Tuesday, December 22, 2015

কালান্তরের বিজয় দিবস

আবুল মোমেন

চুয়াল্লিশ বছর পরে বিজয় দিবসে মনে হচ্ছে গত কয়েক বছরে দেশে এবং পৃথিবীতে যেসব পরিবর্তন ঘটেছে সেগুলো বাদ দিয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতা বোঝা যায় না। অমর্ত্য সেন ও কৌশিক বসুর মত দুজন খ্যাতকীর্তি বাঙালি অর্থনীতিবিদসহ পশ্চিমের অনেক বিশেষজ্ঞ ও পর্যবেক্ষকও উন্নয়নের বিচারে বাংলাদেশকে বিস্ময় আখ্যা দিয়েছেন। এ বিস্ময়কর অর্জনগুলো এড়িয়ে সঠিক বাংলাদেশকে কি বোঝা যাবে?
১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর ভারত-বাংলাদেশ যৌথবাহিনী যখন হানাদার পাকিস্তানি সেনাদলকে পরাজিত করে দেশ দখলমুক্ত করেছিল তখন জাতি ঐক্যবদ্ধ, স্বপ্নে ও প্রত্যাশায় চঞ্চল। সেটা ছিল আদর্শবাদী চিন্তা ও মহৎ স্বপ্নের কাল। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শকে মূলনীতি করে সংবিধান রচিত হয়েছিল। ধর্মবর্ণলিঙ্গ নির্বিশেষে সব নাগরিকের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করে গণতান্ত্রিক ধারায় দেশের অগ্রগতি ছিল লক্ষ্য।
কিন্তু তার জন্যে কি নেতৃবৃন্দ কি মুক্তিযোদ্ধাসহ  দেশের মানুষ প্রস্তুত ছিলেন না। কেন ছিলেন না তা বোঝা যাবে ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথের সাবধান বাণী থেকে। তিনি বলেছিলেন, স্বাধীনতা অন্তরের সামগ্রী। এ কথায় বোঝাতে চেয়েছিলেন নিজের মধ্যেকার পরাধীনতার প্রবণতাগুলো রেখে স্বাধীনতার সুফল মেলে না। নিজে ব্যক্তিগত রিপুর বশীভূত, ব্যক্তিগত ক্ষুদ্রস্বার্থের দাবির কাছে দুর্বল থাকলে স্বাধীনতা মাত্রা ছাড়িয়ে অর্থহীন হবে। নিজের ক্ষুদ্রস্বার্থকে দেশের ও মানুষের বৃহত্তর কল্যাণের মাঝে বিলিয়ে দিতে না পারলে কীভাবে মানুষটা দেশের হয়ে কাজ করবে? দেশবাসী বুঝে-না-বুঝে, কিংবা অবস্থার গতিকে, একাত্তরের মুক্তযুদ্ধকালীন নয়মাস এই উচ্চ ভাবাদর্শ পালনের স্বাক্ষর রেখেছিল।
কিন্তু মানুষ তো স্বাভাবিক অবস্থায় সামাজিক জীব, সংসারের দায়কে অগ্রাধিকার দিতেই অভ্যস্ত। ষাটের দশক থেকে দেশের ছাত্র-শ্রমিক এবং সচেতন নাগরিকসমাজ রাজনৈতিক সংগ্রামে প্রায় নিরবচ্ছিন্নভাবেই লিপ্ত ছিলেন। আর তখন বঙ্গবন্ধুর নির্ভরযোগ্য আবার আকর্ষণীয় নেতৃত্ব পেয়ে দেশে এক অসাধারণ গণজাগরণ ঘটেছিল, আর তার ফলে সৃষ্ট হয় অভূতপূর্ব ঐক্য। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ বাদে বাঙালির রূপান্তর ঘটেছিল সেদিন - ভেতো ভীতু বাঙালি বীরত্বের ডাকে সাড়া দিল, কলহ ও কোন্দল ভুলে এক হয়ে গেল, বাক্যবাগীশ কর্মবিমুখ না থেকে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এর ফল মুক্তিযুদ্ধ এবং ফসল বিজয়।
দুর্ভাগ্য, যুদ্ধকালের এই উদ্দীপনা, এই ব্রতী মনোভাব যুদ্ধপরবর্তী শান্তিকালে দেশগঠনের লড়াই অবধি ধরে রাখা গেল না। প্রায় বিজয়ের পর পরই যেন মানুষ ফিরে গেল তাদের সামাজিক, সাংসারিক সত্তায়। বরং এতদিনের ত্যাগ ও সংযমের পরে অকস্মাৎ যেন ক্ষুদ্র স্বার্থের বাঁধ ভেঙে গেল। একটা অস্থির বিশৃঙ্খল সময় দেশকে গ্রাস করেছিল তখন। এমন অস্থিতিশীল সময়ের সুযোগ নেওয়ার মানুষেরও অভাব ছিল না। একদল বিপ্লবী আদর্শের স্বপ্ন নিয়ে মাঠে নামল তো আরেক দল পরাজিত আদর্শের বীজ সংরক্ষণ করে প্রত্যাঘাতের ষড়যন্ত্রে নেমে গেল। দেশের আদর্শ কি পরিকল্পনা সবই ওলটপালট হয়ে গেল। সামরিক স্বৈরশাসনে রাজনীতিক এবং শিক্ষিতসমাজ উভয়ের চরম অবক্ষয় ঘটায় সমাজের বড় ক্ষতি হল। রাজনীতি সম্পূর্ণ আদর্শচ্যুত হয়ে গেল। আদর্শের ভিৎ ছাড়া ছাত্র রাজনীতি তো চলতেই পারে না, হয়ত তাই এর আদর্শচ্যুতি ঘটেছে সবশেষে - নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পরে। কিন্তু তারপরে অবক্ষয় এত ক্ষিপ্রগতিতে ঘটেছে যে কয়েক বছরেই চলে গেল অপশক্তির গ্রাসে। এখন এর নানান বিকার রাজনীতি ও সমাজ উভয়কেই বড্ড ভোগাচ্ছে।
মার্কিন সমাজ দার্শনিক ড্যানিয়েল বেল ১৯৬৫ সনে পরিবর্তমান মার্কিন সমাজের প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন বই আদর্শবাদের সমাপ্তি - দি এ- অব ইডিওলজি। নব্বইয়ের দশকে এই লক্ষণ আমাদের সমাজেও  দেখতে পেলাম। এই বাস্তবতায় সনাতন বা ধ্রুপদী ধারণা থেকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র বা সুশাসনের মান বিচার করলে হতাশ হতে হবে। গণতান্ত্রিক বিকাশের সাথে মানবাধিকারের সুরক্ষা, আইনের শাসনের নিশ্চয়তা, সকল মত-পথের অন্তর্ভুক্তি, স্বাধীন স্থানীয় সরকার, মানুষের অংশগ্রহণ, নাগরিক অধিকারের সাম্য ও এর সুরক্ষা, সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ইত্যাদি মোটামুটি সহনীয় মাত্রায় ও মানে চর্চা হওয়ার কথা। এসব ক্ষেত্রে আমাদের বাস্তবতা প্রত্যাশীত মানের কাছাকাছি নেই - এটা মানতেই হবে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্যে যেমন রাজনীতি চর্চা কঠিন করে রাখা হয়েছে তেমনি ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও সম্পদের সুরক্ষাও নিশ্চিত করা যায় নি।
কিন্তু এ-ই শেষ কথা নয়। বাংলাদেশ থেমে থাকে নি। বহুকাল আগে মনীষী হুমায়ুন কবীর কবিতার প্রসঙ্গে এই খরস্রোতা নদী-খালের ভাঙাগড়ার দেশে মানুষের উদ্যমশীলতার কথা বলেছিলেন। প্রাণচঞ্চল, খামখেয়ালি দুর্বার প্রকৃতির সাথে বসবাস করে আসা এই জনপদের মানুষের রয়েছে ঘাড় গুঁজে বিপর্যয় সইবার ক্ষমতা আর দুর্যোগের পরেই নবোদ্যমে জীবনজয়ের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার অফুরন্ত উদ্যম।
এই মানুষ গণতন্ত্র বা সুশাসনের অপেক্ষায় বসে থাকে নি, নিজের মত করে প্রাপ্ত সকল সুযোগ কাজে লাগিয়ে রীতিমত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সরকারি কিছু কর্মীর আন্তরিক ভূমিকা, বেসরকারি সংস্থার দূরদর্শী সহায়তা, বেসরকারি উদ্যোক্তার বিনিয়োগ গ্রামবাংলার পল্লীবধূ আর ভীরু বালিকাদের দলে দলে কর্মীতে রূপান্তরিত করেছে, নি¤œবর্গের খেটে খাওয়া মানুষের বেকারত্ব ঘুচিয়ে বিদেশে রোজগারের পথ খুলে দিয়েছে, কৃষি উৎপাদনে চমকপ্রদ বিপ্লব ঘটতে সাহায্য করেছে। একাত্তরে যখন আমরা বিজয় অর্জন করেছি তখন সাড়ে সাতকোটি জনসংখ্যার খাদ্য সংস্থান করতে পারতাম না, এখন চুয়াল্লিশ বছর পরে তার দ্বিগুণ মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ করছেন দেশের কৃষক। প্রত্যেক মানুষের দু’একটা শার্ট আছে, পায়ে আছে অন্তত রাবারের চপ্পল, গ্রামের হাটে মহার্ঘ ফলের সওদা মেলে, মেয়েরা দল বেঁধে স্কুলে যায়, গর্ভবতী নারী স্বাস্থ্য পরামর্শ পান ঘরের কাছেই।  জনমানুষের এই অগ্রগতি মূলত তাদেরই খাটুনির ফসল। একটু খেয়াল করলে বুঝব বাংলাদেশের অর্থনীতির পরিসর বড় হচ্ছে, তাতে অংশীদারিত্বের ব্যাপ্তিও ঘটছে। যে তিনটি ক্ষেত্রের অবদানে অর্থনীতির বিকাশ ঘটে - মানসম্পন্ন শিক্ষা, পুঁজি সঞ্চারের ক্ষমতা এবং অবকাঠামোর উন্নয়ন ইত্যাদিতে সরকার অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। ফলে যে কোনো পরিস্থিতিতে - প্রবল প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রকট রাজনৈতিক সংকট কিংবা বিশ্বব্যাংকের মত সংস্থার  উপেক্ষা সবই বাংলাদেশ নিজেই উপেক্ষা করে এগুতে পারে আজ। দেশের এই সামর্থ্যকে উপেক্ষা করা অন্যায় হবে। বাংলাদেশ এগুচ্ছে, বাংলাদেশের অগ্রগতি কেউ থামাতে পারবে না।
গণতন্ত্র এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট অধিকার সংকোচনের জন্যে সরকারের দিকে আঙ্গুল তোলা যায়। তোলাই যায়, কিন্তু মনে হয় তাতেই সমস্যা বোঝার এবং তার সমাধানের সূত্র পাওয়ার দাবি করা যায় না। আদতে গত তিন দশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির, বিশেষত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিস্ময়কর যে বিস্তার ঘটেছে তা কেবল সর্বগামী ও সুলভ তা নয়, এর প্রভাবে ব্যক্তি ও সমষ্টির জীবনযাপন এবং মানসজগৎ উভয়েই বড় রকমের গুণগত পরিবর্তনের চাপ তৈরি হয়েছে। মানুষের স্ব স্ব জীবন নতুন ধরনের এক গতি, বৈচিত্র্যময়তা এবং ভোক্তা সুবিধার সম্মুখীন হয়েছে। এতে তাকে জড়িয়ে পড়তেই হচ্ছে। এর ওপর চলাচল ও যোগাযোগের বিশ্বায়ন এবং বাজার অর্থনীতির একচ্ছত্র দাপটেও যাপিত জীবন ও মানস জগতে গুণগত পরিবর্তনের চাপ অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এর চাপ দৈনন্দিন আহার্য ব্যবহার্য থেকে সাংস্কৃতিক বিনোদন হয়ে আধ্যাত্মিক চেতনা পর্যন্ত প্রভাবিত প্রসারিত হচ্ছে।
আমার ধারণা, পরিবর্তনের বর্তমান প্রচণ্ড চাপে নিজেদের সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত মনে করছেন সনাতন চিন্তার ধর্মীয় কট্টরপন্থী মানুষ। তাঁরা কখনোই বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে তাল মেলাতে পারেন নি। এই বকেয়া জমেছে ইউরোপীয় রেনেসাঁসের সময় থেকে। আজ তাঁরা কীভাবে নতুন চ্যালেঞ্জর মোকাবিলা করার মত গভীর মনীষার পরিচয় দেবেন? এরকম গোঁড়ামি হয়ত সেক্যুলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও তৈরি হতে পারে। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়ার দাপট ততটা মরীয়া ও মারাত্মক হবে না - তাই রক্ষা।
আমরা জানি, কট্টর ধর্মীয় মৌলবাদীদের জঙ্গি তৎপরতার, যেমন আইএস বা আল কায়েদা ইত্যাদির পেছনে আরও স্বার্থ জড়িত আছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ যেমন কলকাঠি নাড়ে তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈর-শাসকরাও এদের সৃষ্ট অস্থিরতার সুযোগ নেয়। কিন্তু এ সত্ত্বেও একথাই সত্য যে কট্টরপন্থার এই দীর্ঘমেয়াদী স্থবিরতার পেছনে চিন্তার অচলায়তনের ভূমিকাই প্রধান। আর বর্তমানে মুসলিম জঙ্গিবাদ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার কারণ স্থানীয় মোল্লাদের মধ্যে বহুকালের পুুঞ্জিভূত চিন্তার জড়তা ও জাড্য।
২০০১-এর পর থেকে এটা আর আড়ালে নেই যে দেশের অপর প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি শক্তিবর্ধক টনিক হিসেবে ইসলামি জঙ্গিদের কাজে লাগাচ্ছে। এমনকি দেশ-বিদেশ থেকে এত চাপ সত্ত্বেও বিএনপি জামায়াতকে সঙ্গে রেখে চলেছে, যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি সহানুভূতিও গোপন করছে না। তাছাড়া একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ বিভিন্ন জঙ্গি আক্রমণ ও জঙ্গি দলের সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগও কি উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে?
এই প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা থেকে আপাতত বিএনপিকে দূরে রাখার কৌশল নিয়ে এগুনো এবং সেই সূত্রে সরকারের কর্তৃত্ববাদীরূপ ধারণ যেন পরিস্থিতিরই অনিবার্য পরিণতি। হতাশার কথা হল এরকম সময়ে নাগরিকসমাজ কার্যকর এবং গঠনমূলক ভূমিকা নিতে অতীতেও ব্যর্থ হয়েছিলেন, আজও ব্যর্থ হচ্ছেন।
এসব ব্যর্থতার আড়ালে বাংলাদেশে আরও এক পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। সরকারের প্রায় সর্বময় ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে পুঞ্জিভূত হয়েছে। এবারের প্রধানমন্ত্রী ১৯৯৬-২০০১ এর হাসিনা নন, কেবল আরও পরিণত হয়েছেন তা নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত্ব ও কাজ সম্পর্কে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়েছেন, যে আত্মবিশ্বাস দেশের প্রতি অঙ্গীকারের দ্বারা বলীয়ান। উত্তরাধিকারের রাজনীতি তাঁর ক্ষেত্রে যেন নেতিবাচক হয় নি, ইতিবাচক পথেই তিনি একে চালাতে পারছেন।
একটা কথা বোধহয় ভুললে ঠিক হবে না। ইংরেজের সংস্পর্শে এসে পশ্চিমের শিক্ষায় বাংলা ও ভারতবর্ষে কালান্তরের সূচনা হয়েছিল - বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এমন কথাই লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। গত শতকের ষাটের দশক থেকেই আমরা যুগসন্ধি, ক্রান্তিকাল এমনি সব শব্দের মাধ্যমে কালান্তরের কথা বলতে  চেয়েছি। কিন্তু সত্যিকারের কালান্তর এই একবিংশ শতাব্দীর সূচনাতেই এসে হাজির। এর প্রবণতা ও সম্ভাবনাগুলো সমাজের ওপরতলা তেমনটা বুঝতে না পারলেও নিচের তলা তাতে সাড়া দিয়েছে। সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে। তাতে পুরোনো ধ্যান ধারণায় গড়ে ওঠা বসতি থেকে জীবনব্যবস্থা সবই ভেঙে পড়ছে, পাল্টে যাচ্ছে। উট পাখি হয়ে একে অস্বীকার করতে চাইলে ঠকতে হবে। বিএনপি যদি পুরাতনের অচলায়তনকেই রাজনীতিতে ধারণ করতে চায় তাহলে গণতন্ত্র সংহত হবে না। আওয়ামী লীগ সময়ের এই দাবি কতটা বুঝতে পারছে জানি না, কিন্তু মনে হচ্ছে অচলায়তন ভাঙার বারতা শেখ হাসিনা বুঝতে পেরেছেন। তাঁর মধ্যে ক্রমেই যেন নতুন বাংলাদেশের রূপকারের আত্মবিশ্বাসী দেশনেত্রীর রূপ এবং তাঁর মাধ্যমে আগামী দিনের রূপান্তরিত এক আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশের ছবি ফুটে উঠছে। বিশ্বব্যাংকের খবরদারি উপেক্ষা করে যেভাবে নিজস্ব অর্থায়নে তিনি পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করলেন তা যেন ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে তাঁর পিতার অসম সাহস ও অসীম আত্মবিশ্বাসে পাািকস্তানের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা মোকাবিলা করে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ বীরের জাতিতে রূপান্তরের ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। কালান্তরের প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে চলেছে কী?


***

Thursday, December 17, 2015

স্বাধীনতা ও বিজয়

আবুল মোমেন

প্রথমে আমাদের দাবি ছিল পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দির নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের সাথে সাথে জনগণের এ দাবিরও বিজয় হল। কিন্তু নয় মাসের মাথায় ৯২-ক ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিয়ে প্রদেশের জনমত উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় সরকারের একতরফা শাসন চাপিয়ে দেওয়ায় রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই বুঝলেন গণতন্ত্রের দাবি জোরালো করা ছাড়া জনগণের মুক্তি সম্ভব হবে না। ১৯৫৬ সনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করলে এ পথেই যেন আমাদের অগ্রগতি শুরু হল। কিন্তু একদিকে সে সরকার টানাপোড়েনের সমস্যায় ভুগেছে আর অন্যদিকে কেন্দ্রে চলছিল পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের বা কেন্দ্রের তাঁবেদার  সরকার ফিরিয়ে আনার ষড়যন্ত্র। ১৯৫৮ সনের অক্টোবরে জেনারেল আইয়ুব ক্ষমতা দখল করে নিলে সারা দেশে কেন্দ্রের একনায়কী শাসনের সূচনা হয়। সেই থেকে শুরু হল আমাদের গণতন্ত্রের সংগ্রাম।
১৯৬২-র আগে আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন শুরু করা যায় নি। বাষট্টির সেপ্টেম্বরে ছাত্রদের শিক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে এর সূচনা। আইয়ুব কিন্তু যে কোনো সামরিক শাসকের মতই দীর্ঘ মেয়াদে বা আজীবন ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলেন। সেভাবেই তিনি ক্ষমতা সংহত করার চেষ্টা করলেন এবং নিজের ব্যক্তিগত ও পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত ক্ষমতা-বলয়ের মধ্যে দেশ শাসনের সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রয়াস চালালেন। ইতোমধ্যে পাকিস্তান সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তা ব্যক্তিদের সাথে বাঙালিদের নানা স্তরে যোগাযোগ ও টানাপোড়েনের অভিজ্ঞতা প্রদেশের সচেতন মহলকে একটা স্পষ্ট বারতা জোরালোভাবেই দিতে পেরেছে। তা হল, পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাঙালির প্রকৃত মুক্তি ও আত্মবিকাশ সম্ভব নয়।
এই প্রেক্ষাপটে স্বায়ত্বশাসনের দাবি চলে এলো সামনে। শেখ মুজিবের ৬ দফাই হয়ে গেল বাঙালির প্রাণের দাবি। এ নিয়ে শেখ মুজিব ও বাঙালি নেতাদের বিরুদ্ধে আইয়ুবের দমনপীড়ন বাড়ল। হুমকির ভাষায় কথা বলতে থাকলেন আইয়ুব-মোনেম দুজনে। এর মধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করল।
ছাত্র, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে অনেকেই বুঝে গেলেন স্বাধীনতার কমে বাঙালির চলবে না। এই উপলব্ধি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করে তুলেছিল। ফলে জনগণের প্রাণের নেতা শেখ মুজিবের মুক্তি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে স্বতস্ফূর্ত আন্দোলন রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান আইয়ুবের পতন ত্বরান্বিত করে।
আইয়ুবের পরে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা করে পাকিস্তানের ক্ষমতায় এসেছিলেন আরেক সেনা কর্মকর্তা - জেনারেল ইয়াহিয়া। কিন্তু ততদিনে পূর্ব পাকিস্তানবাসী শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধুরূপে ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে বরণ করে প্রস্তুত হয়েছে স্বাধীনতার লক্ষ্যে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্যে। ফলে জেনারেল ইয়াহিয়া, জুলফিকার ভুট্টো এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সকল ধারণা নস্যাৎ করে এদেশে আওয়ামী লীগ দুটি ছাড়া সব আসনেই বিজয়ী হল। এ বিজয় দলকে দিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসক হওয়ার অধিকার। কিংকর্তব্যবিমূঢ় পাক-সরকার, রাজনীতিবিদ ও আমলাতন্ত্র আবারও ষড়যন্ত্রের রাস্তা ধরল। কিন্তু তার আগেই তো এখানকার মানুষ স্বাধীনতার জন্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জানবাজি রেখে লড়তে প্রস্তুত হয়ে আছে। পাকিস্তানের জন্যে সংঘাত এড়ানোর একমাত্র পথ ছিল নির্বাচনী ফলাফল অর্থাৎ জনগণের গণতান্ত্রিক অভিমতকে সম্মান জানানো।
তারা তা করতে চায় নি। ভুট্টো, পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা এবং বেসামরিক আমলাতন্ত্র এ ব্যাপারে আন্তরিক ছিল না।
ছাত্র-জনতা-বুদ্ধিজীবীসহ সমাজের প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষা যে জায়গায় পৌঁছেছিল তাতে পাকিস্তান সরকারের জন্যে সর্বনিম্ন করণীয় হতে পারত নির্বাচনের ফলাফল মেনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে ছয়দফার ভিত্তিকে প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন দেওয়া। আর পাকিস্তান এ দাবি না মানলে ঐক্যবদ্ধ নবজাগ্রত বাঙালির সামনেও একমাত্র পথ ছিল - স্বাধীনতা। পাকিস্তানি শাসকদের একগুঁয়েমি, অদূরদর্শিতা এবং বাঙালি-বিদ্বেষের কারণেই শেষ পর্যন্ত বাঙালিকে স্বাধীনতার পথেই হাঁটতে হয়েছে।
ফলে সাতই মার্চ যখন বঙ্গবন্ধু তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ জনতার সামনে ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন তাঁর ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা আসতেই হত। প্রাজ্ঞ জনদরদী নেতা কেবল উন্মত্ত পাক-সেনাদের সম্ভাব্য বর্বরতা এড়ানোর পথ খোলা রেখেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক এবং বাঙালি জনতা উভয়ের মনোভাব সেদিন যেখানে ছিল তাতে স্বাধীনতার পথে হাঁটা ছাড়া অন্য পথ ছিল না বঙ্গবন্ধু ও এদেশের মানুষের।
আজ চুয়াল্লিশ বছর পরে পাকিস্তান সরকার আবারও প্রমাণ করল সেদিন বঙ্গবন্ধু এবং এদেশের জনগণ ঠিক কাজটিই করেছিল। কেবল পাকিস্তানি শাসকদের একগুঁয়েমি ও বর্বরতার শিকার হয়ে নয়মাসব্যাপী গণহত্যার সম্মুখীন হয়েছি আমরা। কিন্তু ততদিনে তো বাঙালি একতাবদ্ধ এবং বীর জাতিতে রূপান্তরিত। তাই প্রতিরোধও হল, যুদ্ধও চলল এবং ন্যায় ও সত্যের বিজয়ও হল।


***

Friday, December 4, 2015

সন্ত্রাসের চক্রে জড়িয়ে পড়া কার স্বার্থে?

আবুল মোমেন

একটি সন্ত্রাসী হামলা পাল্টা সন্ত্রাসী হামলার সম্ভাবনাই তৈরি করে। প্রতিটি সন্ত্রাসের ঘটনা নৃশংসতার প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। সন্ত্রাস আরও সন্ত্রাস, নৃশংসতা আরও নৃশংসতার জন্ম দেয়। প্যারিসে গত শুক্রবার রাতের নৃশংস সন্ত্রাসের পরপর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোয়াঁ ওঁলাদ প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় নৃশংস প্রতিশোধের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ধারণা ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় ফ্রান্সের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এই হামলা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লুটবে উগ্র জাতীয়তাবাদী বিদেশি বিদ্বেষী মেরি লিপেনের ন্যাশনাল ফ্রন্ট। প্রতিশোধেরই প্রতিজ্ঞা থেকে আইএস আত্মঘাতের মাধ্যমে পশ্চিমের সাংস্কৃতিক রাজধানী প্যারিসে হামলা চালিয়েছে। প্রতিশোধ ও জিঘাংসা প্রতিশোধ ও জিঘাংসারই জন্ম দিয়েছে। যুদ্ধের মাধ্যমে যুদ্ধকে থামানো যায় না এই উপলব্ধি থেকেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সমাপ্তির পর বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন - যুদ্ধকে জয় করা গেছে, শান্তিকে নয়। তাঁর বাণী সত্য হয়েছে। বলা হয়ে থাকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে সারা বিশ্বে ছোটখাট যুদ্ধে মহাযুদ্ধের চেয়েও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
তদুপরি একথাটাও মনে রাখতে হবে হিংসা বা সন্ত্রাস কখনো ঐক্যের ভিত্তি হতে পারে না। ফলে মুসলিম বিশ্ব, বিশেষত আরবের দেশগুলো তাদের অনৈক্য ও বিভেদের পথেই চলবে। কিন্তু আক্রান্তরা মতপার্থক্য ভুলে সবসময়ই দ্রুত ঐক্যবদ্ধ হয়। পশ্চিম, বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, দ্রুত বৃহত্তর কার্যকর ঐক্য গড়ে তুলবে এবং প্রতিপক্ষের ওপর দ্বিগুণ শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়বে। প্রশ্ন হল, তাদের তখন বিশ্বস্ত বান্ধব সৌদি রাজতন্ত্র কি পক্ষ বদল করবে? উত্তরটা আমাদের জানা আছে।
বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে সমাজে হানাহানি, বিভ্রান্তি ও অশান্তি যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলতে থাকে তখনই শান্তির বাণী নিয়ে নানান ধর্মের আবির্ভাব ও বিভিন্ন ভাবান্দোলনের সূচনা হয়েছে। ইসলাম এরকমই এক অরাজক অবস্থায় নাজেল হয়েছে এ কথা বিশেষভাবে বলা হয়ে থাকে। ধর্মের তাৎপর্য এবং সাফল্য নির্ভর করে মানুষের মধ্যে শান্তি, সমঝোতা ও সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরির সামর্থ্যরে ওপর। দুর্ভাগ্যে বিষয় ধর্মের নামেই পৃথিবীতে হানাহানি হয়েছে  সবচেয়ে বেশি। ঐতিহাসিকরা বলেন রাজ্য জয় বা রাজনৈতিক কারণে যত যুদ্ধ ও প্রাণহানী ঘটেছে তারচেয়ে বেশি হয়েছে ধর্মের নামে। কেন এমনটা ঘটেছে বা ঘটে থাকে তা ঘটনাগুলো তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে।
বিশ্বের বড় সব ধর্মই বিস্তার লাভ করেছে শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে। ইসলামের প্রথম যুগে মুসলিম সমাজে খলিফাই ছিলেন শাসক। আদি খ্রিস্টান সমাজে কিছুকাল রাজা ও ধর্মগুরু একই ব্যক্তি হলেও রাজার পাশাপাশি পোপ এবং শক্তিশালী যাজকসম্প্রদায়ের উত্থান হলেও ফরাসি বিপ্লবের পরে রাষ্ট্র ও চার্চ পৃথক হয়ে যায়। কিন্তু কেবল রাজ্য বিস্তারের মাধ্যমেই তো ধর্মের বিস্তার ঘটে নি, খ্রিস্টানদের যেমন মিশনারি মুসলমানদের তেমনি পীর-দরবেশ, জ্ঞানী-গুণী, ফকির-সাধুদের মাধ্যমে ধর্ম নতুন নতুন দেশ ও সমাজে বিস্তৃতি লাভ করেছে। এটি শাসকদের জন্যে নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছিল। আব্বাসীয় খলিফাদের আমল পর্যন্ত বৃহত্তর পারস্য সাম্রাজ্য, ভারতবর্ষ, উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনে ইসলামের বিস্তার ঘটেছে। এ সময়ে মূলত ফারসি ভাষার মাধ্যমে ইসলামি মনীষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। আন্দালুসিয়ার মুসলিম মনীষীরা ল্যাটিন ও গ্রিক শিখেছিলেন এবং প্রাচীন গ্রিক ও রোমান জ্ঞান ভা-ার থেকে বহু মূল্যবান বই অনুবাদ করেছিলেন। মুসলিম দার্শনিক, বিজ্ঞানী, কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পীদের তখন বিশ্বজয়ী অবস্থান।
প্রাচীন গ্রিক, রোমান এবং পারস্যের সমৃদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূল্যবান অনেক কিছুই আত্মীকরণের মাধ্যমে মুসলিম সভ্যতার অবিস্মরণীয় অগ্রগতি ঘটিয়েছিলেন। সমঝোতা ও সমন্বয় গভীর প্রজ্ঞার পথ খুলে দিয়েছিল। মনে রাখা দরকার প্রাচীন পারস্যসভ্যতা কেবল বর্তমান ইরানে সীমাবদ্ধ ছিল না, তার বিস্তার ছিল মধ্য এশিয়া পর্যন্ত, প্রভাব ছিল আরও ব্যাপক। ইসলামের প্রভাব এই সভ্যতা ও সংস্কৃতির ভেতর থেকে কেবল মরমি সুফিবাদ নয় জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা শাখায় অসামান্য সব অবদান সৃষ্টি করেছে। পারস্য থেকে মরক্কো হয়ে স্পেন অবধি বিস্তৃত ছিল সম্পন্ন মুসলিম সভ্যতা, যার অবদানই ইউরোপীয় রেনেসাঁস ও আলোকনের পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে।
মুসলিমদের এই সমৃদ্ধ সভ্যতা ও সংস্কৃতিকেই মধ্য এশিয়া থেকে মুঘলরা ভারতবর্ষে নিয়ে এসেছিল এবং এর প্রভাবে সমৃদ্ধ প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় ও সংস্কৃতিতে স্থায়ী রূপান্তর ঘটিয়েছে। এই অবদান ও এই সত্য কেউই অস্বীকার করতে পারবে না। নরেন্দ্র মোদী বা তাঁর দলবল যতই ঘর ওয়াপসির ধুয়া তুলুক তাতে ভারতীয় সংস্কৃতিতে মুসলিম প্রভাব মুছে ফেলা যাবে না।
বিশুদ্ধতাবাদীরা আদি ইসলামের কথা বলে ইতিহাসকে - অর্থাৎ ইসলামের অগ্রযাত্রার ইতিহাসকেই - অস্বীকার করতে চাইছেন। ইতিহাসের যাত্রাপথ একরৈখিক নয়, মসৃণ নয়, বারবার কঠিন সব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে, সেসব মোকাবিলা করে তবেই এগুতে হয়। লক্ষ্য করব শাসকদের দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার সহযোগিতায় ইসলামি বিশ্বের - তীর্থ ঠিক থাকলেও - রাজধানী বা জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র বদল হয়েছে। মদিনা, দামেস্ক, বাগদাদ, কর্ডোভায়  তা স্থানান্তরিত হয়েছে। অটোমান সাম্রারাজ্যে ইস্তাম্বুলই ছিল কেন্দ্র, যদিও তখন বৃহত্তর পারস্যে অনেক উপকেন্দ্র ছাড়াও ভারতবর্ষে মুসলিম সমাজের সমৃদ্ধি ও অবদান বাড়ছিল। এসবই তো মুসলমানদের কীর্তি - এসবকে অস্বীকার করলে তাতে ইতিহাস কি অসত্য হবে না? কিংবা তাতে মুসলমানদের গৌরব বাড়ে না দৈন্য?
দীনতার অহঙ্কারের দাপটের কথা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। চিত্তের দৈন্য যেমন আত্মিক দৈন্যও তেমনি ভয়াবহ - ভয়ঙ্কর এর পরিণতি, কারণ এটা প্রায়ই আত্মঘাতী পরিণতির তোয়াক্কা করে না। আত্মঘাতী হওয়াটা ইসলামসম্মত নয় জেনেও যাঁরা তরুণদের আত্মঘাতী হওয়ার প্রেরণা দিচ্ছেন তাঁরা কাদের অস্বীকার করছেন? আল্লামা রুমী, আবদুল কাদের জিলানি (রা.), খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রা). কিংবা ইবনে সিনা, ইবনে খালদুন, আল বিরুনীদের অস্বীকার করতে হবে? হাফিজ, ফিরদৌসী, খৈয়ামের মত মহাকবিদের? নজরুলকে?
একেই বলে অন্ধতা, ধর্মান্ধতা।
পশ্চিমের স্বার্থবুদ্ধির কূটচালগুলো যেমন ক্ষমতান্ধ বিলাসী শাসকরা - যেমন সৌদি বাদশাহ - বুঝতে অপারগ তেমনি বুঝতে পারে না ধর্মান্ধ আত্মঘাতী মানুষ, যেমন আইএস। অথচ পশ্চিম বারবার প্রাচ্য ও আফ্রিকাকে পর্যদুস্ত করতে পারছে তার কারণ ক্রুসেড যুদ্ধে পরাজয়ের পর মুসলমানরা যখন দিশেহারা তখন তাদেরই মনীষীদের চর্চিত জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সহায়তায় এরা এগিয়ে গেছে। প্রাচীন ভারতের হিন্দু জ্ঞান ও বিজ্ঞান একসময় সবচেয়ে এগিয়ে ছিল, তাদের গতি থামার পেছনে ধর্মান্ধতা বড় কারণ। তারপর চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম মনীষীরা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় সবচেয়ে অগ্রসর ছিলেন, কিন্তু তারও যে গতি রুদ্ধ হল তার পেছনে যত কারণই থাক, তা কাটিয়ে উঠতে না পারার কারণ কিন্তু ধর্মান্ধতা।
ধর্ম কি পিছুটান হয়েই থাকবে? পিছনে যাওয়ার প্রেরণা দেবে না এগিয়ে চলার? আত্মঘাতী হয়ে এগুনো যায় না, হয়ত প্রতিশোধ নেওয়া যায়, জিঘাংসা চরিতার্থ করা যায়। কিন্তু তাতে জড়িয়ে পড়তে হয় হিংসা-সন্ত্রাসের ক্রমবর্ধমান বিষাক্ত এক চক্রে। এই পরিণতিকে সুফল বলব না বলব হিংসার খেসারত?
আরব বিশ্বের প্রতি পশ্চিম অবশ্যই অবিচার করছে। নিরস্ত্র মানুষকে গলায় ছুরি চালিয়ে হত্যা করা যেমন তেমনি ড্রোন হামলা চালিয়ে বাছবিচারহীন হত্যাকা-ও নিকৃষ্ট  অপরাধ। কিন্তু আরব জনগণ কি নিজেদের দেশে পশ্চিমের তাঁবেদার শাসকদের টিকিয়ে রেখে তাদের সহযোগিতা করছে না? অথবা অন্য কথায়, নিজেদের প্রতি একই অবিচার করছে না? নিজের দুর্বলতা রেখে কোনো প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই বিজয়ী হওয়া যায় না। নিজেদের দেশে দেশে শক্তিশালী বিভীষণদের ক্ষমতায় বসিয়ে রেখে প্যারিস বা বার্লিনে, নিউইয়র্ক বা ক্যানবেরায় রক্তবন্যা বইয়ের দেওয়া যাবে কিন্তু তাতে পরিস্থিতি পাল্টাবে না। দেশে দেশে মুসলিমসমাজ আরও বিভ্রান্ত হবে, হয়ত হানাহানিতে, ভ্রাতৃঘাত ও আত্মঘাতে জড়িয়ে পড়বে। এ মর্মান্তিক পরিণতি হয়ত পশ্চিমের জন্যে তামাশার বেশি হবে না।
ইসলামের গৌরব অনুভব করতে হবে, গৌরবময় ইতিহাস উপলব্ধি করতে হবে। তেমনি মানবসভ্যতার অর্জনসমূহের - ধর্মবর্ণ অঞ্চল নির্বিশেষে - উত্তরাধিকার স্বীকার করতে হবে। সত্যকে বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখলে বাস্তবকে পাল্টানোর কাজে সফল হওয়া যায় না। অন্ধতা সত্য কি বাস্তব দুটিরই উপলব্ধির পথ বন্ধ করে দেয়, অনুভূতি দেয় ভোঁতা করে, এবং মানুষ হিসেবে অর্থাৎ মানুষের মানবিক সত্তাকে, দুর্বল করে দেয়। অমানবিকতা না মনুষ্যত্বের পথ ধর্মের। এ নিয়ে বিভ্রান্ত হওয়া কি মানুষের শোভা পায়?

***


বিএনপির প্রয়োজন দূরদর্শী সিদ্ধান্ত

 আবুল মোমেন

সরকারের দমনপীড়নের মুখে বিএনপি চুপসে গেল। বারবার চেষ্টা করেও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। অনেকবারই তোড়জোর করে ঘুরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল দল, কিন্তু মামলা-মোকদ্দমা আর গ্রেপ্তার-শাস্তির চাপে হাল ছেড়ে দিতে দেখা যাচ্ছে।
আমরা নিশ্চয় বিরোধী দলের ওপর সরকারের এই বলপ্রয়োগের নীতিকে সমর্থন করি না। গণতন্ত্রে বিরোধী মত এবং বহুমত থাকবেই। ফলে সরকারের এই অসহিষ্ণুতা নিন্দনীয়।
এই নিন্দা প্রকাশের সাথে সাথে একটু বিস্ময়ও বোধ না করে পারি না যে বিএনপি কেন কোনো আন্দোলন তৈরি করতে পারল না। বিএনপি নেতৃত্ব এ নিয়ে নিশ্চয় ভাবেন, তবে তাঁদের ভাবনা যেন মূলত সরকারের ভূমিকা ও বক্তব্যেই সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ সরকারি বেপরোয়া পীড়নের মুখে মাঠে নামতে পারছে না কর্মীরা এই অভিযোগই তারা জানাচ্ছে, জনসম্পৃক্ত কোনো ইস্যুতেই তারা মাঠে নামছে না।
অতীতে বাংলাদেশ এরকম পরিস্থতি দেখেছে। ছয় দফার আন্দোলনের সময় আইয়ুব-মোনেম আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের প্রায় সকল প্রধান নেতাকেই জেলে ঢুকিয়েছিল, মামলা-মোকদ্দমায় ফাঁসিয়ে রেখেছিল। তখন দলের মহিলা নেত্রীরা, তরুণ নেতা, ছাত্র সংগঠন ও অন্যান্য অঙ্গ সংগঠন নানা কৌশলী কর্মসূচী দিয়ে তাদের রাজনীতিকে চাঙ্গা রেখেছিল। বিএনপির এসবই আছে, কিন্তু তারা নিষ্ক্রিয়, কেবল ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে তাদের চেহারা ও কণ্ঠস্বরটুকু পাওয়া যাচ্ছে। রাজনীতিতে এটুকুতে কাজ হবে না। হচ্ছেও না।
এর মূল কারণটা বলা দরকার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে দুটি পর্ব কেবল গৌরবময় তা নয়, দেশের স্বাধীনতার পেছনে মূল ভূমিকা এ দুটিরই - একটি ভাষা আন্দোলন ও  ভাষা-ভিত্তিক জাতীয়তার পক্ষে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন আর অন্যটি হানাদার-দখলদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। এই দুটি সংগ্রামেই আওয়ামী লীগ কেবল ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থাকে নি, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। এ হল বাস্তবতা। বিএনপি স্বাধীনতা-পরবর্তী দল, ফলে স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী আন্দোলনে তার যুক্ত থাকার সুযোগ ছিল না। কিন্তু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজনীতি দাঁড় করাতে গিয়ে তারা দেশের ইতিহাসের গৌরবময় দুই পর্ব সম্পর্কে নিজেদের অবস্থানকে দুর্বল তো রেখেছেই, ক্ষেত্রবিশেষে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। একুশে ফেব্রুয়ারি বা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তার সাথে সম্পৃক্ত বাংলা নববর্ষ, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী, লালন উৎসব ইত্যাদিতে এ দলের ভূমিকা নেই বললেই চলে। অথচ স্বাধীনতার পূর্ব বা পরবর্তী যে কোনো সামরিক-স্বৈরাচারের আমলে যখন প্রত্যক্ষ রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা চলে বা রাজনীতিকদের পক্ষে কাজ করা মুশকিল হয় তখন এসব উপলক্ষকে ঘিরে ছাত্র সংগঠন ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানই মাঠে সক্রিয় থেকেছে ও রাজনৈতিক ইস্যুগুলোকে জিইয়ে রেখেছে। আর এসব উদ্যোগের রাজনৈতিক সুফল একচেটিয়াভাবে পেয়েছে আওয়ামী লীগ।
বিএনপির ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে একদিকে বাংলাভাষা, বাংলা সাহিত্য, রবীন্দ্র-নজরুল-বাউলের গানসহ বাঙালি সংস্কৃতি এবং অন্যদিকে মুক্তযুদ্ধের প্রকৃত আদর্শ ও চেতনা এবং বঙ্গবন্ধুসহ এর নেতৃত্ব সম্পর্কে কী ভাবনা তা স্পষ্ট নয়।
স্পষ্ট হল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামির সাথে গাঁটছড়া, এবং তারই সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি পক্ষপাত, এমনকি দেশের ধর্মান্ধ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর প্রতি সহানুভূতি।
একটা বিষয় স্পষ্ট, এদেশের সিংহভাগ মানুষ ধর্মে মুসলমান এবং যথেষ্ট ধর্মভীরু বটে কিন্তু ভাষা, সাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অতীতের বিভ্রান্তি তারা কাটিয়ে উঠেছে। আর যে দেশের সিংহভাগ মানুষ তরুণ তাদের মনোভাবটাও বোঝা দরকার। তাদের কেউ কেউ জঙ্গিবাদের দিকে ঝুঁকছে বটে কিন্তু তা-ও ঘটছে সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা বিশ্বের ইরাক-লিবিয়া-আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্য নীতির কারণে। অধিকাংশ তরুণ তার মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের অংশীদার হতেই ভালোবাসে। বাংলাদেশ এ দুটি অধ্যায় ও অর্জনকে কী করে অস্বীকার করবে?
তদুপরি নাগরিকসমাজের সচেতন ও সৃজনশীল অংশ আপোসহীন আবেগের সাথে এ দুটি বিষয়ে অঙ্গীকারবদ্ধ। বিএনপি নেতৃত্ব এ বিষয়টি হয় অনুধাবন করছে না অথবা বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর গুরুত্ব স্বীকার করছে না।
এর ফলে সাধারণভাবেই ছাত্র ও সচেতন নাগরিকদের কাছে বিএনপির আবেদন কমে গেছে। বরং জামায়াত, যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে। আর একুশের বইমেলা, বাংলা নববর্ষ, রবীন্দ্রজয়ন্তী, নজরুলজয়ন্তী, লালনমেলা, বাউল উৎসব ইত্যাদি বাঙালির প্রাণের উৎসবে কোথাও বিএনপি নেতা বা বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয়তা বা অংশগ্রহণ দেখা যায় না। এভাবে সমাজের সচেতন সক্রিয় সৃজনশীল অংশের কাছে বিএনপি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে।
এভাবে সমাজের মূলধারার বিপরীতে বা বাইরে থাকতে গিয়ে, অনেকের সন্দিগ্ধ মনে প্রশ্ন জাগছে, দলটি কি নানা ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়ছে না?
সরকারের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র চলছে সত্য। সাধারণত সরাসরি মাঠের রাজনীতি সম্ভব না হলে যেসব বিকল্পের সন্ধান করে বিরোধী শক্তিগুলো তার একটি ষড়যন্ত্র। অতীতে আওয়ামী লীগ বিকল্প হিসেবে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও ছাত্র আন্দোলনের সহায়তা নিয়েছিল ও পেয়েছিল। ফলে তারা পাক সরকারের ষড়যন্ত্রের শিকার হলেও নিজেরা ষড়যন্ত্রে জড়ায় নি। এতে আখেরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মাথা উঁচু করে বিজয়ী বেশে বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে দলটির পক্ষে। বিএনপি এ ধরনের প্রকাশ্য প্রত্যক্ষ রাজনীতি বা রাজনৈতিক কার্যক্রম দাঁড় করাতে পারছে না। মাঝে মাঝে তাদের কোনো কোনো নেতা বা জোটভুক্ত সংগঠনের নেতা-কর্মী কিংবা সমর্থক নাগরিকদের গোপন তৎপরতার সন্ধান মিলছে। এতে রাজনৈতিক আন্দোলন দাঁড় করানো আরও কঠিন হয়ে পড়বে বিএনপির জন্যে।
আমার মনে হয় মাঠের অবস্থা ও বাস্তবতা পর্যালোচনা করে বিএনপিকে তার নীতি-আদর্শ ও কার্যক্রম ঠিক করতে হবে। আজকের দিনে রাজনীতিতে ধর্ম ও ভারতবিরোধিতার ধুয়া তুলে ব্যাপক কোনো আন্দোলন বা সুবিধা আদায় করা যাবে না। নাগরিকসমাজ ও বামপন্থীরা পরিবেশ রক্ষার যে ধারাবাহিক আন্দোলন করছে তাতে বিএনপি নেই। সাম্প্রতিক ইস্যুভিত্তিক যেসব আন্দোলন - যেমন নতুন পে স্কেল নিয়ে শিক্ষকদের আন্দোলন, তাতেও এ দলটি নেই, নেই তাদের কোনো বক্তব্য। যেখানে নাগরিকসমাজ অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে ভাষা-সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে একটি প্রগতিশীল অবস্থানেই রয়েছে সেখানে তাদের পক্ষে বিএনপিকে সহজাত বন্ধু ভাবা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের জন্যে এ অনেকটা সরকারকে নিজের ঘরের মানুষদের সামলানোর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এ বাস্তবতায় বিএনপি দর্শকে পরিণত হচ্ছে।
আবার বিএনপির প্রতি সরকারি আচরণকে সমর্থন করতে না পারলেও বিএনপির অবস্থানের কারণে সচেতন জনগণ ও ছাত্রতরুণরা অধিকাংশই এসব ইস্যুতে দর্শকের ভূমিকাই পালন করে যাচ্ছে।
দর্শকের ভূমিকা থেকে খেলোয়াড়ের ভূমিকায় তারা কি এক হবে? সেটা নির্ভর করবে বিএনপির নেতৃত্বের দূরদর্শী সিদ্ধান্তের ওপর। সেটা কি অদূরভবিষ্যতে তারা নিতে পারবে?


***

Saturday, November 7, 2015

বিপদগামীরা সংকট কত গভীর করবে?

আবুল মোমেন

আইএস, আল কায়েদা বা তালিবান নামে আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করার জন্যে মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য দেশে যে জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছে তাতে কি ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী ফুটে ওঠে? এবং এতে কি ইসলামের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়? একই প্রশ্নগুলো তোলা যায় একই উদ্দেশ্যে এ দেশে যেসব সংগঠন জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছে এবং নিরস্ত্র মানুষ খুন করে চলেছে তার ফলাফল সম্পর্কে।
হিংসাত্মক ঘটনাগুলো ঘটানো হচ্ছে ইসলামের নামে। তাদের আক্রমণের শতকরা নব্বই ভাগ ঘটছে প্রতিপক্ষ মুসলমানের ওপর। এটা ভ্রাতৃঘাতী হানাহানির চেহারা নিয়েছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একতরফা আক্রমণের শিকার হচ্ছে মুক্তচিন্তার মানুষ এবং মানবিক তথা প্রকৃত ইসলামে বিশ্বাসীরা। যে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিতর এভাবে নৃশংস হানাহানি চলে তার সম্পর্কে অন্য ধর্মের মানুষের মনে শ্রদ্ধাবোধ থাকে না। ইসলামকে একটি যুদ্ধবাজ জঙ্গি ধর্মের ছাপ লাগিয়ে দিচ্ছে তারা। অথচ ইসলাম শব্দের অর্থ শান্তি। এ ধর্মের মূল শক্তিই শান্তি ও সাম্যের বারতায়।
ইসলামের বিজয় ঠিক তলোয়ারের সাহায্যে হয় নি। সে যুগের যুদ্ধের মাধ্যমে কাউকে পরাজিত করা গেছে, পদানত করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু পরাজিত পদানত মানুষ ধর্মান্তরিত হয় বাধ্য হয়ে, অবস্থার গতিকে। কিন্তু যারা স্বেচ্ছায় সাগ্রহে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে তারা তা করেছে এর সাম্য ও শান্তির বাণী শুনে, বিশেষভাবে নানা তরিকার সাধকদের সান্নিধ্যে এসে, কথা শুনে।
আজকের এই বিশ্বায়নের এবং বাজার অর্থনীতির ভোগবাদী পণ্য-সর্বস্ব জীবনে সব দেশে প্রায় সব মানুষের অন্তরে গভীর সংকট বিরাজ করছে। এ এক ধরনের আধ্যাত্মিক সংকট। শতাব্দীকাল আগে ব্রিটিশ দার্শনিক এ. এন. হোয়াইটহেড আধুনিক কালের ঘনায়মান এই সংকটটি শণাক্ত করে বলেছিলেন চলমান ব্যবস্থার যে প্রবণতা তাতে মানুষ ক্রমেই নিজের অন্তরের শূন্যতায় গভীর সংকটে পড়বে। মানুষ তো সবসময় বিষয়-আশয় নিয়ে মগ্ন থেকে তার মনুষ্য জীবনের সার্থকতা ও চরিতার্থতা খুঁজে পায় না।
আজ এই দার্শনিকের আশংকা সত্যে পরিণত হয়েছে। এ সময়ে এ সংকটগ্রস্ত মানুষকে ইসলাম নিশ্চয় সেবা দিতে পারত। কিন্তু জঙ্গি সংগঠনগুলো ইসলামের নামে সন্ত্রাসের পথে চলে নিরস্ত্র নিরীহ মানুষ হত্যার যে ঘৃণ্য পথ ধরেছে তাতে সেই সুযোগ গভীর চ্যালঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে। এদের অমানবিক তৎপরতাই যদি ইসলামের নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেতে থাকে তাহলে অমুসলিমের মনে ইসলাম সম্পর্কে কী ধারণা হবে? শান্তিকামী নিরীহ সাধারণ মুসলমান - যাদের সংখ্যা সারা বিশ্বে কোটি কোটি - তারাই বা এর কী ব্যাখ্যা খুঁজবে?
জঙ্গি সন্ত্রাসের কারণে পাকিস্তান, আফগানিস্তান উঠে দাঁড়াতে পারছে না। জঙ্গি হানাহানির কবলে পড়ে ইরাক, লিবিয়া বিপর্যস্ত। সিরিয়ায় সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। এসবের পেছনে সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমের স্বার্থবুদ্ধির চাল আছে। তারাই তালেবান, আল কায়েদা, ইসলামিক  স্টেট সৃষ্টি করেছে, এদের অস্ত্র সরবারাহের পিছনেও তারাই রয়েছে। কারণ আমরা দেখছি গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দেওয়া সম্ভব হলে সেসব দেশে সরাসরি এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায় আধিপত্য বিস্তারের হাত বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে পশ্চিমের পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর পক্ষে। বিপর্যস্ত দেশগুলোর স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হওয়ার পর একদিকে তারাই তাঁবেদার শাসক সৃষ্টি করে পুরো অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে আর অন্যদিকে এক সময় তৈরি করা জঙ্গি সংগঠনগুলো সভ্যতা বিনাশের কাজে লিপ্ত হচ্ছে। এই সুযোগে পশ্চিমা শক্তি নিজেদের অবস্থান সংহত করার জন্যে তাদের ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় র্শীষে রেখেছে আল কায়েদা, তালিবান বা আইএস প্রভৃতি সংগঠনকে।
বাংলাদেশে ইসলাম চর্চার ইতিহাস হাজার বছরের বেশি। এখানে মূলত সুফি সাধকরাই ইসলাম প্রচার করেছেন, ইসলামের প্রসার ঘটিয়েছেন। তাঁদের শিক্ষা এবং এদেশের ঐতিহ্যের মিশ্রণে এখানে মাবতাবাদী ধারায় ইসলামের চর্চা হয়েছে ও বিকাশ ঘটেছে। বাংলার মানবতাবাদ অত্যন্ত শক্তিশালী, বিশেষত ইসলামের প্রভাবে এই মানবতাবাদে সাধারণ মানুষের অন্তর্ভুুক্তি ঘটেছে ও সাম্য মৈত্রীর চেতনা পুরিপুষ্ট হয়েছে যা পশ্চিমের মানবতাবাদে আমরা দেখি না। ইসলাম এভাবে জীবনের নানা ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে - এখানে এবং বিশ্বের নানা দেশে। এটাই ইসলামের শক্তিশালী মূলধারা।
আজ পশ্চিমের চালে এবং অশিক্ষা ও ধর্মের ভ্রান্ত ধারণা ও ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে কিছু বিপথগামী মানুষ ভ্রাতৃঘাতী সন্ত্রাসে লিপ্ত হয়ে মুসলমান ও ইসলামের বিরুদ্ধে নেমেছে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ এবং ভ্রাতৃঘাতী হানাহানি কোনো ধর্মেই স্বীকৃত নয়, ইসলামে তো নয়ই। তারা যা করছে তাকে কোরানের আলোকে জেহাদ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। এই সংকটের সময় মুসলিম সমাজ ও ইসলামের এবং মানবতার সেবায় এগিয়ে আসা উচিত প্রকৃত আলেম ওলেমাদের। সাম্য এবং ঐক্য ও শান্তির বাণী আজ জরুরি যা ইসলামের জ্ঞান ভাণ্ডার থেকে তারা দিতে পারেন।

***

Monday, October 19, 2015

শিক্ষামন্ত্রীর অসহায়তা ও হতাশা

আবুল মোমেন

পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে উদ্ভূত সমস্যাকে সরকার পাশ কাটাতে চাইছে। শিক্ষামন্ত্রীর একটি মন্তব্যে বোঝা যায় তাঁরা অনন্যোপায়। সম্প্রতি তিনি বলেছেন - যত সুপার টেকনোলজি ব্যবহার করা হোক না কেন প্রশ্নপত্র ফাঁস পুরোপুরি ঠেকানো যাবে না। যারা অপরাধী তারা সুপার টেকনোলজির চেয়েও এগিয়ে থাকে (দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ অক্টোবর, ২০১৫)। শিক্ষামন্ত্রীর কথায় ফাঁসের সত্যতার স্বীকৃতি মেলে, যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় অস্বীকৃতির সংস্কৃতি ধরেই চলছে।
যে তরুণরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নের ভিত্তিতে গৃহীত পরীক্ষা বাতিলের দাবি তুলেছে তাদের দাবির নৈতিক ন্যায্যতা অনস্বীকার্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা থেকে আমরা বুঝতে পারি এখানে আদতে কচি-মাথার নীতিবোধ আর পাকা-মাথার বাস্তববুদ্ধির টানাপোড়েন চলছে।
সরকার হয়ত ভাবছে এ পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করা হলে কৃতকার্য হয়ে ভর্তি হওয়া ছাত্ররা না পাল্টা আন্দোলনে নামে। রীতিমত সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে পড়ে যাবে সরকার। এই সম্ভাব্য বিপদ তারা ডেকে আনতে চাইছে না।
নাগরিকসমাজ নিশ্চয় ফাঁস বা দুর্নীতিমুক্ত পরীক্ষা এবং নৈতিক ন্যায্যতার পক্ষেই থাকবে। কিন্তু এটি একটি ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন বলে ক্ষতিগ্রস্ত অকৃতকার্য ছাত্রদের পক্ষে ব্যাপক ছাত্র-তরুণ ও নাগরিকসমাজের সক্রিয় ভূমিকা ঘটবে কিনা সন্দেহ। নৈতিকভাবে দুর্বল সমাজ অনবরত ছোটবড় নৈতিক ত্রুটিকে উপেক্ষা করে এবং আপস করেই চলতে অভ্যস্ত।
শিক্ষামন্ত্রী তাঁর সততার ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ন রেখেছেন, যা আজকের দিনে রাজনীতিবিদদের মধ্যে দুর্লভ। তাঁর সরল উক্তির মধ্যে এ সমাজে সৎ মানুষের অসহায়তা ফুটে উঠেছে। এইখানে আমি মনে করি নাগরিকসমাজের দায়িত্ব রয়েছে। কেননা সমাজে সততা অসহায় এতিম থাকবে, বিশেষত শিক্ষার ক্ষেত্রে, এটা কি মেনে নেওয়া যায়?
অন্যান্য ক্ষেত্রের কায়েমি স্বার্থের তুলনায় পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের দুর্নীতির ফলাফলে পার্থক্য রয়েছে। এর সাথে একদিকে ছাত্র-তরুণদের বৈষয়িক ও নৈতিক স্বার্থ জড়িত আর অন্যদিকে শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটির প্রশ্ন যুক্ত। আমরা অনেক কাল ধরে বলে আসছি শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য যদি হয়ে ওঠে পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়া তাহলে শিক্ষা নিয়ে দুর্নীতির চক্র সহজে ভাঙা যাবে না। কিন্তু পাকেচক্রে আমরা সেই চক্রের জালেই আটকেছি। আজকে গোটা শিক্ষাব্যবস্থা - প্রাথমিক থেকে  - স্নাতকোত্তর পর্যন্ত - মূলত সম্পূর্ণভাবে পরীক্ষাকেন্ত্রিক হয়ে পড়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে পরীক্ষার সম্পর্ক যে অঙ্গাঙ্গী, অন্যোন্যনির্ভর, তা সকলেই মানবেন। বিভিন্ন পর্বান্তে বা চূড়ান্ত পর্বের শেষে সনদ ও ডিগ্রি শিক্ষার ফসল বৈকি। কিন্তু তার মূল্য কি ব্যক্তিনিরপেক্ষ, অর্থাৎ মানুষটির চাইতেও বেশি?
শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা এবং অনুসৃত নীতির কারণে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাই আজ পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। এ কারণে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সকলেরই একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে পড়েছে পরীক্ষার ফলাফল। ফলাফল-নিবেদিত ব্যবস্থায় পরীক্ষায় সফল হওয়ার জন্যে উল্লিখিত ত্রিপক্ষ সবসময় মরিয়া হয়ে থাকে। সবাই যেন রেসের ঘোড়া - প্রথম হওয়ার জন্যে টগবগ করে ছুটছে। জয়ের জন্যে সবার সম্মিলিত উদগ্র চাহিদার ফলে পরীক্ষাকে ঘিরে জুয়াড়িদের আবির্ভাব হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সফল হওয়ার সহজ ও কার্যকর পন্থার সন্ধান করতে করতে স্কুলকেও পাশ কাটিয়ে পরীক্ষায় সিদ্ধিলাভের দক্ষ মোক্ষম পদ্ধতি ও ক্ষেত্র তৈরি করে নিয়েছে এই আক্কেলমন্দরা - তার নৈতিক ভিত্তি না থাকুক। গড়ে উঠেছে নোটবই ব্যবসা কোচিং সেন্টার এবং মডেল টেস্ট পদ্ধতি। মানতেই হবে বাজার অর্থনীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ব্যবস্থা। এখন উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ছাত্রদের ফরজ কাজ - নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শ্রেণিকক্ষে পাঠগ্রহণ নয় - কোচিং সেন্টারে উপস্থিত থাকা ও অবিরত মডেল টেস্ট দিয়ে পরীক্ষার্থী হিসেবে দক্ষ ও পোক্ত হয়ে ওঠা। নকল বন্ধের জন্যে নোটবই বন্ধ করার জেহাদে নেমেছিলেন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, কিন্তু ব্যবস্থার কারণে পরীক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান ক্ষুধা ও চাহিদা মেটাতে শিক্ষা-জুয়াড়িদের নোটবইসহ সব ব্যবসা বেশ জাঁকিয়েই চলছে। 
এভাবে আমরা একেবারে নিচের শ্রেণি থেকে ছাত্রদের শিক্ষার্থী সত্তার অকালমৃত্যু ঘটিয়ে তাদের পরীক্ষার্থী সত্তার বিকাশ ঘটাচ্ছি - সেটা শেষ পর্যন্ত উগ্র রূপই ধারণ করে এবং পরিণতিতে মানবিক মূল্যবোধ, সামান্য নীতিবোধেরও আকাল দেখা দেয়। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি একে অন্যের দেখাদেখি ভীত-বিভ্রান্ত অভিভাবকরা কোনো ঝুঁকিতে যেতে চান না। একেবারে প্রথম শ্রেণি থেকেই সন্তানকে কোচিং সেন্টারের বা বাড়তি গৃহশিক্ষকের জিম্মায় দিয়ে হাঁপ ছাড়েন। পুরো স্কুল জীবনে পিএসসি-জেএসসি-এসএসসি শিশুর অবসর, বিনোদন, খেলাধূলা, বেড়ানো, সৃজনশীল কাজ, সাহিত্যপাঠ, এমনকি বাবা-মা-স্বজনদের সাথে নির্মল সময় কাটানো সবকিছুই শিকেয় ওঠে। এভাবে কেবল ছাত্রের মানুষ হওয়া কঠিন হচ্ছে তা নয়, সংশ্লিষ্টদের এবং এই তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যে সৃষ্ট ভাগ্যান্বেষণের সুযোগ নিতে তৎপর ‘বুদ্ধিমানদের’ মন্যুষ্যত্ব বোধ ক্রমেই বিলুপ্ত হবে। ফলে প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ নানা দুর্নীতি পিছু ছাড়বে না।
এভাবে বেড়ে উঠে অধিকাংশ শিশু প্রায়ই কৃতিত্বের সাথে বিভিন্ন পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ ডিগ্রিধারী ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল-আমলা হলেও সমাজচিত্র কি বলছে? ভালো মানুষের আকাল দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না? এভাবে চললে সব প্রতিষ্ঠান, সব ব্যবস্থা ঘুণে ধরবে। চকমিলানো রাস্তা, ভবন বাড়বে, চকচকে-ঝকঝকে মানুষ হয়ত বাড়বে, তবে দখলদারি, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতি, নেশা, প্রশ্নপত্র ফাঁস ইত্যাদি থামবে না।
প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানো যাবে না? - বালাই ষাট্, এমন কথা মানতে নেই! বাঙালি এতটা অক্ষম জাতিতে পরিণত হয়নি। কেননা এ ফাঁস কার গলায় শক্তভাবে লাগছে? অবশ্যই ভবিষ্যত প্রজন্মের গলায় এবং পরিণামে দেশের।
আমাদের ধারণা শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণা সঠিক হলে এবং সে অনুযায়ী মানুষ, অবশ্যই কর্মদক্ষ মানুষ, তৈরিতে যথার্থ পদ্ধতির আশ্রয় নিলে দুর্নীতির ফাঁসে শিক্ষাকে ফাঁসি দিতে হয় না। শিক্ষার প্রতিটি স্তরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অত্যন্ত পরিস্কার। বিষয়টি বুঝে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত আমাদের সবার জন্যে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বিষয়টা সরকার বা শিক্ষামন্ত্রী যে বোঝেন না তা নয়। বোঝেন বলেই ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সনেই শিক্ষা কমিশন গঠন করেন, তিন মাসের মধ্যে কমিটি খসড়া রিপোর্ট দেয় এবং আনন্দের বিষয় ছিল অতীতের ধারা ভেঙে এ প্রতিবেদনটি সর্বমহল গ্রহণ করেছে। এটি নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণে কথা থাকলেও মোটের ওপর এটি ধরে এগিয়ে গেলে শিক্ষার ব্যাধি - মুখস্থ, নোটবই, পরীক্ষা ও ফল-কেন্দ্রিকতা কাটিয়ে ওঠা যেত। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় পরীক্ষা অবশ্যই থাকবে। কিন্তু থাকবে আরও অনেক কিছুর সাথে অনুশীলনের অংশ হিসেবে। ঘন ঘন পরীক্ষার ফলে জ্ঞানানুশীলনের ধারাবাহিকতায় বাধা বা ছেদ পড়তে থাকলে শিক্ষার্থী এবং সংশ্লিষ্ট সকলে অভ্যস্ত হয়ে যায় প্রশ্নের উত্তর-আকারে জ্ঞানের বিষয়টিকে দেখতে। জ্ঞানের বা বিষয়ের অখ-তা ও ধারাবাহিকতা সম্পর্কে তাদের ধারণা তৈরি হয় না। এরকম ব্যবস্থায় অভ্যস্ত মানুষের পক্ষে, বড় হয়েও, কোনো পূর্ণাঙ্গ বই পড়া, জটিল ব্যাখ্যা বা দূরূহ বিষয় ধৈর্য ধরে পড়া, শোনা বা বোঝার অভ্যাস তৈরি হয় না। এতে মানুষটার সর্বনাশ হয়ে যায়, কারণ এতে  শিক্ষার যে চূড়ান্ত লক্ষ্য একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করা এবং তাই প্রকৃত স্বাধীন এবং তাই আত্মবিশ্বাসী ও আত্মমর্যাদাশীল ব্যক্তির যোগ্যতা দেয়া, তা সম্পূর্ণ বিফলে যাবে। কেবল একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষের বিবেচনা ও দায়িত্ব বোধ তৈরি হয় এবং তাই নিজের নিজের মর্যাদার পরোয়া করেন। অর্থাৎ মানুষ হিসেবে তাঁর চরিত্র গঠিত হয়। তেমনি মানুষ প্রশ্ন ফাঁস করাকে হীন কাজ বলে বুঝতে পারেন, এবং বড় কথা হল, এর সাথে নিজেকে যুক্ত করতে তাঁর রুচি ও নৈতিকতায় বাধবে। ভালো মানুষ ও মানবিক সমাজ নির্মাণে উপযুক্ত শিক্ষাকে অগ্রাধিকার না দিলে পুলিশ-র‌্যাব-ডিবি, সিসিক্যামেরা-টহলদারি-নজরদারি, জঙ্গিবাদ-নেশাগ্রস্ততা-অপরাধ, রাজনীতির দেউলিয়াপনা-সংস্কৃতির সংকট-সমাজের অবক্ষয় এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন ইত্যাদি কেবল বাড়তে থাকবে। তখন হয় মনে হবে প্রশ্নপ্রত্র ফাঁস কোনো গুরুতর বিষয় নয় অথবা তা জেনেও এ উৎপাত মেনে নিতে হবে। 
এটা আদতে গুরুতর বিষয়। কেননা এতে সমাজে শিক্ষার সংকট লেগেই থাকবে, তেমনি থাকবে জাতির চরিত্র গঠনের সমস্যা। প্রশ্ন হল যে কথাটা আমরা জানি এবং মানি, যে কারণে ক্ষমতায় এসে সরকার শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিল, তিনমাসে প্রতিবেদন প্রণয়ন এবং সে বছর থেকেই তা ধাপেধাপে বাস্তবায়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিল তাকে কেন উপেক্ষা করা হচ্ছে? আমরা জানি না অর্থের অভাবে না অন্য কোনো কারণে সরকার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে হাত দিচ্ছে না। তবে এটা স্পষ্টভাবে বলা যায়, বাজেটে শিক্ষাখাতে জিডিপির তিন শতাংশের নিচে বরাদ্দ রেখে সংখ্যাগত উন্নতি সম্ভব হলেও গুণগত মান অর্জন সম্ভব নয়। তার জন্যে অন্তত আন্তর্জাতিক মান ৬% বিনিয়োগ প্রয়োজন। বর্তমান পরীক্ষার ফলের পিছনে ছুটে সংখ্যাগত সাফল্য আসবে, কিন্তু গুণগত মান অর্জন ঠেকে থাকবে। এ বাস্তবতায় যে একদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁসকারীদের ঠেকানো যাবে না এবং অন্যদিকে সমস্যার জবাব দিয়ে গুণগত মান অর্জনের অভীষ্ট পথে চলা সম্ভব নয় তা বুঝে শিক্ষামন্ত্রীকে বারবার হয় অসহায়তা নয়ত হতাশা প্রকাশ করতে হবে। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।

Thursday, October 1, 2015

সিরিয়া সংকটের সমাধান ইউরোপের হাতে

আবুল মোমেন

২০১১ সালে সিরিয়ায় যখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয় তখন সে দেশের জনসংখ্যা ছিল ২২ মিলিয়ন বা দুই কোটি ২০ লক্ষ। গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে এযাবৎ ৪০ লক্ষ মানুষ দেশান্তরিত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন। আরও ৮০ লক্ষ মানুষ দেশের ভিতরেই উদ্বাস্তু হয়েছেন। হিসেব কষলে দেখা যায় দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ গত ৪ বছরে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। আর দেশান্তরী হতে গিয়ে রক্ষণশীল হিসেবেও অন্তত তিন হাজার মানুষ ভূমধ্য ও ইজিয়ান সাগরে ডুবে মারা গেছেন, যাদের মধ্যে শিশু আয়লান কুর্দি ও তার বোন এবং তাদের মত অসংখ্য শিশুও রয়েছে।
আমরা দেখেছি সাদ্দাম হোসেন-উত্তর ইরাকে পুনর্গঠনের কাজ স্থানীয় বিবদমান গোষ্ঠীর ভ্রাতৃঘাতী হানাহানির কারণে বারবার কেবল ব্যাহত হয়নি, এক অর্থে তা ব্যর্থ হতেই চলেছে। সেখানে শূন্যতা সৃষ্টি না হলে ইসলামিক স্টেট কীভাবে ইরাকে এত শক্তিশালী হয়, এতটা জায়গা দখলে নেয়, এত নৃশংসতা চালায়?
সিরিয়া আপাতত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের শেষ টার্গেট। সাদ্দাম, গাদ্দাফির মত বাশার আসাদকে এ পর্যায়ে তারা সর্বশেষ শিকার হিসেবে দেখতে চায়। বাশারকে রাশিয়া সমর্থন দিচ্ছে, ইরানও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তবে  গুরুত্বপূর্ণ হল রাশিয়ার ভূমিকা ও সমর্থন। রাশিয়া কি পরাশক্তি হিসেবে তার হৃতসম্মান পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে সিরিয়াকেই পরীক্ষার গিনিপিগ হিসেবে বেছে নিচ্ছে? গিনিপিগের ওপর পরীক্ষা চালালে নিজের তেমন ক্ষতি নেই। পুতিন বলেছেন সিরিয়াকে বাশার ও ইসলামি স্টেটের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে। বিপরীতে পশ্চিমা মিত্রশক্তির বক্তব্য হল, সিরিয়ার জন্যে দুটিমাত্র বিকল্প নয়, তৃতীয় বিকল্পটিই একমাত্র পথ। বাশার এবং ইসলামি স্টেট উভয়কেই পরাভূত করে উদারপন্থী বাজার অর্থনীতির সমর্থক সরকার বসাতে হবে। এতে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার আশংকা এবং সিরিয়াবাসীর দুর্দশা অন্তহীন হয়ে উঠবে। ভয় হয় ভাবতে আরও কত লক্ষ মানুষের প্রাণ গেলে এবং দেশ গেলে তবে সিরিয়াবাসীর ‘বন্ধুরা’ শান্ত হবে।
বাঙালি কবির বাণী শিরোধার্য করেও কুহকিনী আশার ছলনে একটু হলেও সাড়া দেওয়া যায়। কারণ ইউরোপের শরণার্থী নেওয়ার এবং মানবতার দু:খজনক বিপর্যয় সহ্য করার ক্ষমতার শেষপ্রান্ত দেখা যাচ্ছে। তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির ওপর সুবিন্যস্ত মলাট ভেতরকার সংকট ও তিক্ত চেহারা আর ঢাকতে পারবে না। কিন্তু ইউরোপ কি সভ্যতার বড়াই এমনি ছেড়ে দেবে? এখানেই সিরিয়াবাসীর জন্যে সামান্য সম্ভাবনার আলো দেখা যাচ্ছে।
আবার ইউরোপে কিছু মৌলিক সংকটও দেখা দিয়েছে। যুক্তরাজ্য ই ইউ থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তা ছাড়ে নি, নতুন নির্বাচনও গ্রিসের সংকট থামাতে পারবে না এবং খোদ ইউরোপের পূর্ব ও পশ্চিমের দেশের মধ্যে বিভেদ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। এগুলোকে এড়িয়ে ইউরোপ কীভাবে সব দিক রক্ষা করবে তাই সামনের কয়েকটি দিনে দেখতে হবে। সময় খুবই কম। তাদের অত্যন্ত দ্রুততার সাথে সমস্যার জট খুলতে হবে এবং সম্ভবত চির-ধরা ঐক্যের বাঁধনটা সময়মত সারাতে হবে। এ ছাড়া ইউরোপের জন্যে অন্য বিকল্প  নেই বলেই মনে হয়।
জার্মেনি ইউরোপীয়  ঐক্যের নেতার ভূমিকা নিয়েছে, চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল তাঁর চেষ্টা থামান নি। ফ্রান্স প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে সঙ্গে থাকার চেষ্টা করছে। কিন্তু সিরিয়া সংকট এবং তা থেকে উদ্ভূত অব্যাহত শারণার্থী প্রবাহ তাদের যেন ভাববারও সময় দিচ্ছে না। কৌশল নির্ধারণে এবং তা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তের জন্যে যে দূতিয়ালি, সংলাপ-আলাপ চালাতে হয় তার ফুরসৎ নেই। শরণার্থীর চাপে গ্রিস, বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়া, হাঙ্গেরি জেরবার। তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং পশ্চিমের সাথে সম্পর্কে টানাপোড়েন বাড়ছে। ইউরোপের স্বার্থে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ দ্রুত থামা দরকার। যুদ্ধ থামানো কি সমাধান? রাশিয়ার জন্যে হ্যাঁ, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে না। এখনও অবস্থা এরকমই।
এ পর্যায়ে একমাত্র এই ভয়াবহ মানবিক ট্র্যাজেডি থামাতে পারে ইউরোপ, তার নিজের প্রয়োজনের জরুরি তাগিদ থেকে। ইউরোপে অস্থিরতা চলতে থাকলে, অনৈক্যই সত্য হয়ে দাঁড়ালে গোটা বিশ্বের ভবিষ্যত ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমরা জানি না  ইউরোপের দেশগুলো যুগপৎ ঐতিহাসিক ও মানবিক এই দায়িত্ব পালন করবে কিনা। 

Sunday, September 20, 2015

বারবার তারা কেন জয়ী হবে?

আবুল মোমেন

এই যে লিবিয়া ইরাক এবং সম্প্রতি সিরিয়া থেকে দলে দলে মানুষ দেশত্যাগী হয়ে পাড়ি দিচ্ছে তার মূলে গেলে কোন চেহারাগুলো ভেসে উঠবে তা যেন ইউরোপীয় নেতৃবৃন্দ বুঝতে পারছে না। ব্রিটেন ওদের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি অনুদার মনোভাব নিয়েছে। উত্তর-পশ্চিমের সুইডেন দুয়ার খুলতেই নারাজ। ফ্রান্সও দুয়ার এঁটে বসে থাকতে চাইছে। জার্মেনি-অষ্ট্রিয়ার সরকারি ঔদার্য অবাধ ছিল না, উদ্বাস্তুর সংখ্যা লাখ ছোঁয়ার আগেই তটস্থ হয়ে ওরা সীমানা বন্ধ করে দিয়েছে। মনের কথা খুলে বলেছেন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী - মুসলমান উদ্বাস্তু নিতে তাঁর আপত্তি আছে। তাঁর মনোভাব হচ্ছে তাঁরই মত পুরো ইউরোপেরও আপত্তি থাকা উচিত।
লিবিয়া ইরাক সিরিয়া থেকে হঠাৎ বাঁধভাঙা ঢলের মত দারা-পুত্র-পরিবার নিয়ে মানুষ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ছাড়তে চাইছে কেন? আর কেউ না বুঝলেও ইউরোপেরই তো জানার কথা। 
তিনটি দেশে যে অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে কারা? এসব অঞ্চলে যে আইএস আর আইএসআইএল নামে মুসলিম জঙ্গি সংগঠন সৃষ্টি হয়ে মানবতা ও মানবসভ্যতার বিরুদ্ধে তা-ব চালাচ্ছে তাদের এই সুযোগটা তৈরি করে দিয়েছে কারা? কারাইবা তৈরি করেছিল আল-কায়েদা, তালেবান? কারা পেছনে ছিল ওসামা বিন লাদেন কিংবা মোল্লা ওমর অথবা জওয়াহিরি-বকরদের উত্থানের পিছনে? একটু খবরাখবর যারা রাখেন তারা অবশ্যই জানেন কোন দেশগুলোর অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি অস্ত্রব্যবসায়? মানুষ এও জানে ডব্লিউএমডি বা গণবিধ্বংসী অস্ত্র মওজুদের অজুহাত তুলে কারা স্থিতিশীল দেশ ইরাক আক্রমণ করে সাদ্দামকে হত্যা করে ইরাকে বর্তমান গৃহযুদ্ধের নৈরাজ্য সৃষ্টির মূলে। মানুষ জানে গণতন্ত্রের নামে লিবিয়া-আফগানিস্তানে উপজাতীয় বিবাদ উশকে গৃহযুদ্ধের অবস্থা তৈরি করেছে কোন মিত্রশক্তি। আজ সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে হটানোর নামে কারা সে দেশের স্থিতিশীলতা ভেঙে দিয়ে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়েছে? তা কি কারো অজানা? আজকের ইউরোপ অভিমুখী উদ্বাস্তু পরিবারগুলো তো এসব গৃহযুদ্ধেরই বলি।
অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রই এই মারাত্মক মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টির মূল কারিগর। ব্রিটেন-ফ্রান্স-জার্মেনি মৈত্রী সূত্রে গণতন্ত্রের নামে এসব আগ্রাসনে অংশ নিয়েছে। সুইডেন খুচড়ো অস্ত্রের ব্যবসায়ে শীর্ষদের অন্যতম। কে না জানে গৃহযুদ্ধে ব্যবহৃত হয় এরকম অস্ত্রই। আইএসের কাছ থেকে কিংবা দস্যুতায় লিপ্ত গোষ্ঠীগুলোর কাছে থেকে তেল কিনছে যে সব বহুজাতিক কোম্পানি তাদের মালিকানা কাদের সেসবও সবারই জানা। আর ইতিহাসের পাতা ধরে পিছিয়ে গেলে জানা যাবে কীভাবে ব্রিটেন-ফ্রান্স-স্পেন-পর্তুগাল ছাড়াও হল্যাণ্ড-বেলজিয়ামের মত ছোট ছোট ইউরোপীয় দেশও একসময় এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকায় উপনিবেশ স্থাপনের জন্যে হামলে পড়েছিল। আমরা জানি কী পাশব নৃশংসতায় তারা সব লুটে নিয়েছে উপনিবেশগুলোর। ছোট্ট প্রশ্ন - আজ পর্যন্ত সেসব বহুজাতিক কোম্পানির আড়ালে তেল ও অন্যান্য খনিজের ওপর প্রভুত্ব বজায় রাখছে কারা? মানুষ তো সব জানে। ইউরোপের বিত্ত, ঐশ্বর্য আর নাগরিকদের উচ্চমানের জীবনের পিছনে বিপুল পুঁজির যোগান এসেছে কীভাবে সে ইতিহাস আজ কারো অজানা নেই।
পালের গোদা আজ অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র এবং তারা যথেষ্ট ধূর্ততার সঙ্গে কাজ চালাচ্ছে। দেখুন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে কতকগুলোতে - সৌদি আরব, কুয়েত, আরব আমিরাত প্রভৃতিতে - আছে তাদের বশংবদ সরকার। সেখানে নিজেদের স্বার্থে তেলের ব্যবসা চালিয়ে যেতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। অতএব এসব দেশে অগণতান্ত্রিক সরকার বহাল থাকলেও  গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনো তাগিদ তাদের নেই, মানবাধিকার নিয়ে মাথাব্যথা নেই। উত্তর আফ্রিকা ও মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে তুলনামূলকভাবে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও আধুনিক জীবনব্যবস্থায় অগ্রগামী ছিল লিবিয়া ও ইরাক। তদুপরি এ দুটি দেশের সরকার-প্রধান সাদ্দাম হোসেন ও মুয়ামার গাদ্দাফি ছিলেন স্বাধীনচেতা, এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। তাই এসব দেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিম অস্থির হয়ে পড়েছিল। সরাসরি হস্তক্ষেপ করে দেশ দুটি তছনছ করে দিয়েছে। ইরান আর সিরিয়াকে বাগে আনতে না পেরে বড়ই পেরেশানে  আছে পশ্চিম। অবশেষে সিরিয়ার ব্যাপারে ধৈর্য রক্ষা করা গেল না। আক্রমণে এগিয়ে এলো আইএস - স্বার্থ সিদ্ধি হচ্ছে পশ্চিমের।  আর এরই খেসারত হিসেবে এত মানুষের ঢল ইউরোপ অভিমুখে। যুক্তরাষ্ট্র জানে উত্তর আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে তার দেশে ঢোকা সম্ভব নয়। যদি যায় তো ভূমধ্যসাগর অথবা তুরস্ক হয়ে ইজিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাবে মানুষ। ফলে তার গায়ে আঁচড়টিও লাগবে না। 
সাম্প্রতিক উদ্বাস্তু ঢলকে এসব অঞ্চলে পশ্চিমের হস্তক্ষেপ ও ভুল নীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। কিন্তু এও আমরা জানি জাতিসঙ্ঘ বলুন আর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা বা শরণার্থী কমিশন বলুন সর্বত্রই ওদের স্বার্থ বিবেচনার মানুষ রয়েছেন। তদুপরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের সমর্থকরাই পাল্লায় ভারি। তারা তো শক্তি ও বিত্তের জোরে বিশ্বব্যবস্থাটা নিজেদের মত করে সাজিয়ে নিয়েছে।
পশ্চিমা উন্নত জীবন ও গণতন্ত্রের স্বপ্ন  দেখিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে বিশ্বশক্তির ভারসাম্যই শুধু নষ্ট করা হয় নি, তৃতীয় বিশ্বের স্বতন্ত্র অস্তিত্বও বিলীন হয়েছে এতে। গণতন্ত্র ও বাজার অর্থনীতির ধুয়া তুলে একমেরু বিশ্বের নেতারা তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশকেই শক্ত স্বাধীন অবস্থানে থাকতে দিচ্ছে না। এভাবেই ভেঙে গেছে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন, অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে আফ্রো-এশীয় সংহতি পরিষদের, শক্তিহীন ও গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে আফ্রিকান ঐক্য সংস্থা, আরব লীগ, ওআইসির মত সংগঠনগুলো। বরং ডব্লিউটিও এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর ভূমিকা জোরদার করে পশ্চিমই এককভাবে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় চলে এসেছে।
আমার তো মনে হয় মর্যাদা ও স্বার্থ রক্ষার জন্যে এশিয়া ও আফ্রিকার দেশসমূহের উচিত হবে জাতিসঙ্ঘের পাশাপাশি নিজেদের একটি স্বতন্ত্র জাতিসঙ্ঘ গড়ে তোলা। ইউএনওর পাশাপাশি ইউএনএএ বা ইউনাইটেড ন্যাশনস্ অব এশিয়া অ্যা- আফ্রিকা গঠিত হওয়া উচিত। ইতোমধ্যে চীন যেভাবে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প হিসেবে আরেকটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে তেমন সব উদ্যোগ নিতে হবে। নিজেদের বিবাদ মিটিয়ে চীন এসব উদ্যোগে ভারত ও জাপানকে সম্পৃক্ত করতে চাইছে। তাতে অগ্রগতিও আছে, যুক্ত হবে রাশিয়া - যেদেশটি ইউরোপ ও এশিয়ায় ছড়িয়ে আছে। ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া গুরুত্বপূর্ণ সদস্য দেশ হতে পারে।
এশিয়া আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার এইসব দেশের বিকল্প শক্তি দাঁড় করাবার সামর্থ্য রয়েছে। এসব দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিলে, ক্ষমতার স্থিতি নষ্ট হতে থাকলে সন্দেহ করতে হবে যে তার পেছনে পশ্চিমের স্বার্থান্ধ সাম্রাজ্যবাদের হাত আছে কিনা। কারণ, অতীতের এবং সাম্প্রতিক কালের সব ঘটনার পেছনেই তাদের হাত ও কারসাজি তো জলজ্যান্ত সত্য বিশ্ববাসীর সামনে। দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তি মানুষ মানবিক ও উদার হলেও রাষ্ট্রশক্তি শেষ পর্যন্ত স্বার্থান্ধ হয়ে পড়ে। ফলে আরও সাবধানতা দরকার। ওরা বারবার ধর্মের কার্ড খেলে চলেছে, উত্তরোত্তর কট্টর জঙ্গি পন্থীদের ভরসা করছে ও উশকে দিচ্ছে। মুখে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের বুলি আওড়ালেও এসব কি কোথাও তারা বাস্তবায়ন করেছে, করতে পেরেছে যেসব দেশে হাজার হাজার মানুষ খুন হয়েছে আর লাখ লাখ মানুষ মাতৃভূমি ত্যাগে বাধ্য হয়েছে এর খেসারত হিসেবে? না, তারা পারে নি, কারণ গণতন্ত্র রফতানি-যোগ্য পণ্য নয়। একইভাবে মানবাধিকার বা আইনের শাসনও রফতানি করা যায় না। তা সংশ্লিষ্ট জনগণকেই অর্জন ও আদায় করতে হয়। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুতে সে প্রক্রিয়াকে তারা বরং ব্যাহত করেছে।
ধর্মের আফিমের মত ব্যবহার গরিব দেশে এখনও কার্যকর - এটা মস্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়। উগ্র ও জঙ্গি ধর্মপন্থার আড়ালে সাম্রাজ্যবাদ নতুন নতুন কায়দায় ঠিকই তার স্বার্থ হাশিল করে যাচ্ছে। এতে মানুষের সত্যিকারের ধর্মবোধ, মানবিক নৈতিকতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অযথা বিঘ্ন ঘটছে। সাম্রাজ্যবাদ অবশ্যই বরাবরই চতুর ধূর্ত খেলোয়াড়। কিন্তু বারবার তারাই জয়ী হবে?

Monday, September 14, 2015

মিলানেও উচ্চারিত হল সংস্কৃতির গুরুত্বের কথা

আবুল মোমেন

আরব বিশ্বে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের যোদ্ধাদের হাতে একের পর এক প্রাচীন সাংস্কৃতিক নিদর্শন ধ্বংস হওয়ার পর রণাঙ্গনের বাইরেও প্রতিকার নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক যে সংস্থাটি মানবসভ্যতার এসব মূল্যবান প্রত্নসম্পদ রক্ষার কাজে নিয়োজিত সেই ইউনেস্কো সঙ্গতভাবেই এগিয়ে এসেছে। এরই রেশ ধরে ইতালির সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রী বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডেকেছিলেন মিলানে। মিলান এক্সপো ২০১৫-এর সম্মেলন কক্ষে এটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে আমাদের সংস্কৃতি সচিবের সাথে আমারও যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল।
এতকাল সাংস্কৃতিক নিদর্শন রক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা দুর্ঘটনা অথবা পাচারকারীদল। কিন্তু এরকম স্বেচ্ছাপ্রণোদিত পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ এক অভাবিত ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। এরকম পরিস্থিতি অভিনব, এরকম প্রতিপক্ষও কল্পনাতীত ছিল সকলের। মিলানে আলোচনার একটি মোদ্দা শিরোনাম ছিল : জাতিসমূহের মধ্যে সংলাপের উপকরণ হিসেবে সংস্কৃতি। এতে উপস্থিত ৮৫টি দেশের মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের মধ্যে দু’দিনে (৩১ জুলাই ও ১ আগস্ট) ৫৭ জন কথা বলেছেন। প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ সময় ছিল ৪ মিনিট করে। ইতালির সংস্কৃতি ও পর্যটন বিষয়ক মন্ত্রী ও লেখক দারিও ফ্রান্সেসচিনি এতসব কেউকেটা ব্যক্তিদের সামলেছেন ভালোভাবেই। মিনিটখানেকের বেশি বাড়তি সময় কেউ নিতে পারেন নি। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রীকে বরাদ্দ সময়ের মধ্যেই কথা শেষ করতে হয়েছে। মাইক্রোফোনে কলম বেশ জোরেই ঠুকে সময়-সচেতন করেছেন সকলকে। বক্তৃতায় প্রত্যেকেই নিজ নিজ সংস্কৃতির মানবিক ঐতিহ্যের দিক তুলে ধরেছেন, পাশাপাশি সংস্কৃতি আদানপ্রদানের গুরুত্বও স্বীকার করেছেন। বাঙালি সংস্কৃতির মানবিক ঐতিহ্যের ধারা এবং বর্তমান সরকারের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী কঠোর ভূমিকার কথা আমাদের দিক থেকে সংস্কৃতি সচিব ভালোভাবে তুলে ধরেছেন।
মানবিক সংস্কৃতির ধারা ও সাংস্কৃতিক সম্পদ রক্ষা যে যুদ্ধের মাধ্যমে সম্ভব নয় তা সকলেই বুঝতে পারছেন। এটি কেবল স্থানীয় কিছু মানুষের সচেতনতাতেও সম্ভব হচ্ছে না। এর জন্যে সকলের চিন্তার নৈকট্য দরকার এবং তাই সব দেশ মিলে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলা জরুরি। এভাবে একটি সম্মিলিত বৈশ্বিক প্রয়াস দ্রুত প্রণীত ও বাস্তবায়িত হওয়া দরকার। সেই তাগিদ থেকেই মিলানের এ সম্মেলন।
বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের এ উপলব্ধি উপস্থিত নগণ্য আমাকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে। এর একটি বিশেষ কারণ আছে। ১৯৭৫-এর পট-পরিবর্তনের পর দেশে যখন আমাদের জন্যে দমবন্ধ-করা পরিবেশ তখন তেমন কিছু না ভেবে শিশুদের আনন্দে-সৃজনে মাতিয়ে রাখার যে কাজ শুরু করেছিলাম তা পাঁচ বছরের মধ্যে শিশুশিক্ষার কাজে টেনে নিয়েছিল আমাদের। কাজটার প্রাথমিক তাড়না এসেছে প্রতিষ্ঠান রক্ষার প্রয়োজনে। তার সাথে ছিল শিশুদের মানসগঠনে বুনিয়াদ তৈরিতে ভূমিকা রাখার তাগিদ। বুঝতে পারছিলাম শিক্ষা হল মূল জায়গা, সেখানে কাজ না হলে তাদের মনে স্থায়ী প্রভাব ফেলা যাবে না।
কাজ শুরু করে বুঝতে পারলাম প্রথাগত শিক্ষার ধারা আমাদের কাজে আসবে না। নিজেদের পথ নিজেদেরই তৈরি করতে হবে। মাটি তৈরি না করেই শিশু-চারার কাছে ফল চাওয়ার যে প্রচলিত ধারা তা আমাদের অন্যায় এবং নিষ্ঠুরতা বলে মনে হয়। আমরা দুটো বক্তব্যের ওপর জোর দিয়েছিলাম - ভয়হীন আনন্দময় পরিবেশে শিক্ষা এবং পরোৎকর্ষ (perfection) নয় অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি। অভিভাবকদের ডেকে বললাম আমাদের ওপর আস্থা রাখতে, ব্যক্তিগতভাবে আমি ও অধ্যক্ষা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের জিম্মাদার হতে চাইলাম। আমাদের কথা ছিল - এ বয়সে অন্তত তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ওরা কেবল গ্রহণ, সংগ্রহ ও সঞ্চয় করবে - এর পরিমাপের দায়িত্ব থাকবে কেবল স্কুলের। স্কুলই দেখবে তাদের ভাণ্ডারে কতটা ছড়া, কবিতা, গল্প, নানা তথ্য, বিভিন্ন ধারণা, জ্ঞানের কথাবার্তা জমা পড়ছে এবং যা জমছে তার মান কেমন। এ পর্যায়ে তাদের গোগ্রাসে নিতে দিন - সব ইন্দ্রিয় পূর্ণ সত্তায় নিতে থাকুক। আমরা বলেছিলাম, একটু চ্যালেঞ্জ দিয়েই, ওদের ভিত্তির পরিসরটা আমরা অনেক বড় ও গভীর করে দেব, তাতে বড় হয়ে কোনো পর্যায়েই আর তাদের ঠেকতে হবে না। তারা নিজের শক্তিতেই এগিয়ে যাবে। প্রথম বছরে আমাদের ওপর আস্থা রাখলেন ১৫ জন অভিভাবক। তারা নানা রকম পরিবার থেকে এসেছেন - উচ্চশিক্ষিত চাকুরে, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, মাঝারি দোকানদার, তবে বেশির ভাগ ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত চাকুরে পরিবারের ছেলেমেয়ে। বলাই বাহুল্য, অভিভাবকরা নিশ্চিন্ত ছিলেন না, এরকম নিরীক্ষাপ্রবণতার ঝুঁকিটা তাঁদের সবসময় ভাবিত রাখত। অধ্যক্ষা হিসেবে শীলা মাঠে থেকে অভিভাবকদের প্রাত্যহিক চাপ সামলে গেছে। সবার কথা ছোট্ট পরিসরে বলা যাবে না, প্রথম যে ছাত্রটি ভর্তি হয়েছিল, টিঅ্যাণ্ডটির সীমিত আয়ের চাকুরে পিতার সন্তান, সে এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান। এভাবেই আমরা চলেছি, এবং চেয়েছি চালিয়ে যেতে। 
আমরা চেয়েছি ওদের মনের সবকটা জানালা সবসময় খোলা রাখতে। পরীক্ষা এক ধরনের কপাট, আবদ্ধতা তৈরি করে। একে বড় করে তুলে বাধার প্রাচীর বানিয়ে কোনো চাপ তৈরি করতে চাই নি। প্রত্যেক ছাত্র গাইতে পারত, আবৃত্তি পারত, গল্পবলা, বিতর্ক - সবই পারত (এখনও স্কুলে ছাত্রসংখ্যা অনেক বাড়ার পরও বেশিরভাগই পারে)। পঁচিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে প্রাক্তনীদের স্বতস্ফূর্ত ও সপ্রতিভ সব পরিবেশনা দেখে উপস্থিত বহুজাতিক কোম্পানির এক প্রধান কর্তাকে এদের এই সপ্রতিভতা ও পারঙ্গমতা চমকে দিয়েছিল।
এসবই শিশুদেরই কৃতিত্ব। আমরা কেবল তাদের সুপ্ত ক্ষমতাগুলো জাগিয়ে তুলতে ও রাখতে চেয়েছি, চেষ্টা করেছি অনাহুত অন্যায্য চাপের কারণে এসব যেন নষ্ট না হয়।
আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই আমরা বাইরেও একটু বলতে থাকলাম - শিশুশিক্ষা মূলত একটি সাংস্কৃতিক কাজ। গানবাজনা বা কলা (art) অর্থে নয়, সৃজনশীলতা, সুরুচি, সৌন্দর্য এবং মাত্রাজ্ঞানের মত গুণের চর্চা ও তা আয়ত্ত্ব করাই সংস্কৃতি চর্চা। নীতিবোধ ও মানবিকতার বিষয়ে সংবেদনশীলতাও এতে তৈরি হয়ে যায়। এই শেখার নৈপুণ্য মেলে কেবল যথার্থ সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে। তাই শিক্ষার সুফল পাওয়ার শর্ত হল উপযুক্ত মানবিক সাংস্কৃতিক বাতাবরণ নির্মাণ। ফুলকিতে আমরা এই চেষ্টাই করেছি। প্রাথমিকে এভাবে তৈরি হলে তারা পরবর্তী উচ্চতর ধাপগুলো যোগ্যতার সাথে পেরুতে পারে।
যত দিন গেছে, দেশের অর্থনৈতিক বা মানুষের বৈষয়িক উন্নতি হলেও, সামাজিক সংকট ঘনীভূত হয়েছে। সামরিক ও ছদ্ম সামরিক শাসন তো বটেই এমনকি গণতান্ত্রিক আমলেও এ সংকট কেবল ঘনিয়েছে। এর প্রতিষেধক যে যথার্থ শিক্ষা তা কেউই তেমন ভাবেন নি। এক সময় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ, মাদক ও অপরাধ মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে অনেককেই ভাবিত করেছে। প্রচলিত শিক্ষার সীমাবদ্ধতা নজরে পড়ল এবং মানসম্পন্ন আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা একটি বড় কাজ বলে মনে করলেন অনেকেই। এ ধারায় দেশের অগ্রণী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট প্রতিষ্ঠা করল নালন্দা ২০০১ সনে। এ স্কুল এখন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অনেকেরই মনোযোগ পাচ্ছে। এটা আশার কথা। কিন্তু এ দেশে যে স্কুলগামী ছাত্রের সংখ্যা চার কোটির অধিক। তাদের পরীক্ষামুখী মুখস্থ বিদ্যার দু:স্বপ্নের (আইনস্টাইনের ভাষায়) মধ্যে ফেলে রেখে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি উদ্যোগ কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারবে সমাজে!
তবে আশার কথা সরকারের ভিতরেই অনেকেই বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সচেতন, সংস্কৃতিমন্ত্রী বিষয়টা বোঝেন ও কিছু করতে আগ্রহী, এবং শিক্ষামন্ত্রীসহ মন্ত্রি-পরিষদের আরও অনেকেই হয়ত এ নিয়ে ভাবেন। সচিবালয়েও কর্মকর্তাদের অনেকের মধ্যে ইতিবাচক ভাবনা রয়েছে। আমরা বুঝি অভ্যস্ত ধারা থেকে নতুন একটি ধারায় আসার ঝুঁকি নিয়েও তাঁদের ভাবনা-দুর্ভাবনা রয়েছে। এটা আদতে আলাপ-আলোচনা ও মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষামূলক কাজ করে ক্রমে সর্বত্র বাস্তবায়নের বিষয়। তবে কোনো অবস্থাতেই সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই। মাত্রাতিরিক্ত পরীক্ষার অব্যাহত মুখস্থের প্রবণতাই কেবল বাড়ছে না চাপের মধ্যে থাকা ছাত্রদের মাদক ও ধর্মান্ধতাসহ অন্যান্য ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। নিজেদের জানাবোঝার ঘাটতি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই হচ্ছে না এবং পুঞ্জিভূত ঘাটতির বিপুল ফাঁক নিয়ে তারা সর্বোচ্চ শিক্ষার দুয়ারে এসে রীতিমত হোঁচট খাচ্ছে। সেখানে তৈরি হয়েছে জ্ঞানের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ এক বাস্তবতা।
মিলানের সম্মেলন থেকে কেন ফুলকির কথায় এসেছি সেটা আশা করি পরিষ্কার হয়েছে। পচাত্তরের পটপরিবর্তন এবং পরবর্তী অবক্ষয়ের মুখে ত্রিশ বছর আগে যে কথাটি ফুলকি বলেছিল, আজ দ্যাখা যাচ্ছে তা অন্য এক ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে বিশ্বনেতৃবৃন্দের চিন্তায়ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।
আসলে একজন মানুষ যতটা সামাজিক জীব ততটাই সাংস্কৃতিক প্রাণী। শিক্ষা, ধর্ম, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, খাদ্য, সজ্জা, ভাষা, শিল্প - মানুষের চর্চিত ও আচরিত এবং সৃষ্ট ও কৃত সকল কর্ম মিলে তৈরি হয় তার সংস্কৃতি। এর গোড়াপত্তন শৈশবে না হলে সর্বনাশ, কারণ এসময়ই মনোজগতের ভিৎ তৈরি হয়ে যায়। বিষয়টা ফ্যাল্না নয়, জাতির ভবিষ্যত এবং দেশের অগ্রগতির সাথেই এটি যুক্ত।

***

Monday, September 7, 2015

ধিক্কারের অধিক


আবুল মোমেন

এটা ছবি?
এটা কি শিশুর ছবি?
না, এটা তো ধিক্কার,
ধিক্কারের অধিক,
তিরস্কার -
আমাকে তোমাকে
পৃথিবীসুদ্ধ মানুষকে।

ভূমধ্যসাগর কেন হবে
আয়লানের প্রতিপক্ষ বলো,
যুদ্ধবাজ জঙ্গি মুসলিম আর
আপন পাপের প্রায়শ্চিত্তে বিমুখ
উদাসীন গৃধ্নু প্রতীচী
যুগপৎ ইতিহাস থেকে বর্তমানে
যোগসূত্র বেঁধেছে যখন!

এটা ছবি?
এটা কোনো ছবি হলো?
যা কিছু দেখছি প্রতিদিন
এর একটিও ছবি নয়,
ভুলেও ভেবো না এরা শুধু ছবি,
সব কটি ধিক্কার এরা,
ধিক্কারের অধিক
তিরস্কার।

 লোকেই দিয়েছে নাম ছবিটিকে
- ভেসে যাওয়া মানবতা।
সেই সাথে বলো
সভ্যতার অবনত পতাকার প্রতিচ্ছবি।
তোমরা ভুলো নি নিশ্চয়
ইতিহাস -
এসবই তো মানচিত্র ভাগের
সেই পুরোনো খেলার
শেষ-দৃশ্যের ছবি।
লোভ আর নিষ্ঠুরতার
অবিনত আগ্রাসনে ক্লান্ত শ্রান্ত
মাথাহেঁট - ন্যায় ও জয়ের
অস্তরবি।
এসবই মনুষ্যত্ব বলিদানের
বিয়োগান্ত মর্মান্তিক
অন্তিম সময়ের
ধাবমান দৃশ্যাবলী।
যবনিকা - টলতে টলতে ধীরে
এগিয়ে আসছে
সভ্যতার ভগ্নস্তূপ জুড়ে।

হায় পয়গম্বর, হায় যীশু
হায় হায় সক্রেটিস
কী হাল দেখি তোমাদের
অনুসারীদের?
এক দল খুনে লিপ্ত, মুখর ধ্বংসে,
অন্যরা গা বাঁচাতে উদ্গ্রীব!

মানবতা নয়, আপন
মনুষ্য পরিচয়ও নয়,
সবকিছু জমে জমে তলিয়ে যাচ্ছে
ভূমধ্যসাগরের অতল সুনীলে।
শিশু নয়, ওরা নয় নারী,
নয় যেন একটিও মানুষ ওখানে -
ভয়-পাওয়া তাড়া-খাওয়া যারা
ছুটছে ওখানে, শূন্য চোখে
ওদের বারতা একটিই -
সভ্যতার ঘণ্টা বেজেছে,
ছুটি হয়ে গেছে।
যে ওখানে শুয়ে আছে
সে কিন্তু আয়লান কুর্দি নয় -
ছিন্ন পাপড়ি ওটি
উড়ে এসে ভেসে এসে
পড়েছে ওখানে।
প্রাণ দিয়ে বহন করেছে
সাধ্য ছিল যতটুকু
ওর ছোট্ট দেহের
পাপার্ত এ পৃথিবীর
অবশিষ্ট পুণ্যটুকু।

ওরা তো শিশু নয়.
জলের জিম্মায় প্রাণ রেখে
জননী মৃত্তিকায়
ফুটে আছে
শুভ্র পারিজাত ফুল,
জবাব দিচ্ছে তোমাদের
খুনে-স্বভাবের আর
টেনে খুলে দিচ্ছে
মুখোশ সবার -
তোমার আমার। আর
হাটে হাড়ি ভেঙে জানিয়ে দিয়েছে
সভ্যতার নামে যত জারিজুরি।

দেবশিশু লজ্জায় মুখ নিচু
করে আছে।
এত শূন্য ফাঁপা মানুষের কাছে
তার নেই কোনো প্রত্যাশা।
বাবাকে বাঁচার শেষ আকুতিতে
ধ্বনিত হয়েছে শিশুকণ্ঠে
ধিক্কারের রুদ্র ভাষা।
তারপর খুলেছে অর্গল।
অবশেষে সভ্যতার শ্লেষ্মা ঝেড়ে
আড়মোড়া ভেঙেছে ইউরোপ,
যদিও ওপাড়ে দলপতি
এখনো নিশ্চুপ।
কথা হল, কতটা জাগবে
সবার বিবেক? বলি,
কতদূর, কতদিন স্থায়ী হবে
জাগরণ?

তোমাদের বুদ্ধি বটে
ওকে ভাবো কুর্দি আয়লান শুধু
বেহদ্দ বেকুব যত -
এখন ও শুধুই ধিক্কার,
বিবেকের ছিন্ন পাপড়ি।
মুখ নিচু করে উপুড় শরীরে
প্রত্যাখ্যান করেছে ব্যর্থ
আমাদের। আর ওর
নিথর ভাষায় সোচ্চার
শুয়ে আছে যে শরীর
সেটি কোবানি শিশুর নয়,
দগদগে মোটা অক্ষরে
লিখেছে সে
প্রত্যাখ্যান।
ওটি শিশু নয়,
শুধ্ইু তজর্নি
দ- ঘোষণার আগে
উঁচানো আঙুল।
শিশুর বারতা সামান্যই -
ধিক্কার তোমাদের,
ধিক্কারের অধিক
তিরস্কার।
৫-৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫
চট্টগ্রাম



Tuesday, August 25, 2015

স্কুল শিক্ষা নিয়ে নতুন ভাবনার সময় এসেছে

আবুল মোমেন

দেশের সামগ্রিক শিক্ষাকে পরীক্ষামুখী মুখস্থবিদ্যার বৃত্ত থেকে কীভাবে বের করে প্রকৃত শিক্ষার বৃহৎ পরিসরে মুক্তি দেওয়া যায় সেটাই আজ শিক্ষামন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলের ভাবনার প্রধান বিষয় হওয়া উচিত। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে - অন্তত শিক্ষার ক্ষেত্রে - সংখ্যাগত দিকটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং তাতে নিঃসন্দেহে আমরা ভালো করেছি। প্রাথমিক পর্যায়ে মেয়েশিশুসহ প্রায় শতভাগ শিশুর স্কুলে ভর্তি হওয়াই একটা বড় অর্জন। মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার যথেষ্ট হলেও আমাদের গ্রামগঞ্জের বাস্তবতায় এটাকেও বড় অর্জন বলতে হবে। আর সব ছাত্রের জন্যে বছরের প্রথম দিনে উৎসবের মাধ্যমে বিনামূল্যে সব বই - প্রায় ৩২ কোটি বই - বিতরণ চমকপ্রদ এবং বিস্ময়কর সাফল্য।
২০১৫ তে এমডিজি শেষ হবে এবং তারপর শুরু হবে কৌশলগত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনের পর্ব। এই লক্ষ্য অর্জন আমাদের জন্যে কঠিন হয়ে পড়তে পারে যদি না গুণগত উন্নয়নের চ্যালেঞ্জগুলো সময়মত অনুধাবন করে এখনই যথাযথ পদক্ষেপের কথা ভাবা না হয়। আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা এবং যোগ্যতা নিয়ে কারো মনে প্রশ্ন নেই। তাঁর সাথে কথা বলে মনে হয়েছে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাটি দেশের গ্রামগঞ্জের দরিদ্রমানুষের জন্যে  যাঁরা দেশের জনসংখ্যার গরিষ্ঠাংশ - সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার বিষয়ে ইতিবাচক প্রণোদনার কাজ করেছে। মনে হয় তাঁর পর্যবেক্ষণটি বাস্তবতারই প্রতিফলন। কিন্তু মাঠপর্যায়ে কাজ করে প্রথম থেকেই যারা এই পরীক্ষা প্রচলনের যৌক্তিকতা ও সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি, এটাই তাদের প্রশ্নের সদুত্তর কিনা সে বিষয়ে এখনও আমি সংশয় প্রকাশ করব। এডুকেশন ওয়াচের গত ১৯ আগস্ট প্রকাশিত ২০১৪ সনের প্রতিবেদন আমার মত সকলের সংশয়কে যথেষ্ট শক্ত ভিত্তি দেয়। এটি নিয়ে ব্র্যাক-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরিটাস এবং প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে দেশের অগ্রগণ্য বিশেষজ্ঞ ড. মনজুর আহমদ, গত ১৯ আগস্ট ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারে যে নিবন্ধ লিখেছেন তা থেকে কয়েকটি পয়েন্ট তুলে ধরছি। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার মূল্যায়নভিত্তিক এই প্রতিবেদনে উল্লিখিত, ড. মনজুরের ভাষায়, কয়েকটি মূল লক্ষণীয় বক্তব্য হল - এ পরীক্ষা প্রবর্তনের ফলে ১. পরীক্ষাকেন্দ্রিক প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করার প্রবণতা উৎসাহিত হচ্ছে, ২. স্কুলের বাইরে প্রাইভেট পড়ার ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, ৩. গাইডবই মূল পাঠ্যবইকে ছাপিয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে, ৪. ছাত্ররা নকল ও অনৈতিক আচরণে আকৃষ্ট হচ্ছে, ৫. এ পদ্ধতিতে শিক্ষার বৈষম্য বাড়ছে।
ওপরের পাঁচটি বক্তব্য নিয়ে বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকেবহাল কারো মনে সংশয় থাকার কথা নয়। আর যদি আরেকটু গভীরে গিয়ে এ পর্যায়ে শিক্ষার হালচাল সম্পর্কে জানতে চাই তার জন্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনই যথেষ্ট বলে মনে করি। সরকার কেন নিজেদেরই মাঠপর্যায়ের জরীপের প্রতিবেদন উপেক্ষা করছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। মোটের ওপর এ দুই প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে ড. মনজুর সমাপনী পরীক্ষার কারণেই সৃষ্ট প্রাথমিক শিক্ষার পাঁচটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় তুলে ধরেছেন । পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে - এডুকেশন ওয়াচ -
১. পরীক্ষা কি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের সুনির্দিষ্ট দক্ষতাগুলো পরিমাপ করতে পারে? প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণেই দেখা যাচ্ছে উচ্চ পাশের হারের বিপরীতে কেবল বাংলা ও গণিতে নির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জনের হার মাত্র এক চতুর্থাংশ। বাকি তিন-চতুর্থাংশের অর্জন নানামাত্রায় অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রার নিচে। আমরা জানি তার মধ্যে বেশ বড় অংশের অবস্থা হতাশাজনক।
২. এতে কি শিক্ষাদান ও গ্রহণ প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার মান বাড়ছে? না, এতে মুখস্থের প্রবণতা উৎসাহিত হচ্ছে, ছাত্রের বিষয় বোঝা ও সৃজনশীলতা এবং পাঠক্রমের মূল বিষয়গুলো অনুধাবন উপেক্ষিত হচ্ছে। তদুপরি চিন্তা ও যুক্তিচর্চা নিরুৎসাহিত হচ্ছে।
৩. এটা কি মানসম্পন্ন শিক্ষার আবশ্যিক উপাদান হিসেবে শ্রেণিকক্ষে ছাত্রের বুনিয়াদি মূল্যায়নের সহায়ক, সম্পূরক এবং এ প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করে? বুনিয়াদি মূল্যায়ন শিক্ষকের জন্যে প্রাত্যহিক কাজ যা সমাপনী পরীক্ষার মত সামষ্টিক চূড়ান্ত মূল্যায়নের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সকলে মিলে এ পরীক্ষাটিকেই প্রাথমিক শিক্ষার এমন এক কেন্দ্রীয় নায়ক করে তোলা হয়েছে যাতে অত্যুৎসাহী অভিভাবক, কোচিং ব্যবসায়ী এবং অযাচিত হস্তক্ষেপে সিদ্ধ গণমাধ্যম (নিয়মিত প্রশ্নোত্তর ছাপিয়ে আর পরীক্ষাভিত্তিক প্রচারণার মাধ্যমে) মিলে প্রায় প্রথম শ্রেণি থেকেই যে কোনো পরীক্ষাতেই নব্বইয়ের ঘরে নম্বর পাওয়াকেই মোক্ষ বানিয়ে ছেড়েছে। বাস্তব অবস্থা জেনে সাক্ষ্য দিচ্ছি অভিভাবক-শিক্ষকরা মিলে ছাত্রদের শৈশব তছনছ করে দিচ্ছে।
৪. এটি কি শিক্ষাব্যবস্থায় সমতা বজায় রেখে মান অর্জনে অবদান রাখছে? সঙ্গত কারণেই যেসব অভিভাবক পাঁচসালা পরিকল্পনা নিয়ে (১ম-৫ম শ্রেণি) সন্তানদের মডেল টেস্টের মুখস্থবিদ্যায় পারঙ্গম করে তুলতে পারেন তারা বেশি ভালো করেছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অপেক্ষাকৃত গরিব ঘরের ছাত্ররা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
৫. এটি কি শিশুদের জন্যে একটি উন্নয়নমুখী ও সহায়ক বাতাবরণ তৈরির গুরুত্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ? ম্যাজিক মান জিপিএ ৫ নিয়ে গণমাধ্যম, অভিভাবকসহ সমাজ, কোচিং ব্যবসায়ী শিক্ষকবৃন্দ মিলে যে প্রচারণার মায়াজাল সৃষ্টি করেছেন তাতে যে অধিকাংশ ছাত্র তুলনায় কম নাম্বার পায় তাদের কল্পনাতীত সামাজিক ও মানসিক দুর্দশা আড়ালে থেকে যায়। আমাদের নিষ্ঠুর অসংবেদনশীল গণমাধ্যম ও অভিভাবকসমাজ শিশুমনের ব্যথা-বেদনা, সংকোচ-সংবেদনার কোনো খবরই রাখে না, তোয়াক্কা করে না।
সকলেই জানেন প্রাথমিক পর্ব হচ্ছে শিশুর শিক্ষার - জীবনব্যাপী অব্যাহত শিক্ষাগ্রহণের - প্রস্তুতি কাল। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় - এ হল সংগ্রহ ও সঞ্চয়ের কাল। এটি কোনো কারণেই ছাত্রের কাছে ফল প্রত্যাশা করার সময় নয়। যা দেখার তা হল তার সংগ্রহ ও সঞ্চয়ের কাজটি বাধাহীনভাবে ঠিকঠাকমতো চলছে কি না, তার সংগ্রহ ও সঞ্চয়ের ভা-ার মানসম্পন্ন সম্ভারে সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে কিনা। পরীক্ষা কেবল বাধা নয়, তার ভূমিকা মুখ্য ও প্রধান হয়ে উঠলে ছাত্রের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। সাধে কি মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন একে নাইটমেয়ার বা দুঃস্বপ্ন আখ্যা দিয়েছেন। আমাদের ব্যবস্থার গুণে এখন পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়াটাই শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্ররা সাক্ষ্য দিচ্ছে কীভাবে বাবা-মা এবং কোচিং শিক্ষকরা জিপিএ ৫ পাওয়ার জন্যে তাদের ওপর শারীরিক-মানসিক লাঞ্ছনাসহ জুলুম চালায়। তাদের শৈশব হরণ করা হয়েছে। 
পরীক্ষা প্রকৃতিগতভাবে একটি প্রতিযোগিতা। জীবন প্রতিযোগিতাময় এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, এবং এর জন্যে প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে মানবসমাজ গঠন এবং মানবসভ্যতার বিকাশে প্রতিযোগিতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল সহযোগিতা। মানুষের অগ্রগতিকে পাখির উড্ডয়নের সাথে তুলনা করে বলা  যায় দুটি ডানার মত-ই সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার ভূমিকা এখানে। কিন্তু কেবল প্রতিযোগিতার মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠলে তাতে স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতার বীজ নিয়েই বড় হবে শিশু। আর বৃহত্তর সমাজবাস্তবতায় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তার ভিতরে পরিপুষ্ট এসব বীজ শক্তি নিয়েই প্রকাশিত হবে। আমাদের সমাজে এটাই ঘটছে। মানবমনের এই গতিপ্রকৃতির সাথে শিক্ষার সংশ্লিষ্টতা বুঝতে হলে শিক্ষা ও মানবজীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে যে ধারণা থাকা প্রয়োজন, দুর্ভাগ্যের বিষয়, তা বাস্তবজীবনে জয়ী হওয়ার জন্যে মরিয়া ও মোহগ্রস্ত বিষয়বুদ্ধি-তাড়িত সমাজের নেই। অথচ হাতেনাতে এর প্রমাণ পাওয়া যায় উচ্চ শিক্ষার ভর্তি পরীক্ষার ফল বিপর্যয়ে। অধিকসংখ্যায় উত্তীর্ণ করাতে এবং উচ্চ শিক্ষায় আসন দিতে কেবলই মান নামানোর নির্দেশনা আসে। তাতে প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরিসংখ্যান চমকপ্রদ দেখায়, কিন্তু মানবিচারের সময় ধরা পড়ে যায় ফাঁক ও ফাঁকি। এভাবে আমরা শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য অর্জন করতে পারব না এবং, আরও রূঢ় বাস্তবতা হল, দুর্নীতির মহামারিসহ সামাজিক অবক্ষয় ঠেকাতে পারব না, সকল প্রতিষ্ঠানের অধোগতি ও অকার্যকরতার অবসান হবে না।
টানা চল্লিশ বছর ধরে শিশুর শিক্ষা ও মানসবিকাশের কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি উত্তরোত্তর পরীক্ষার চাপ বাড়ছে, এবং গত কয়েক বছরে তা শিশু-নিপীড়নের মাত্রাছাড়া পর্যায়ে পৌঁছেছে। সকলকে সতর্ক করে বলব, এর ফল জাতির জন্যে ভালো হবে না। ধর্মান্ধতা, সন্ত্রাস ও মাদকের মত অভিশাপ বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ শৈশবে মানবিক বিকাশের উপযুক্ত রসদের ঘাটতি। আর সমাজে অসহিষ্ণুতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, ক্ষুদ্রতা, নিষ্ঠুরতা এবং শিশু-নারী-দরিদ্র ও  প্রান্তিকজনের প্রতি উপযুক্ত সংবেদনশীলতার অভাবের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা থেকে পরিত্রাণ দূরের কথা, তা আরও প্রকট হয়ে উঠবে। দুর্নীতি এবং অপরাধপ্রবণতা তো গলগ্রহের মত সঙ্গী হয়ে রয়েছে।
সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশেদেশে ইসলামি জঙ্গিদের উত্থান এবং তাদের হাতে মানবজাতির সাংস্কৃতিক সম্পদের যে বেহাল দশা হচ্ছে তার  প্রেক্ষাপটে গত এপ্রিলে প্যারিসে ইউনেস্কোর একটি বৈঠক হয়েছিল। আর তার আলোচনার পটভূমিতে গত ৩১ জুলাই ও ১ আগস্ট ইতালির সংস্কৃতি মন্ত্রীর আহ্বানে মিলান এক্সপো ২০১৫-র হল ঘরে বসেছিল ‘জনগণের মধ্যে সংলাপের উপকরণ হিসেবে সংস্কৃতি’ শীর্ষক সম্মেলন। তাতে বিশ্বের ৮৫টা দেশের সংস্কৃতিমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা যোগ দিয়েছিলেন। আমন্ত্রণপত্রেই গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতির ভূমিকা উত্তরোত্তর বাড়ছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ উপন্যাস শেষের কবিতায় লিখেছিলেন, কমলাহীরের পাথরটি হল বিদ্যা আর তা থেকে যে আলো ঠিকরে বেরোয় তা হল সংস্কৃতি। আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি পরীক্ষার আতিশয্য ও সামূহিক চাপে খোদ বিদ্যাই অনর্জিত থেকে যাচ্ছে, ফলে আজ শিক্ষিত (আদতে ডিগ্রিপ্রাপ্ত) মানুষের কর্ম ও চিন্তায় আলোর প্রকাশ ঘটে না।
আমরা আমাদের কাজ শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আশির দশকের গোড়া থেকে স্কুল চালু করে, খানিকটা রবীন্দ্রনাথের ভাবনার অনুসারে, বলে এসেছি শিক্ষার সাথে সংস্কৃতিচর্চার সমন্বয় না হলে তা সার্থক হবে না। বলা প্রয়োজন, আমরা সংস্কৃতি বলতে গান-বাজনা-নাচ-নাট্য অর্থাৎ কেবল কলাচর্চার কথা বলি না, সংস্কৃতি শব্দটির ব্যাপ্ত ও পুঙ্খানুপঙ্খ তাৎপর্যসহ এর সমগ্রতায় ধরতে চাই। এভাবে চর্চা হলে শিশু সাহিত্যশিল্পে দক্ষতার পাশাপাশি সৃজনশীল প্রতিভা ও মানবিক গুণাবলী বিকাশের অবকাশ পাবে। আর শিশু সমৃদ্ধ মন নিয়ে বড় হলে তার প্রভাব সমাজে পড়বেই। তাতে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা, নিষ্ঠুরতার মত ক্ষুদ্রতা ও অমানবিকতার সংস্কৃতি ও গ্লানি থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব। শিক্ষা নিয়ে - অন্তত স্কুল শিক্ষা নিয়ে - আমাদের নতুনভাবে ভাবার সময় এসেছে।
                                                                                 ***

Sunday, August 23, 2015

ছাত্রসংগঠনের হাজারিবাগ শাখা কেন?

আবুল মোমেন

শেষ পর্যন্ত সরকার হার্ড লাইনেই গেল। দু’দিনে ছাত্রলীগ-যুবলীগের তিনজন ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেল।
বিচারবহির্ভূত হত্যা বা মৃত্যু সুস্থ মস্তিষ্কে সমর্থন করা যায় না। বোঝা যায় সরকারও আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার ওপর আস্থা রাখতে পারে নি। আশু সমাধানের বেআইনি মর্মান্তিক পথটিই গ্রহণ করল।
দেশে দু’ধরনের সংকটে এমন এক বিষচক্র তৈরি হয়েছে যা ভাঙা সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশের দিক থেকে তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া পর্যন্ত একদিকে চলে দুর্নীতি আর অন্যদিকে দুর্নীতি ও অদক্ষতার যোগফল হিসেবে মামলা হয় দুর্বল। দ্বিতীয় সংকট হল, প্রথম সংকটটি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকায় অপরাধীরা মামলা বা আইনি প্রক্রিয়ায় কোনো না কোনো স্তরে প্রভাবিত করার সুযোগ তৈরি করে তা কাজে লাগায়। রাজনীতির অপরাধ-সংশ্লিষ্টতার সংস্কৃতি জোরদার হওয়ার পর থেকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রছায়ায় সংঘটিত কয়টি খুনের সুবিচার নিশ্চিত ও সম্পন্ন হয়েছে? খুনের সংখ্যা তো শয়ের ঘর ছাপিয়ে হাজারের কোঠায় পৌঁছেছে। এই বিচারহীনতার পুঞ্জিভূত পরিণতি নিয়ে আমরা কখনো গভীরভাবে ভাবি নি। বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে এমনটা হতে দিয়েছি। অবস্থা এমন হয়েছে যে সর্বোচ্চ আদালত থেকেও বলা হচ্ছে নিচের স্তরে যোগ্য বিচারকের অভাব রয়েছে, সুষ্ঠুভাবে রায় লেখার মত মানুষও কমে যাচ্ছেন। তেমনি দক্ষ আইনজীবীও সেভাবে তৈরি হচ্ছে না। সবটা মিলে সর্বত্র একটা ফাঁপা চাকচিক্যের আড়ালে আমরা আসল বিষয় হারিয়ে ফেলছি। দালানকোঠার বহর বাড়ছে, প্রযুক্তির আড়ম্বর ঘটছে, গাড়ি এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ের বৈভবও বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে চলেছে।
বিচারহীনতা থেকে বিচারবহির্ভূত ‘বিচারের’ ফাঁদ খুব দূরের কিছু নয়। যারা ক্রসফায়ারের শিকার হচ্ছে তারা এতটাই ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিল যে তার সীমা সম্পর্কে ধারণা হারিয়ে ফেলেছিল। ওদের এই ধারণাটা আপনা-আপনি হয় নি, তারা তো আস্কারা পেয়েই এভাবে চলে এসেছে অর্থাৎ তাদের এভাবে চলতে দেওয়া হয়েছে।  তাদের এই ভাবনাটাকে ভিত্তিহীন বলাও মুশকিল। কারণ সত্যিই তো বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং সেইসূত্রে ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিচারের আওতামুক্ত থাকার চক্রটি বহুদিন ধরেই কার্যকর রয়েছে। হঠাৎ যে সরকার তাদের ইনফর্মাল বাহুবল নিয়ে বিব্রতবোধ করবে বা সমালোচনা থেকে বাঁচার জন্যে এমন বেপরোয়া নির্মমভাবে তাদের শায়েস্তা করা হবে সেটা তারা ভাবতেই পারে নি।
সরকার তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বরং কিছুটা বাহবা নিতে চাইবে - দ্যাখ, আমরা কতটা ন্যায়নিষ্ঠ, নিজের দলের কেউ আইন ভাঙলে তাকেও ছাড়ি না। তবে ক্রসফায়ারে না দিয়েও অনেককে দল থেকে বহিষ্কার করে মামলায় গ্রেপ্তার করে, দীর্ঘমেয়াদে জেলে রেখে সরকারের বারতাটা পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু ক্ষমতা আর লোভ সত্যিই তো অন্ধ - এ হল অন্ধশক্তি। 
ক্রসফায়ারে নিহত ছাত্রলীগ নেতা আরজুর পরিচয় জেনে প্রথমেই প্রশ্ন করতে হয় - হাজারিবাগ থানা ছাত্রলীগ কমিটি থাকবে কেন? ছাত্রলীগ একটি ছাত্রসংগঠন, এর শাখা তো থাকবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ভিত্তিক হবে ছাত্র সংগঠনের শাখা। একটি কেন্দ্রীয় কমিটি থাকবে, তার অধীনে জেলা কমিটি এবং মহানগর কমিটি থাকবে। কিন্তু এলাকাভিত্তিক কমিটি কেন? এরকম কর্মক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্টতাহীন কমিটি হলে তাদের কাজ কী হবে? নির্দিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব না থাকায় এসব শাখায় ভাগ্যান্বেষী অছাত্র তরুণরা এসে ভীড় করবে। ক্ষমতাসীন দলের ক্ষেত্রে তো তাদের ভীড় ঠেকানো যাবে না। ছাত্র সংগঠনের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হলে এগুলোকে অবশ্যই শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যায়ল ও কলেজ-কেন্দ্রিক সংগঠন হতে হবে। তাতে নেতাদের ছাত্রত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সহজ হবে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, দেশে গণতান্ত্রিকব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচনগুলো বন্ধ হয়ে আছে। নির্বাচনহীনতার অর্থ গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি আর এর পরিণতি হল অসহিষ্ণুতা এবং ভিন্ন পথে নেতাদের ক্ষমতাবান হওয়ার ঝোঁক বাড়া। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংগঠনের দখলদারি এবং কায়েমি স্বার্থ প্রতিষ্ঠার কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি - প্রধান দলগুলোর ক্ষেত্রে - মূলত ভর্তি বাণিজ্য, টেণ্ডারবাজি, নিরীহ ছাত্রদের শোষণ এবং একছত্র কায়েমি ক্ষমতার অন্যান্য অনুষঙ্গ অপতৎপরতার দূষণ ও বিকার সমাজদেহে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ছাত্র রাজনীতি থেকে আপাতত জাতি কিছুই পায় না।
লক্ষ্যহীন, আদর্শহীন, উদ্দেশ্যহীন এবং সৎকর্মহীন নেতৃত্ব এবং রাজনীতি নানা ধরনের উৎপাত তৈরি করে। দোকানপাটে চাঁদাবাজি, তোলাবাজি, ছিনতাই রাহাজানি, অপহরণ ও মুক্তিপণ ইত্যাদি বলপ্রয়োগের ক্ষমতার চর্চা অপ্রতিহতভাবে চলছে। মানুষ এসব উৎপাতে এতটা অতিষ্ঠ হয়েছে যে ছাত্র-তরুণদের সম্পর্কে সমাজে নেতিবাচক মনোভাব প্রবল। এমনকি ক্রসফায়ার নিয়ে মানুষ বিচলিত নয়। সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী পরিবার ব্যতীত কেউ মাথাই ঘামায় না। এই অবক্ষয় থেকে বেরুতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এলাকার দখলদারি বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমান ধারার নেতৃত্ব ও কাঠামো থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে।
এ জন্যে আমি প্রস্তাব করব - অন্তত এক বছরের জন্যে - ছাত্রসংগঠনগুলোর কার্যক্রম বন্ধ রাখা হোক, সকল কমিটিও ভেঙে দেওয়া হোক। ছাত্রদের রাজনৈতিক অধিকার ও রাজনীতি করার অধিকার বন্ধ হবে না। কিন্তু সংগঠন থাকবে না। এই এক বছরের মধ্যে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান - বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ - স্ব স্ব ছাত্রসংসদের নির্বাচন করবেন। এ নির্বাচনে ছাত্ররা সরাসরি অংশ নেবে, তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে প্যানেল তৈরি করতে পারবে। কিন্তু কেবলমাত্র নিয়মিত ছাত্ররাই এতে অংশ নিতে পারবে। একবার এম. এ. পাশ করে আবার অন্য বিষয়ে ভর্তি হলেও তারা নির্বাচনের যোগ্য হবে না। এভাবে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান প্রচারণা, প্রার্থী নির্বাচন, ভোট, নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে নিয়মাবলী নির্ধারণ করে নেবেন।
আমার ধারণা একবার ছাত্রসংসদের নির্বাচন চালু হলে, প্রথম দু’একবার যদি কিছু কিছু সমস্যা হয়ও, আখেরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ভালো ছাত্র, যোগ্য প্রার্থীদের সামনে আনতে চাইবে সাধারণ ছাত্ররা। অছাত্র, চাঁদাবাজ, দখলদার, অস্ত্রবাজ, মাস্তান, ধর্ষকদের হাত থেকে শিক্ষা, রাজনীতি, ছাত্রসমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জনগণ এবং দেশ ও সমাজকে রক্ষা করার এটাই পথ। সাধারণ ছাত্ররা তাদের মনোবল ফিরে পাবে, নিজেদের সংঘবদ্ধ শক্তির চমকপ্রদ প্রকাশ দেখে উৎসাহিত হবে। পাশাপাশি বিতর্কিত ব্যক্তিরা দখলদার হিসেবে বিতাড়িত হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে সংলাপে বসতে পারেন। তার আগে জাতীয় সংলাপও হতে পারে । সংসদেও বিষয়টি আলোচিত হওয়া সম্ভব। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই যা চলছে তা আর চলতে দেওয়া উচিত নয়। কে কোন স্বার্থে কোন এলাকায় নিজে নিজে ক্ষমতাসীন দলের কোনো অঙ্গ সংগঠনের শাখা খুলে নিজেই সভাপতি পদ গ্রহণ করে নিজের কোন স্বার্থ হাসিল করবে তা না পারবে বুঝতে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, না তাদের সরকার। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেছেন, ছাত্রলীগে শিবির এবং আওয়ামী লীগে জামায়াতের লোকজন ঢুকে পড়ছে। ঢুকে পড়বেই তো। যদি সংঠনের নাম এবং গণতন্ত্র ও আদর্শ উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো কাজ না থাকে তাহলে নেতাদের একমাত্র কাজ তো হবে নিজের অর্থবিত্ত, ক্ষমতাবৃদ্ধি আর সে ক্ষমতার রোয়াব দেখিয়ে আশেপাশের সবাইকে দাবিয়ে রাখা। 
এখন একাজই তো করছে অঙ্গ সংগঠনগুলো। তার মধ্যে ছাত্রলীগ-যুবলীগ তাদের তারুণ্যের কারণে রাখঢাক করে কাজটা সারতে পারছে না। খোদ সরকারের জন্যে কেউ কেউ আপদ-বালাই হয়ে উঠছে। কিন্তু সে বালাই ক্রসফায়ারে দূর করার ব্যবস্থাটি সুবুদ্ধির বা দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করছে না।  এটিকে বলব, সকল বিকল্পের মধ্যে নিকৃষ্ট বিকল্প। কারণ বিচারহীনতার পুঞ্জিভূত সংস্কৃতি আজ আমাদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে সংস্কৃতিতে নিয়ে আসছে। এরপরের স্তরটি হল জায়গায় জায়গায় মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেবে, যেমনটা সেদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নরসিংদিতে ডাকাত সন্দেহে মোট ছয়জনকে পিটিয়ে খুন করা হল। 
তার পরের ধাপটি হল কাউকে প্রতিপক্ষ মনে হলেই ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে সন্দেহভাজন বানিয়ে গণপিটুনির ব্যবস্থা করা। আমরা বিচারহীনতা ও বিচার বহির্ভূত ক্ষমতার বহুমুখী কুফলও এ সমাজে দেখছি। দুর্নীতি সাথে এই অপরাধপ্রবণতা পাল্লা দিয়ে চলতে থাকলে কোথায় গিয়ে থামব আমরা? তাই আশু পরিবর্তন চাই। প্রথমে ছাত্র সংগঠন থেকেই শুরু হোক। এখানে শৃঙ্খলা ফেরোনো হলে অন্য সব অঙ্গ সংগঠনেও ফেরানো সহজ হবে। বিষয়টা ভাবতে হবে। 
শেষে আবারও বলব, ছাত্রসংগঠনের আবার হাজারিবাগ শাখা কেন?

***

Saturday, August 15, 2015

শূন্যতায় তুমি শোকসভা

আবুল মোমেন


আজকের দিনটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে বিশেষভাবে স্মরণ করার দিন। ১৯৭৫ সালের এইদিনে ঘাতকদল তাঁকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। তারপর থেকে বাংলাদেশ যেন এক অভিভাবকহীন পরিবার - ছন্নছাড়া, দিগভ্রান্ত।
একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালালে বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়। সে রাতেই বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে, কিন্তু তাঁরই নেতৃত্বে, মুক্তিযুদ্ধ চলেছিল। পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুদণ্ডের হুমকির মধ্যে তিনি প্রিয় দেশ ও দেশবাসীর কাছ থেকে শারীরিকভাবে অনেক দূরে ছিলেন।
সেদিন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তাঁর সহকর্মীদের যোগ্য নেতৃত্ব ও ভারতের সহায়ক সরকারের সহযোগিতায় আমরা অত্যন্ত কঠিন সেই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম গৌরবের সঙ্গে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যা সম্ভব হয়েছিল পঁচাত্তরে তাঁর মৃত্যুর পরে তা সম্ভব হয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কেন? একাত্তরে তাকে ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল, সেটাই কি কারণ? একাত্তরে তাঁর পক্ষে যোগ্য নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মানুষ ছিলেন, যেমন তাজউদ্দিন আহমদসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ, সেটাই কি কারণ? এ দুটি কারণই সত্য বলে মনে হয়।
কিন্তু তারও চেয়ে সত্য তৃতীয় একটি কারণ। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড কেবল বঙ্গবন্ধু বা তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি অপরাধ ছিল না; এ ছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অংশ; খন্দকার মুশতাক এই ষড়যন্ত্রের একজন অংশীদার, বাংলাদেশের ইতিহাসের দ্বিতীয় মীর জাফর।
পটপরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে বায়ান্নো থেকে বিপুল ত্যাগ ও দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে জাতির অর্জিত আদর্শ ও মূলনীতিগুলো বিসর্জন এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন তছনছ করে দিয়ে প্রত্যাখ্যাত পাকিস্তানি ধারার ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা ও ধর্মান্ধ  চিন্তাচেতনা ও সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করে। কেবল তা-ই নয়, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সংস্কৃতিকর্মীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ নির্যাতনও  চালায়। এরই ধারাবাহিকতায় জেনারেল জিয়া সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে মুসলিম ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার প্রাধান্য দিতে শুরু করেন। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী এবং ধর্মান্ধ দলসমূহকে রাজনৈতিকভাবে পুনরুজ্জীবিত ও সেসব দলের নেতৃবৃন্দকে সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করেন। জিয়ার পরে এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আর সংবিধানে ধর্মীয় পরিচয় লাগিয়ে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক চেহারা পাল্টে দিলেন। নব্বইয়ের পরে ক্ষমতায় এসে বেগম জিয়া একই ধারাই অব্যাহত রাখেন।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত দীর্ঘ দু-দশক ধরে বঙ্গবন্ধুর নাম গণমাধ্যমে, পাঠ্যবই ও অন্যান্য প্রচারণা থেকে মুছে দেওয়া হয়, তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ থাকে। অন্যান্য জাতীয় নেতাদের কথাও অনুচ্চারিত থেকে যায়। ফলে এ সময়ে দেশে নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়, যারা এ দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারেনি। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিন বা মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভূমিকা তা ঠিকভাবে জানতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধে ও স্বাধীনতা অর্জনে কারা ছিল বন্ধুরাষ্ট্র, এ সময় ভারত-সোভিয়েতের ভূমিকা ইত্যাদিও জানা হয়নি তাদের। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয়, ভূমিকা এবং বিপরীতে রাজাকার-আলবদর ও অন্যান্য দালালদের কী ভূমিকা তা-ও ঠিকভাবে জানানো হয়নি। চীন, সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক ভূমিকার কথাও তারা জানতে পারেনি।
ফলে কুড়ি বছরের বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারের মাধ্যমে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে মানুষের মনে বিভ্রান্তি এবং বিতর্কের জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়েছে। আজও আমরা এই বিভ্রান্তি ও বিতর্কের জের টানছি, এবং তার খেসারত দিয়ে যাচ্ছি। এ যেন সত্যিকারের অভিভাবকহীন এক ছন্নছাড়া পরিবারের দিগভ্রান্ত পদচারণা চলছে।
পরিস্থিতি আজ এ রকম যে, একজন দেশদ্রোহী ও যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে সরকার পরিচালনার ব্যর্থতাকে গুলিয়ে ফেলছি আমরা। অপরাধের সঙ্গে অপারগতাকে এক করে ফেলছি। চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতাকে এক কাতারে রাখছি।
আমরা জানি, স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, নবগঠিত অনভিজ্ঞ সরকার ও প্রশাসন পরিচালনার মতো দুরূহ কাজ করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে একদিকে দেশের অভ্যন্তরে ওঁত পেতে থাকা পরাজিত শক্তির এদেশীয় দোসরদের চক্রান্ত এবং অন্যদিকে অতি-উৎসাহী উচ্চাভিলাষী মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতাও মোকাবিলা করতে হয়েছে। আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরাজিত পাকিস্তান, তার বন্ধুরাষ্ট্র চীন ও সমর্থক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহ মিলে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল বাংলাদেশকে বিপদগ্রস্ত করার  চেষ্টা করে গেছে। এদেরই অপতৎপরতার ফলে ১৯৭৪-এ দুর্ভিক্ষ হয়েছে, গোলাম আজমগং প্রশ্রয় পেয়েছে ও জামায়াতসহ অসংখ্য ধর্মান্ধ দল শক্তি সঞ্চয় করেছে। এভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা এবং ক্রমে চরম মনোভাবের এক বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। আজকের দিনে বাংলাদেশের এই অস্থির বর্তমান ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আমরা যে অভাব প্রতিদিন অনুভব করি তা হল একজন যোগ্য নেতার, একজন যথার্থ অভিভাবকের। আর তখন স্বভাবতই মনে পড়ে যায় বঙ্গবন্ধুর কথা। মনে পড়ে যায় কীভাবে ইতিহাসের উজান বেয়ে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এ দেশের মানুষের নয়নমণি, একমাত্র নেতা, পরম নির্ভর অভিভাবক।
তাই বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েই তার আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করতে হবে। মৃত্যুদিবসে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করব জাতির এই চরম সংকটকালে তাঁর কন্যা একজন যোগ্য উত্তরসূরি রাজনৈতিক নেতাই ও রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠেন সেই প্রার্থনা জানিয়ে।
২০০৯ সনে জাতীয় সংসদে বিপুল আসনে বিজয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। আমরা লক্ষ করছি শেখ হাসিনা এবারে ক্ষমতায় এসে দেশকে পঁচাত্তর-পরবর্তী পিছুটান থেকে উদ্ধারের ব্রত নিয়েছেন। সত্যি বলতে কি এখন কাজটা বঙ্গবন্ধুর আমলের চেয়েও কঠিন। তখন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের কাল, বাঙালির ঐক্য গঠনের কাল। আজ বিশ্বায়ন আর বাজার অর্থনীতির চাপ একদিকে আর অন্যদিকে ধর্মান্ধ জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। কঠিন এই পথ থেকে অবশ্য সরতে রাজি নন বঙ্গবন্ধু-কন্যা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া, এসডিজি পূরণ করে এমডিজি পূরণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা তিনি বজায় রেখেছেন। তবুও বর্তমান আওয়ামী লীগের পক্ষে আগের মত একাট্টা হয়ে আদর্শ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে আন্তরিক থাকা সম্ভব হচ্ছে না। দলের ভিতর থেকেই নানা সংকট তৈরি হচ্ছে, বাইরের সংকট তো আছেই।
তবুও মনে হয় পঁচাত্তরের পিছুটান কাটানোর এটাই শেষ সুযোগ। ফলে শেখ হাসিনাকে সফল হতেই হবে। আর সে পথে বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে সবচেয়ে বড় যে শিক্ষা নিতে পারেন তা হল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা। আজকে দেশে তরুণের সংখ্যা জনসংখ্যার অর্ধেক তারা কোনো দল করে না, আর অর্ধেক যে নারী তারাও অধিকাংশ দলভুক্ত নয়। ফলে ঐক্যের সঠিক বাতাবরণ তৈরি হলে যারা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী রাজনীতি করছে তারা আবারও একাত্তরের মত জনবিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্রগোষ্ঠীতে পরিণত হবে।

***


Wednesday, August 12, 2015

রাজন রাকিব রবিউল আর হন্তারক সমাজ

আবুল মোমেন

রাজন, রাকিব, রবিউল - তিনটি শিশুরই নামের অদ্যাক্ষর -র। প্রথম জনের খুঁটিতে বাঁধা করুণ কাতর চাহনির মর্মান্তিক ছবিটি মন থেকে তাড়ানো সম্ভব নয়। রাজন আর রাকিবের ছবি দেখেছি, রবিউলের মুখটা অদেখা হলেও কল্পনা করে নিতে পারি। পত্রিকায় মুদ্রিত রাজন-রাকিবের চেহারা দুটি বড় মায়াবী, বড়ই নিষ্পাপ কমনীয়তায় পবিত্র। ভাবি বয়সোচিত দুষ্টুমির সময় কেমন প্রাণবন্ত দেখাত ছেলেদুটিকে। প্রাণচাঞ্চল্য তো এ বয়সেরই ধর্ম। রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের সূত্রে দুষ্টুছেলে ফটিকের সাথে আমরা গভীরভাবে পরিচিত। ফটিক, বলাই, আশু - তাঁর এসব বালক চরিত্রের কাকে ছেড়ে কার কথা ভাবি। এই নিষ্কলুষ বালকেরা সকলেই যেন ছিল এই কলুষ-তামস-ভারাক্রান্ত জগতে অতিথিমাত্র। বড়দের নিষ্ঠুরতায় অকালে ছুটি হয়ে গেছে রাজন, রাকিব, রবিউলের। তবে এ ছুটি ফটিক বা বলাইয়ের পথে হয় নি।
গল্পে বালক দুটির মৃত্যুর পেছনে সমাজ এবং সংসারের উপেক্ষা আর অবহেলা-অনাদরের ভূমিকাই মুখ্য। গিন্নি গল্পে অবোধ নিষ্পাপ প্রাণচঞ্চল বালক আশুর প্রতি সমাজের অভিভাবকদের নিষ্ঠুর পীড়নের দৃষ্টান্ত পাই। এ সমাজে বালক বয়সের দুরবস্থার কথা রবীন্দ্রনাথ সরাসরিই বলেছেন। হঠাৎ শরীরে বেড়ে ওঠে তারা, গলার স্বর পাল্টাতে শুরু করে - ছোটর দলেও পড়ে না বড়র দলেও মানায় না। এদিকে শরীরের অভ্যন্তরে তো হরমোনের রূপান্তর ঘটতে থাকে। বালক শৈশব ছাপিয়ে পৌঁছে যায় বয়:সন্ধিতে। স্বয়ং সন্ত অগাস্টিন তাঁর স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন কী এক অজানা তাড়নার অস্থিরতায় কতই না ভুগেছেন তখন। বাধ্য হয়ে নিজেকে সংযত করতে কত কা-ই না তাঁকে করতে হয়েছে। রুশ ভাষার শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক তলস্তোয়ের নামের আগে ঋষি অভিধা প্রয়োগ করা হয়। ঋষি তলস্তোয় তাঁর বালক বয়সের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বয়:সন্ধির তাড়নায় কীসব অপকীর্তি ঘটাতেন সেসব কথা অকপটেই লিখে গেছেন। বালকমাত্রই অনুসন্ধিৎসু, কৌতূহল তার বয়সোচিত স্বভাবধর্ম। বিধাতা তাকে এভাবে তৈরি করেছেন বলেই সে কিছু অনাসৃষ্টি ঘটিয়ে তবেই সৃষ্টির অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। মার্কিন কথাসাহিত্যিক মার্ক টোয়েন ডানপিটে দূর্ধর্ষ হাকল্কে সাহিত্যে অমর করে গেছেন। সাহিত্যে ডানপিটেদের রাজা হল অলিভার - হতদরিদ্র পরিবারের রাস্তায় বেড়ে ওঠা ছেলে অলিভার টুইস্ট। এসবই বাস্তব থেকে নেওয়া চরিত্র।
বড়রা চিরকালই ছোটদের দুষ্টুমির জন্যে একটু-আধটু শাসন করতেন, তাঁদের এই অধিকার সবাই মেনেই নেয়, এ নিয়ে বালকরাও বিশেষ মাথা ঘামায় না। শিশুদের - মনে রাখতে হবে বালকরাও শিশু - শারীরিক শাস্তি দেওয়া বা অপমানসূচক তিরস্কার করা তাদের মানসিক  (অনেক ক্ষেত্রে শারীরিকও) স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে এবং তা মাত্রা ছাড়ালে ক্ষতি গভীর, এমনকি স্থায়ীও হতে পারে। তাই আধুনিক কালে শিশুদের প্রতি এ ধরনের শাস্তিমূলক আচরণকে দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষণা করা হয়েছে।
কিন্তু সমাজমানস সহজে পাল্টায় না। বাবা-মা, শিক্ষক এবং দুর্ভাগা শিশু শ্রমজীবীদের নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে মনিবগণের দিক থেকে শিশুর অপরাধের জন্যে শাস্তিই - যা প্রায় ক্ষেত্রে চরম অপমানসূচক তিরস্কার দিয়ে শুরু হয়ে তাতেও গায়ের ও মনের ঝাল না মিটলে পিটুনির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয় - বরাদ্দ এ সমাজে। এ যেন সমাজ-সংস্কৃতির অচ্ছেদ্য ঐতিহ! শুনেছি প্রায় সব স্কুলেই মার অব্যাহত রয়েছে, পরিবারেও প্রহার-সংস্কৃতির প্রতাপ থামে নি।
রাজন, রাকিব বা রবিউলের ওপর প্রযুক্ত শাস্তি কোনো ব্যক্তি রাগের মাথায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আকস্মিকভাবে ঘটান নি। তিন ক্ষেত্রেই শাস্তি দেওয়া হয়েছে পরিকল্পিতভাবে, অনেকক্ষণ সময় নিয়ে এবং মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত। মনস্তাত্ত্বিক হয়ত বলবেন, ক্রোধের সাথে অহঙের যোগে এসব মাত্রাছাড়া নৃশংসতা ঘটছে। হত্যাকারীরা এই শিশুগুলোর ওপর চরম নির্যাতন চালিয়ে তিলেতিলে অসীম যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে খুন করেছে। তাদের কৃতকর্মে এও বোঝা যায় যে এই পৈশাচিকতা তারা উপভোগ করেছিল। হত্যার মূল অভিপ্রায় হয়ত একজনেরই ছিল, কিন্তু অপরাধীর শাস্তি বিধানে ‘দায়িত্বশীল’ আরও ‘অভিভাবক’ প্রতিটি ঘটনাতেই স্বত:প্রণোদিত হয়ে জুটে গিয়েছিল। ফলে বোঝা যায় এ সমাজে নিষ্ঠুরতা, অপরাধপ্রবণতা এবং বিবেকহীনতার এক মারাত্মক অমানবিক সংস্কৃতি বহমান রয়েছে। এসব ঘটনা এমনি ঘটছে না, আমাদের প্রশ্রয়ে, আমাদেরই সাহচর্যে-সহযোগিতায়, সবার সমন্বিত যোগসাজশে একাত্তরের বীর বাঙালির অপমৃত্যু ঘটিয়েছি আমরা। কারণ প্রকৃত কাপুরুষই পারে শিশুর ওপর নিষ্ঠুর প্রতিশোধ চরিতার্থ করতে। আজ শিশু-নারী, আদিবাসী, দরিদ্র, দুর্বলমাত্রই এ সমাজে সবলের শাসন-শোষণের শিকার হচ্ছে। আমরা সমাজ হিসেবেই মনুষ্যত্বের গভীর সংকটে তলিয়ে যাচ্ছি।
বিচারহীনতা ও অপরাধীর শাস্তি না হওয়ার একটা পরিণতি এক্ষেত্রে অবশ্যই যুক্ত হচ্ছে। রাজন, রাকিব, রবিউলদের হত্যাকারীদের বিচার ও কঠিন শাস্তি অবশ্যই হতে হবে। এটি রাষ্ট্রের করণীয়। রাষ্ট্র অবশ্য সমাজেরই সৃষ্টি এবং তারই প্রতিফলন মাত্র। ফলে বিবেকহীনতা ও অপরাধের সাথে সহবাস এরও মজ্জাগত রোগ।
সমাজে পচন ব্যাপক ও গভীর সে কথা আমরা সকলেই জানি। তবুও একদম বসে পড়ছে না তার কারণ দুটি - এত কিছুর মধ্যেও শুভবোধসম্পন্ন মানুষ, তা যত অঙ্গুলিমেয়ই হোক, সমাজে টিকে আছেন। তাঁরা সংখ্যালঘু হলেও বিবেকের কণ্ঠস্বর ও সচ্চরিত্রের মহিমা কাপুরুষ বিবেকহীনদের কিছুটা হলেও দমাতে পারে। দ্বিতীয় কারণ হল, এ সমাজে তথাকথিত বিবেকহীন অভিভাবকদের চেয়ে ভুক্তভোগী রাজন-রাকিব-রবিউলরাই সংখ্যায় বেশি। তাদের চেয়ে একটু বড় বালক ও তরুণরাও সমাজে বিবেকহীনদের চেয়ে বেশি পরিমাণেই রয়েছে। নষ্ট সমাজ এদের পীড়ন করলেও এবং বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট করার সব আয়োজন চালিয়ে গেলেও, মনে হয়, প্রাণশক্তিতে ভরপুর সজীব প্রাণ এত সহজে পরাজিত হয় না।
আজ প্রয়োজন শুভশক্তির কাছ থেকে সমাজের শুভবোধকে জাগানোর জন্যে নিরন্তর উচ্চারণ এবং ধারাবাহিক কাজ। সে কাজের শ্রেষ্ঠ উপায় হল বালক-বালিকা, তরুণ-তরুণীদের সাথে সেতুবন্ধন রচনা। অর্থাৎ তাদের সাথে কথা বলার অসংখ্য সুযোগ তৈরি করা এবং তা অব্যাহত রাখা। এ কাজে বাহন হতে পারে শিল্পকলা ও সংস্কৃতিচর্চা। ধরা যাক, পাঠচক্র তৈরি করলেন বড়রা, তাতে সেরা সাহিত্যের সাথে লিঙ্গ-নির্বিশেষে শিশু-কিশোর-বালকদের পরিচয় ঘটানো হবে। তাদের পরিচয় ঘটাতে হবে জীবনের বিচিত্র সব সম্ভারের সাথে। বুঝতে হবে জীবন কেবল সংগ্রাম এবং যাপনের বিষয় নয়, নয়  কেবল ভোগ ও প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার মঞ্চ, এ হল উপভোগ এবং উদযাপনের  ক্ষেত্র। উপভোগ করতে হলে সে কেবল নিষ্ক্রিয় শ্রোতা বা পাঠক থাকলেও হবে না, তাতে কিছু উপকার নিশ্চয় হবে, কিন্তু সবচেয়ে ফলপ্রসূ পথ হচ্ছে শিশুরা যদি সক্রিয় অংশীদার হয়ে চর্চা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জীবনকে উপভোগ ও উদযাপন করতে শেখে। তাই প্রয়োজন সাহিত্য পাঠকে অগ্রাধিকার দিয়ে আবৃত্তি, নাটক, গান, নাচ ইত্যাদি যার যার সামর্থ্য ও অভিরুচি অনুযায়ী চর্চার সুযোগ করে দেওয়া। এতেও শেষ নয়, কারণ বড়দের ভুলে গেলে চলবে না, শৈশব-কৈশোরে তাঁদের মনেও ছিল অফুরন্ত বিস্ময়বোধ - যা সামান্যের ছোঁয়ায় সাড়া দিতে সক্ষম, ছিল অসীম কৌতূহল - যা তুচ্ছকেও জানতে চায়। আর এ বয়সে নগণ্যের মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পায় শিশু। সে ভালোবাসে অভিযান, রোমাঞ্চ এবং নানা রকম চ্যালেঞ্জ। ফলে কেবল ঘরবন্দী জীবন তার নয়। প্রাসঙ্গিক হতে পারে ভেবে জানাই, একবার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা আমাকে বলেছিল - মানুষ আসলে অন্যান্য প্রাণীদের মতই বহিরঙ্গন (ওরা বলেছিল আউটডোর) প্রাণী, ভুল করে ঘরে ঢুকে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন বিশ্বপ্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে বিশ্বশিশুর নিত্য খেলা চলে। ‘আবরণ’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি শৈশবে দিগম্বর শিশুকে ধূলোবালিতে ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। কবির দু:সাহস অনেক, লিখেছেন সাত বছর পর্যন্ত পোশাকের বালাই দিয়ে ওকে কষ্ট না দিলেও চলে। হায়, যেদেশে দু-তিন বছরের শিশুকন্যাও ধর্ষিতা হয় সেখানে এ সৎসাহস কবে বিদায় নিয়েছে, কবি কীভাবে বুঝবেন!
সমাজের অঙ্গনে আমাদের অনেক কাজ। নারীদের মধ্যেও শিশু উৎপীড়ক ও নির্যাতক বেড়ে চললেও মূলত পুরুষ সম্প্রদায়ের মধ্যে সত্যিকারে পৌরুষের অভাব থেকেই সমস্যা বাড়ছে। সৎসাহস হারিয়ে কে-ই বা পুরুষ থাকতে পারে? রবীন্দ্রনাথ অবিস্মরণীয় বাঙালি বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলেছিলেন, তাঁর চরিত্রের প্রধান গৌরব ‘তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব’।
হ্যাঁ অজেয় পৌরুষ ও অক্ষয় মনুষ্যত্বের সাধনাই করতে হবে - নারীমাত্র দর্শনেই যে পৌরুষ লালসা কাতর হয়, অন্যের আত্মসম্মানবোধে যে মনুষ্যত্ব ক্ষয় পায় তার হাত থেকে সমাজকে উদ্ধার করতে হবে।
এ কাজে প্রথমে আমাদেরই দোষ স্বীকার করতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে রাজন-রাকিব-রবিউল কিংবা ত্বকীদের অপমৃত্যুর দায় সমাজের অংশ হিসেবে আমরা কেউ এড়াতে পারি না। আমরা সকলেই শিশুহত্যার অংশীদার! ব্যক্তি পর্যায়ে এই উপলব্ধি ঘটলে পরিবর্তনের কাজ কিছুটা সহজ হবে। কাজ হতে হবে দুই ক্ষেত্রে - পরিবারে এবং স্কুলে। আপাতত এক্ষুনি সরকার স্কুলে স্কুলে মূল শিক্ষাক্রমের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক শিক্ষা চালু করে দিতে পারেন।
সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা ও সাংস্কৃতিক পাঠ নিয়ে সত্তর বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রইল। এখন এ মুহূর্তে চাই রাজন-রাকিব-রবিউলসহ গত সাড়ে তিন বছরে যে প্রায় এক হাজার শিশুহত্যার ঘটনা ঘটেছে এ সম্পর্কে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হোক, প্রত্যেকটি মামলা পরিচালনার দায়িত্ব রাষ্ট্র নিক এবং দ্রুতবিচার আইনে অভিযুক্তদের অপরাধ প্রমাণ ও শাস্তির বিধান করা হোক।

***