Thursday, August 11, 2016

বিবেক হারালে মানুষের থাকে কি?

আবুল মোমেন

কুমিল্লার নাট্যকর্মী কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনু হত্যার পর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। তাতে আশা জেগেছিল যে অপরাধী বা অপরাধীরা যতই শক্তিশালী হোক তারা ধরা পড়বে এবং বিচার ও শাস্তি এড়াতে পারবে না। ঘটনার সাড়ে চারমাস পরে তনুর মায়ের উপলব্ধি হল কন্যার ওপর অত্যাচারকারী ঘাতকেরা রাষ্ট্রের চেয়েও শক্তিশালী। নয়ত, কুমিল্লা সেনানিবাসের মত নিরাপদ স্থানে সংঘটিত এমন বর্বর হত্যাকাণ্ডের কুলকিনারা আজও হবে না কেন?
কত বছর হয় কিশোর ত্বকী হত্যার? হায়, আমাদের স্মৃতিতে ত্বকীর নিষ্পাপ মুখটি জ্বলজ্বল করলেও তার হত্যাকাণ্ডের বিচার থেমে থাকার অপরাধ আমরা ভুলে যাচ্ছি। সেবারেও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যাপক লেখালেখির মাধ্যমে দেশব্যাপী প্রতিবাদ হয়েছিল। মনে হয়েছিল এক লড়াকু পিতা তাঁর সন্তান হত্যার বিচার পাবেন। ঘটনা গড়িয়েছে নিজস্ব গতিতে, এবং একসময় সন্তান হত্যার বিচারপ্রার্থী পিতাকেই ঘটনা পরম্পরায় মামলার সম্মুখীন হয়ে জেলেও যেতে হয়েছে!
এদেশে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদবে? দেশে বিচার যে নেই তা নয়, অনেক মামলার বিচার হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, অনেকের বিরুদ্ধে রায় কার্যকরও হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার হয়ে রায় কার্যকর হয়েছে। আরো হচ্ছে। এসব জঘন্য অপরাধের বিচার বহুদিন বন্ধ ছিল, অনেক ক্ষেত্রে মামলাও করা যায় নি, অপরাধীদের জন্যে দায়মুক্তির আইনও ছিল। সেসব বাধা পেরিয়ে আমরা এসব অপরাধের বিচার পেয়েছি, পাচ্ছি।
আমাদের উচ্চ আদালত অনেক ক্ষেত্রেই স্বত:প্রণোদিত হয়ে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্যে মামলা করেছে, বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা রাষ্ট্রের অন্যান্য শাখা ও বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছে। তেমনি এক নির্দেশনার ভিত্তিতে পুলিশ নারায়ণগঞ্জের এক হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের অবমাননার বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা। সংশ্লিষ্ট শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের অবমাননার দৃশ্যটি কেউ ধারণ করেছিল এবং তা সেই সূত্র থেকে সকল বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রদর্শিত হয়েছে, ভিডিও ক্লিপটি ছড়িয়ে পড়েছিল সোশ্যাল মিডিয়াতে। দেশবাসী দেখেছে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে থেকে স্থানীয় এমপি কীভাবে একজন প্রধান শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করিয়ে হেনস্থা করছেন। এ ঘটনা সারা  দেশে আলোড়ন তুলেছিল, ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। শিক্ষা মন্ত্রণালয় হস্তক্ষেপ করে শিক্ষকের চাকুরি রক্ষা করলেন, তাঁর মর্যাদা পুনরুদ্ধারেও ভূমিকা রাখলেন।
ঐ সময় আত্মপক্ষ সমর্থন করে এমপি সেলিম ওসমান বলেছিলেন শিক্ষকের ওপর উত্তেজিত জনগণ এতই মারমুখী হয়ে উঠেছিল যে তাঁকে এরকম একটা শাস্তি দিয়ে তিনিই কোনো মতে প্রাণে রক্ষা করেছেন, উপস্থিত জনতাকেও শান্ত করেছিলেন। কিন্তু এখন আদালতের নির্দেশে তদন্ত চালিয়ে পুলিশ এ ঘটনায় এমপির কোনো সংশ্লিষ্টতাই খুঁজে পায় নি!
তাহলে দেশে সেই কাল এসে গেল যখন নিজের চোখ ও কানকেও অবিশ্বাস করতে হবে! চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জনের উপায়ও থাকল না! ক্ষমতাবানের ক্ষমতা কতদূর হতে পারে তার দৃষ্টান্ত কিছু কিছু মানুষ আগেও পেয়েছে। কিন্তু মানুষের চোখে দেখা তথ্যকে এবং বিশ্বাসকে এভাবে দলে থেঁৎলে দেওয়ার নমুনা আর দ্বিতীয়টি নেই। বিচিত্র নয় যে ঘটনার শিকার সংখ্যালঘু মানুষটির ওপর মানসিক চাপ প্রয়োগ করে তাঁর কাছ থেকেও এ বাবদে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে! কথা উঠতে পারে ভুক্তভোগী নিজেই ঘটনা অস্বীকার করলে অন্যে আর কী করবে?
কিন্তু এমনটা হওয়া উচিত হবে না। আমরা দেশ ও এর ভবিষ্যতের স্বার্থে আদালতের দিকে তাকিয়ে থাকব পুনরায় স্বত:প্রণোদিত হয়ে দুর্বলের পাশে দাঁড়াবার আশা নিয়ে। যে ঘটনা মানুষের মনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল, মানুষের বিবেক ও মর্যাদাবোধকে নাড়া দিয়েছিল, সমাজের অত্যন্ত মান্য ব্যক্তিরাও শিক্ষকের অপমানকে নিজেদের গায়ে নিয়েছিলেন। এর সাথে যেমন সত্যের টিকে থাকবার একটা ব্যাপার আছে তেমনি রয়েছে জাতির বিবেকের টেকা না টেকার প্রশ্ন।
ঘটনাটি ঘটে নি এ কথা তো বলা যাবে না, কেউ না কেউ সেদিন কাজটা করিয়েছিল, এমপি সেলিম ওসমানও সেখানে উপস্থিত ছিলেন - এসবই তো সত্য, এসবই ঘটনা। ঘটনা অস্বীকার করা যাচ্ছে না, তাই কি বলা হচ্ছে কেউ কিছু বোঝার আগে আকস্মিকভাবে ঘটে গেছে? এই আকস্মিকতার তত্ত্ব কার মাথা থেকে এসেছে? কারো মাথা থেকে তো নিশ্চয় এসেছে এবং তিনি নিশ্চয় অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি। আমরাও প্রভাবশালীর ক্ষমতার দৌড় কতদূর, সেটাই বুঝতে আইছি।  ফলত ঘটনা এখানে শেষ হয় না, নতুন মোড় নিয়ে নতুনভাবে শুরু হয়। আমরা তাই এ বিষয়ে আদালতের পরবর্তী ভূমিকার দিকে তাকিয়ে থাকব।
বিষয়টা গুরুতর। কেবল এটি নয়, তনু, ত্বকী, মিতুর হত্যাকাণ্ডের মত ঘটনাগুলো রহস্যে আবৃত হয়ে থাকলে মানুষের মনে হবে আইনের জন্যেও অনেক স্থান, প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি দুর্ভেদ্য। এতে বিচার বিভাগের ক্ষমতা সম্পর্কে জনধারণায় চিড় ধরে। কিন্তু সবচেয়ে বড় ক্ষতি হল, এতে জাতির বিবেক এবং সত্যবোধ ক্ষয় পেতে থাকে। সত্য ও মিথ্যাকে একাকার হতে দিলে, করা সম্ভব হলে সে সমাজে অপরাধ ঠেকানো মুশকিল, জঙ্গিবাদের প্রবণতার কাছেও তা দুর্বল থাকবে। আর বিবেক অস্বীকৃত হলে, বিবেককে অকার্যকর করে দিলে অর্থাৎ বিবেকের মৃত্যু ঘটলে সেটি আর মানুষের সমাজ থাকে কি?
মানুষ খুন হচ্ছে আকছার, বেঁচে থাকা মানুষের সম্মানও খুন হচ্ছে, এরপর বাড়তে বাড়তে পুরো জাতির বিবেক খুন হয়ে যাবে, মানুষের সত্যবোধ লুণ্ঠিত হবে। হয়তবা এসবও হচ্ছে, আমাদের ভোঁতা চেতনা অসাড় হয়ে যাচ্ছে বলে বুঝতে পারছি না। আমরা কথায় কথায় চরিত্র গঠনের কথা বলি, নৈতিক শিক্ষার কথা বলি। চরিত্র কিংবা নীতিবোধ পুঁথিগত শিক্ষা থেকে আসে না, বই পড়ে বিষয়টা জানা হয়, জানা হয় যে সদা সত্য কথা বলিবে। কিন্তু সেই নীতিবোধ চরিত্রে ধারণ করা যায় দৃষ্টান্ত থেকে। তাই রোল মডেলের কথা ওঠে, সমাজে দৃষ্টান্ত দেওয়ার মত মানুষের আকালের কথা বলে আমরা আফশোস করি। সমাজে প্রতিনিয়ত কপটতার আশ্রয় নিয়ে মিথ্যার জয় ঘটছে, ভ-ামি ও চাতুর্য সাফল্যের পথ তৈরি করছে, এমনকি অন্যায় ও অপরাধই জয়ী হচ্ছে বারংবার।
তার মধ্যেও সমাজ কেন টেকে? টিকে থাকে ছিটেফোঁটা দৃষ্টান্তের ওপর। যুদ্ধাপরাধীদের দম্ভ ও আস্ফালন শুনতে শুনতে মানুষ একসময় বিশ্বাস হারিয়েছিল যে এদের বিচার কোনো দিন এদেশে হতে পারবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হল, এবং মানুষের হৃতবিশ্বাস ফিরে এলো। ইয়াসমিন হত্যার বিচার পেয়েও মানুষ আশাবাদী হয়ে উঠেছিল।
সমাজমানস কোনো কোনো ঘটনায় ত্বরিত এবং প্রবল প্রতিক্রিয়া জানায়। কারণ ঘটনা তার সংবেদনশীলতার জায়গায় প্রবল ধাক্কা দেয়,  তার বিবেককে নাড়া দেয়। সেসব ঘটনায় পারস্পরিক যোগাযোগ ছাড়াই সারাদেশে একযোগে মানুষ একইভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে থাকে। মানুষের এই প্রতিক্রিয়া, এই সংহতির মধ্য দিয়ে জাতির বিবেক কথা বলে। এ হল জাতীয় বিবেকের সত্যাশ্রয়ী ভূমিকা।
খুব সাম্প্রতিক কালে ত্বকী ও তনুর হত্যাকা- সাড়া দেশকে নাড়া দিয়েছিল। এ ছিল দুটি কিশোর-কিশোরীর অন্যায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জাতির বিবেকের তীব্র হাহাকার ও ক্ষোভের প্রকাশ। আর সম্প্রতি শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তের অন্যায় অবমাননায় জাতির বিবেক শিক্ষকের মর্যাদার প্রশ্নে এক হয়ে প্রতিকার চেয়েছিল। এসব ঘটনা কেবল ভুক্তভোগী ব্যক্তির বা তাদের পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ ঘটনা নয়। এতো জমিজমার খুনের মামলা নয়, দাম্পত্যকলহের উত্তেজনার ফলে ঘটা খুনের মামলাও নয়। সব হত্যাই অপরাধ, তবুও অনেক ক্ষেত্রে দোষ-দায় নিয়ে সওয়াল চলে, কিন্তু তনু-ত্বকীর হত্যাকাণ্ড, যেমন রাশেদ-রাকিব-সাগর হত্যায়, তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করার কিছু নেই।
নিরাপরাধ শিশু-কিশোরদের হত্যা তাই মানুষকে এতো পীড়িত করে, তার বিবেক প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। একইভাবে একজন প্রধান শিক্ষকের প্রকাশ্যে অবমাননা জাতি মেনে নিতে পারে নি। তা যদি জাতিকে মানতে বাধ্য করা হয় তবে সেটা হবে জাতির গালে চপেটাঘাত, তার বিবেক ও সত্যবোধকে হত্যা করার সামিল। বিবেক ও সত্য এমন বিষয় যে তা কোথাও চলবে আবার কোথাও অচল হয়ে থাকবে এমন সুবিধাবাদ বা আপোসের নীতি চলতে পারে নি।
আমাদের জানতে হবে যে এ জাতির সত্যবোধ কি আছে নাকি নেই। জানতে হবে এটি কি বিবেকবোধসম্পন্ন জাতি নাকি নয়।
ইতিহাস বলে, সব কাল একরকমভাবে যায় না। কোনো কোনো কাল আসে যখন আপাত উন্নতি ও বৈভবের নিচে মনুষ্যত্বের কঙ্কাল তৈরি হতে থাকে। সেটা সময়মত বোঝা যায় না, বাহ্য চাকচিক্যে মোহগ্রস্ত মানুষ বিবেকের হাহাকার ও কাতরোক্তি শুনতে পায় না।
বিবেক হারালে ধনী হোক, জ্ঞানী হোক, সে তো আর মানুষ থাকে না। জাতিও কি তবে মানুষের জাতি থাকে?

***