Thursday, April 10, 2014

কোথায় আছে অমৃত?

আবুল মোমেন

রাষ্ট্রের গতিপথ কখনও মসৃণ নয়, উত্থানপতন ও বাঁকবদল এত বড় আকারে হয়ে থাকে যে বিশেষজ্ঞরা বলে থাকেন, প্রতি পঞ্চাশ বছরে একবার মহাদেশের মানচিত্রে পরিবর্তন ঘটে। ইউরোপের দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টা সহজে বোঝা যাবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পর ইউরোপের মানচিত্রে কিছু পরিবর্তন ঘটেছিল। তারপর ১৯৮৯-এর পরে জার্মেনি, চেকেশ্লোভাকিয়া (এখন বিলুপ্ত), যুগোশ্লাভিয়া (এখন পাঁচটি ভাগে বিভক্ত) এবং পূর্বেকার সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এই অস্থিরতা যে এখনও কাটেনি তা সাম্প্রতিক ক্রাইমিয়া ক্রাইসিসে ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে। এশিয়া ও আফ্রিকাতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক কাল শেষ হয়ে স্বাধীনতার পর্ব শুরু হওয়ায় তখনই রদবদল ঘটেছে। তাতে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর ও মধ্য আফ্রিকার মানচিত্র নির্মাণ ঠিক ছিল কিনা তা নিয়ে সংশয় আছে। অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত এতে সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের বিষয়টিই অগ্রাধিকার পেয়েছে। তারই জের ধরে  প্যালেস্টাইন সমস্যা ষাট বছর ধরে চলছে বা ইরাক আকষ্মিকভাবে কুয়েত দখল করে নিতে চেয়েছিল। বাংলাদেশের আবির্ভাব প্রমাণ করে উপমহাদেশে ১৯৪৭-এর সাম্রাজ্যবাদী দেশভাগ সঠিক ছিল না। এসব দৃষ্টান্ত থেকে রাষ্ট্রের অস্থিরতা আমরা বুঝতে পারি।
এর ওপরে আছে রাষ্ট্রশাসনেও নানা উত্থানপতন। ভিন্ন মতাবলম্বী নিয়েই গণতন্ত্র, কিন্তু সেই গণতন্ত্রই অনেক সময় চরম ফ্যাসিবাদের উত্থানে সহায়ক হয়ে থাকে, যেমন হয়েছিল ১৯৩৬ সালে জার্মেনিতে নির্বাচনে হিটলারের বিজয়ের মাধ্যমে।
এখন প্রতিবেশী এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের  দেশ ভারতবর্ষে সাধারণ নির্বাচন শুরু হয়েছে। সব জরিপ ও জল্পনায় বলা হচ্ছে এবারের নির্বাচনে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন জোট ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়ান্স (এনডিএ) বিজয়ী হবে এবং ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গার জন্যে অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদীই হবেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। সবার আশংকা বিজেপির অতীতের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ির তুলনায় মোদী শক্ত হাতে তাঁর নিজস্ব ও দলীয় এজেণ্ডা বাস্তবায়ন করতে চাইবেন। তাতে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের সমাজজীবনে পরিবর্তনের হাওয়া লাগার সম্ভাবনা রয়েছে। একটি মুসলিম সমাজের তুলনায় বলা যায় হিন্দু সমাজের উপরিকাঠামোর পোশাকি সংস্কৃতি দৃশ্যত অনেক উদার হলেও তার হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সামাজিক এজেন্ডা বস্তুত অনেক রক্ষণশীল ও কট্টরভাবে অনুদার। ফলে এরকম শাসনামলে অহিন্দু সম্প্রদায়গুলো, বিশেষত বৃহত্তম সংখ্যালঘু মুসলিমসমাজ, বৈষম্যের শিকার হতে পারে। এর প্রতিক্রিয়া উপমহাদেশের মুসলিমপ্রধান দেশেও যে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই।
এবারের নির্বাচনে বিজেপি হিন্দুত্ববাদী দলের ভূমিকা নেওয়ার বিষয়ে যথেষ্ট সংযত ছিল। ইশতেহারের ঘোষণায় এমন ইঙ্গিত থাকলেও নির্বাচনী প্রচারণায় তারা ভারতবর্ষের ঐক্য ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির ওপর জোর দিচ্ছে। তাতে ভারতীয় শক্তিশালী বণিকসম্প্রদায় মোদীকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া দারিদ্র, বৈষম্য, শোষণ-পীড়িত সমাজের সাধারণ মানুষ বরাবর স্থিতিশীল সরকার ও শক্তপোক্ত শাসকের পক্ষে। একারণেই ভারতের সাধারণ মানুষ আম আদমি পার্টির নীতি বাগিশ অবস্থানকে দুর্বলতা বলে গণ্য করেছে এবং ক্ষমতা প্রয়োগ না করে ত্যাগ করার নীতিকে সমর্থন জানায় নি। দলের নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ঝাড়ার কারণ সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায় যাকে পাঠিয়েছিল তার এভাবে নীতির দোহাই দিয়ে দুম করে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়াকে তারা দুর্বলের আচরণ ও প্রতারণার শামিল মনে করেছে। এর চেয়ে অল্পসল্প দুর্নীতি করে শক্ত হাতে ক্ষমতা প্রয়োগ করলে তাকে নেতা মানতে তারা স্বস্তি বোধ করত। এই মনস্তত্ত্ব আমাদের সমাজেও প্রবল।
রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রশাসনে এরকম উত্থান পতন ও বাঁকবদল অবশ্যম্ভাবী বলেই সমাজকে পরিণত, স্থিতিশীল ও পোক্ত হতে হয়। তা না হলে অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্যে রাজনীতি ও সংস্কৃতির অঙ্গনে নানা রকম ঢেউ আছড়ে পড়তে থাকলে সমাজ তা নিজ শক্তি ও প্রজ্ঞায় সামলাতে পারবে না। সমাজ বকাটা ঘুড়ির মত দিগ্ভ্রান্ত হয়ে নানান স্রোতের মধ্যে যে ঢেউটি প্রবল হবে তাতেই সওয়ার হবে। অভীষ্ট পথে না গিয়ে ভুল পথেও চলে যেতে পারে। সে কারণে সমাজে কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয় যেগুলো বিভ্রান্তিকর অবস্থার মধ্যেও পথ দেখাতে পারে। তেমনি থাকতে হয় অভিভাবকতুল্য জ্যেষ্ঠ নাগরিক, যাঁরা সংকটের সময় নির্দিষ্টভাবে পথের দিশা দিয়ে থাকেন।
আমরা যদি দেশের ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখব  গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনেক রকম ঢেউ উঠেছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা পথ হারাইনি। ভাষা-সাহিত্য-শিল্প নিয়ে চরম বিভ্রান্তিকর কথাবার্তা হয়েছে, অর্থনৈতিক বৈষম্যও চরম ছিল, ছিল ধর্মীয় মৌলবাদ ও সামাজিক কুসংস্কারের দৌরাত্ম্য, রাজনীতিতে ভ্রান্ত পথের মোহও ছড়ানো হয়েছিল। এই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ জাতির অভিভাবক ও পথ প্রদর্শকের ভূমিকা এবং ছাত্ররা অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করেছিল। একেবারে আলাদাভাবে বলা যায় ভাষা আন্দোলনের সময় বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও পুথি গবেষক মুন্সী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ একেবারে বয়োজ্যেষ্ঠ অভিভাবকের ভূমিকা নিয়েছিলেন, তাঁরা যুগান্তকরী বক্তব্য রেখেছেন এ সময়ে। আর তাঁদের সাথে সে সময়ের প্রবীণ-নবীন অধিকাংশ লেখক ও শিক্ষাবিদ এককাতারে শামিল হয়েছিলেন। ষাটের দশকের রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় কথাসাহিত্যিক শিক্ষাবিদ আবুল ফজল ও কবি ও নারীনেত্রী বেগম সুফিয়া কামাল বলিষ্ঠভাবে অভিভাবকত্ব দিয়েছেন। তখনকার অস্থির সময়ে লেখক-শিল্পীদের পাশাপাশি অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানীসহ বুদ্ধিজীবীরা সরব ও সক্রিয়া ভূমিকা পালন করেছিলেন। আমাদের সৌভাগ্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রাজনীতিবিদরা সেই সময়ে এদের  প্রদর্শিত পথেই হেঁটেছেন। তাতে জাতীয় ঐক্য যেমন হয়েছে, তেমিন সকল বাধা জয় করে সামনে এগুনোও সম্ভব হয়েছে। সেই সময় সংবাদপত্র, যেমন দৈনিক ইত্তেফাক, সংবাদ, অবজার্ভার ও পূর্বদেশের ভূমিকা স্মরণ করুন। নিশ্চয় মনে পড়বে মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী, আবদুস সালাম-এর মত সম্পাদক-সাংবাদিকদের কথা। আজকে এই সমাজে সাহসী প্রজ্ঞাবান নি:স্বার্থ অভিভাবকের অভাব প্রকট। বিশ্ববিদ্যালয়ও অভিভাবকহীন। বিদ্যা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মূল্য এখানেও হতাশাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানচর্চার পাদপীঠ থেকে ডিগ্রি ও সনদ বিক্রয়ের কারখানায় পরিণত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হল সেই প্রতিষ্ঠান যেখানে বিদ্যা উৎপন্ন হয়। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এখানে দেশবিদেশের জ্ঞানীগুণীরা নিজেদের কাজ করবেন আর ছাত্ররা তাঁদের সঙ্গে থেকে জ্ঞানচর্চার জোগালি হিসেবে কাজ করে পরিণতি লাভ করবে। অতীতের নালন্দা বা তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশবিদেশের জ্ঞানীগুণীদের আগমনের কথা আমরা ইতিহাস থেকে জানতে পারি। একইভাবে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, চৌষট্টির দাঙ্গা বিরোধী ভূমিকা, ছেষট্টির ছয়দফার আন্দোলন, আটষট্টির স্বাধিকার আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ভূমিকার কথা ভাবুন। এখন কোথায় সংবাদপত্রের সেই ভূমিকা, কোথায়ইবা সেইসব মানবের সম্পাদক ও সাংবাদিক?
এখন বিশ্বায়নের এই কালে বাস করেও আমরা কূপমণ্ডুকতার চর্চা করছি। এর প্রভাব পড়ছে সর্বত্র, আমাদের জীবনের কোথাও মননশীলতার ছাপ নেই, এর প্রয়োজনও নেই। তাই চিন্তার দৈন্য, রুচির বিকার, অনুকরণসর্বস্বতা চলছে সর্বত্র। স্বার্থচিন্তা, ভোগের উদগ্র লালসার আগুনে পুড়ে যাচ্ছে ন্যায়-অন্যায় বোধ, জ্বলে যাচ্ছে সুশাসন ও আইনের শাসনের ধারণা, মিথ্যাচার, কপটতা, তোষামোদী, ক্ষমতার ও বিত্তের দম্ভ, ফাঁপা ও ফাঁকা গরিমায় প্রায় অসহ্য হয়ে উঠছে সমাজ জীবন। এ অবস্থার মধ্যেও পুরস্কার-স্বীকৃতি-সম্মাননার হিড়িক চলছে। তার কোনটা ঠিক কোনটা ছলনা বোঝা দায়। এভাবে মুড়ি-মুড়কি একদর হয়ে গেছে। খনার বচনে আছে যে দেশে ঘি ও তেলের দাম সমান সেই দেশে বাস করবে না। এদেশে অনেক আগেই মুজিব-জিয়াকে এক পাল্লায় তোলার কৌশল কাজ দিয়েছে। এবার কি তারেক জিয়া সেরকম একটা ভূমিকায় পৌঁছে যাবে? তাঁর সর্বশেষ কথার চালটা অনুসারীরা এদেশেও  চালু করে পাল তোলার মত বাতাস সৃষ্টির চেষ্টা চালাবেন সন্দেহ নেই। কথা হল তাতে কি উঠে পড়বেন তাঁদের সমর্থক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও অধ্যাপকরাও? ভবী কি ভুলবে এসব কথায়? বিশ্বাস করা যায় না এমন তরল অস্থির সমাজের মনমানসিকতা।
কিন্তু এই বাস্তবতা এবং এর পরিণতি নিয়ে কেউ যেন মাথা ঘামাতে রাজি নন। সবাই গা ভাসিয়ে দিয়েছেন। ফলে ক্ষমতা ও বিত্তই সমাজে প্রভাব ও প্রতিপত্তি নির্ধারণ করছে আর দুর্বল অংশ তোষামোদ ও কপটতার আশ্রয় নিয়ে গা ভাসাচ্ছে। এ যেন অমেরুদণ্ডী প্রাণীর সমাজ। সমাজে এ ধরনের লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠার সময়ে আজ থেকে শিকি শতাব্দী আগে কবিতায় লিখেছিলাম -
এখন উচু হওয়ার সময়/ কুঁজো হওয়ার/’
এবং ‘... প্রবল অনুরাগে/নিচু হয়ে সবাই
এ ওর/‘শিরদাঁড়া ভেঙে বেছে দেয় কাঁটা-/ যা কিনা
বিশ্রি/অপ্রয়োজনীয়/এবং/কাঁটার আপদ ঘুচিয়ে/
সরীসৃপ শৈথিল্যে মেতে ওঠে/তারপর।’
আমরা শিরদাঁড়াহীন প্রাণীতে পরিণত হচ্ছি, সরীসৃপ শৈথিল্যে
মেতে উঠছি। বিষ নিয়ে খেলছি-অমৃত কোথায় জানি না।