আবুল মোমেন
জাতীয় সংসদের যে নির্বাচন আগামীকাল অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেটি নিয়ে বর্তমান সরকার—অর্থাত্ আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র দলের জোট—কেন একগুঁয়েমির বিপজ্জনক পথেই চলল, তা অনুদ্্ঘাটিত থেকে যাচ্ছে। দেশটি একা আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের নয়। যে ইস্যু মাথায় নিয়ে তাদের এই অবস্থান, সেটিও তাদের একার নয়। বরং ইস্যুটি এত দিনেও চাপা পড়তে না দেওয়ার মূল কারিগর তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, শিল্পী-সাহিত্যিক প্রমুখ। তাদের সঙ্গে ধীরে-ধীরে যোগ দিয়েছেন ছাত্র-তরুণরা।
গত শতকের আশির দশক থেকে এদের সব আন্দোলন-সংগ্রামের মূল অঙ্গীকার ছিল পরাজিত পাকিস্তানি ধারার ধর্মান্ধতার রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় নীতির বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রতি। এ আন্দোলনকে সরাসরি লক্ষ্যাভিমুখী করে তুলেছিল শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালালবিরোধী আন্দোলন। তিনি যখন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে গণতদন্ত কমিশন ও গণআদালত গঠন করলেন, তখন তাতে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেওয়ায় এটি সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও বৈধতা পেয়ে যায়। আর এর বিরোধিতা করে দেশের বরেণ্য ২৪ বুদ্ধিজীবীকে দেশদ্রোহের মামলায় জড়িয়ে বেগম জিয়া তার দলের বিপরীত অবস্থান পরিষ্কার করে তোলেন। তখনই দেশে আদর্শিক সংঘাতের রাজনীতি সূচিত হতে পারত, কিন্তু আওয়ামী লীগ সে ঝুঁকি তখন নেয়নি। সে কারণে তখন আওয়ামী লীগ দেশের মূলধারার বুদ্ধিজীবী ও বামদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছিল।
দুই দলের আদর্শিক দ্বন্দ্ব জিয়ার আমল থেকেই তৈরি হয়েছিল, তা এতকাল সরাসরি সংঘাতে গড়ায়নি। কারণ সামরিক শাসক এরশাদের আমল থেকে দুটি দলই মূলত ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টা চালিয়েছে। ক্ষমতা মূল বিবেচ্য বিষয় হওয়ায় আদর্শ এবং আদর্শের দ্বন্দ্ব ‘সমস্যা’ সৃষ্টি করেনি। ফলে আমরা লক্ষ করি, ক্ষমতার সংগ্রামে লিপ্ত থেকে কৌশলী আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময় সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন (যেমন রাষ্ট্রধর্ম বা বিসমিল্লাহর সংযোজন) নিয়ে নিশ্চুপ থেকে কিংবা জামায়াতের সঙ্গে মেলামেশা করে বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, বাম রাজনৈতিক দলের সমালোচনার পাত্র হয়েছিল। আমরা এ-ও লক্ষ করি, সমাজবাস্তবতা মাথায় রেখে ক্ষমতায় ফেরা ও থাকার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ দলটির বিরুদ্ধে বিরোধীদের পরিচালিত ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামবিরোধিতার মতো মূল সমালোচনাটি অকার্যকর করে দেওয়ার কাজ যত্ন নিয়েই করেছে। আবার যেহেতু দেশের দুই বড় দল ক্ষমতা নিয়েই মগ্ন ছিল ফলে তার জের ধরে সারা দেশে সুবিধাভোগী শ্রেণীর মধ্যে (বিশেষত পেশাজীবীদের মধ্যে) দুই বড় দলকে কেন্দ্র করে বিভাজন ছড়িয়ে পড়েছে। এতে আদর্শের অজুহাত থাকলেও স্বার্থের বিবেচনাই ছিল মুখ্য। ফলে ক্ষমতাকেন্দ্রিক দুই দলের প্রভাব ও প্রশ্রয়ে সমাজে একদিকে দুর্নীতি লালিত হয়েছে ও ছড়িয়েছে আর অন্যদিকে প্রশাসনের দক্ষতা ও কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে। এ নিয়ে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ হতাশ, সমালোচনামুখর। তা সত্ত্বেও কোনও রকম তৃতীয় সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তির উত্থান দেশে হয়নি। গণতান্ত্রিক আমলে এ দুটি দলের মধ্যেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে। বিরক্ত ও হতাশ হলেও মানুষের সামনে অন্য বিকল্প ছিল না, আজও নেই।
নাগরিকসমাজ ক্ষমতার দূষিত রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার কোনও পথ দেখাতে বা তৈরি করতে পারেনি। এটি এ সমাজেরই সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা। এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় বিবেচনায় নিতেই হয়। প্রথমত, নাগরিকদের সব স্তরেই বর্তমান রাজনীতির আদর্শহীনতা আর তা থেকে সৃষ্ট দুর্নীতি, দখলদারি, মাস্তানির আধিপত্য নিয়ে উদ্বেগ ও সমালোচনা আছে। দ্বিতীয়ত, নাগরিকসমাজ এবং ছাত্র-তরুণদের বড় অংশ দীর্ঘকাল ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে আমাদের দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনতে। তাদের সেই নিরন্তর প্রয়াসের কিছু ফল সমাজে তো দেখা দেবেই। এবং তা ঘটেছে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক হারে, প্রায় গণহারে, অবশেষে এর বিস্ফোরকতুল্য প্রকাশ ঘটেছিল গণজাগরণ মঞ্চের অভ্যুদয়ে।
গণতান্ত্রিক আমলেও আমাদের নির্বাচনকালীন রাজনীতিতে বড় দুই দলের তীব্র টানাপড়েন আমরা দেখেছি। সত্যিই তো এখন আদর্শের চেয়ে ক্ষমতাই বেশি কাঙ্ক্ষিত। তাতে সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি দখলদারি ও লুণ্ঠনের বেপরোয়া মত্ততায় মানুষ অতিষ্ঠ। আর যত অতিষ্ঠ ও বিরক্ত হয়েছি আমরা, ততই আদর্শের কথা, নীতির কথা বলে আফসোস করেছি। এটা পরিষ্কার যে, আজকের দিনে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে চাইছেন না। তার সব চেষ্টা নিয়োজিত ছিল বিএনপিকে কেবল ক্ষমতা থেকে দূরে নয়, ক্ষমতার দৌড় থেকেও বিরত রাখতে। তার ফাঁদে বিএনপি পা দিয়েছে। এমনটা ভাবার কারণ— যে-কোনও, এমনকী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েও এবার বিএনপিরই জেতার সম্ভাবনা ছিল বেশি। আমার ধারণা, বিএনপির মূল নেতৃত্ব—খালেদা জিয়া ও তারেক— আদর্শিক দ্বন্দ্বের ওপর জোর দিয়ে জামায়াতকে রক্ষার দায় গ্রহণ করেছে। কেননা এবারও যদি নিছক ক্ষমতাই দুই বড় দলের একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হত, তাহলে পারস্পরিক বিরোধকে এত চরম অবস্থায় তারা নিত না। কারণ ক্ষমতা বা ক্ষমতার প্রলোভন কাউকেই স্বার্থবুদ্ধির বাইরে নেয় না, অর্থাত্ দুই পক্ষের মধ্যে শেষ পর্যন্ত একটা আপসরফা হত। কিন্তু এখন উভয় পক্ষ ক্ষমতার গণ্ডি ডিঙিয়ে স্ব-স্ব নীতি-আদর্শের জায়গায় চলে এসেছে। জামায়াত নীতি-আদর্শভিত্তিক দল, বিএনপি তার বিপদের দিনে সমর্থন দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। আর আওয়ামী লীগ বুঝতে পারছে নীতি-আদর্শ ঠিক অর্থবিত্ত-ক্ষমতার মতো আন্দোলনের বিষয় নয়। এখন একবার যে কাজ শুরু করেছে, তা অসমাপ্ত রেখে তারই বিপরীত আদর্শের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে কেবল যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়াই ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে তা-ই নয়, দল ও সমমনাদের ওপর প্রত্যাঘাত আসবে মারাত্মক হিংস্রতা নিয়ে। শেখ হাসিনার পক্ষে পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ড ও এর ভয়াবহ পরিণতি এবং একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার ভয়াবহতা আর এর পেছনের শক্তির কথা ভুলে যাওয়া কি সম্ভব? দুই পক্ষই নিজ-নিজ আদর্শিক অবস্থান স্পষ্ট করে খুলে ধরার পর যে বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তার প্রতিবিধান হিসেবে জাতিসংঘ, পশ্চিমা কূটনীতিকরা বা আমাদের নাগরিকসমাজ যে সমাধানের পথ দেখাচ্ছেন তা কি সমস্যা-সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য পর্যাপ্ত হচ্ছে? আমার মনে হয়, তারা সংকটের গভীরতাই উপলব্ধি করতে পারছেন না। অথচ তারা যদি সংকটের মূলে যেতেন তাহলে অন্তত বুদ্ধিজীবী ও বামদলগুলো তাদের নিজেদের ভূমিকার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বর্তমান সংঘাতে স্বীয় অবস্থান ও পক্ষপাত পরিষ্কার করতেন। আর তখন বিএনপির পক্ষে জামায়াতকে ছেড়ে আসা সহজ হত। অন্তত বিএনপির ভেতরে যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আগ্রহী, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী বা আধুনিক চিন্তার অনুসারী, তারা দলের ভেতরে একটা চাপ তৈরি করতে পারতেন অথবা দল থেকে বেরিয়ে এসে ভূমিকা নেওয়ার তাগিদ বোধ করতেন।
ফলে এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগও সমালোচনা থেকে রেহাই পাবে না। সমাজে যারা সহজাতভাবে আদর্শিক সহযাত্রী, তাদের কীভাবে কাছে টানতে হবে—সেটা রাজনীতির আবশ্যিক কৌশলের একটি। কিন্তু অতি আত্মবিশ্বাস, দলীয় অহংকার এবং হয়তো দীর্ঘদিন একক ক্ষমতা ভোগের ফলে হাসিনা-নেতৃত্ব সংকট উত্তরণে জাতীয় জীবনে বৃহত্তর ঐক্যের ও সমঝোতার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। ফলে উভয় পক্ষের—নাগরিকসমাজ ও আওয়ামী লীগের—বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার অভাবে সহজে সমাধানযোগ্য সংকট অযথা গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে এবং অনিশ্চিত ক্ষয়ক্ষতির দিকে গড়াচ্ছে।
আমি বলব, এখনও সময় আছে, প্রধানমন্ত্রীর উচিত হবে সমমনা নাগরিকসমাজের সঙ্গে সংলাপে বসা, এই দুঃসময়ে জাতীয় প্রয়োজনে তাদের আদর্শিক বিশ্বাসের কার্যকর প্রতিফলন কামনা করা। বৃহত্তর জাতীয় জাগরণ ও ঐক্য ব্যতীত কোনও জাতি তার নীতি-আদর্শের বিরোধ ও সংঘাতে জয়ী হতে পারে না। এর অর্থ নির্বাচনের পরেও অনিশ্চয়তা ও সংঘাত বহাল থাকা।
আমার ধারণা, আগামীকালের নির্বাচনটি স্থগিত করার ও যে-কোনও মূল্যে সমঝোতা সৃষ্টির জন্য নাগরিকসমাজের দিক থেকে চাপ তৈরি হওয়ার কারণ এটিই। আর তাতে আন্তর্জাতিক মহলের চাপও বাড়ছে। মনে রাখতে হবে, জনগণ যদি সম্পৃক্ত না হয়, তাহলে ন্যায্য ইস্যুও সুবিচার পায় না। কারণ প্রতিপক্ষের সৃষ্ট সহিংসতা নিরপেক্ষ নাগরিকসমাজ বহন করতে রাজি হয় না। আর জনসম্পৃক্তি না ঘটলে পক্ষের মানুষও ভোগান্তি সহ্য করার উদ্দীপনা পায় না। সে রকম লক্ষণ সমাজে তীব্রভাবে ফুটে উঠছে, যা আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে দীর্ঘদিনের জন্য ভোগাতে পারে। ফলে ৫ তারিখের নির্বাচনের চেয়েও তাই শেখ হাসিনার জন্য তার সম ও কাছাকাছি মতাদর্শের মানুষদের এখনকার প্রত্যাশার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সে জন্য সময় নিয়ে তাদের সঙ্গে ঐক্যের সংলাপ করা ও জাতীয় জাগরণ ঘটানোই তার জন্য এ মুহূর্তের বড় কাজ ছিল। নয়তো এ নির্বাচন-পরবর্তী পরিণতি আওয়ামী লীগের (সরকারের) পক্ষে এককভাবে সামলে ওঠা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।