Friday, December 4, 2015

সন্ত্রাসের চক্রে জড়িয়ে পড়া কার স্বার্থে?

আবুল মোমেন

একটি সন্ত্রাসী হামলা পাল্টা সন্ত্রাসী হামলার সম্ভাবনাই তৈরি করে। প্রতিটি সন্ত্রাসের ঘটনা নৃশংসতার প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। সন্ত্রাস আরও সন্ত্রাস, নৃশংসতা আরও নৃশংসতার জন্ম দেয়। প্যারিসে গত শুক্রবার রাতের নৃশংস সন্ত্রাসের পরপর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোয়াঁ ওঁলাদ প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় নৃশংস প্রতিশোধের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় ফ্রান্সের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এই হামলা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটবে উগ্র জাতীয়তাবাদী বিদেশি বিদ্বেষী মেরি লিপেনের ন্যাশনাল ফ্রন্ট। প্রতিশোধেরই প্রতিজ্ঞা থেকে আইএস আত্মঘাতের মাধ্যমে পশ্চিমের সাংস্কৃতিক রাজধানী প্যারিসে হামলা চালিয়েছে। প্রতিশোধ ও জিঘাংসা প্রতিশোধ ও জিঘাংসারই জন্ম দিয়েছে। যুদ্ধের মাধ্যমে যুদ্ধকে থামানো যায় না এই উপলব্ধি থেকেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তির পর বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন - যুদ্ধকে জয় করা গেছে, শান্তিকে নয়। তাঁর বাণী সত্য হয়েছে। বলা হয়ে থাকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে সারা বিশ্বে ছোটখাট যুদ্ধে মহাযুদ্ধের চেয়েও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
তদুপরি একথাটাও মনে রাখতে হবে হিংসা বা সন্ত্রাস কখনো ঐক্যের ভিত্তি হতে পারে না। ফলে মুসলিম বিশ্ব, বিশেষত আরবের দেশগুলো তাদের অনৈক্য ও বিভেদের পথেই চলবে। কিন্তু আক্রান্তরা মতপার্থক্য ভুলে সবসময়ই দ্রুত ঐক্যবদ্ধ হয়। পশ্চিম, বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, দ্রুত বৃহত্তর কার্যকর ঐক্য গড়ে তুলবে এবং প্রতিপক্ষের ওপর দ্বিগুণ শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। প্রশ্ন হল, তাদের তখন বিশ্বস্ত বান্ধব সৌদি রাজতন্ত্র কি পক্ষ বদল করবে? উত্তরটা আমাদের জানা আছে।
বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে সমাজে হানাহানি, বিভ্রান্তি ও অশান্তি যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলতে থাকে তখনই শান্তির বাণী নিয়ে নানান ধর্মের আবির্ভাব ও বিভিন্ন ভাবান্দোলনের সূচনা হয়েছে। ইসলাম এরকমই এক অরাজক অবস্থায় নাজেল হয়েছে এ কথা বিশেষভাবে বলা হয়ে থাকে। ধর্মের তাৎপর্য এবং সাফল্য নির্ভর করে মানুষের মধ্যে শান্তি, সমঝোতা ও সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরির সামর্থ্যরে ওপর। দুর্ভাগ্যে বিষয় ধর্মের নামেই পৃথিবীতে হানাহানি হয়েছে  সবচেয়ে বেশি। ঐতিহাসিকরা বলেন রাজ্য জয় বা রাজনৈতিক কারণে যত যুদ্ধ ও প্রাণহানী ঘটেছে তারচেয়ে বেশি হয়েছে ধর্মের নামে। কেন এমনটা ঘটেছে বা ঘটে থাকে তা ঘটনাগুলো তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে।
বিশ্বের বড় সব ধর্মই বিস্তার লাভ করেছে শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে। ইসলামের প্রথম যুগে মুসলিম সমাজে খলিফাই ছিলেন শাসক। আদি খ্রিস্টান সমাজে কিছুকাল রাজা ও ধর্মগুরু একই ব্যক্তি হলেও রাজার পাশাপাশি পোপ এবং শক্তিশালী যাজকসম্প্রদায়ের উত্থান হলেও ফরাসি বিপ্লবের পরে রাষ্ট্র ও চার্চ পৃথক হয়ে যায়। কিন্তু কেবল রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমেই তো ধর্মের বিস্তার ঘটে নি, খ্রিস্টানদের যেমন মিশনারি মুসলমানদের তেমনি পীর-দরবেশ, জ্ঞানী-গুণী, ফকির-সাধুদের মাধ্যমে ধর্ম নতুন নতুন দেশ ও সমাজে বিস্তৃতি লাভ করেছে। এটি শাসকদের জন্যে নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছিল। আব্বাসীয় খলিফাদের আমল পর্যন্ত বৃহত্তর পারস্য সাম্রাজ্য, ভারতবর্ষ, উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনে ইসলামের বিস্তার ঘটেছে। এ সময়ে মূলত ফারসি ভাষার মাধ্যমে ইসলামি মনীষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। আন্দালুসিয়ার মুসলিম মনীষীরা ল্যাটিন ও গ্রিক শিখেছিলেন এবং প্রাচীন গ্রিক ও রোমান জ্ঞান ভা-ার থেকে বহু মূল্যবান বই অনুবাদ করেছিলেন। মুসলিম দার্শনিক, বিজ্ঞানী, কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীদের তখন বিশ্বজয়ী অবস্থান।
প্রাচীন গ্রিক, রোমান এবং পারস্যের সমৃদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূল্যবান অনেক কিছুই আত্মীকরণের মাধ্যমে মুসলিম সভ্যতার অবিস্মরণীয় অগ্রগতি ঘটিয়েছিলেন। সমঝোতা ও সমন্বয় গভীর প্রজ্ঞার পথ খুলে দিয়েছিল। মনে রাখা দরকার প্রাচীন পারস্যসভ্যতা কেবল বর্তমান ইরানে সীমাবদ্ধ ছিল না, তার বিস্তার ছিল মধ্য এশিয়া পর্যন্ত, প্রভাব ছিল আরও ব্যাপক। ইসলামের প্রভাব এই সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভেতর থেকে কেবল মরমি সুফিবাদ নয় জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা শাখায় অসামান্য সব অবদান সৃষ্টি করেছে। পারস্য থেকে মরক্কো হয়ে স্পেন অবধি বিস্তৃত ছিল সম্পন্ন মুসলিম সভ্যতা, যার অবদানই ইউরোপীয় রেনেসাঁস ও আলোকনের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে।
মুসলিমদের এই সমৃদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতিকেই মধ্য এশিয়া থেকে মুঘলরা ভারতবর্ষে নিয়ে এসেছিল এবং এর প্রভাবে সমৃদ্ধ প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় ও সংস্কৃতিতে স্থায়ী রূপান্তর ঘটিয়েছে। এই অবদান ও এই সত্য কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। নরেন্দ্র মোদী বা তাঁর দলবল যতই ঘর ওয়াপসির ধুয়া তুলুক তাতে ভারতীয় সংস্কৃতিতে মুসলিম প্রভাব মুছে ফেলা যাবে না।
বিশুদ্ধতাবাদীরা আদি ইসলামের কথা বলে ইতিহাসকে - অর্থাৎ ইসলামের অগ্রযাত্রার ইতিহাসকেই - অস্বীকার করতে চাইছেন। ইতিহাসের যাত্রাপথ একরৈখিক নয়, মসৃণ নয়, বারবার কঠিন সব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে, সেসব মোকাবিলা করে তবেই এগুতে হয়। লক্ষ্য করব শাসকদের দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার সহযোগিতায় ইসলামি বিশ্বের - তীর্থ ঠিক থাকলেও - রাজধানী বা জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র বদল হয়েছে। মদিনা, দামেস্ক, বাগদাদ, কর্ডোভায়  তা স্থানান্তরিত হয়েছে। অটোমান সাম্রারাজ্যে ইস্তাম্বুলই ছিল কেন্দ্র, যদিও তখন বৃহত্তর পারস্যে অনেক উপকেন্দ্র ছাড়াও ভারতবর্ষে মুসলিম সমাজের সমৃদ্ধি ও অবদান বাড়ছিল। এসবই তো মুসলমানদের কীর্তি - এসবকে অস্বীকার করলে তাতে ইতিহাস কি অসত্য হবে না? কিংবা তাতে মুসলমানদের গৌরব বাড়ে না দৈন্য?
দীনতার অহঙ্কারের দাপটের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। চিত্তের দৈন্য যেমন আত্মিক দৈন্যও তেমনি ভয়াবহ - ভয়ঙ্কর এর পরিণতি, কারণ এটা প্রায়ই আত্মঘাতী পরিণতির তোয়াক্কা করে না। আত্মঘাতী হওয়াটা ইসলামসম্মত নয় জেনেও যাঁরা তরুণদের আত্মঘাতী হওয়ার প্রেরণা দিচ্ছেন তাঁরা কাদের অস্বীকার করছেন? আল্লামা রুমী, আবদুল কাদের জিলানি (রা.), খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রা). কিংবা ইবনে সিনা, ইবনে খালদুন, আল বিরুনীদের অস্বীকার করতে হবে? হাফিজ, ফিরদৌসী, খৈয়ামের মত মহাকবিদের? নজরুলকে?
একেই বলে অন্ধতা, ধর্মান্ধতা।
পশ্চিমের স্বার্থবুদ্ধির কূটচালগুলো যেমন ক্ষমতান্ধ বিলাসী শাসকরা - যেমন সৌদি বাদশাহ - বুঝতে অপারগ তেমনি বুঝতে পারে না ধর্মান্ধ আত্মঘাতী মানুষ, যেমন আইএস। অথচ পশ্চিম বারবার প্রাচ্য ও আফ্রিকাকে পর্যদুস্ত করতে পারছে তার কারণ ক্রুসেড যুদ্ধে পরাজয়ের পর মুসলমানরা যখন দিশেহারা তখন তাদেরই মনীষীদের চর্চিত জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সহায়তায় এরা এগিয়ে গেছে। প্রাচীন ভারতের হিন্দু জ্ঞান ও বিজ্ঞান একসময় সবচেয়ে এগিয়ে ছিল, তাদের গতি থামার পেছনে ধর্মান্ধতা বড় কারণ। তারপর চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম মনীষীরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় সবচেয়ে অগ্রসর ছিলেন, কিন্তু তারও যে গতি রুদ্ধ হল তার পেছনে যত কারণই থাক, তা কাটিয়ে উঠতে না পারার কারণ কিন্তু ধর্মান্ধতা।
ধর্ম কি পিছুটান হয়েই থাকবে? পিছনে যাওয়ার প্রেরণা দেবে না এগিয়ে চলার? আত্মঘাতী হয়ে এগুনো যায় না, হয়ত প্রতিশোধ নেওয়া যায়, জিঘাংসা চরিতার্থ করা যায়। কিন্তু তাতে জড়িয়ে পড়তে হয় হিংসা-সন্ত্রাসের ক্রমবর্ধমান বিষাক্ত এক চক্রে। এই পরিণতিকে সুফল বলব না বলব হিংসার খেসারত?
আরব বিশ্বের প্রতি পশ্চিম অবশ্যই অবিচার করছে। নিরস্ত্র মানুষকে গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করা যেমন তেমনি ড্রোন হামলা চালিয়ে বাছবিচারহীন হত্যাকা-ও নিকৃষ্ট  অপরাধ। কিন্তু আরব জনগণ কি নিজেদের দেশে পশ্চিমের তাঁবেদার শাসকদের টিকিয়ে রেখে তাদের সহযোগিতা করছে না? অথবা অন্য কথায়, নিজেদের প্রতি একই অবিচার করছে না? নিজের দুর্বলতা রেখে কোনো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই বিজয়ী হওয়া যায় না। নিজেদের দেশে দেশে শক্তিশালী বিভীষণদের ক্ষমতায় বসিয়ে রেখে প্যারিস বা বার্লিনে, নিউইয়র্ক বা ক্যানবেরায় রক্তবন্যা বইয়ের দেওয়া যাবে কিন্তু তাতে পরিস্থিতি পাল্টাবে না। দেশে দেশে মুসলিমসমাজ আরও বিভ্রান্ত হবে, হয়ত হানাহানিতে, ভ্রাতৃঘাত ও আত্মঘাতে জড়িয়ে পড়বে। এ মর্মান্তিক পরিণতি হয়ত পশ্চিমের জন্যে তামাশার বেশি হবে না।
ইসলামের গৌরব অনুভব করতে হবে, গৌরবময় ইতিহাস উপলব্ধি করতে হবে। তেমনি মানবসভ্যতার অর্জনসমূহের - ধর্মবর্ণ অঞ্চল নির্বিশেষে - উত্তরাধিকার স্বীকার করতে হবে। সত্যকে বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে বাস্তবকে পাল্টানোর কাজে সফল হওয়া যায় না। অন্ধতা সত্য কি বাস্তব দুটিরই উপলব্ধির পথ বন্ধ করে দেয়, অনুভূতি দেয় ভোঁতা করে, এবং মানুষ হিসেবে অর্থাৎ মানুষের মানবিক সত্তাকে, দুর্বল করে দেয়। অমানবিকতা না মনুষ্যত্বের পথ ধর্মের। এ নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়া কি মানুষের শোভা পায়?

***


বিএনপির প্রয়োজন দূরদর্শী সিদ্ধান্ত

 আবুল মোমেন

সরকারের দমনপীড়নের মুখে বিএনপি চুপসে গেল। বারবার চেষ্টা করেও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। অনেকবারই তোড়জোর করে ঘুরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল দল, কিন্তু মামলা-মোকদ্দমা আর গ্রেপ্তার-শাস্তির চাপে হাল ছেড়ে দিতে দেখা যাচ্ছে।
আমরা নিশ্চয় বিরোধী দলের ওপর সরকারের এই বলপ্রয়োগের নীতিকে সমর্থন করি না। গণতন্ত্রে বিরোধী মত এবং বহুমত থাকবেই। ফলে সরকারের এই অসহিষ্ণুতা নিন্দনীয়।
এই নিন্দা প্রকাশের সাথে সাথে একটু বিস্ময়ও বোধ না করে পারি না যে বিএনপি কেন কোনো আন্দোলন তৈরি করতে পারল না। বিএনপি নেতৃত্ব এ নিয়ে নিশ্চয় ভাবেন, তবে তাঁদের ভাবনা যেন মূলত সরকারের ভূমিকা ও বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ সরকারি বেপরোয়া পীড়নের মুখে মাঠে নামতে পারছে না কর্মীরা এই অভিযোগই তারা জানাচ্ছে, জনসম্পৃক্ত কোনো ইস্যুতেই তারা মাঠে নামছে না।
অতীতে বাংলাদেশ এরকম পরিস্থতি দেখেছে। ছয় দফার আন্দোলনের সময় আইয়ুব-মোনেম আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের প্রায় সকল প্রধান নেতাকেই জেলে ঢুকিয়েছিল, মামলা-মোকদ্দমায় ফাঁসিয়ে রেখেছিল। তখন দলের মহিলা নেত্রীরা, তরুণ নেতা, ছাত্র সংগঠন ও অন্যান্য অঙ্গ সংগঠন নানা কৌশলী কর্মসূচী দিয়ে তাদের রাজনীতিকে চাঙ্গা রেখেছিল। বিএনপির এসবই আছে, কিন্তু তারা নিষ্ক্রিয়, কেবল ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে তাদের চেহারা ও কণ্ঠস্বরটুকু পাওয়া যাচ্ছে। রাজনীতিতে এটুকুতে কাজ হবে না। হচ্ছেও না।
এর মূল কারণটা বলা দরকার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দুটি পর্ব কেবল গৌরবময় তা নয়, দেশের স্বাধীনতার পেছনে মূল ভূমিকা এ দুটিরই - একটি ভাষা আন্দোলন ও  ভাষা-ভিত্তিক জাতীয়তার পক্ষে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন আর অন্যটি হানাদার-দখলদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। এই দুটি সংগ্রামেই আওয়ামী লীগ কেবল ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকে নি, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। এ হল বাস্তবতা। বিএনপি স্বাধীনতা-পরবর্তী দল, ফলে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী আন্দোলনে তার যুক্ত থাকার সুযোগ ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজনীতি দাঁড় করাতে গিয়ে তারা দেশের ইতিহাসের গৌরবময় দুই পর্ব সম্পর্কে নিজেদের অবস্থানকে দুর্বল তো রেখেছেই, ক্ষেত্রবিশেষে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একুশে ফেব্রুয়ারি বা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার সাথে সম্পৃক্ত বাংলা নববর্ষ, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী, লালন উৎসব ইত্যাদিতে এ দলের ভূমিকা নেই বললেই চলে। অথচ স্বাধীনতার পূর্ব বা পরবর্তী যে কোনো সামরিক-স্বৈরাচারের আমলে যখন প্রত্যক্ষ রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা চলে বা রাজনীতিকদের পক্ষে কাজ করা মুশকিল হয় তখন এসব উপলক্ষকে ঘিরে ছাত্র সংগঠন ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানই মাঠে সক্রিয় থেকেছে ও রাজনৈতিক ইস্যুগুলোকে জিইয়ে রেখেছে। আর এসব উদ্যোগের রাজনৈতিক সুফল একচেটিয়াভাবে পেয়েছে আওয়ামী লীগ।
বিএনপির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে একদিকে বাংলাভাষা, বাংলা সাহিত্য, রবীন্দ্র-নজরুল-বাউলের গানসহ বাঙালি সংস্কৃতি এবং অন্যদিকে মুক্তযুদ্ধের প্রকৃত আদর্শ ও চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুসহ এর নেতৃত্ব সম্পর্কে কী ভাবনা তা স্পষ্ট নয়।
স্পষ্ট হল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামির সাথে গাঁটছড়া, এবং তারই সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি পক্ষপাত, এমনকি দেশের ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রতি সহানুভূতি।
একটা বিষয় স্পষ্ট, এদেশের সিংহভাগ মানুষ ধর্মে মুসলমান এবং যথেষ্ট ধর্মভীরু বটে কিন্তু ভাষা, সাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অতীতের বিভ্রান্তি তারা কাটিয়ে উঠেছে। আর যে দেশের সিংহভাগ মানুষ তরুণ তাদের মনোভাবটাও বোঝা দরকার। তাদের কেউ কেউ জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকছে বটে কিন্তু তা-ও ঘটছে সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা বিশ্বের ইরাক-লিবিয়া-আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্য নীতির কারণে। অধিকাংশ তরুণ তার মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের অংশীদার হতেই ভালোবাসে। বাংলাদেশ এ দুটি অধ্যায় ও অর্জনকে কী করে অস্বীকার করবে?
তদুপরি নাগরিকসমাজের সচেতন ও সৃজনশীল অংশ আপোসহীন আবেগের সাথে এ দুটি বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। বিএনপি নেতৃত্ব এ বিষয়টি হয় অনুধাবন করছে না অথবা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর গুরুত্ব স্বীকার করছে না।
এর ফলে সাধারণভাবেই ছাত্র ও সচেতন নাগরিকদের কাছে বিএনপির আবেদন কমে গেছে। বরং জামায়াত, যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে। আর একুশের বইমেলা, বাংলা নববর্ষ, রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী, লালনমেলা, বাউল উৎসব ইত্যাদি বাঙালির প্রাণের উৎসবে কোথাও বিএনপি নেতা বা বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয়তা বা অংশগ্রহণ দেখা যায় না। এভাবে সমাজের সচেতন সক্রিয় সৃজনশীল অংশের কাছে বিএনপি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে।
এভাবে সমাজের মূলধারার বিপরীতে বা বাইরে থাকতে গিয়ে, অনেকের সন্দিগ্ধ মনে প্রশ্ন জাগছে, দলটি কি নানা ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়ছে না?
সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র চলছে সত্য। সাধারণত সরাসরি মাঠের রাজনীতি সম্ভব না হলে যেসব বিকল্পের সন্ধান করে বিরোধী শক্তিগুলো তার একটি ষড়যন্ত্র। অতীতে আওয়ামী লীগ বিকল্প হিসেবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ছাত্র আন্দোলনের সহায়তা নিয়েছিল ও পেয়েছিল। ফলে তারা পাক সরকারের ষড়যন্ত্রের শিকার হলেও নিজেরা ষড়যন্ত্রে জড়ায় নি। এতে আখেরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মাথা উঁচু করে বিজয়ী বেশে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে দলটির পক্ষে। বিএনপি এ ধরনের প্রকাশ্য প্রত্যক্ষ রাজনীতি বা রাজনৈতিক কার্যক্রম দাঁড় করাতে পারছে না। মাঝে মাঝে তাদের কোনো কোনো নেতা বা জোটভুক্ত সংগঠনের নেতা-কর্মী কিংবা সমর্থক নাগরিকদের গোপন তৎপরতার সন্ধান মিলছে। এতে রাজনৈতিক আন্দোলন দাঁড় করানো আরও কঠিন হয়ে পড়বে বিএনপির জন্যে।
আমার মনে হয় মাঠের অবস্থা ও বাস্তবতা পর্যালোচনা করে বিএনপিকে তার নীতি-আদর্শ ও কার্যক্রম ঠিক করতে হবে। আজকের দিনে রাজনীতিতে ধর্ম ও ভারতবিরোধিতার ধুয়া তুলে ব্যাপক কোনো আন্দোলন বা সুবিধা আদায় করা যাবে না। নাগরিকসমাজ ও বামপন্থীরা পরিবেশ রক্ষার যে ধারাবাহিক আন্দোলন করছে তাতে বিএনপি নেই। সাম্প্রতিক ইস্যুভিত্তিক যেসব আন্দোলন - যেমন নতুন পে স্কেল নিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলন, তাতেও এ দলটি নেই, নেই তাদের কোনো বক্তব্য। যেখানে নাগরিকসমাজ অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে ভাষা-সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে একটি প্রগতিশীল অবস্থানেই রয়েছে সেখানে তাদের পক্ষে বিএনপিকে সহজাত বন্ধু ভাবা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের জন্যে এ অনেকটা সরকারকে নিজের ঘরের মানুষদের সামলানোর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ বাস্তবতায় বিএনপি দর্শকে পরিণত হচ্ছে।
আবার বিএনপির প্রতি সরকারি আচরণকে সমর্থন করতে না পারলেও বিএনপির অবস্থানের কারণে সচেতন জনগণ ও ছাত্রতরুণরা অধিকাংশই এসব ইস্যুতে দর্শকের ভূমিকাই পালন করে যাচ্ছে।
দর্শকের ভূমিকা থেকে খেলোয়াড়ের ভূমিকায় তারা কি এক হবে? সেটা নির্ভর করবে বিএনপির নেতৃত্বের দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ওপর। সেটা কি অদূরভবিষ্যতে তারা নিতে পারবে?


***