Monday, July 10, 2017

চরমপন্থা দমানোর পরিবেশ তৈরি করতে হবে

আবুল মোমেন

হলি আর্টিজানে হামলার বছর পূর্তিতে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে যখন ভাবছিলাম দেশে জঙ্গি সৃষ্টির কারণ কী তখন স্বভাবতই প্রথমে মনে এসেছে সঠিক শিক্ষা ও সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার সুযোগের কথা। হয়ত ব্যাখ্যা দিয়ে বলা যায় সঠিক শিক্ষা বলতে কি বোঝায়, কেন আমাদের পরীক্ষাকেন্দ্রিক মুখস্থনির্ভর ব্যবস্থাকে সঠিক শিক্ষা বলা যাচ্ছে না। হয়ত বিস্তৃত করে কলাচর্চা ও জীবনশৈলীর নানা দিকের দৃষ্টান্ত দিয়ে সুস্থ সংস্কৃতি বলতে কী বোঝাতে চাই তা-ও আলোচনায় আনা যায়। কিশোর-তরুণদের প্রসঙ্গে খুব গুরুত্বপূর্ণ অথচ উপেক্ষিত একটি বিষয় তাদের মনের সবচেয়ে জোরালো আবেগের সাথে যুক্ত। সেটা হল তাদের নিজেকে ছাপিয়ে ওঠার আকাক্সক্ষা। কিশোর বয়স থেকে তারুণ্য পর্যন্ত মানুষের মনের মধ্যে এই বোধ খুব জোরালোভাবে কাজ করে। ঐকান্তিক আবেগ কিংবা বলা যায় প্রেরণাই তাদের মহত্ত্বের সাধনায় অনুপ্রাণিত করে। এ সময় যদি সঠিক পথনির্দেশ এবং যথার্থ কাজে তাকে যুক্ত করা না যায় তাহলে অতৃপ্ত প্রেরণার তীব্র আবেগ তাদের ভুল পথেও নিয়ে যেতে পারে। সংবেদনশীল কিশোর-তরুণ (কিশোরী ও তারুণীসহ বোঝাচ্ছি) মন যদি এই উচ্চ আদর্শের রসদ বা পুষ্টি পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজ থেকে না পায় তাহলে তার মনে যে শূন্যতা এবং হতাশা তৈরি হবে সেটার অভিঘাতও হবে তীব্র, যা তার ব্যক্তিত্বে ভাঙচুর ঘটাতে পারে, এতে তৈরি হতে পারে তার গভীর মানসিক সংকট।
একসময় সব স্কুলে প্রভাতী সমাবেশ হত। আমার অভিজ্ঞতায় দেখি তাতে জাতীয় সঙ্গীত ছাড়াও একটি দেশাত্মবোধক গান হত, শপথবাক্য পাঠ করা হত, তার আগে হাল্কা ব্যায়ামের শৃঙ্খলায় ছাত্রদের মনকে এতক্ষণের ছুটাছুটি, দুষ্টামি ও কলরব থেকে একটু ভাবগম্ভীর আয়োজনের জন্যে প্রস্তুত করা হত। কাজটা সহজেই হতে পারত প্রধানত প্রধান শিক্ষককের উপস্থিতির ফলে, কারণ তিনি নিজ ব্যক্তিত্বের গুণে ছাত্র-শিক্ষকদের সমীহ ও শ্রদ্ধা পেতেন। এর পরে বলতে হবে দক্ষ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ক্রীড়া শিক্ষকদের পরিচালনা, নিত্যদিনের সযতœ শিক্ষণের গুণে শ্রেণি শিক্ষকের ভূমিকা এবং শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় অন্যান্য শিক্ষকম-লীর সক্রিয় উপস্থিতির কথা। কখনো বিশেষ দিনে বা উপলক্ষে প্রধান শিক্ষক ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতেন, সাধারণত মহৎ কোনো মানুষ বা উপলক্ষ কিংবা স্কুলের প্রাক্তন ছাত্রদের কারো কোনো বড় ও মহৎ অর্জন-অবদানের প্রসঙ্গ টেনে মানবিক গুণাবলি বা সাফল্য অর্জনে ছাত্রদের অনুপ্রাণিত করতেন।
সেকালে এর বাইরে স্কুলে কাব, স্কাউট ও গার্লস গাইড ছিল যেখানে সদস্য হয়ে মানব ও দেশ সেবার মত মহৎ কাজের জন্যে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করার প্রণোদনা মিলত। এছাড়াও মুকুল ফৌজ, পরে খেলাঘর, কচিকাঁচার আসর প্রভৃতিতে যোগ দিয়েও দেশ ও মানুষের জন্যে কাজের সুযোগ তৈরি হত। এগুলো এবং আরো অসংখ্য পাড়ার ক্লাব, পাঠাগার ইত্যাদি কিশোর-তরুণদের জীবনে নিজেকে ছাপিয়ে ওঠার সুযোগ করে দিত। এসব সংগঠনে তারা যথার্থ নেতা পেয়েছে, যৌথভাবে আনন্দময় বিনোদনের সুযোগ পেয়েছে, সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে নিজেকে সবার মাঝে মেলে ধরবার এবং স্বীকৃতির সুযোগ পেত, বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের মত জাতীয় দুর্যোগে ত্যাগের মনোভাব নিয়ে কাজেরও সুযোগ এসে যেত। শিশু-কিশোরদের কচি মনের এসবই হল সাধ পূরণের যথার্থ খোরাক। তাদের মনের সুষ্ঠু বিকাশের জন্যে এসবই প্রয়োজন। ছাত্র রাজনীতিও একসময় তরুণদের দেশ ও মানবসেবার বড় সুযোগ করে দিয়েছিল।
আজকে যারা ধর্মীয় জঙ্গীবাদের দিকে ঝুঁকছে তারা অনেকেই স্কুলে হয়ত সঠিক প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষকম-লী পেয়েছিল, তাদের স্কুলে প্রভাতী সমাবেশও হয়ত গুরুত্বের সাথে হত, তারা অনেকেই হয়ত গানবাজনা, সংস্কৃতি চর্চাও করেছে, কিন্তু তারপরেও কেন তারা বিভ্রান্ত হল, বিপথে গেল? তার উত্তরে বলব তারা যা পায় নি তাহল নিজেকে ছাপিয়ে ওঠার অর্থাৎ মহৎ কোনো সাধনায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ। কিশোর ও তরুণদের জীবনে এই যে মস্ত বড় একটা শূন্যতা তৈরি হল এর দায় কি সমাজের বড়রা এড়াতে পারব? আজ স্বাধীনতার পরে পূর্বাপর সবটা বিচার করলে কি অস্বীকার করতে পারব দেশের শিশু-কিশোর-তরুণদের মনের মহত্ত্বের স্বপ্ন ও আকাক্সক্ষা পূরণের পথ যে আমরাই রুদ্ধ করে দিয়েছি?
কথা হল সুস্থ সাংস্কৃতিক বাতাবরণে শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণে শিক্ষা হয় প্রাণবন্ত, নানান বিষয়বৈচিত্র্যে তার মন বহুতর ভাবনা, সৃজন ও উপভোগের জন্যে তৈরি হয়ে ওঠে। এমন পরিবেশ থেকে সাধারণত কেউ সংকীর্ণ চিন্তা ও অন্ধবিশ্বাসের গণ্ডিতে আটকে পড়ে না। সে জীবন ও জগতের মধ্যে বৈচিত্র, বহুমুখিতা, বিকাশমানতা, পরিবর্তনশীলতা নবায়নযোগ্যতা এবং আতশকাঁচের মত বহুবর্ণিল রূপ ও রসের সন্ধান পেয়ে যায়। সে বাঁচার আনন্দ এবং জীবনের তাৎপর্য খুঁজে পায়। এমন মানুষ গোঁড়া কিংবা চরমপন্থী হতে পারে না। আমরা কেন শিক্ষার চরিতার্থতা ভাবলাম একমাত্র পরীক্ষার ফলাফলে? বই, পোশাক, নগদ টাকা, খাবার - এসবের মধ্যেই শিশু-কিশোরের মানুষ হয়ে ওঠার সকল সংকটের সমাধান ভাবলাম? পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ালাম, হয়ত বৃত্তির অর্থমূল্যও বাড়াব, জিপিএ৫ এর সংখ্যা হয়ত বাড়তে থাকবে (এ বছর যদিও কমেছে), সব মানুষই হয়ত জেএসসি এসএসসি পাশ করবে একদিন - কিন্তু তাতে কি কিশোর-তরুণদের নিজেকে ছাড়িয়ে ওঠার আকাক্সক্ষা পূরণ হবে? এভাবে হয় না বলে তাদের মনে বিভ্রান্তির ঝড়ো মেঘ জমতে পারে। তাদের বিপথগামিতাও বন্ধ হয় না, জঙ্গিবাদে দীক্ষগ্রহণ এবং আত্মঘাতী পথে হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিও দূর হয় না।
শিক্ষাকে যেমন কেবলমাত্র পরীক্ষার ফলের উচ্চাশা তথা চাহিদা পূরণের গ-িতে আবদ্ধ করেছি তেমনি সমাজেও পরিণত মানুষের জন্যে বৈষয়িক সাফল্যের চাপ পূরণই জীবনের একমাত্র ব্রত হয়ে উঠেছে। তার ফলাফলের একটা চরম দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ সবার অলক্ষ্যে কখন যে চেতনা থেকে অন্ধ বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে তা কেউই বলতে পারব না। চেতনা বহুতর ভাবনা ও ধারণাকে গ্রহণ করতে  পারে, আর তাতেই একাত্তরে বামপন্থী-মধ্যপন্থী-ডানপন্থী সকলেই এক হতে পেরেছিল, যে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে এই চেতনা প্রতিনিধিত্ব করে তা লালন-হাছনের মত সহজিয়া সাধক, রবীন্দ্রনাথের মত সৃষ্টিশীল বিশ্বাসী, নজরুলের মত বৈচিত্র্যময় অধ্যাত্ম সাধক, নিষ্ঠাবান মুসলিম মওলানা মাসুদকে এক কাতারে আনতে পারে। বাঙালির হাজার বছরের মনীষার ঐতিহ্য তো এই মানবতাবাদী চেতনাই যা মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শই অন্তর্গত। কিন্তু এটাকে ক্ষমতাসীন দল ও তার সমর্থকরা নিছক বিশ্বাস, অন্ধ-বিশ্বাসে পরিণত করছে। এক অন্ধবিশ্বাসের বিপরীতে আরেক অন্ধবিশ্বাসের উত্থান প্রায় অবশ্যম্ভাবী, যা কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বী অন্ধবিশ্বাস।
বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির বাম ও মধ্য কোনো অংশই ধর্মপ্রাণ মুসলিম-প্রধান দেশের জনগণকে আলোকনের মাধ্যমে যুগোপযোগী মানসে ঋদ্ধ করে তোলার কাজটি করে নি। উভয় পক্ষই এক্ষেত্রে ভিন্নভাবে নিরুত্তর থেকেছে - বাম অংশ বিষয়টি এড়িয়ে কেবল বাঙালির মানবিক ঐতিহ্যের বয়ান দিয়ে গেছে আর মধ্যপন্থীরা (যার মূল প্রতিনিধি আওয়ামী লীগ) ধর্মবাদীদের সাথে আপসের পথেই চলছে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এক অন্ধবিশ্বাসে পরিণত করছে। সমাজে জ্ঞানচর্চার প্রকৃত পরিবেশ থাকছে না, এতে শিল্প ও সংস্কৃতি চর্চার পথও সংকীর্ণ হয়ে আসছে।
চেতনার বিপরীতে যে অন্ধবিশ্বাস তার মৌলিক প্রবণতাই হল জবরদস্তি, তার ঝোঁক যুক্তি ও চিন্তার বিস্তারের পরিবর্তে বলপ্রয়োগের দিকে, তার অনিবার্য পরিণতি সংকীর্ণতা, অবক্ষয় এবং সংঘাত। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার যেমন তেমনি ইসলামের প্রকৃত চেতনার মধ্যেও ঔদার্য ও মানবিকতার স্থান নিশ্চয়ই অনেকখানি। কিন্তু জঙ্গিরা তাদের তৎপরতার মাধ্যমে ইসলামের এই সত্যরূপকেই অস্বীকার করছে।
তাই বলব ইরাক ও লিবিয়ায় পশ্চিমের অন্যায় হস্তক্ষেপে সেসব দেশে ভয়ঙ্কর মানবিক বিপর্যয়ের পরে এই মুসলিম-প্রধান দেশের - প্রতিক্রিয়াশীল অন্ধবিশ্বাসীদের প্রতিক্রিয়ার কথা না ভাবলেও - সংবেদনশীল কিশোর-তরুণদের প্রতিক্রিয়ার কথা তো ভাবা উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এরকম দূরদর্শী ভাবনা আমাদের নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের মনে সহজে আসে না যেভাবে আসে নি একাত্তরে। সেদিন রণাঙ্গনে অস্ত্রচালনা, হত্যা, রক্ত ও মৃত্যুযন্ত্রণার অভিজ্ঞতার পরে ঘরছাড়া এসব তরুণদের পুনরায় ঘরে ফেরানো এবং তাদের অতৃপ্ত স্বপ্নপূরণের জন্যে দেশ পুনর্গঠনের মত বৃহৎ মহৎ কাজে দলমত নির্বিশেষে তাদের লাগানোয় ব্যর্থতা এবং তার খেসারত কি আমরা উপলব্ধি করি? সেই ব্যর্থতার ফলে তারুণ্যের উৎশৃঙ্খলতা, বেপরোয় ভূমিকা, কখনো সন্ত্রাস ও অপরাধে জড়ানো, চরমপন্থায় ঝোঁকার প্রবণতার সূচনা হয়েছিল এদেশে।
তবে ইসলামি চরমপন্থা ও জঙ্গিবাদ সম্পর্কে আরো কথা বলতে হবে। এ নিয়ে বিস্তারিত পৃথক কলামে লেখা যাবে। এখানে কেবল এটুকু বলা যায় এই চরমপন্থার পিছনে তিনটি প্রধান কারণ আছে - ১. ইসলামি শাস্ত্রের বিভিন্ন পাঠে এর পক্ষে যেসব বক্তব্য আছে তার বর্তমান বিজ্ঞান-প্রযুক্তি উৎকর্ষের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সুষ্ঠু যুগোপযোগী ব্যাখ্যা সমেত পাঠ আলেমরা দিতে পারেন নি; ২. সৌদি আরবসহ উত্তর আফ্রিকা ও আরবভূখণ্ডের মুসলিম দেশগুলোর ইসলামের কট্টরপন্থী ভাষ্যকে আঁকড়ে রাখা, যা তারা মূলত জনগণের বিরুদ্ধে তাদের রাজতন্ত্রী/স্বৈরশাসনকে রক্ষা করার জন্যে কাজে লাগছে। এ কাজে তাদের রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্বের (এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ইজরায়েলের সাথেও) পারস্পরিক স্বার্থরক্ষার সম্পর্ক; ৩. তেল-গ্যাস সমৃদ্ধ মুসলিম দেশে পুঁজিবাদী পশ্চিমের স্বার্থের স্বরূপ তাদের ইরাক-লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপে ফাঁস হওয়ায় সচেতন সংবেদনশীল তরুণদের মনে সৃষ্ট তীব্র অভিঘাত ও প্রতিক্রিয়া।
এসব বিষয় বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। তবে আজকের আলোচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় শিক্ষাকে ঠিক পথে ঢেলে সাজানো জরুরি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবকটা বন্ধ জানালা খুলে দিতে হবে, কিশোর-তরুণদের জন্যে নিজেকে ছাপিয়ে ওঠার আকাক্সক্ষা পূরণের আনন্দ ও তৃপ্তির সুযোগ তৈরি করতে হবে, এবং ইসলামের সহিষ্ণু উদার শিক্ষায় বিজ্ঞান-প্রযুক্তিরও যে স্থান রয়েছে (আধুনিক পশ্চিমা বিজ্ঞানের গোড়ায় মুসলিম বিজ্ঞান সাধকদের অবদান স্মরণীয়) তা আলোচনায় আনা প্রয়োজন।
যে কোনো চরমপন্থা মোকাবিলা করা সম্ভব, তবে তার জন্যে ধৈর্য, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং ঔদার্য প্রয়োজন। অন্ধবিশ্বাস অন্য কোনো অন্ধবিশ্বাসের জগদ্দল ভাঙতে পারে না - এ কথাটা মানতে হবে।

***