Wednesday, December 28, 2016

নাসিকের অভিজ্ঞতা, জাতীয় রাজনীতিতে প্রত্যাশা

আবুল মোমেন

নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনটি সরকার একটা টেস্ট কেস হিসেবে নিয়েছিল বলে মনে হয়। অনেকের ভাষ্য মতে এসিড টেস্ট। সরকারের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে বলা যায়। ইতিপূর্বে সিলেট, বরিশাল, রাজশাহীতে এবং পরে গাজিপুরে মেয়র নির্বাচনে হোঁচট খেয়ে সরকার কৌশল পাল্টেছিল। বিশেষভাবে রাজশাহী ও গাজিপুরে পরাজয়ে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয় সম্পর্কে সন্দিহান হওয়ার কারণ ঘটেছিল। রাজশাহীর লিটন কাজ দিয়ে মানুষের মন এতটাই জয় করেছিলেন যে পরিচিত অনেক বিএনপিপন্থীকেও দেখেছি তাঁকে ভোট দিতে চট্টগ্রাম থেকে পরিবার নিয়ে সুদূর রাজশাহী যেতে। আর গাজিপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী অ্যাডভোকেট আজমতউল্লা খান বিএনপি প্রার্থী অধ্যাপক এম. এ. মান্নানের তুলনায় পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির কারণে জনপ্রিয় স্থানীয় নেতা ছিলেন। তাঁদের পরাজয়ে মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিএনপি-জামায়াত চক্রের নেতিবাচক ভূমিকা সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট নয়। এমনকি তারা পরিবর্তনের জন্যে সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রমকেও হিসেবের মধ্যে নেয় নি। অবশ্য ঐ সময়ে সরকারের উন্নয়ন কাজ ও দেশের উন্নতির চিত্র মানুষের কাছে স্পষ্ট ছিল না। তখন মাত্র দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে উত্তরণ ঘটতে শুরু করেছে। তবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে এসব বিষয় আলোচিত হচ্ছিল। কিন্তু স্থানীয় ভোটার পর্যায়ে তখনও তা ততটা দৃষ্টিগোচর হয় নি। ফলে সরকারের দাপটে অসহায় বিএনপি যেন সহানুভূতি টেনেছিল মানুষের।
এর পরে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচন হয়েছে তিনটি - ঢাকার দুটি এবং চট্টগ্রামের একটি। এবারে প্রার্থী নির্বাচনে সরকার দলীয় পরিচয়ের বৃত্ত থেকে বাইরে থাকতে পেরেছিল। তবে নির্বাচনে বিএনপির জন্যেও সম-সুযোগের ক্ষেত্র তৈরি ছিল এমন কথা বলা যাবে না। ভোটাররা সরকারের উন্নয়নের বারতাটা ততদিনে পেতে শুরু করেছে, আবার সরকারের কঠোর অবস্থানের মুখে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা ও অপারগতাও অস্পষ্ট থাকে নি। ভোট কম পড়েছিল, প্রতিদ্বন্দ্বিতাও হয় নি। বিএনপি অভিযোগ তুলে মাঠ ছেড়ে দিয়েছিল।
এর পরে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন প্রায় একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। এর ফলে বহু কষ্টে অর্জিত গণতান্ত্রিক ভোটাধিকারের কার্যকারিতা সম্পর্কে জনমনে সংশয়ের কারণ ঘটেছিল। মানুষ ভোট বা নির্বাচনে আগ্রহ হারাতে থাকে।
এ সময়ে আরো দুটি ঘটনা ঘটে। সত্যিই দেশে উৎপাদন, বিশেষত কৃষি উৎপাদনে চমকপ্রদ সাফল্য অর্জিত হয়ে সাধারণের জীবনে স্বস্তি এসেছে। শহরগুলোয় রাস্তাঘাট, উড়ালপুল, দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করেছ, সারা দেশে সড়ক যোগাযোগে ব্যাপক কার্যকর উন্নয়ন ঘটেছে। সরকারও এ সাফল্যকে এই প্রথম ভালোভাবে প্রচারণায় কাজে লাগাতে পেরেছে। মানুষ সরকারের প্রতি, বিশেষভাবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ফিরে পেতে থাকে।
অপর বিষয়টি হল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, শাস্তি ও শাস্তি কার্যকরের পাশাপাশি এই সূত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে প্রচারণার নতুন পরিবেশ তৈরি। এতে নতুন প্রজন্ম, যারা নতুন ভোটার হচ্ছে - তাদের প্রায় সত্তর হাজার এবারে নাসিক নির্বাচনে ভোটার ছিলেন - তারা বিএনপির জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ থাকার বিষয়টি ভালোভাবে নেয় নি। আমার ধারণা এরা নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে আইভির পক্ষে ভোট দিয়েছে।
তৃতীয় একটি বিষয়ও নজরে রাখা দরকার। গত প্রায় আট বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের ভাবমূর্তি আরো বাড়াতে পেরেছেন। প্রথম থেকেই, সেই বিডিআর ঘটনা থেকে, তিনি সাহস ও দক্ষতার সাথে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন ও মোকাবিলা করেছেন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তাঁর নেতৃত্ব প্রশংসিত ও স্বীকৃত হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও চেতনার বিষয়ে বিএনপির অস্পষ্ট সন্দেহজনক ভূমিকা খুলে ধরার ব্যাপারে তাঁর দৃঢ়তা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে।
স্বীকার করতেই হবে স্বাধীনতার পরে এই প্রথম যেন সবরকম প্রশাসনিক শাখা ও স্তরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষেরা বেশি সংখ্যায় দায়িত্বে এসেছেন। মনে হয় বিচার বিভাগও এক্ষেত্রে সঠিক অবস্থানে আছেন।
অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সুফল সাধারণের হাতে আসতে থাকলে নিম্ন পর্যায়ে দলীয় রাজনীতির অন্ধ অনুসারী থাকার প্রবণতা কমে আসে। সাধারণত রাজনীতি অল্প কিছু মানুষের জন্যে লাভজনক বিষয় হয়, অধিকাংশকে এ থেকে লাভ আদায়ে অনেক ঝুঁকি ও অপবাদ সইতে হয়। এর চেয়ে নানা রকম উদ্যোগের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা অর্জনের পথগুলো এখন অনেকটা দৃশ্যমান। তরুণরা আজ রাজনীতির চেয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে আগ্রহী হচ্ছে বেশি। তারা জানে বর্তমান স্থিতিশীলতা এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শক্ত হাতের শক্তিশালী শাসন এক্ষেত্রে বেশি কার্যকর হবে। ফলে বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলেও আম মানুষ, বিশেষত উদীয়মান তরুণ উদ্যোক্তা ও তারুণ্যশক্তি, এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামায় নি। আপাতত ঘামাবে বলেও মনে হয় না। এ অবস্থায় বাংলাদেশে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘটানো বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। তাছাড়া বিএনপি যদি জামায়াত ও ইসলামি ঐক্য জোটের মত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ দলগুলোকে সঙ্গে রেখে জনগণকে কাছে টানতে চায় তাহলে খুব কাজ হবে না।
শেখ হাসিনা প্রায় একক সিদ্ধান্তেই বড় রকমের ঝুঁকি নিয়ে তাঁর প্রশাসন ও রাজনীতি পরিচালনা করছেন। তিনি সর্বাধিক জোর দিয়েছেন অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর, তাতে বিশেষত জ্বালানি খাতের উন্নয়নের প্রশ্নে - অনেক মহলের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়েও - বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিতে চান। কিন্তু এর কোনো কোনোটি, অন্তত রামপাল প্রকল্প, শেষ হওয়ার আগেই তাঁকে ভোগান্তিতে ফেলতে পারে, কারণ এটি সত্যিই বিশ্ব-ঐতিহ্য সুন্দরবনকে ক্ষতিগ্রস্ত  করবে। তবে আপাতত বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়লে ও সঞ্চালন ঠিকঠাকভাবে চললে তিনি লাভবান হবেন। শহরে দৃশ্যমান উন্নয়নে জোর দিচ্ছেন, গ্রামেও উন্নয়দের ছোঁয়া পৌঁছে গেছে, তাও দৃশ্যমান ভাবেই। সামাজিক সব সূচকে উন্নতি দৃশ্যমান - গড় আয় আর গড় আয়ুর অগ্রগতি এককথায় চমকপ্রদ।
শেখ হাসিনা এখন দুর্নীতি দমনের বিষয়ে আন্তরিক হতে পারেন। তাঁর আত্মবিশ্বাস এতটাই বেড়েছে যে দলের অনেক বিশৃঙ্খলাকারী সদস্যের বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়ার অগ্রাধিকার মেনে নিচ্ছেন। এতে যুবলীগ-ছাত্রলীগের আধিপত্য বিস্তারের ও বিত্ত অর্জনের অবৈধ তৎপরতা কমে এলে আওয়ামী লীগ আরো লাভবান হবে। অবস্থান শক্ত হওয়া এখন সরকার মানবাধিকার ও আইনের শাসনের বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারেন। এতে যেসব অপবাদ ও অপশক্তির বোঝা বইতে হয় তা থেকে দল মুক্তি পাবে। সেটা আখেরে আওয়ামী লীগ ও তার সরকারকেই লাভবান করবে।
এবারে নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে সুকৌশলে শামীম ওসমানকে দমানো হয়েছে। নির্বাচনের আগেপড়ে তিনি অনেক বাগাড়ম্বর ও নাটকীয় চমকের আশ্রয় নিলেও বস্তুত তাকে সম্পূর্ণ উপক্ষো করেই নারায়ণগঞ্জ মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বিশাল বিজয় অর্জন করেছেন। এটা নারায়ণঞ্জের ভবিষ্যত রাজনীতির জন্যে একটি নাটকীয় পরিবর্তনের বারতা দিচ্ছে বলেই মনে হয়।
এ নির্বাচন থেকে জাতীয় নির্বাচনের জন্যেও কিছু বারতা তো পাওয়া গেল। নির্বাচনে বিজয়ী হতে টাকা কিছু লাগলেও পেশিশক্তির প্রয়োজন নেই। সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়াও সুষ্ঠু নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বিজয়ী হতে পারে, সাথে প্রয়োজন দলীয় কোন্দল ও স্থানীয় স্বার্থের বিরোধগুলোকে কাটিয়ে ওঠার মত পরিকল্পনা, সর্বোপরি সত্য হল যোগ্য ও সৎ প্রার্থীই বিজয়ী হন।
এই বারতা বিএনপি আওয়ামী লীগ উভয় দলের জন্যেই এসেছে। উভয় দল মিলে যেভাবে গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস্থার অবক্ষয় ঘটিয়েছিল এখন তা থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ এসেছে, সময় তৈরি হয়েছে। এভাবেই তো একটা দেশ এগিয়ে যায়।
বর্তমান বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ পর্যায়ে। নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। আশার কথা রাষ্ট্রপতি বড় দুই দলের আস্থায় আছেন এবং আমরা আশা করি তিনি সে আস্থার ভালো প্রতিদান উভয় দলকেই দেবেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনোরূপ হস্তক্ষেপ ছাড়া অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের সাহস অর্জন করেছে - এটাই আজ বড় কথা। তবে তা পূর্ণতা পাবে যদি এই  সাহস দেশকে আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন থেকে একটি স্বাধীন মর্যাদাপূর্ণ নির্বাচন কমিশন উপহার দিতে পারে। তার পরীক্ষা যদি নারায়ণগঞ্জে হয়ে থাকে, তাহলে তাতে সরকার ও কমিশনকে সকলেই পাশ মার্ক দেবেন। ইতোমধ্যে পর্যবেক্ষকরা সকলেই তা দিয়েছেন ,দিচ্ছেন।
শেষে দুটি কথা বলতে হয়। প্রথমত, রাজনীতি সৎ লোকের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এবারে জোরদার করা হোক। দ্বিতীয়ত, দেশে সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে হলে দেশের  অপর বড় দল বিএনপিকে তাদের প্রশ্নবিদ্ধ রাজনীতি নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন ও নির্বাচন কমিশনকে স্থায়ীভাবে বিতাড়ন করতে চাইলে গণতান্ত্রিক রাজনীতির অংশীদার বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দলকেও যে কোনো রকম প্রশ্নবিদ্ধ রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আশা করি এই পরাজয়ের জন্যে গৎবাঁধা সমালোচনার পথে না হেঁটে বিএনপি তাদের জন্যে সৃষ্ট নতুন চ্যালেঞ্জগুলো বুঝে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে।

***