Wednesday, August 21, 2013

নাগরিক সমাজ দায়িত্ব এড়াতে পারে না

আবুল মোমেন

দু বছরের অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং দুটি স্বল্প মেয়াদের সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিলে গত তেইশ বছরের মধ্যে কুড়ি বছর দেশ দুই নেত্রীর অধীনে শাসিত হয়ে আসছে।
দেশ শাসন করলেও কখনও তাঁরা দু’জন দেশ নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন নি, বা করতে পারেন নি কিংবা করতে চান নি। জনসভার ভাষণে অবশ্য তাঁরা একে অপরের সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। কখনও একের মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন অন্যে। জনসভার এই চর্চায় অবশ্য দূরত্বই বাড়ে, আলোচনার সম্ভাবনা যায় কমে। দুই নেত্রীর কাছে সুশীল সমাজের এটি একটি প্রধান চাওয়া। বিগত তেইশ বছরে দুই নেত্রীর মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ যে হয় নি তা নয়, কিন্তু সেসব সাধারণ সৌজন্য বিনিময়ের বেশি আলোচনা পর্যন্ত গড়ায় নি।
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া দু’জনেই প্রায় একই সময়ে রাজনীতিতে এসেছেন। এসেছেন তাঁরা নিজ নিজ বিপর্যস্ত দলের হাল ধরবার জন্যে। ফলে দু’জনেই দলীয় সভানেত্রীর ভূমিকা নিয়ে প্রত্যক্ষ দলীয় রাজনীতি শুরু করেছেন। তবে এখানে বলতে হবে, শেখ হাসিনা এক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে আছেন। বঙ্গবন্ধু-কন্যা হিসেবে তিনি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেই বড় হয়েছেন এবং ছাত্রজীবনে সক্রিয়ভাবে ছাত্র রাজনীতি করেছেন। উপমহাদেশের রাজনৈতিক ধারা থেকে বলা যায়, কোনো একসময় তাঁর জাতীয় রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার সম্ভাব্যতা বরাবরই ছিল।
খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টা ভিন্ন। স্বয়ং জিয়াউর রহমান প্রথমে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বিশেষ পরিস্থিতিতে জাতীয় পরিচিতি পান এবং পরে বিশেষ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণ করেন ও তারপরে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। একজন সামরিক কর্মকর্তার স্ত্রী হিসেবে বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসার বিষয়টি একেবারেই আকস্মিক। তাঁর স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর পর তাঁকে বিএনপি নেতৃবৃন্দ জিয়ার শূন্যতা পূরণ ও দলীয় ঐক্য ধরে রাখার জন্যে সভানেত্রীর পদ দিয়ে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। আর পঁচাত্তরের পরে আওয়ামী লীগে উপদলীয় কোন্দল মাথাচাড়া দিচ্ছিল। জিয়া-এরশাদের নির্যাতনে দলে সংকট বাড়ছিল, গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গতিশীল নেতৃত্বে ফিরে আসার জন্যে তৎকালীন নেতৃবৃন্দ শেখ হাসিনাকেই দলীয় প্রধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন।
শেখ হাসিনা ধীরে ধীরে দলে তাঁর একক ও একচ্ছত্র নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। বিপরীতে বেগম জিয়ার নেতৃত্বের বিষয়টি খুব স্পষ্ট নয়, তিনি সহযোগীদের পরামর্শ কতটা নেন, কতটা পুত্র তারেকের ওপর নির্ভর করেন তা বোঝা যায় না। তবে বিএনপির গঠনতন্ত্রের এবং তাঁর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার কারণেই তিনিও একক ও একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করেন।
দুই নেত্রী যেভাবে একক ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তা নিয়ে আপাতত বলার কিছু নেই। কিন্তু যে দু’জন মানুষের ওপর দেশ ও দেশবাসীর ভাগ্য নির্ভর করছে তাঁরা যে দেশ নিয়ে পরস্পর কোনো আলোচনাই করতে পারছেন না তাতে দেশের ক্ষতি হচ্ছে। কারণ যে কোন দেশের শাসনব্যবস্থায় ধারাবাহিকতা দরকার। গণতন্ত্রে এটি আরও অপরিহার্য। আলাপ-আলোচনা ছাড়া এ কাজ তো সম্ভব নয়। এর ফলেই আমাদের রাজনীতিতে বিদেশি কূটনীতিকদের বারবার নাক গলাতে দেখি, আবার আমাদের রাজনীতিকদেরও বিদেশিদের কাছে গিয়ে নালিশ জানাতে দেখি, এবং মাঝে মাঝে সেনা-সমর্থিত অসাংবিধানিক সরকারের আবির্ভাবও ঘটে যাচ্ছে।
কিন্তু কুড়ি বছরেও দুই নেত্রীর বৈঠক সম্ভব না হওয়ায় এখন বোধহয় সময় এসেছে এর কারণ খুঁজে বের করে বিকল্প কোনো পথ খুঁজে দেখা।
সচেতন নাগরিকের চোখে দুই দলের মধ্যেকার আস্থার সংকট ধরা পড়বেই। বোঝা কঠিন নয় আওয়ামী লীগের পক্ষে জেনারেল জিয়ার কিছু ভূমিকা মেনে নেওয়া কঠিন। প্রথমত, বঙ্গবন্ধুর স্ব-স্বীকৃত খুনীদের বিচার না করে বরং প্রজাতন্ত্রের মূল্যবান চাকুরি দিয়ে পুরস্কৃত করা। দ্বিতীয়ত, ১৫ আগস্টের হত্যার বিচার থেকে তাদের অব্যাহতি দিয়ে জারিকৃত ইণ্ডেমনিটি আইন বহাল রাখা। তৃতীয়ত, নিষিদ্ধ ঘোষিত যুদ্ধাপরধীদের দল জামায়াতকে বৈধতা দান ও পুনর্বাসিত করা। চতুর্থত, মুক্তিযুদ্ধের দালালদের পুনর্বাসিত করা ও দালাল আইন সম্পূর্ণ রহিত করা। পঞ্চমত, মুক্তিযুদ্ধের অর্জিত ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণের পথ থেকে সরে এসে পাকিস্তানি ধারার ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার রাজনীতির প্রচলন।
এর সাথে যদি বেগম জিয়ার বিগত আমলের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা এবং দশ ট্রাক অস্ত্র মামলাকে বিবেচনায় নিই তাহলেও কয়েকটি গুরুতর প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। একুশে আগস্ট হামলার মূল টার্গেট ছিলেন বেগম জিয়ার প্রতিপক্ষ শেখ হাসিনা। সেদিন মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ বাইশজন আওয়ামী লীগ-কর্মী নিহত হয়েছিলেন। তদন্তে বেরিয়ে এসেছে এই হামলার সাথে কেবল নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবির লোক জড়িত ছিল না, এদের অনেকের জামায়াত কানেকশন ছিল এবং বিএনপির এমন কোনো কোনো নেতার পৃষ্ঠপোষকতা ছিল যাঁদের যোগাযোগ ছিল হাওয়া ভবনের সাথে। আর দশ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনায় বিএনপি ও জামায়াতের একাধিক মন্ত্রী-নেতার যোগাসাজশের বিষয় তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
এখন জাতীয় পর্যায়ে আরও প্রশ্ন উঠে আসছে। যে কোনো বিবেচনায় জামায়াতে ইসলামি যুদ্ধাপরাধীদের দল, এ দল একাত্তরের ভূমিকার ভুল স্বীকার করে নি। বরং ধর্মকে ব্যবহার করে বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে দেশে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ানো এবং দেশে নাশকতা, উত্তেজনা ও হানাহানি সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি জামায়াতে ইসলামিকে নিয়ে জোট গঠন করেছে। এই বাস্তবতায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট ক্ষমতায় গেলে জামায়াত-নেতারা মন্ত্রীও হবেন। তারা হেফাজতে ইসলামের মত একটি ধর্মান্ধ ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীকে অরাজকতা সৃষ্টিতে উৎসাহ দিতে কুণ্ঠিত হয় নি।
এসব প্রশ্নের সদুত্তর সুশীল সমাজ যদি নাও চায়, একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে যদি আওয়ামী লীগ চায় তাহলে তাকে তো দোষ দেওয়া যাবে না।
আমরা জানি দখলদারি, টেণ্ডারবাজি বা ক্ষমতার জন্যে দলীয় কোন্দল ও হানাহানি দু’দলে  একইভাবেই চলে। এতে জনগণের ভোগান্তি হয় তাও সবাই স্বীকার করবেন। কিন্তু এর বাইরে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড, ইতিহাস বিকৃতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থী ভূমিকা, যুদ্ধাপরাধীদের মদত দেওয়ার মত ঘটনার কি বিহিত হবে?
মনে হচ্ছে শেখ হাসিনা এখন নির্বাচনে পরাজিত হলেও তাঁর অবস্থান থেকে নড়তে চাইছেন না, কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় যে রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছেন তা নিয়ে আপোস করতে চান না। কথা হল, তাহলে কী হবে? 
আমার মনে হয়, নির্বাচনের আগে অত্যন্ত জরুরি হল - বিএনপির দাবি নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা এবং তার বিপরীতে আওয়ামী লীগের দাবি হওয়া উচিত জামায়াত ও ধর্মান্ধ শক্তি সম্পর্কে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করা। কেননা, গণতন্ত্র তো কেবল নির্বাচন আর পাঁচ বছর পরপর সরকার পরিবর্তন নয়। গণতন্ত্রের অন্যতম বিষয় হল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমানাধিকার নিশ্চিত করা, একটি অসাম্প্রদায়িক নাগরিক সমাজ গঠন, আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করা ইত্যাদি। এ বিষয়ে সুরাহা না হলে হয়ত নির্বাচন হবে, নতুন সরকার আসবে, কিন্তু অবিশ্বাস ও অনাস্থা, সংঘাত ও হানাহানি, অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা চলতেই থাকবে।
দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান চাইলে এ বিষয়ে নাগরিকসমাজকে কথা বলতে হবে ও উদ্যোগ নিতে হবে।