Sunday, September 28, 2014

আরবদেশে মুক্তি কোন্ পথে?

আবুল মোমেন

কয়েকটি ছোট ছোট প্রশ্ন তোলা যাক।
সাদ্দাম হোসেনকে একনায়কত্বের পথে শক্তি জুগিয়েছে কে?
ইরানের বিরুদ্ধে সাদ্দামকে অস্ত্রসজ্জিত করে যুদ্ধে ঠেলেছে কে?
আফগানিস্তানের তালিবানদের অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সংগঠিত করেছে কে?
ওসামা বিন লাদেন ও আল-কায়েদার পৃষ্ঠপোষক ছিল কে?
পিএলও-র বিপক্ষে হিজবুল্লাহর উত্থানে মদত দিয়েছিল কে?
ইজরায়েলকে আরবদের বিরুদ্ধে একতরফা পক্ষপাতমূলক সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে কে?
এ ছ’টি প্রশ্নের উত্তর একটিই - যুক্তরাষ্ট্র।
আজ এটা পরিস্কার এই সব মানুষ ও সংগঠনের উত্থান সেসব অঞ্চলের জন্যে কল্যাণকর হয় নি।
আরও কয়েকটি প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক বলেই উত্থাপন করা দরকার।
ইরাকে আক্রমণ চালানোর জন্যে গণ-ধ্বংসাত্মক অস্ত্র মওজুদের অজুহাত কি সত্য ছিল?
প্যালেস্টাইনি নেতা ইয়াসির আরাফাতকে সন্ত্রাসী আখ্যা দেওয়া কি সঠিক ছিল?
ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরে ইরাকে কি শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?
একতরফা ব্যবস্থার মাধ্যমে আফগানিস্তান সমস্যার কি যথাযথ সমাধান করা গেছে?
চারটি প্রশ্নেরই উত্তর একই - না।
আমরা দেখছি এ সব অঞ্চলে ভোগান্তি আরও বেড়েছে, প্রাণহানি অব্যাহত রয়েছে, রক্তপাত ও ধ্বংস চলছেই। শত্র“তারও অবসান হচ্ছে না।
উপরের প্রশ্নোত্তর পর্বের পটভূমিতে যদি মধ্যপ্রাচ্যের নতুন বিভীষিকা আইএস বা ইসলামিক স্টেট দলের ভূমিকা বিচার করি তাহলে পশ্চিমা প্রচারণার ওপর-ভাষ্যে ভুলে গেলে বোধহয় চলবে না। তলিয়ে বিচার করা দরকার।
বহুকাল ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে অন্যান্য আরব দেশের মত সিরিয়াতেও বশংবদ সরকার কায়েম। ইরাকে সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করে শিখণ্ডি সরকার বসিয়ে বিপুল তেলসম্পদের বখরা ভালোভাবে আদায় হয়েছে। এ অঞ্চলে এখন একমাত্র হাতছাড়া রয়েছে সিরিয়া। দীর্ঘদিন নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েও সার্থক হয় নি যুক্তরাষ্ট্র। পুরোনো সম্পর্কের জের ধরে মধ্যপ্রাচ্যে শেষ সমর্থক-রাষ্ট্রকে রক্ষায় রাশিয়া এখনও আন্তরিক। ইরানও রয়েছে পাশে। যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপক কোনো যুদ্ধে আর জড়াতে চায় না। বিশেষত ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধে মার্কিন সৈনিকদের প্রাণহানি, পেশাগত নৈতিকতাচ্যুতি, এবং আহতদের মানসিক বৈকল্য ও বিপুল খরচের চাপ মার্কিন ভোটারদের একই ধরনের অভিজ্ঞতার প্রতি বিরূপ করে রেখেছে। কিন্তু সিরিয়াকে অমনি ছেড়ে দিতে রাজি নয় যুক্তরাষ্ট্র, হস্তক্ষেপের ফিকিরেই ছিল পরাশক্তিটি।
এমন সময়ে আকস্মিকভাবে ইরাক থেকে উত্থান ঘটল ভয়ঙ্কর মতাদর্শের আইএস। তারা একটি অঞ্চলে রাতারাতি ইসলামি খেলাফতই প্রতিষ্ঠা করে ফেলল! তারপর এমন জঙ্গি নিষ্ঠুর অমানবিক আচরণ শুরু করল যা কোনো ধরনের ইসলামি দল-উপদলের পক্ষেও সমর্থন করা সম্ভব নয়। লক্ষ্য করবার বিষয় আইএসকে সমর্থন করার মত কোনো স্বীকৃত মুসলিম সংগঠন নেই। আবার সকল বিরুদ্ধতাকে হেলায় অগ্রাহ্য করে আইএস তার মানবতাবিরোধী অপরাধ চালিয়েও যাচ্ছে। কোনো রাষ্ট্রশক্তি এবং কোনো বড় সাংগঠনিক শক্তির সমর্থন ছাড়াই আইএসের অমানবিকতার অগ্রাভিযান অব্যাহত রয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।
এবার যদি আমরা প্রশ্নটা তুলি - আইএসের আকস্মিক উত্থান এবং এত বাধার মুখেও অগ্রাভিযানের পিছনে কে?
উত্তরটা কী হতে পারে বলে আপনারা ভাবছেন? উত্তর কিন্তু একটিই Ñ আগের অঘটনগুলোর ধারাবাহিকতা এখানেও ক্ষুণœ হয় নি। বলা যায়, কলকাঠি যুক্তরাষ্ট্রই নাড়াচ্ছে, সঙ্গে যথারীতি মিত্ররাও রয়েছে। ফ্রান্স ও অষ্ট্রেলিয়া ইতোমধ্যে আইএসের ওপর বিমান হামলা চালিয়েছে। পশ্চিমে যারা বসবাস করেন, তাদের মধ্যে যাদের চোখকান খোলা তারা পুঁজিবাদী বিশ্বের এসব চালাকি ভালোই ধরতে পারছে। তাদের মধ্যে যারা তরুণ, যাদের রক্ত গরম, তারা অনেক সময় এত অন্যায় দেখে নিজেদের ধরে রাখতে পারে না। তারা প্রতিকারের জন্যে আরেকটি ভুলের ফাঁদে পা দেয়, যেমন করে অতীতে তালিবান ও আল কায়েদায় ভুলে এভাবে শিক্ষিত ছেলেরা জেহাদী যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু পুঁজিবাদের হাতে সৃষ্ট এসব জঙ্গি সংগঠনের প্রাণভোমরা কখনও তারা হাতছাড়া করে নি। তারা মূলত পুঁজিবাদের সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহৃত হওয়ার জন্যেই সৃষ্ট। প্রয়োজনে ফুরানোর পর যথারীতি তাদের ধ্বংস করেও দেওয়া হয়েছে। এখন তালিবান আল কায়েদার যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাদের বাগাড়ম্বরের ক্ষমতাটুকই আছে, সমান তালে লড়ে পুঁজিবাদী বিশ্বকে পরাস্থ করার কোনো ক্ষমতাই নেই।
আইএস ব্যাপক হৈচৈ বাধিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ভালোভাবে জায়গা করে দেওয়ার উপলক্ষ তৈরি করে দিয়েছে। তারাও আসরে নেমে পড়তে দেরি করে নি। প্রথমে বারাক ওবামা তাঁর ভোটারদের আশ্বস্ত করে বললেন, আমরা এবার আর স্থলবাহিনী পাঠাব না, কেবল বিমান আক্রমণ চালিয়েই কাজ সারব। সেভাবেই শুরু হল। এবারে তাঁদের সামরিক কৌশলবিদ আসরে নেমেছেন। তাঁদের কণ্ঠে একটু একটু শোনা যাচ্ছে যে শুধু বিমান আক্রমণ চালিয়ে সম্ভবত কাজ হবে না, এক পর্যায়ে স্থলবাহিনী পাঠাতেই হবে। এদিকে বিমান আক্রমণ এবং তাতে বেশ ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও আইএস তার নিষ্ঠুর জঙ্গি কার্যক্রম জোরদার করে চলেছে। ফলে পুঁজিবাদী মিত্রশক্তির মধ্যপ্রাচ্যে ঢুকে পড়ার উপলক্ষটা আরও ভালভাবে তৈরি হয়ে গেল।
আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি, যথাসময়ে আইএসের পরিণতিও তালিবান ও আলকায়েদার মতই হবে। কেবল দেখতে হবে পুঁজিবাদের তাদের কতটুকু এবং কতদিন লাগবে।
মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়ে মনে রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে রয়েছে সৌদিআরব, মিশর, কুয়েত, জর্ডান, প্রভৃতি আরববিশ্বের প্রভাবশালী ধনী মুসলিম দেশ।
আরব দেশগুলোতে আধুনিক শিক্ষা এখনও সাধারণের মধ্যে ছড়ায় নি। ফলে প্রথা এবং সংস্কৃতির প্রাচীন ধারার ঘোর থেকে জনগণ মুক্ত হয় নি। এসব দেশের শাসকদলের কাছে - তা রাজতন্ত্র স্বৈরতন্ত্র বা ছদ্মগণতন্ত্র, যা-ই হোক Ñ জনগণের এই পরিণতিই কাম্য। রাজা-প্রজার সম্পর্কের বাইরে এসব দেশে গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ এখনও সম্ভব নয়। নির্বাচনও এরকম সমাজে স্বৈরতন্ত্রী ও ধর্র্মান্ধদেরই ক্ষমতায় পাঠায়। গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা, মানবাধিকার, নারীর সমানাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদির পক্ষে সমাজমানসকে তৈরি করার জন্যে কোনো সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন এসব দেশে এখনও হয় নি। ফলে বেশিরভাগ দেশে শরিয়ার নামে এমন সব রীতি চালু রয়েছে যা সমাজের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করছে। এতে ধনী দেশ হওয়া সত্ত্বের সাধারণ মানুষ শিক্ষা ও চেতনায় অগ্রসর হচ্ছে না। তাতে ইসলামের মূল শিক্ষা ও নবীর মূল চেতনার পরিপন্থী হয়ে পড়ছে সমাজগুলো। তাদের নেতৃত্বের পুঁজিবাদের তাঁবেদারির ফলে আজ ইসলাম ও মুসলিম জনগণ চরম প্রতিকূলতার মধ্যে পড়ে গেছে। তাদের সাথে সরাসরি যোগ দিয়ে কিংবা এদের সৃষ্ট তথাকথিত ধর্মীয় সংগঠনে জুটে গিয়ে মুক্তির পথ মিলবে না। এর জন্যে প্রয়োজন সমাজ সংস্কার, রাজনৈতিক সংস্কার, এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লব। এটা জেহাদী জোশ দিয়ে অর্জিত হবে না, এটা সম্ভব হবে প্রত্যেক দেশে সচেতন মানুষ একাট্টা হয়ে নিজ নিজ দেশে সমাজ ও সরকার পরিবর্তনের কাজ করলে। তার ভিত্ তৈরি করে দেবে আধুনিক জনশিক্ষার প্রসার।
পশ্চিমের অস্ত্র কিনে, ভাড়াটে সৈন্য দিয়েও একাজ হবে না। নবীর দেখানো পথ জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতা ও শক্তি বৃদ্ধি করে সমাজের নবায়নের মাধ্যমেই এটা অর্জন সম্ভব। পথটা সহজ বা সংক্ষিপ্ত নয়, দীর্ঘ ও বন্ধুর। সবাই জানি বড় কিছু অর্জন করতে হলে কঠিন পথে বিপুল ত্যাগেই তা মেলে। আর তার জন্যে যথাযথ হাতিয়ার প্রয়োজন। সেটি আপাতত একে ৪৭, রকেট লাঞ্চার, কামান-বাজুকা নয়। তার আগে দরকার জ্ঞানের আলোয় নির্মিত দূরদর্শী প্রজ্ঞাপূর্ণ নেতৃত্ব ও আলোকিত অনুসারীর দল। এই নেতৃত্বই নিজ দেশের জনগণকে জাগিয়ে তুলে ঐক্যবদ্ধ করবে। অর্থাৎ দূরদর্শী জ্ঞানী গণনায়কের প্রয়োজন আজ আরব দেশগুলোতে। এটাই তাদের মুক্তির একমাত্র পথ।

***

Tuesday, September 23, 2014

কী তৈরি করছি - শিক্ষার্থী নাকি পরীক্ষার্থী?

আবুল মোমেন

শিক্ষামন্ত্রীর নিরহঙ্কার নেতৃত্বে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অগ্রযাত্রা আমাদের দেশে ব্যতিক্রমী ঘটনা। এর মধ্যে সাড়ে তিন কোটি ছাত্রকে বত্রিশ কোটি বই শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনেই পৌঁছে দেওয়ার মত বিস্ময় যেমন আছে তেমনি আছে সর্বমহলের কাছে গ্রহণযোগ্য শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে রীতিমত বাস্তবায়ন শুরু করার মত ঐতিহাসিক অর্জন। শিক্ষামন্ত্রীর সততা ও আন্তরিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। সে ভরসায় শিক্ষা নিয়ে যাঁরা ভাবেন তাঁদের বিবেকের ওপর চেপে বসতে থাকা একটি দুর্ভাবনা ও উদ্বেগ তুলে ধরার কথা ভাবছি।
একেবারে প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত পুরো শিক্ষাকে যে আমরা পরীক্ষার মধ্যে -গণ্ডিবদ্ধ করে ফেললাম কাজটা কি ঠিক হল? প্রশ্নটা তোলা জরুরি কারণ এতে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য - জ্ঞানবান বিবেচক নাগরিক তৈরি - বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই ঘাটতি রেখে শিক্ষার অপর গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি কতটা হতে পারে তাও বিচার্য বিষয়। এ দুটি বিষয়ের পরিপূরকতা বাধাগ্রস্ত হলে কাজ হবে না, কারণ দক্ষকর্মী তৈরি হবে জ্ঞানবান বিবেচক নাগরিকের ভিত্তিভূমির ওপর।
পরীক্ষা হল শিক্ষার্থীর সিলেবাস ভিত্তিক অর্জিত শিক্ষার মান যাচাইয়ের একটি পদ্ধতি। আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে শ্রেণিকক্ষের পাঠ দেওয়া এবং তার ভিত্তিতে পরীক্ষা নেওয়া হয় তাতে বিভিন্ন স্তরের সম্পূর্ণ অর্জনলক্ষ্য পূরণ ও পরিমাপ কোনোটাই করা সম্ভব নয়। নিচের পর্যায় থেকে অসম্পূর্ণ শিক্ষা এবং তার আবার পরীক্ষাকেন্দ্রিকতার ফল কেমন তা আমাদের উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষিতসমাজের গড় আচরণ ও ভূমিকা থেকেই বোঝা উচিত। একটি অসম্পূর্ণ শিক্ষার প্রভাবে নানা অসম্পূর্ণতা নিয়েই সমাজ গড়ে উঠছে। বরং এই নব্যশিক্ষিতদের দাপটে আমাদের সনাতন ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ ও নৈতিকতাও চ্যালেঞ্জের মুখে অকার্যকর হয়ে পড়ছে। সমাজ আজ নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শূন্যতায় বিপথগামী হয়ে পড়েছে।
কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থায় শিক্ষার নগদ-লক্ষ্য হচ্ছে পরীক্ষায় ভালো ফল এবং তা এত উগ্রভাবে প্রধান হয়ে উঠেছে যে বাকি লক্ষ্যগুলো বাকিই থেকে যাচ্ছে, আর তাতে প্রত্যেক ছাত্রের জীবনে মানবিক শিক্ষার বকেয়ার পাহাড় জমছে। ছাত্র যেমন তেমনি শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিচারও হয় একমাত্র পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে। পরীক্ষা সর্বগ্রাসী হয়ে রীতিমত স্কুল ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই অকেজো করে দিয়েছে। কারণ পরীক্ষায় ভালো করা আদতে এমন একটি দক্ষতা যার জন্যে স্কুলে ব্যয়িত সময়কে রীতিমত অপব্যয় বলে মনে হচ্ছে অনেকেরই, বিপরীতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে কোচিং সেন্টার ও টিউটরের পাঠ। লক্ষ্য যদি একমাত্র পরীক্ষাই হয় তবে সে বিচারে এটাই বেশি ফলপ্রসূ। ছাত্র-অভিভাবকদের চাহিদা এবং সরকারের চাপের মধ্যে পড়ে শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরের কাজ করছেন এবং স্কুল নয় বস্তুত পরীক্ষার্থী তৈরির কারখানায় খাটছেন (কোচিং সেন্টার সম্পর্কে একথা আরও বেশি খাটে)। তবে তারা খুশিমনেই খাটছেন কারণ এটি আর্থিকভাবে লাভজনক। শিক্ষার্থীকে নিছক পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরের এ অন্যায় দীর্ঘদিন চলতে থাকায় বর্তমানে শিক্ষক-অভিভাবক সকলেই পরীক্ষাকেই ধ্যানজ্ঞান এবং শিক্ষা বলে ভুল - না, অন্যায় - করছেন। ফলে শিক্ষা প্রশাসন-শিক্ষকসমাজ-অভিভাবক এবং এর ভিকটিম ছাত্র মিলে বিপথগামিতার ও অধোগতির রমরমা চলছে অবাধে। সোনালি পাঁচ-তারকা শিক্ষার্থীদের, থুড়ি পরীক্ষার্থীদের, সহাস্য ছবির আড়ালে এ অবক্ষয় ঢাকা যাচ্ছে না।
মুশকিল হল, এ আনন্দ প্রায়ই দেখা যাচ্ছে স্বল্পস্থায়ী। কারণ প্রাপ্ত শিক্ষা যে টেকসই নয় তা প্রথমে পরবর্তী ধাপের ভর্তি পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়ে যায় তাতে অধিকাংশের ফলাফলের হাল দেখে। কিন্তু তার আরও স্থায়ী অর্থাৎ টেকসই কুফল দেখা যায় সমাজে - শিক্ষিত মানুষদের দক্ষতার মান এবং  দুর্নীতি-অনৈতিকতার নৈরাজ্য দেখে। এছাড়া একজন শিক্ষিত মানুষের ন্যূনতম অর্জনের চিত্রও ভয়াবহ। দু একটি নমুনা দেওয়া যাক।
প্রাথমিকের মোদ্দা কয়েকটি অর্জনলক্ষ্য হল পড়া-লেখা-বলা-শোনা (শুনে বোঝা) এবং গণিতে নির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জন। গোটা ছাত্রজীবনেই এসব অর্জনের অগ্রগতি চলবে।
বাস্তবে কী ঘটছে? প্রাথমিক স্তর নিয়ে একটি নির্ভরযোগ্য জরীপে দেখা যাচ্ছে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ শিশু উপরোল্লিখিত দক্ষতাগুলো নির্দিষ্ট মান অনুযায়ী অর্জনে ব্যর্থ থেকেই প্রাথমিক পর্যায় সমাপ্ত করে, যাদের অনেকেই জিপিএ ৫-ও পেয়ে থাকে। তাদের কথা ছেড়ে দিন, আপনি যদি বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের  ছাত্র বা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্তদের সামনে শরৎচন্দ্র বা হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের পাতা খুলে পড়ে শোনাতে বলেন তাহলে অভিজ্ঞতাটা কেমন হবে? আমার অভিজ্ঞতা বলে, দুচারজন ছাড়া কেউই ভাব ও অর্থ ফুটিয়ে শুদ্ধ উচ্চারণে গড়গড় করে পড়তে পারে না। পদে পদে হোঁচট খায়, এবং পাঠ ও রস উভয়ই ব্যাহত হয়।
চার বছর (বা ৬ বছর) বয়স থেকে আঠার বছর (অনেক ক্ষেত্রে তা আরও প্রলম্বিত হচ্ছে) একটানা পড়াশুনার মধ্যে থাকা সত্ত্বেও প্রায় সবারই জ্ঞানভিত্তিক স্মৃতি অত্যন্ত দুর্বল। অর্থাৎ এত বছরে তারা যেসব বিষয় পড়েছে (বা তাদের পড়ার কথা) যেমন - বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজ, পদার্থ বিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের নানা শাখা, মানবিক ও অন্যান্য বিদ্যা - তার পুঞ্জিভূত যে সঞ্চয় তাদের থাকার কথা তা গড়ে উঠছে না। বেচারা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন কেবল সঞ্চয় থাকলেও হবে না, কারণ তা স্তূপাকার হয়ে জঞ্জালে পরিণত হবে যদি না এ দিয়ে ভাবনা, চিন্তা, দর্শনসহ মনন ও উপভোগের নানান রসদ তৈরির প্রক্রিয়া চালু থাকে। এ কথা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে কেবল নির্ধারিত কিছু পাঠ্যবই পড়িয়ে প্রকৃত শিক্ষিত জাতি তৈরি করা যায় না। আর আমাদের দেশে পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরিত ছাত্র অযথা পুরো পাঠ্যবই বা কেন পড়বে? শিক্ষক-টিউটরের সহযোগিতায় তারা আসন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তরগুলোই শুধু শেখে, প্রায় ক্ষেত্রে মুখস্থ করে। এভাবে কোনো বিষয় পূর্ণাঙ্গভাবে জানা হয় না, যেটুকু জানা হয় তার কোনো মননশীল চর্চার সুযোগ নেই। এই কাটছাঁট করা শিক্ষার উপমা হতে পারে পাখা ছেঁটে দেওয়া পাখি, যে আর উড়তে পারে না।
এভাবে শিক্ষাটা অর্থাৎ জানা বোঝা ইত্যাদি হয় ভাসা-ভাসা। যা সে পড়ে বা তার পড়ার কথা, সেসব কখনও তার ভাবনার বিষয় হয় না, বস্তুত এভাবে কারও সমৃদ্ধ চিন্তাজগত তৈরি হয় না। এ কারণে আমরা দেখি সংসদে সুস্থ তর্ক হয় না অশ্লীল ঝগড়া হয়। জাতীয় জীবনে কোনো ইস্যুতে সারগর্ভ আলোচনা হয় না একতরফা গোঁয়ার্তুমির প্রকাশ ঘটে।
পরীক্ষার এই দোর্দ--প্রতাপে জ্ঞানার্জন ও সাংস্কৃতিক মানসম্পন্ন মানুষ হয়ে ওঠার রসদগুলো অধিকাংশের অনায়ত্ত থেকে যাচ্ছে। এর চরম দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় বাংলা সম্মানের পাঠ শেষ করে  রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি ভিন্ন কোনো বইয়ের নাম বলতে পারে না এমন তরুণ প্রচুর এবং মূল টেকস্ট না পড়ে ইংরেজিসাহিত্যে ডিগ্রি অর্জন এদেশেই সম্ভব। একথাও বলা যায়, উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার পরও অধিকাংশের সাহিত্যবোধ, সমাজচিন্তা, বিজ্ঞানমনষ্কতা ইত্যাদি অবিকশিত থেকে যায়। পরীক্ষার রিলে রেসে আবদ্ধ ছাত্রজীবন কাটিয়ে অধূনা অধিকাংশ শিক্ষিতজনের স্কুলজীবনে নাটকে, অভিনয়ে, গানে, আবৃত্তিতে, বিতর্কে কি স্কাউটিং, ক্যাম্পিং, ক্রীড়ার অভিজ্ঞতা থাকছে না; স্কুল, সহপাঠী, শিক্ষককে নিয়ে এমন বৈভবময় অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হচ্ছে না যা ভবিষ্যত জীবনে বারবার ফিরে ফিরে আসবে মধুর উদ্দীপক স্মৃতিচারণ হয়ে। সঞ্চয়হীন মানুষ জ্ঞানের দিক থেকে অবশ্যই দরিদ্র থাকবে, আর স্মৃতিহীন মানুষের মানবিক খুঁটিগুলো তৈরি হয় না। বেপরোয়া কাজে কি বখাটেপনায় লিপ্ত হতে তার অন্তর থেকে রুচির বাধা তৈরি হবে না। নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া তাদের পক্ষে সম্ভব। এই রিক্ততার বড় খেসারত হচ্ছে আমাদের শিক্ষিতজনদের প্রকৃত দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম গড়ে উঠছে না - পেশা বা জীবিকার সত্তার বাইরে মনুষ্যসত্তার মান খুবই খারাপ হচ্ছে।
পরীক্ষাই সব হয়ে ওঠায় একে ঘিরে শিক্ষার প্রতিকূল, অবাঞ্ছিত, এমনকি বেআইনি কাজ ও দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। এটাই স্বাভাবিক পরিণতি হওয়ার কথা। অন্ধবিশ্বাস যেমন ধর্মকে ঘিরে অসাধু ব্যক্তিদের ব্যবসার সুযোগ করে দেয় এ শিক্ষাও তার উপজাত হিসেবে নোটবই, টেস্ট পেপার, মেডইজি, কোচিং সেন্টার, টিউশিন এবং অবশ্যই প্রশ্নপত্র ফাঁসে শিক্ষাকে জড়িয়ে রাখছে। বত্রিশ সেট প্রশ্ন তৈরি করেও এটা বন্ধ করা যাবে না। কারণ শিক্ষার একমাত্র আরাধ্য দেবতা যদি হয় পরীক্ষা তো তাঁকে তুষ্ট করার জন্যে পুণ্যলোভী - এক্ষেত্রে A+ লোভী - শিক্ষার্থী বা তার অভিভাবক, তেমন পুরোহিতই খুঁজবেন যিনি যে কোনো মূল্যে - অর্থাৎ অবৈধ পথে হলেও - মোক্ষ লাভে সহায় হবেন। শিক্ষকের মধ্যে তেমন যোগ্য সাহসী মানুষের অভাব ঘটাই স্বাভাবিক। তাতে কেউ দমবেন না। সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা, কেরানি, প্রেসকর্মী, দপ্তরি, মায় দারোয়ান ইত্যাদি যেকোনো স্তর থেকে কাক্সিক্ষত সাহসী যোগ্য পুরুষ এগিয়ে আসবেনই। হয়ত দর চড়বে, প্রণামী বাড়বে - এই যা।
২.
এটি আদতে শৈশবেই সশ্রম দ-প্রাপ্ত শিশুর বেড়ে ওঠার গল্প। ঘরের নামে ওদের খাঁচায় বন্দি রাখা হয়, শিক্ষা জীবন কাটে কারাগারে, পরীক্ষার দ- খাটতে খাটতে। আশ্চর্য ব্যাপার হল শিক্ষা নয় এই দ- ভোগেই সবাই যেন প্রলুব্ধ হয়, এমনকি এতে আনন্দ পেতে থাকে, তার জন্যে নানা প্রলোভনও মওজুদ থাকছে। ফলে মানবজীবনের প্রস্তুতিকাল, পুরো কৈশোর ও প্রথম তারুণ্য, পরীক্ষার শৃঙ্খলে বাঁধা থাকছে। তাদের মাঠের, মুক্ত হাওয়ার, আলোর, আকাশের, গাছের, মাটির, জলের, সমবয়সীর সঙ্গের, বড়দের  স্নেহমমতার এবং গল্পের, সুরের, রঙের, আঁকার, ভাঙার, গড়ার, চড়ার, লাফাবার, দৌড়োবার যে অপরিমেয় ক্ষুধা-চাহিদা তা কি পূরণ করেছি আমরা? তার প্রকৃত আনন্দ, তার মনের বিকাশ কিসে সেসব ভাবনা কি আমাদের শিক্ষার এজেণ্ডায় আর সমাজের ভাবনায় আছে?
কোন ব্যবস্থায় একজন নিউটন জীবনসায়াহ্নে বলতে পারেন আমি মাত্র জ্ঞানসমুদ্রের তীরে নুড়ি কুড়াচ্ছি তা আমরা ভাবি না। আর ভাবি না বলেই জীবনপ্রভাতেই শিক্ষার্থীর গায়ে পরীক্ষার্থীর যুদ্ধ চড়িয়ে দিচ্ছি।
আমরা কেন এভাবে একটি - আসলে কোটি কোটি - বিয়োগান্তক গল্প রচনা করে চলেছি? এটা আফসোসের কথা, কারণ এ পরিণাম ঠেকানো সম্ভব - সহজেই এর পরিণতি মিলনাত্মক করা যেত।

***



Monday, September 8, 2014

কোন্ পথে চলবে বিএনপি

আবুল মোমেন

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত বিরোধী দলের মূল কাজ হল জনগণের পাশে থেকে দেশ ও জনস্বার্থে বিভিন্ন ইস্যুতে অবস্থান গ্রহণ। বক্তব্য প্রকাশ এবং নানা মাত্রার আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে তা করাই রেওয়াজ। এছাড়া জনগণের কোনো ভোগান্তির সময়ও তাদের পাশে দাঁড়ানো রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব।
বর্তমানে উত্তরবঙ্গে বন্যা হচ্ছে। বন্যা বেশ ভালো মতই হচ্ছে এবং বহু মানুষ জলবন্দি হয়ে পড়েছেন। পত্রপত্রিকার খবরে বোঝা যাচ্ছে ত্রাণ কাজ এখনও অপ্রতুল। তাছাড়া এসব অঞ্চলে বিপুল দরিদ্র মানুষ এমনিতেই যে কষ্টে থাকে তা জানা থাকলে এ সুযোগে তাদের ঘরবসতি ও জীবনমানের উন্নতির জন্যে কিছু মানবিক কাজ করে রাজনৈতিক দল লাভবান হতে পারে। এছাড়া গার্মেন্টস কারখানাকে ঘিরেও মানবিক তৎপরতা চালানোর সুযোগ রয়েছে।
সারাদেশে রাস্তাঘাটের বেহাল দশায় যোগাযোগ খাতে জনদুর্ভোগ চরম পর্যায়ে রয়েছে। কয়েকটি লঞ্চডুবি ও প্রচুর প্রাণহানিতে  এ খাতের ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি ধরা পড়েছে। এভাবে তালিকা দীর্ঘ করা সম্ভব।
বিএনপি এরকম কোনো ইস্যু নিয়েই আন্দোলনে নামছে না। সব সময় সব ইস্যুতে তাদের সুচিন্তিত বক্তব্য থাকে না। ভুক্তভোগী মানুষের পাশে দলটিকে দেখাও যাচ্ছে না। বলা যায়, প্রত্যক্ষভাবে মাঠ-পর্যায়ে জনসেবার রেওয়াজ যেন এ দলটির মধ্যেই নেই।
বিএনপি নেতা-কর্মীরা জানেন কোনো মতে সাধারণ নির্বাচনের সুযোগ তৈরি করা গেলে তাদের জয়লাভের সম্ভাবনাই বেশি। হয়ত তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপির জয় অবধারিত। ফলে দেখা যাচ্ছে তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য ও কর্মকা- মূলত সরকার পতন ও দ্রুত মধ্যবর্তী নির্বাচনকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে।  মনোভাবটা হয়ত এরকম, একবার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ফিরে পেলে সব কাজই করা সম্ভব, করা হবে।
এই মনোভোবের কারণে দলের রাজনীতির জন্যেই কতকগুলো সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রথমত, বিএনপি যে সরকারের বাইরে থাকলেও প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের ভূমিকা পালনে অসচেতন ও অক্ষম এ সমালোচনা সমর্থিত হয়। দ্বিতীয়ত, বিএনপির রাজনীতি একমাত্র এই দাবিকে ঘিরে আবর্তিত হওয়ায় একে অগ্রাহ্য করা কিংবা এটি আদায়ে সম্ভাব্য আন্দোলন ঠেকানোর জন্যে আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে মাঠে না নেমে সরকারি নানা ব্যবস্থা ও বাহিনীর সহায়তার মাধ্যমেই কাজ সম্পন্ন করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে দেশের নানা অঞ্চলে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন গড়ে ওঠা ও দানা বাঁধানোর কোনো সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। তৃতীয়ত, সরকার পরিবর্তন ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জনকল্যাণের জন্যে যদি করাও হয়ে থাকে তা মূলত একটি আইন ও সাংবিধানিক বা বলা যায় আদর্শিক বিষয় কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে জনদুর্ভোগ ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় বলে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। তারা বোঝে এটা দলের নীতি-নির্ধারকদের এজে-া, এতে যুক্তি বা বক্তব্য হাজির করা তাদের এক্তিয়ারের বিষয় নয়। চতুর্থত, এভাবে চলতে থাকায় জেলা পর্যায়ের নেতা ও সারাদেশের কর্মীদের মধ্যে যথার্থ রাজনৈতিক কর্মসূচি ও আন্দোলন দাঁড় করাতে না পারার হতাশা ছড়াচ্ছে। ফলে দিনে দিনে দল ও দলীয় কাজকর্মে স্থবিরতা নামছে। সরকার শাসনদ- আরও শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণে রাখার ও চালানোর সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে।
নি:সন্দেহে এটি বিএনপির রাজনীতির জন্যে কঠিন সময়। এ সময় নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, সৃজনশীলতা এবং অঙ্গীকার ও সাহসী ভূমিকা প্রয়োজন ছিল। মানতেই হবে নেতৃত্ব এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। এ সূত্রে বলা দরকার বর্তমান সময়ে মুসলিম জাতীয়তাবাদের পুরোনো ধরণ ও ভাবনা নিয়ে রাজনীতিতে এগুনো যাবে না। সময়োপযোগী পরিবর্তনের তাগিদ বোঝার জন্যে নেতৃত্বে দূরদর্শিতা প্রয়োজন, আর তা সম্পাদন করার জন্যে প্রয়োজন সৃজনশীল হওয়ার ক্ষমতা। তারপর চাই কর্মীদের নিয়ে সরকারি দল ও বাহিনীর প্রতিবন্ধকতা ভেঙে মাঠে নামার সাহস। এ তিন ক্ষেত্রেই এখনও পর্যন্ত খালেদা জিয়া বা তারেক রহমান দলকে যথাযথ নেতৃত্ব দিতে পারেন নি।
বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতির বিবেচনায় আওয়ামী লীগের একটি বড় সাফল্য হল জামায়াতে ইসলামির গায়ে ভালোভাবে যুদ্ধাপরাধীর ছাপ মেরে দিতে পারা। তার ওপর, বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি এবং ইসলামি জঙ্গিবাদ উত্থানের সমস্যার আলোকে ওয়াহাবিপন্থাসহ সুন্নিধারা থেকে উদ্ভূত নানান কট্টরপন্থা সম্পর্কে মুসলমানদের মধ্যেও সচেতনতা ও সতর্কতা তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় জামায়াতে ইসলামকে রাজনৈতিক সঙ্গী রাখা এবং রাজনৈতিক কর্মকা-ে তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছে বলে মনে হয়  না।
একটি খাঁটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপির উচিত ছিল ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা বর্তমান সরকারের ভূমিকায় ধীরে ধীরে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হতে থাকা নাগরিকসমাজের বিভিন্ন ফোরামের সাথে সংযোগ বাড়ানো। এটি ফলপ্রসূ করতে হলে অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ ও জামায়াত সম্পর্কে তাদের বক্তব্য পরিষ্কার করে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। অতি সম্প্রতি দলে ক্রমেই সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে থাকা সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বললেও দলীয় অবস্থান ও ভূমিকায় তার প্রতিফলন দেখা না গেলে এ কেবল সাময়িক রাজনৈতিক চাল বলেই গণ্য হবে। জনমনে কোনো গুরুত্ব পাবে না।
মনে রাখা দরকার, রাজনৈতিক অঙ্গনে কঠিন সময় ও প্রতিকূল চ্যালেঞ্জ একটি রাজনৈতিক দলের সামনে দলীয় ভাবমূর্তি, দলের প্রভাব এবং দল ও নেতৃত্বের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর বিরাট সুযোগ তৈরি করে। বস্তুত এভাবেই ষাটের দশকে পাকিস্তানের কর্তৃত্ববাদী শাসকের দমনপীড়নের মুখেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাঙালির জনপ্রিয় সর্ববৃহৎ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। বিপরীতে ক্ষমতায় থেকে সামরিক এজেন্সির সহযোগিতায় বিভিন্ন দলমতের মানুষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা দলের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক দুর্বলতা আজ প্রকট হয়ে ধরা পড়ছে। এতকাল বিএনপির নেতা-কর্মীরা দলের এই সংকটের সাথে পরিচিত হন নি, কারণ তেমন বাস্তবতা তৈরি ছিল  না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আজ তা প্রকাশ হওয়ার পরে দলের নেতৃত্বকে পরিবর্তন-সংশোধনের বিষয় উপলব্ধি করতে দেখা যাচ্ছে না। বরং সরকারের চাপের মুখে তাদের আচরণ ও ভূমিকা দিশাহীন শিক্ষানবীশ রাজনীতিকের মত মনে হচ্ছে। ফলে কর্মসূচিগুলো যে নামকাওয়াস্তে দায়সারাগোছের কাজ তা বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না। নিজেরাসহ কেউই এগুলোর ব্যাপারে এখনও সিরিয়াস নন। এভাবে চললে আগামী নির্বাচনে আপনা-আপনি বিজয় এসে ধরা দেবে বলে নিশ্চিত থাকার সুযোগ বিএনপির জন্যে আর থাকবে না। আর কর্মীদের ছাপিয়ে ততদিনে হতাশার ছোঁয়া জনমনেও পৌঁছাবে।
বিএনপির ভবিষ্যত বর্তমানে নিহিত রয়েছে। বলা যায় বর্তমান সময় বিএনপির জন্যে ক্রান্তিকাল হিসেবে এসেছে। দেখা যাক তারা কি আওয়ামী লীগের মত সকল প্রতিকূলতা পেরিয়ে টিকে থাকতে পারবে নাকি মুসলিম লীগের মত বড় ধরনের পরাজয়ের ধাক্কায় ধীরে ধীরে কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে।