আবুল মোমেন
শিক্ষামন্ত্রীর নিরহঙ্কার নেতৃত্বে
শিক্ষামন্ত্রণালয়ের অগ্রযাত্রা আমাদের দেশে ব্যতিক্রমী ঘটনা। এর মধ্যে সাড়ে তিন
কোটি ছাত্রকে বত্রিশ কোটি বই শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনেই পৌঁছে দেওয়ার মত বিস্ময়
যেমন আছে তেমনি আছে সর্বমহলের কাছে গ্রহণযোগ্য শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে রীতিমত
বাস্তবায়ন শুরু করার মত ঐতিহাসিক অর্জন। শিক্ষামন্ত্রীর সততা ও আন্তরিকতা নিয়ে
কোনো প্রশ্ন নেই। সে ভরসায় শিক্ষা নিয়ে যাঁরা ভাবেন তাঁদের বিবেকের ওপর চেপে বসতে
থাকা একটি দুর্ভাবনা ও উদ্বেগ তুলে ধরার কথা ভাবছি।
একেবারে প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত
পুরো শিক্ষাকে যে আমরা পরীক্ষার মধ্যে -গণ্ডিবদ্ধ করে ফেললাম কাজটা কি ঠিক হল? প্রশ্নটা তোলা জরুরি কারণ এতে শিক্ষার মূল
উদ্দেশ্য - জ্ঞানবান বিবেচক নাগরিক তৈরি - বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এই ঘাটতি রেখে শিক্ষার অপর গুরুত্বপূর্ণ
লক্ষ্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি কতটা হতে পারে তাও বিচার্য বিষয়। এ দুটি বিষয়ের
পরিপূরকতা বাধাগ্রস্ত হলে কাজ হবে না,
কারণ
দক্ষকর্মী তৈরি হবে জ্ঞানবান বিবেচক নাগরিকের ভিত্তিভূমির ওপর।
পরীক্ষা হল শিক্ষার্থীর সিলেবাস ভিত্তিক
অর্জিত শিক্ষার মান যাচাইয়ের একটি পদ্ধতি। আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে শ্রেণিকক্ষের
পাঠ দেওয়া এবং তার ভিত্তিতে পরীক্ষা নেওয়া হয় তাতে বিভিন্ন স্তরের সম্পূর্ণ
অর্জনলক্ষ্য পূরণ ও পরিমাপ কোনোটাই করা সম্ভব নয়। নিচের পর্যায় থেকে অসম্পূর্ণ
শিক্ষা এবং তার আবার পরীক্ষাকেন্দ্রিকতার ফল কেমন তা আমাদের উচ্চ শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষিতসমাজের গড় আচরণ ও ভূমিকা থেকেই বোঝা উচিত। একটি অসম্পূর্ণ
শিক্ষার প্রভাবে নানা অসম্পূর্ণতা নিয়েই সমাজ গড়ে উঠছে। বরং এই নব্যশিক্ষিতদের
দাপটে আমাদের সনাতন ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধ ও নৈতিকতাও চ্যালেঞ্জের মুখে অকার্যকর হয়ে
পড়ছে। সমাজ আজ নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শূন্যতায় বিপথগামী হয়ে পড়েছে।
কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থায় শিক্ষার নগদ-লক্ষ্য
হচ্ছে পরীক্ষায় ভালো ফল এবং তা এত উগ্রভাবে প্রধান হয়ে উঠেছে যে বাকি লক্ষ্যগুলো
বাকিই থেকে যাচ্ছে, আর তাতে প্রত্যেক
ছাত্রের জীবনে মানবিক শিক্ষার বকেয়ার পাহাড় জমছে। ছাত্র যেমন তেমনি শিক্ষক ও
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিচারও হয় একমাত্র পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে। পরীক্ষা
সর্বগ্রাসী হয়ে রীতিমত স্কুল ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই অকেজো করে দিয়েছে। কারণ
পরীক্ষায় ভালো করা আদতে এমন একটি দক্ষতা যার জন্যে স্কুলে ব্যয়িত সময়কে রীতিমত
অপব্যয় বলে মনে হচ্ছে অনেকেরই, বিপরীতে
গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে কোচিং সেন্টার ও টিউটরের পাঠ। লক্ষ্য যদি একমাত্র পরীক্ষাই
হয় তবে সে বিচারে এটাই বেশি ফলপ্রসূ। ছাত্র-অভিভাবকদের চাহিদা এবং সরকারের চাপের
মধ্যে পড়ে শিক্ষকরাও শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরের কাজ করছেন এবং স্কুল
নয় বস্তুত পরীক্ষার্থী তৈরির কারখানায় খাটছেন (কোচিং সেন্টার সম্পর্কে একথা আরও
বেশি খাটে)। তবে তারা খুশিমনেই খাটছেন কারণ এটি আর্থিকভাবে লাভজনক। শিক্ষার্থীকে
নিছক পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরের এ অন্যায় দীর্ঘদিন চলতে থাকায় বর্তমানে
শিক্ষক-অভিভাবক সকলেই পরীক্ষাকেই ধ্যানজ্ঞান এবং শিক্ষা বলে ভুল - না, অন্যায় - করছেন। ফলে শিক্ষা প্রশাসন-শিক্ষকসমাজ-অভিভাবক এবং এর
ভিকটিম ছাত্র মিলে বিপথগামিতার ও অধোগতির রমরমা চলছে অবাধে। সোনালি পাঁচ-তারকা
শিক্ষার্থীদের, থুড়ি
পরীক্ষার্থীদের, সহাস্য ছবির আড়ালে
এ অবক্ষয় ঢাকা যাচ্ছে না।
মুশকিল হল, এ আনন্দ প্রায়ই দেখা যাচ্ছে স্বল্পস্থায়ী। কারণ প্রাপ্ত
শিক্ষা যে টেকসই নয় তা প্রথমে পরবর্তী ধাপের ভর্তি পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়ে যায় তাতে
অধিকাংশের ফলাফলের হাল দেখে। কিন্তু তার আরও স্থায়ী অর্থাৎ টেকসই কুফল দেখা যায়
সমাজে - ‘শিক্ষিত’ মানুষদের দক্ষতার মান এবং
দুর্নীতি-অনৈতিকতার নৈরাজ্য দেখে। এছাড়া একজন শিক্ষিত মানুষের ন্যূনতম
অর্জনের চিত্রও ভয়াবহ। দু’ একটি নমুনা দেওয়া যাক।
প্রাথমিকের মোদ্দা কয়েকটি অর্জনলক্ষ্য হল
পড়া-লেখা-বলা-শোনা (শুনে বোঝা) এবং গণিতে নির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জন। গোটা
ছাত্রজীবনেই এসব অর্জনের অগ্রগতি চলবে।
বাস্তবে কী ঘটছে? প্রাথমিক স্তর নিয়ে একটি নির্ভরযোগ্য জরীপে
দেখা যাচ্ছে শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ শিশু উপরোল্লিখিত দক্ষতাগুলো নির্দিষ্ট মান
অনুযায়ী অর্জনে ব্যর্থ থেকেই প্রাথমিক পর্যায় সমাপ্ত করে, যাদের অনেকেই জিপিএ ৫-ও পেয়ে থাকে। তাদের কথা
ছেড়ে দিন, আপনি যদি বিশ্ববিদ্যালয়
স্তরের ছাত্র বা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সর্বোচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্তদের সামনে শরৎচন্দ্র বা হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের পাতা
খুলে পড়ে শোনাতে বলেন তাহলে অভিজ্ঞতাটা কেমন হবে? আমার অভিজ্ঞতা বলে,
দু’চারজন ছাড়া কেউই ভাব ও
অর্থ ফুটিয়ে শুদ্ধ উচ্চারণে গড়গড় করে পড়তে পারে না। পদে পদে হোঁচট খায়, এবং পাঠ ও রস উভয়ই ব্যাহত হয়।
চার বছর (বা ৬ বছর) বয়স থেকে আঠার বছর (অনেক
ক্ষেত্রে তা আরও প্রলম্বিত হচ্ছে) একটানা পড়াশুনার মধ্যে থাকা সত্ত্বেও প্রায়
সবারই জ্ঞানভিত্তিক স্মৃতি অত্যন্ত দুর্বল। অর্থাৎ এত বছরে তারা যেসব বিষয় পড়েছে
(বা তাদের পড়ার কথা) যেমন - বাংলা ও ইংরেজি
সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজ,
পদার্থ
বিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের নানা শাখা, মানবিক ও অন্যান্য
বিদ্যা - তার পুঞ্জিভূত যে সঞ্চয় তাদের থাকার কথা তা গড়ে উঠছে না।
বেচারা রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন কেবল সঞ্চয় থাকলেও হবে না, কারণ তা স্তূপাকার হয়ে জঞ্জালে পরিণত হবে যদি
না এ দিয়ে ভাবনা, চিন্তা, দর্শনসহ মনন ও উপভোগের নানান রসদ তৈরির
প্রক্রিয়া চালু থাকে। এ কথা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে কেবল নির্ধারিত কিছু
পাঠ্যবই পড়িয়ে প্রকৃত শিক্ষিত জাতি তৈরি করা যায় না। আর আমাদের দেশে পরীক্ষার্থীতে
রূপান্তরিত ছাত্র অযথা পুরো পাঠ্যবই বা কেন পড়বে? শিক্ষক-টিউটরের সহযোগিতায় তারা আসন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য
প্রশ্নের উত্তরগুলোই শুধু শেখে, প্রায় ক্ষেত্রে
মুখস্থ করে। এভাবে কোনো বিষয় পূর্ণাঙ্গভাবে জানা হয় না, যেটুকু জানা হয় তার কোনো মননশীল চর্চার সুযোগ
নেই। এই কাটছাঁট করা শিক্ষার উপমা হতে পারে পাখা ছেঁটে দেওয়া পাখি, যে আর উড়তে পারে না।
এভাবে শিক্ষাটা অর্থাৎ জানা বোঝা ইত্যাদি হয়
ভাসা-ভাসা। যা সে পড়ে বা তার পড়ার কথা,
সেসব
কখনও তার ভাবনার বিষয় হয় না, বস্তুত এভাবে কারও
সমৃদ্ধ চিন্তাজগত তৈরি হয় না। এ কারণে আমরা দেখি সংসদে সুস্থ তর্ক হয় না অশ্লীল
ঝগড়া হয়। জাতীয় জীবনে কোনো ইস্যুতে সারগর্ভ আলোচনা হয় না একতরফা গোঁয়ার্তুমির
প্রকাশ ঘটে।
পরীক্ষার এই দোর্দ--প্রতাপে জ্ঞানার্জন ও
সাংস্কৃতিক মানসম্পন্ন মানুষ হয়ে ওঠার রসদগুলো অধিকাংশের অনায়ত্ত থেকে যাচ্ছে। এর
চরম দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় বাংলা সম্মানের পাঠ শেষ করে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি ভিন্ন কোনো বইয়ের নাম
বলতে পারে না এমন তরুণ প্রচুর এবং মূল টেকস্ট না পড়ে ইংরেজিসাহিত্যে ডিগ্রি অর্জন
এদেশেই সম্ভব। একথাও বলা যায়, উচ্চতর ডিগ্রি
নেওয়ার পরও অধিকাংশের সাহিত্যবোধ, সমাজচিন্তা, বিজ্ঞানমনষ্কতা ইত্যাদি অবিকশিত থেকে যায়।
পরীক্ষার রিলে রেসে আবদ্ধ ছাত্রজীবন কাটিয়ে অধূনা অধিকাংশ শিক্ষিতজনের স্কুলজীবনে
নাটকে, অভিনয়ে, গানে,
আবৃত্তিতে, বিতর্কে কি স্কাউটিং, ক্যাম্পিং, ক্রীড়ার অভিজ্ঞতা থাকছে না; স্কুল, সহপাঠী, শিক্ষককে নিয়ে এমন বৈভবময় অভিজ্ঞতা সঞ্চিত
হচ্ছে না যা ভবিষ্যত জীবনে বারবার ফিরে ফিরে আসবে মধুর উদ্দীপক স্মৃতিচারণ হয়ে।
সঞ্চয়হীন মানুষ জ্ঞানের দিক থেকে অবশ্যই দরিদ্র থাকবে, আর স্মৃতিহীন মানুষের মানবিক খুঁটিগুলো তৈরি
হয় না। বেপরোয়া কাজে কি বখাটেপনায় লিপ্ত হতে তার অন্তর থেকে রুচির বাধা তৈরি হবে
না। নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়া তাদের পক্ষে সম্ভব। এই রিক্ততার বড় খেসারত হচ্ছে আমাদের
শিক্ষিতজনদের প্রকৃত দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম গড়ে উঠছে না - পেশা বা জীবিকার সত্তার বাইরে মনুষ্যসত্তার মান খুবই খারাপ
হচ্ছে।
পরীক্ষাই সব হয়ে ওঠায় একে ঘিরে শিক্ষার
প্রতিকূল, অবাঞ্ছিত, এমনকি বেআইনি কাজ ও দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না।
এটাই স্বাভাবিক পরিণতি হওয়ার কথা। অন্ধবিশ্বাস যেমন ধর্মকে ঘিরে অসাধু ব্যক্তিদের
ব্যবসার সুযোগ করে দেয় এ ‘শিক্ষাও’ তার উপজাত হিসেবে নোটবই, টেস্ট পেপার, মেডইজি,
কোচিং
সেন্টার, টিউশিন এবং অবশ্যই
প্রশ্নপত্র ফাঁসে শিক্ষাকে জড়িয়ে রাখছে। বত্রিশ সেট প্রশ্ন তৈরি করেও এটা বন্ধ করা
যাবে না। কারণ শিক্ষার একমাত্র আরাধ্য দেবতা যদি হয় পরীক্ষা তো তাঁকে তুষ্ট করার
জন্যে পুণ্যলোভী - এক্ষেত্রে A+ লোভী - শিক্ষার্থী বা তার অভিভাবক, তেমন পুরোহিতই খুঁজবেন যিনি যে কোনো মূল্যে - অর্থাৎ অবৈধ পথে হলেও -
মোক্ষ
লাভে সহায় হবেন। শিক্ষকের মধ্যে তেমন যোগ্য সাহসী মানুষের অভাব ঘটাই স্বাভাবিক।
তাতে কেউ দমবেন না। সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা, কেরানি, প্রেসকর্মী, দপ্তরি,
মায়
দারোয়ান ইত্যাদি যেকোনো স্তর থেকে কাক্সিক্ষত ‘সাহসী যোগ্য’ পুরুষ এগিয়ে আসবেনই। হয়ত দর চড়বে, প্রণামী বাড়বে -
এই
যা।
২.
এটি আদতে শৈশবেই সশ্রম দ-প্রাপ্ত শিশুর বেড়ে
ওঠার গল্প। ঘরের নামে ওদের খাঁচায় বন্দি রাখা হয়, শিক্ষা জীবন কাটে কারাগারে, পরীক্ষার দ- খাটতে খাটতে। আশ্চর্য ব্যাপার হল শিক্ষা নয় এই
দ- ভোগেই সবাই যেন প্রলুব্ধ হয়, এমনকি এতে আনন্দ
পেতে থাকে, তার জন্যে নানা প্রলোভনও
মওজুদ থাকছে। ফলে মানবজীবনের প্রস্তুতিকাল,
পুরো
কৈশোর ও প্রথম তারুণ্য, পরীক্ষার শৃঙ্খলে
বাঁধা থাকছে। তাদের মাঠের, মুক্ত হাওয়ার, আলোর,
আকাশের, গাছের,
মাটির, জলের,
সমবয়সীর
সঙ্গের, বড়দের স্নেহমমতার এবং গল্পের, সুরের,
রঙের, আঁকার,
ভাঙার, গড়ার,
চড়ার, লাফাবার,
দৌড়োবার
যে অপরিমেয় ক্ষুধা-চাহিদা তা কি পূরণ করেছি আমরা? তার প্রকৃত আনন্দ,
তার
মনের বিকাশ কিসে সেসব ভাবনা কি আমাদের শিক্ষার এজেণ্ডায় আর সমাজের ভাবনায় আছে?
কোন ব্যবস্থায় একজন নিউটন জীবনসায়াহ্নে বলতে
পারেন ‘আমি মাত্র
জ্ঞানসমুদ্রের তীরে নুড়ি কুড়াচ্ছি’ তা আমরা ভাবি না। আর ভাবি না বলেই জীবনপ্রভাতেই শিক্ষার্থীর
গায়ে পরীক্ষার্থীর যুদ্ধ চড়িয়ে দিচ্ছি।
আমরা কেন এভাবে একটি - আসলে কোটি কোটি - বিয়োগান্তক গল্প
রচনা করে চলেছি? এটা আফসোসের কথা, কারণ এ পরিণাম ঠেকানো সম্ভব - সহজেই এর পরিণতি মিলনাত্মক করা যেত।
***