ও রাজন্যদের বিরুদ্ধে রীতিমত যুদ্ধ করেছে। পাকিস্তান সৃষ্টির দু’বছরের মাথায় গঠিত দল আওয়ামী লীগকে বলা যায় সর্বসাধারণের রাজনৈতিক মঞ্চ। মওলানা ভাসানী এ দলের সভপতি হিসেবে যথার্থই ছিলেন। কিন্তু মুসলিম লীগ-ত্যাগী অভিজাতদের নিয়ে দল প্রায়ই সমস্যায় পড়েছে। দলে সাধারণদের মুখপাত্র ছিলেন তরুণ সংগঠক মুজিব। পালযুগে কৈবর্ত বিদ্রোহে যেমন বিদ্রোহী জেলেদের নেতা ছিলেন দিব্যক, ব্রিটিশ যুগে বিদ্রোহী চাষীদের নেতা ছিলেন নূর আল দীন বা তিতুমীর তেমনি এ সময়ে মুুজিব যেন বাংলার বঞ্চিত নিপীড়িত সাধারণের নেতা হয়ে ওঠার দীর্ঘ পথে যাত্রা শুরু করলেন। সাধারণের এই নেতা এক পর্যায়ে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়েছেন দলের অভিজাত নেতাদের নিয়ে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ক্ষুব্ধ নেতা লিখেছেন, ‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়। (পৃ. ২৭৩)
২.
দুটি কারণে আওয়ামী লীগ এদেশের উদীয়মান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। ভাষা-সংস্কৃতির প্রশ্নে এই শ্রেণি পাকিস্তানের শাসকদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয়ে উপযুক্ত রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন প্রত্যাশা করছিল এবং সব শ্রেণির অন্তর্ভুক্তিমূলক বঞ্চনামুক্ত সমাজের স্বপ্ন তাঁদের অধিকাংশকে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের আদর্শে উজ্জীবিত করেছিল। এই সচেতন দেশপ্রেমিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি একটি জাতীয়তাবাদী জাগরণের জন্যে উন্মুখ ছিল। ততদিনে পরিণত দূরদর্শী শেখ মুজিব এদেশে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির মূল প্রবক্তা এবং প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন। জননায়ক শেখ মুবিজকে ঘিরে গণজোয়ার এমন প্রবল হয়ে উঠেছিল যে একসময় বামপন্থী দলগুলোর জন্য হয় তাঁর সহযাত্রী হওয়া নয়ত বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য গতির উপায় থাকল না।
সেদিনে পরিস্থিতিই গণতান্ত্রিক দলে এবং গণতন্ত্র-প্রত্যাশী সমাজে একক নেতৃত্ব সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু তারই অনুষঙ্গ হয়ে আরও একটি ঘটনা ঘটেছে। চুয়ান্নর নির্বাচনে ভরাডুবির পর থেকে এখানে মুসলিম লীগের সংগঠন ভেঙে পড়েছিল, তাকে কেন্দ্রীয় সরকার ক্ষমতার প্রসাদ দিয়ে টিকিয়ে রাখছিল মাত্র। ফলে বিরোধী দল হলেও তখন থেকেই আওয়ামী লীগ এদেশের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের সবটা জুড়েই তৎপর ছিল। এটা রাষ্ট্রীয় না হলেও দলের সামাজিক ক্ষমতা ও প্রভাব ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে। আর পূর্ববঙ্গে পুরো ষাটের দশক জুড়ে রাষ্ট্রের ক্ষমতা সংকুচিত ও সমাজের ক্ষমতা প্রসারিত হয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ তখন থেকেই এদেশের বড় দল, ক্ষমতাধর দল। দীর্ঘদিন এই অবস্থানে অভ্যস্ত দলের নেতা-কর্মীরা স্বভাবতই ক্ষমতাধরের মনস্তত্ত্বে আক্রান্ত হয়েছে। যার যার পরিসরে কর্তৃত্ব, মুরুব্বিয়ানা এবং সেই সূত্রে সাঙ্গপাঙ্গসহ নিজস্ব কায়েমি স্বার্থের ক্ষমতাবলয় তৈরির প্রবণতা দেখা দেওয়া বিচিত্র নয়। এ প্রবণতাকে ঠেকানোর অস্ত্র যে-রাজনৈতিক আদর্শ, রাজনৈতিক শিক্ষা এবং গণতান্ত্রিক সাংগঠনিক কাঠামো তাকে অকার্যকর করে রাখার বিষয়ে এ ধরনের নেতাদের মধ্যে যোগসাজশ ঘটবেই। এর বিষময় ফল আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার পর থেকেই ভোগ করছে। হয়ত এখন তা আরও বেড়ে গেছে। আমরা সরাসরি আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্বকে উদ্দেশ্য করে হয়ত বলতে পারি, দেশকে এই অগণতান্ত্রিকতার বৃত্ত থেকে মুক্ত কারার দায়িত্ব আপনাদেরকেই নিতে হবে। মনে হয় না এতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব অখুশিও হবেন। কারণ এতে তো মান্যতাই প্রকাশ পায়, যাচ্ঞা করার মত আর কোনো বিকল্প আজও তৈরি না হওয়া তো তাদের জন্যে শ্লাঘারই বিষয়।
৩.
গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকারের জন্যে যারা প্রাণপাত করছি তারা কেন এই ক্ষমতাধর দলের বিকল্পের - যদি শূন্যতা নাও বলি - সংকট নিয়ে কথা বলছি না ? ১৯৪৮ এর জানুয়ারি থেকে - অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টির পাঁচ মাসের মাথায় - রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে যে নতুন জাতির ভ্রুণ তৈরি হয়ে ধীরে ধীরে আন্দোলন-সংগ্রামের ভিতর দিয়ে পূর্ণতা পেয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তার কাক্সিক্ষত পরিণতি কি বিএনপি নিশ্চিত করতে পারে? বিএনপি আন্দোলনের প্রশ্নে জামায়াতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছে। কিন্তু কেবল যুদ্ধাপরাধ নয় এ দল তো আদতে গণতন্ত্রেই বিশ্বাস করে না, ধর্ম ও লিঙ্গ-সমতাও তো মানে না যা গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত? সে দলকে সঙ্গে রেখে কী করে বায়ান্ন থেকে একাত্তরের লাখো শহীদের স্বপ্ন পূরণ হবে? যদি বিএনপির শক্তিশালী সক্রিয় সংগঠন থাকত তাহলে জামায়াতকে ক্ষমতার অংশীদার করা নিয়ে ততটা আশংকা থাকত না। কিন্তু বাস্তবতা হল বিপুল সমর্থক আছে বিএনপির, আর সংগঠন রয়েছে জামায়াতের। ফলে ক্ষমতার ফায়দা তারাই অনেক বেশি উশুল করবে। আর আন্তর্জাতিকভাবে ইসলামের নামে যেসব জঙ্গি গোষ্ঠী আজ মানবতাবিরোধী মারাত্মক সন্ত্রাস চালাচ্ছে তার শাখা-প্রশাখা এই মুসলিমপ্রধান দেশেও তো ছড়াচ্ছে। জামায়াত-বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় এলে তারা প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী হবে, কারণ জোটের অগ্রাধিকার পাবে আওয়ামী লীগ ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে দুর্বল করার পাল্টা প্রতিশোধ।
দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিকশিত করতে অবশ্যই আওয়ামী লীগের বিকল্প দল চাই। সে দল আওয়ামী লীগের চেয়েও এগিয়ে রাজনীতি করতে পারে যদি তারা একদিকে রাজনীতিতে সমাজের নিম্নবর্গের বিপুল জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং অন্যদিকে ইরাক-আফগানিস্তান-লিবিয়ার বিপর্যয়কে মাথায় রেখে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয়তার আদর্শকে ধারণ করে। বলে রাখা দরকার, বিগত ৬৬ বছরের ইতিহাসে আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে যে দলটি অত্যন্ত সজীব, এবং বাস্তবতা অনুধাবনে দক্ষ, এমনকি প্রয়োজনে সৃজনশীল হতেও সক্ষম। এভাবে দলটি ষাটের দশকেই বামপন্থীদের প্রায় অকেজো করে ফেলেছিল, এখন ইসলামপন্থী রাজনীতির ঘরে হানা দিতে সক্ষম হয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধুর এই দল শেখ হাসিনার নেতৃত্বেও বাঙালি জাতীয়তাবাদের মর্যাদার বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। আওয়ামী লীগ তার চেয়ে অগ্রসর রাজনৈতিক দলের জায়গা প্রায় পুরোপুরি দখল করে এখন তার চেয়ে পশ্চাৎপদ দলের জায়গায়ও দখল বাড়াচ্ছে। তা তাকে করতেই হচ্ছে কারণ সেদিকে সমর্থক-ভোটারের সংখ্যা বেশি বৈ কম নয়। পাশাপাশি মুক্তবাজার অর্থনীতি আর জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ দমনে কঠোরতার মাধ্যমে ভারত ও পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থনও ধরে রেখেছে। এটাই সুশাসন ও গণতান্ত্রিক মানদণ্ডে অকৃতকার্য হয়েও আওয়ামী লীগের ক্ষমতা নিশ্চিত থাকার কারণ।
ফল হল এই, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রশ্রয়ে-আনুকূল্যে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ক্ষমতা ভোগ করে যাওয়ার লাইসেন্স পেয়ে গেছে। মধ্যপন্থী দল হওয়ার সামর্থ্য রেখেও নিজের শক্তিতে নিজের স্বতন্ত্র জায়গাটি ধরে একা দাঁড়ানোর সাহস নেই বিএনপির। ফলে আপাতত পাল্টা প্রশ্ন হল একা হাসিনা কি দলে ভিড়ে থাকা উচ্চাভিলাষী, ভাগ্যান্বেষী তরুণ বা পাতিনেতাদের সামলাতে পারবেন? মনে হয় না এটা সম্ভব। এদের হাতে দিনে দিনে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে এবং তাতে তিনি তো ভুগবেনই, ডুববে দেশ। এতে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নেত্রী ক্ষমতা, অধিকতর ক্ষমতার নিশ্ছিদ্র সুরক্ষায় বন্দী হয়ে যাবেন, তার প্রতিক্রিয়ায় অন্যদের স্বাধীনতাও হ্রাস পাবে, গণতন্ত্র আরও সংকুচিত  হবে। তাছাড়া তলে তলে রাজনৈতিক সংকট গভীরতর হতে থাকবে।
তাহলে বাংলাদেশ কি আপাতত আওয়ামী লীগপন্থী ও আওয়ামী লীগ-বিরোধী রাজনীতিতে বিভক্ত হয়েই থাকবে? মনে হয় নাগরিক সমাজ এক্ষেত্রে কিছু করতে পারে। এক. আওয়ামী লীগের ওপর আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি ও দল-পরিচালনার প্রক্রিয়া প্রবর্তনের জন্যে চাপ তৈরি করতে পারে। দুই. রাজনীতিকে আর্থিক দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অস্ত্র ও কালোটাকা থেকে মুক্ত রাখার জন্যেও চাপ তৈরি করা যায়। তিন. ইসলামের প্রকৃত মানবিক সহনশীল রূপটি তুলে ধরে মুসলিমসমাজেও যে বহুমতের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যুগপৎ ইসলাম ও সুশাসন ভালোভাবেই বিকশিত হতে পারে তার পক্ষে জনমত তৈরি করতে পারে। চার. পুরোনো সমাজব্যবস্থা ও ধ্যানধারণার অচলায়তন ভেঙে সমাজের নবায়ন ঘটিয়ে সত্যিকারের মানবিক বিকাশমান সমাজ কায়েমে কাজ করতে পারে। ইতিহাসের আলোকে গণতান্ত্রিক সমাজের বিকাশের ধারা এবং ধর্মান্ধ রক্ষণশীল সমাজের সংকটের প্রেক্ষাপটে এই বিষয়গুলো বিচার-বিবেচনা করে দেখা উচিত।
কোনো সমাজ যথার্থভাবে গণতন্ত্রের উপযোগী হয়ে উঠলেই কেবল কর্তৃত্ববাদী শাসনের হাত থেকে মুক্তি পেতে পারে। এমনকি সে কাজ শেখ হাসিনাও করতে পারেন যদি ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বেড়াজাল তিনি ভাঙতে চান।
***


Saturday, July 4, 2015

৬৬ বছরের আওয়ামী লীগ

আবুল মোমেন

দেশের বৃহত্তম ও প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সম্প্রতি দলের ৬৬ বছর পূর্তি উদযাপন করল। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠনে শেখ হাসিনা বলেছেন দেশে দুটি রাজনৈতিক ধারাই আছে - আওয়ামী লীগ ও এন্টি আওয়ামী লীগ। এ কথা তিনি আগেও বলেছেন, নাগরিকসমাজেরও কেউ কেউ একই কথা বলে থাকেন। কথাটা ভুল বা মিথ্যা নয় বলেই মনে হয়।
মুসলিম লীগের বিকল্প হিসেবেই আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের চিন্তা মাথায় এসেছিল মওলানা ভাসানি, শামসুল হক, শেখ মুজিবের। সেজন্যেই তাঁরা মুসলিম লীগ নামটির আগে বিশেষণ হিসেবে আওয়াম বা সাধারণ জনের কথাটা যুক্ত করেছিলেন। মুসলিম লীগে ভীড় করেছিলেন ভারতবর্ষের মুসলমান অভিজাতরা। বাঙালি মুসলিম সমাজে তখন বংশগত অভিজাত পরিবার কম। এখানে কৃষক পরিবারের শিক্ষিত সন্তানরাই মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে অভিজাত্য গৌরব বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানভুক্ত অন্যান্য অঞ্চলে জনবিচ্ছিন্ন ছিল মুসলিম লীগ। তাই অবিভক্ত ভারতে বাংলা-ভিন্ন পাকিস্তানে যুক্ত হওয়া অন্য কোনো প্রদেশে মুসলিম লীগ বিজয়ী হতে পারে নি।
মুসলিম লীগ সমাজ থেকে উঠে আসা দল নয়। মুসলমানদের সেরকম সংগঠনও ছিল, যেমন জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দ, তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া, মুসলিম সাহিত্য সমাজ, রেনেসাঁ সোসাইটি ইত্যাদি। কিন্তু এদের শেষের দুটি অরাজনৈতিক সংগঠন, অন্য দুটির রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রধান এজেণ্ড ছিল ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম। ফলে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার হিন্দু মুসলিম উভয় স্বাধীনতাকামীর বিপক্ষে দাঁড় করানোর লক্ষ্যেই সৃষ্টি করেছিল মুসলিম লীগ। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট দল ক্ষমতা বা ক্ষমতার প্রসাদ ভিন্ন টিকে থাকতে পারে না। তদুপরি পড়ে পাওয়া ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে কামড়া-কামড়ি হওয়াই স্বাভাবিক। এ হল অভিজাতদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব। তাতে রাজনীতিতে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, স্বার্থের চক্রান্ত, আপোসকামিতা, লেজুড়বৃত্তি, রাজনীতিকদের ডিগবাজি খাওয়া ইত্যাদি নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই এসব খেলা শুরু হয়ে যায়। তাতে অন্তত তরুণ শেখ মুজিব বুঝেছিলেন এসব নেতাদের নিয়ে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার রাজনীতি হবে না। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে খেদের সাথে এই উপলব্ধির কথা তিনি লিখেছেন - ‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’ (পৃ. ২৭৩) তাঁর এ উপলব্ধি অবশ্য আরও পরের, চুয়ান্ন সনে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে কেন্দ্রীয় সরকার এদেশে ৯২/ক ধারা জারি করার পর নেতাদের ভীরুতা, আপোসকামিতার পরিপ্রেক্ষিতে।
কিন্তু সংবেদনশীল, সাহসী, জনদরদী এই রাজনৈতিক কর্মী গোড়া থেকেই নেতৃত্বের এই দোদল্যমানতা ও স্বার্থকামিতা খেয়াল করেছেন। ফলে মুসলিম লীগের বিকল্প দল গঠন অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল তাঁর জন্যে। সেভাবে দলটি আওয়াম মুসলমান বা আমমুসলমান অর্থাৎ মুসলিম জনগণের দল হিসেবে গড়ে উঠেছিল। পরে ভাষা আন্দোলন এবং যুক্তফ্রন্টের অভিজ্ঞতায় তিনি উপলব্ধি করেন পূর্ব বাংলাকে ঘিরেই তাঁর রাজনীতি আবর্তিত হবে। ফলে তার রাজনীতির জন্য মুসলমান পরিচয় নয় বাঙালি পরিচয়ই হল প্রধান বিষয়। এভাবে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ পড়ল। এ দলটি হয়ে উঠল ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে আম বাঙালির দল। রাজনীতির হাল ধরেই শেখ মুজিব একজন রাজনৈতিক কর্মী থেকে জাতির নায়ক ও পিতা হয়েছেন। আওয়ামী লীগ প্রতিপক্ষ মুসলিম লীগের বিকল্প দল থেকে বাঙালিমাত্রের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছিল।
তবে ইতিহাসের পথ অনেক দূর পাড়ি দিয়েও বাঙালি মুসলমান তার আত্মপরিচয়ের সংকট আজও কাটাতে পারে নি। এই মুসলিম আইডেন্টিটি আর তার সাথে ক্ষমতার ষড়যন্ত্র বরাবর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকিয়েছে। নানা নামে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ বা এই মুসলিম আইডেন্টিটির রাজনীতি পাকিস্তান আমল জুড়ে এ কাজ করেছে।
বাংলাদেশেও এর পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায় নি। ১৯৭৫ এর পরে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের মত ঠিক এই কাজটি করেছেন জিয়াউর রহমান। ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারের গর্ভেই যেমন  আইউবের কনভেনশন লীগের জন্ম তেমনিভাবে জন্ম জিয়ার বিএনপির। আইউব যেমন দল গঠনের আগে রাজনীতিবিদদের জন্যে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে এবডো (ইলেকশন বডিজ ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার) জারি করেছিলেন জিয়াও তাঁর দল গুছানোর সময় নেওয়ার জন্যে সরাসরি রাজনীতিই নিষিদ্ধ করেছিলেন। উভয় সরকার-প্রধানই প্রগতিশীল শক্তির জন্যে জেলজুলুমের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, উভয় জেনারেলেরই মূল টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করা। একজন বিশেষভাবে জীবিত শেখ মুজিবকে নানাভাবে বিনাশের চেষ্টা করেছেন। আরেকজন নিহত বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন থেকে গেলেন, আর অনুপস্থিত নেতার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু প্রতিবারই আওয়ামী লীগ সকল বাধা ডিঙিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়েছে, পরিস্থিতি সামলেছে।
বর্তমান বাস্তবতায়ও আমরা দেখছি ক্ষমতায় বসে জেনারেলরা যে দুটি দল তৈরি করেছেন তাদের পক্ষে কোনো কালে নিজস্ব রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সংগঠন দাঁড় করানো সম্ভব হয় নি। মুসলিম লীগ যেমন ১৯৫৪ সনে প্রদেশে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জায়মান বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সামনে দাঁড়াতে পারেনি কখনও, বর্তমানে ক্ষমতাচ্যুত বিএনপিও সরকারি চাপে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক বিপর্যয়ে পড়েছে। এ বিপর্যয় দলটি কাটাতে পারবে কিনা বলা মুশকিল। আর এরশাদের জাতীয় পার্টিকে সরকারের লেজুড় হয়েই টিকে থাকতে হচ্ছে।
তবে মনে রাখতে হবে এটি একদিকে একটি প্রতারক ফাঁদ আর অন্যদিকে বিপজ্জনক পরিস্থিতি। প্রতারক এ জন্যে যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার এ দলগুলো দুর্বল হওয়ার অর্থ কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পথ নিরঙ্কুশ হওয়া নয়। কারণ রাজনীতির এত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এবং সর্বস্তরে বিশ্বায়ন-আধুনিকায়নের প্রভাব পড়া সত্ত্বেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এখনও আত্মপরিচয়ের বিভ্রান্তি কাটাতে পারে নি এবং তাই এদেশের রাজনীতিতে ইসলাম ও ধর্মান্ধতার ভূমিকা থেকে যাচ্ছে। ফলে এর মধ্যে ভুল বোঝার সম্ভাবনা থেকে যায়। আর এর বিপজ্জনক দিক হল, যদি প্রতিপক্ষ-শক্তি দুর্বল ও অকেজো হয়ে পড়ে, তবে ক্ষমতাসীন দলের হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা পুঞ্জিভূত হয় এবং তাতে তাদের ফ্যাসিবাদী রূপ ধারনের সমূহ সম্ভাবনা থাকে। বলা বাহুল্য, এতে গণতন্ত্র সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে, দেশের ভবিষ্যতও অনিশ্চিত হয়ে যায়। তাই যেকোনো অবস্থাতেই দেশের সচেতন নাগরিক সমাজকে আজ অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। তাঁদেরই গণতন্ত্র রক্ষা ও এর বিকাশে সক্রিয় এবং সোচ্চার হতে হবে।

***