Monday, April 25, 2016

শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষা দশকের ঘোষণা চাই

আবুল মোমেন

প্রাথমিকে ভর্তির হার প্রায় শতভাগে পৌঁছেছে - নানা পরিসংখ্যান বলছে তা ৯৭-৯৮ ভাগ হবে। তবে প্রাথমিকের শেষ পর্যায়ে পৌঁছুতে পৌঁছুতে ২০ ভাগের মত ছাত্রের ঝরে-পড়া উদ্বেগজনকই বলতে হবে। স্কুলের দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব ছাত্রই বছরের প্রথম দিন বিনামূল্যে বই পাচ্ছে। মেয়েদের জন্যে বিশেষ সুবিধাগুলো তাদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হচ্ছে। নি:সন্দেহে এ এক বিরাট অগ্রগতি। শিক্ষামন্ত্রী ও মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলেই এর জন্যে ধন্যবাদার্হ।
এখন আমাদের করণীয় হল শিক্ষার মান বাড়ানো এবং ঝরে পড়ার হার কমিয়ে আনা। সরকারি জরিপেই দেখা যাচ্ছে প্রাথমিকে অর্জনলক্ষ্য পূরণের হার বেশ হতাশাজনক, কারণ এ পর্যায়ে আদতে সকলেরই প্রায় সমমাত্রায় অগ্রগতি হওয়া দরকার। তবে আশার কথা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সচেতন। এর জন্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নানা রকম ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় আইনও প্রণয়ন করেছেন। এই সূত্রে দুএকটি ভাবনা সংশ্লিষ্টদের সাথে ভাগ করে নিতে চাই।
আমাদের স্কুলশিক্ষা সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই বস্তুত মুখস্থবিদ্যার কারবার। এটা পরীক্ষায় ভালো ফলাফল আদায়ে কার্যকর বলে প্রমাণিতও হয়েছে। ইদানীংকালে, বিশেষত গত দুই দশকে, সম্পূর্ণ স্কুলশিক্ষাই পরীক্ষাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। আমাদের দেশে বরাবর প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি থাকায় তাদের প্রয়োজনে গৃহশিক্ষক, বাড়তি কোচিং এবং নোটবইয়ের প্রচলন হয়েছে। ক্রমে এটা স্কুল শিক্ষাব্যবস্থার অংশ হয়ে উঠেছে। আর একালে পরীক্ষার ফলাফলই শিক্ষাজীবনের সাফল্যের একমাত্র মানদ- হয়ে দাঁড়ানোয় এ নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়ে স্কুল-বহির্ভূত উৎস থেকে কেবল পরীক্ষাকেন্দ্রিক পাঠগ্রহণের এক বিশাল বাণিজ্যের পথ খুলে গেছে। অনিশ্চিত ফলাফলকে সন্তানের জন্যে নিশ্চিত করতে সম্পন্ন অভিভাবকরা বড় অঙ্কে প্রয়োজনাতিরিক্ত বিনিয়োগে পিছপা হচ্ছেন না। শিক্ষার এই পণ্যায়নের সুবিধা অন্যান্যরাও নিচ্ছেন - শিক্ষক, লেখক, প্রকাশক তো বটেই এমনকি প্রশ্নকর্তা, মডারেটর বা মুদ্রাকর, পরীক্ষা-সংশ্লিষ্ট প্রশাসক বা ক্ষুদে কর্মী কেউই বাদ যায় নি।
আজকে কোনো ছাত্রই বলতে পারবে না যে কোন স্কুল ও বাড়িতে পড়েই তারা পরীক্ষা দিয়ে থাকে। যে শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের গোড়া থেকেই পরীক্ষার্থীতে রূপান্তর করে নেয় তার অংশীদার থেকে সফল হয়ে কোচিং-গাইডবই-নোটবই সংস্কৃতির বাইরে থাকার উপায় নেই বা সাহস কেউ দেখাতে যায় না। একইভাবে বলা যায় এমন কোনো সফল স্কুল-শিক্ষক মেলা কঠিন হবে যিনি কোচিং বাণিজ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট নন। আজকে পাব্লিক পরীক্ষায় দুর্দান্ত ফলাফলের জন্যে দেশের বিখ্যাত বেসরকারি স্কুলে খোঁজ নিলে দেখা যাবে সেখানে পড়াশুনা মানে নানামাত্রিক পরীক্ষা - শ্রেণিপরীক্ষা, বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা, সাময়িক পরীক্ষা, সাপ্তাহিক পরীক্ষা, ত্রৈমাসিক পরীক্ষা, ষান্মাসিক পরীক্ষা, বার্ষিক পরীক্ষা ইত্যাদি ইত্যাদি। কোচিং সেন্টারেও চলে নিরন্তর মডেল টেস্ট। অর্থাৎ এভাবে ছাত্রদের পরীক্ষায় দক্ষ করে তোলা হয়। আর ঐতিহ্যবাহী সব সরকারি স্কুলে খোঁজ নিলে দেখা যাবে স্কুলে পঠনপাঠন নেই, কক্ষের এবং আসবাবের অপ্রতুলতার পাশাপাশি একজন শিক্ষকের অনুপাতে শ্রেণিতে ছাত্রসংখ্যাও অনেক বেশি বলে যথাযথভাবে পড়ানোর উপায়ও নেই। তাছাড়া সবাই জানে পড়াশুনা হবে কোচিং সেন্টারে। ফলে স্কুলে পড়াশুনা তো বাহুল্য। বেসরকারি স্কুল ছাত্র উপস্থিতিসহ শৃঙ্খলা ঠিক রাখে মূলত ছাত্রদের ওপর নানা রকম পরীক্ষার প্রবল চাপ চাপিয়ে দিয়ে। এভাবে কোচিং, গাইড ও নোটবই এবং পরীক্ষার নির্বাচিত প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করার মধ্যে আমাদের শিক্ষা বৃত্তাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ব্রিটিশ আমল থেকেই শিক্ষার লক্ষ্য ছিল সংকীর্ণ - অল্পবিস্তর লেখাপড়া জানা, কিন্তু জ্ঞানের শক্তি এতই যে তারই ফাঁক গলে বিদ্যাসাগরসহ অনেক জ্ঞানীগুণী আমরা পেয়েছি। দুর্ভাগ্য এখন লক্ষ্য আরও সংকীর্ণ - কেবল ডিগ্রি, জিপিএ-৫ অর্জন, জ্ঞানচর্চার সাথে কোনো সংযোগ নেই।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় কোচিং-গাইড-নোটবইয়ের ত্র্যহস্পর্শ দূর করার জন্যে আন্তরিকভাবেই তৎপর হয়েছেন বলে মনে করি। কোচিং নোটবই ও গাইড বইয়ের বাণিজ্য বন্ধ করার জন্যে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছেন সরকার। শুধু বলব, অতীতেও এ নিয়ে কঠোর শাস্তির বিধানসহ আইন ছিল, হয়ত তা এখনও বলবৎ রয়েছে, কিন্তু এটিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই আমাদের স্কুলশিক্ষা সম্পূর্ণভাবে কোচিং-নোট-গাইড বাণিজ্যের হাতে জিম্মি হয়ে গেছে। আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করলে হয়ত পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে কিন্তু তাতে আমাদের মূল লক্ষ্য মানসম্পন্ন শিক্ষার প্রচলন নিশ্চিত করা যাবে না। বরং শিক্ষার সংকীর্ণ লক্ষ্য বহাল থাকলে আইনকে ফাঁকি দিয়ে, আইন প্রয়োগকারীদের আয়ত্বে এনে তলে তলে অব্যবস্থা চলতে থাকবে। তাই বলব, আইন প্রয়োগের পাশাপাশি শিক্ষার মানোন্নয়নের কাজ এবং স্কুল ও পাঠ্যবই ভিন্ন অন্যান্য সহায়ক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে। এও মনে রাখতে হবে আমাদেরই ঔদাসীন্যে ও সমায়েচিত পদক্ষেপের অভাবে এই অব্যবস্থা আজ শিক্ষাব্যবস্থার অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার ধারণা, পরিস্থতি ও বাস্তবতা ভালোভাবে অনুধাবন করেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
গত কুড়ি বছরের মধ্যে এসএসসি পাশ করা এমন কোনো মেধাবী ছাত্রছাত্রী পাওয়া যাবে না যারা এক বা একাধিক কোচিং-এ যায় নি, এক বা একাধিক নোট-গাইডবই ব্যবহার করে নি, এদের মধ্যে খুবই দুষ্প্রাপ্য হবে কোনো ছাত্রছাত্রী পাওয়া যারা নিজেরা নিজের নোট তৈরি করেছে। এই সূত্রে প্রায় ঢালাওভাবে বলা যায় সব অভিভাবক, শিক্ষকও কোনো-না-কোনোভাবে এতে অংশ নিয়েছেন; তাঁরা এর সুবিধাভোগী। ফলে আজ এটা একটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এটি যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিষয় তা বোঝা যায় যখন দেখি এদেশে প্রকৃত জ্ঞানচর্চার কদর নেই, সাধারণভাবে প্রয়োজনও নেই, এমনকি সমাজের ক্ষমতাবান উচ্চমহলের কাছে স্বাধীন বুদ্ধিজীবী তথা সুশীলসমাজ উপহাসের পাত্র হন। বিশুদ্ধ জ্ঞান ও সে জ্ঞানচর্চার গুরুত্ব সম্পর্কে সমাজের অবজ্ঞা অস্পষ্ট নয়। এই মনোভাবের প্রভাব পড়েছে সমাজের সর্বমহলে, উচ্চশিক্ষার স্তরেও। সেখানেও ছাত্ররা কেবল আসন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তর শেখে, টেক্সট বই পড়ে না, এমনকি সাহিত্যও নয়। আর মুষ্টিমেয় কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া উচ্চশিক্ষার অধ্যাপকরা ছাত্রজীবনের পরে পড়াশুনার পাঠ সম্পূর্ণ চুকিয়ে দিয়েছেন। যারা সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় আছেন, যেমন সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক তাঁদের মধ্যে আজ আর নানা বিষয়ে জ্ঞানাহরণের কোনো আগ্রহ দেখা যায় না।
তাহলে আমরা যে কথায় কথায় বলি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলব সেটা কীভাবে হবে? জ্ঞানের প্রতি পিঠ ফিরিয়ে সেটা কি সম্ভব?
আমার মনে হয় শিক্ষা ক্ষেত্রে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে পারলে ব্যত্যয়গুলো নিয়ন্ত্রণে আসবে। কারণ ত্র্যহস্পর্শের দুষ্টচক্র আজ শিক্ষার বিকল্প এবং প্রধান নিয়ন্তা হয়ে উঠলেও তা বস্তুত আমাদের অব্যবস্থারই উপজাত, অনেকসময় প্রতিক্রিয়াজাত। তাই সঠিক অবস্থা এত গুরুত্বপূর্ণ। কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত তা বিস্তারিত বলার জায়গা পত্রিকার কলাম নয়। তবে একটি সংক্ষিপ্ত রূপরেখা দেওয়া যায়।
২০১৬-২০২৫ এই দশ বছরকে শিক্ষাদশক ঘোষণা এবং শিক্ষাকে এ সময় জাতীয় অগ্রাধিকার খাত গণ্য করা যায়। বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে এর জন্যে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করে এক দশকের উপযুক্ত বাজেট প্রণয়ন করতে হবে। প্রথম পাঁচ বছরের লক্ষ্য হবে  প্রাথমিক শিক্ষাকে ঠিক করা। প্রথমে একে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, শিক্ষকসহ জনবল, পাঠাগার ও মাঠসহ অন্যান্য সুবিধার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সমাজের বিদ্যোৎসাহী ব্যক্তিবর্গদের - যেমন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, উৎসাহী পেশাজীবী, সংস্কৃতি সংগঠক প্রমুখকে - স্ব স্ব এলাকার স্কুল তদারকিতে যুক্ত করা প্রয়োজন।
মনে রাখতে হবে কেবল প্রশ্নের উত্তর শিখে কেউ শিক্ষিত হয় না, এমনকি শুধু পাঠ্যবইমাত্র পড়েও শিক্ষিত জাতি তৈরি করা যাবে না। জ্ঞানের পরিধি আরও ব্যাপ্ত, গভীর হতে হবে যাতে শিক্ষিত ব্যক্তির ভাবনা-চিন্তার ক্ষমতা তীক্ষ্মতা পায়, কার্যকর হয়। আবার কেবল বইপড়েও মনের সব দরজা খোলে না, আরও সব উপচার যোগ করা চাই - সুর, অভিনয়, আবৃত্তি, সৃজনশীল রচনা, খেলাধূল ইত্যাদি। এসব বিষয় এক মানুষকে তার দেশ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সংযুক্ত করে দেশপ্রেম খাঁটি হয়, সাংস্কৃতিক বোধ সঠিক হয়। সবার জন্যে  অংশগ্রহণের সুযোগ ও পরিবেশ থাকতে হবে। দশকের পরবর্তী পাঁচ বছরে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়ন ঘটাতে হবে একইভাবে। 
এভাবে যদি আমরা মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শিশু ও তরুণকে মানসম্পন্ন উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারি তবেই আমাদের মূল যে সম্পদ মানুষ - তা সত্যিকার অর্থে মানবসম্পদে রূপান্তরিত হবে। বিদেশের বাজারেও আমাদের মানুষের দাম বাড়বে। 
শিক্ষা নিয়ে আজকাল সকলেই ভাবছেন, বিশেষত ভালো শিক্ষার বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এটা আশার কথা। তবে সেই সাথে এও বলব, শিক্ষা নিয়ে এদেশে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে আসছে। অধিকাংশ সময় তা ভালো ফল দেয় নি। আমরা দেখছি, শিশু এবং শিক্ষার সাথে প্রত্যক্ষ যোগবিহীন, অভিজ্ঞতাহীন নানা বিশেষজ্ঞ নানাভাবে নীতিনির্ধারণ ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে প্রভাব বিস্তার করেন। তাতে শিক্ষা ক্ষেত্রে অনেক উদ্ভট ঘটনা ঘটছে। ছাত্ররা এতে ভুগছে, জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মনে রাখা দরকার, প্রাথমিক শিক্ষাই ভবিষ্যতের মানুষটির ভিত্তি তৈরি করবে, ফলে যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করে ধীরে ধীরে এগুনোই ভালো।
***