Sunday, March 26, 2017

একাত্তরের চেয়েও সময় এখন প্রতিকূল

আবুল মোমেন

১৯৭১ সনে যখন আমরা মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছি তখন দেশের এবং বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা কেমন ছিল?
এক কথায় বলা যায়, তা ছিল আমাদের অনুকূল। যদিও পাকিস্তান আমাদের ওপর ভয়াবহ অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল এবং আন্তর্জাতিকভাবে পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও প্রতিবেশী চীন আমাদের বিপক্ষে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করেছিল তবুও বলব, সামগ্রিকভাবে দেশের ও বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতা ছিল আমাদের অনুকূল।
একাত্তরের উদ্ভব হল সত্তরের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের পক্ষে এদেশের জনগণ বিপুলভাবে সমর্থন দেওয়ার ফলে। এ ছিল জনগণের ঐক্য ও জাগরণের ফল। এর সূচনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ছেষট্টিতে ছয়দফা কর্মসূচি দেওয়ার পর। এটি যদিও আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ছিল তবুও এর প্রতি দলমত-নির্বিশেষে জনগণের সমর্থন পাওয়া গিয়েছিল। মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নেতা মেনেছিল। তাঁর সাহসিকতা, অঙ্গীকার এবং জনগণের প্রতি ভালোবাসা দিনে দিনে মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়েছে এবং তারা বুঝেছে ইনিই হলেন বাঙালির মুক্তির কাণ্ডারি। গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেদিন ন্যাপ-সিপিবির সমর্থন। তাতে ছাত্রদের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে ওঠার পথ সুগম হয় এবং ছয়দফার পাশাপাশি ছাত্রদের এগারদফা বাঙালির স্বাধীনতার যাত্রাপথকে সুগম করে তোলে। ছাত্রদের মধ্যে এমন এক ঐক্য তৈরি হয় যার ফলে এক প্রান্তে চীনপন্থী ছাত্র ইউনিয়ন ও অন্যপ্রান্তে সরকারদলীয় জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের একটি অংশও এতে যুক্ত হয়েছিল। আদতে মুষ্টিমেয় ধর্মান্ধ ও চরম-পন্থী দল ব্যতীত গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল সেদিন।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তখনও দুই মেরু বিশ্বব্যবস্থাই চলমান, সোভিয়েত ইউনিয়ন তখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি। তখন মাত্রই সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সহযোগিতায় তৎকালীন তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম শেষ হয়ে দেশগুলো স্বাধীন হয়েছে। বিশ্বব্যাপী তরুণ, শ্রমজীবী, বুদ্ধিজীবী ও শিল্পসাহিত্যেকদের মধ্যে সমাজতন্ত্রের পক্ষে জোরালো স্রোত বইছে তখন। তখনকার তৃতীয় বিশ্বের দেশে দেশে রাজনীতিতে সমাজতন্ত্রের আদর্শ ও স্বপ্নই সবচেয়ে শক্তিশালী অনুষঙ্গ। যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে সামরিক জোট ন্যাটোর প্রতিদ্বন্দ্বী ওয়ারশ চুক্তি কার্যকর ভূমিকায় ছিল। তাছাড়া তথাকথিত প্রথম বিশ্বের রাজনৈতিক নেতৃত্বের তুলনায় তৃতীয় বিশ্বের  নেতৃবৃন্দের ক্যারিসমা ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল অনেক বেশি। এটি তৈরি হয়েছিল পঞ্চাশ ও ষাটের দশক জুড়ে মূলত নেহেরু, নক্রুমা, শোয়েকর্ন, নাসের, টিটোর মত নেতাদের কারণে। আর একাত্তরে খুবই বড় বিষয় ছিল বাংলাদেশকে ঘিরে যে প্রতিবেশী দেশ ভারত তার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নেহেরু-কন্যা ইন্দিরা গান্ধি।
১৯৭১ সনে বছর জুড়ে ইন্দিরা গান্ধির ভূমিকা একবার মনে করুন। জটিল পরিস্থিতিটি তিনি সে সময়ের বাস্তবতার  আলোকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সুকৌশলে সমাধানের পথে পরিচালনা করেছিলেন। ভারতের জোট নিরপেক্ষ দেশের ভাবমূর্তি ধরে রেখেই তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে নিরাপত্তা চুক্তি করে মার্কিন তৎপরতার সম্ভাবনা বন্ধ করেছিলেন এবং প্রয়োজনের সময় জাতিসঙ্ঘে সোভিয়েত সমর্থন আদায় করে নিয়েছিলেন। চীন ব্যতীত মোটামুটি সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের সমর্থন নিয়েই তিনি এগিয়েছেন।
এ কথাও স্মরণ করা প্রয়োজন তখন তাজউদ্দিন আহমেদ দলীয় ও দল-বহির্ভূত অভ্যন্তরীণ সকল কোন্দল, টানাপোড়েন দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেন। এক লক্ষ্য স্বাধীনতা থেকে বিচ্যুত হতে দেন নি এত মানুষের এত ত্যাগকে। তাছাড়া কিছু নেতার মধ্যে বিভ্রান্তি ও দূরভসন্ধি থাকলেও জনগণ কিন্তু অসাম্প্রদায়িক সমাজতান্ত্রিক একটি দেশের স্বপ্নেই উজ্জীবিত ছিল।
সমাজতন্ত্র, সেই আদর্শের ভিত্তিতে গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজব্যবস্থাই ছিল মানুষের লক্ষ্য। ঐক্যবদ্ধ জাগ্রত জনগণ যখন যুদ্ধে জড়িয়ে যায় তাদের জন্যে সেটি হল মুক্তির যুদ্ধ, ন্যায় যুদ্ধ, জনযুদ্ধ। একাত্তরে বাংলাদেশে আমরা তেমন এক যুদ্ধেই লিপ্ত ছিলাম। এরকম যুদ্ধে কেউ পরাজিত হয় না, বিজয়ীই হয়। আমাদের পরে ভিয়েতনামেও একইভাবে জনগণ বিজয়ী হয়েছিল, তারা তো সরাসরি পরাশক্তি মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এ বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল।
সেই সব দিনে সমাজতন্ত্রের আদর্শ স্বাধীনতাকামী মানুষকে এগিয়ে চলার, যুদ্ধ জয়ের মন্ত্র দিয়েছিল।
আজ কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আগেই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের পতন হয়েছে, এক মেরু বিশ্বের একক মোড়ালে পরিণত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটোর পরিসর ও শক্তি বৃদ্ধি পেলেও ভারসাম্য রক্ষার মত ওয়ারশ চুক্তি আর কার্যকর নেই। তারও চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় হল রাশিয়া ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের শাসনব্যবস্থা ও অর্থনীতির নানা দুর্বলতা, ব্যর্থতা, জনসমক্ষে যেভাবে প্রকাশ পেয়েছে তাতে দেশে দেশে এই স্বপ্ন প্রবল ঘা খেয়েছে। এর বিপরীতে পুঁজিবাদী বিশ্ব এ সময়ে মুক্তবাজার অর্থনীতি চাপিয়ে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক আগ্রাসন ও আধিপত্য বজায় রাখার সব কৌশল অবলম্বন করেছে। আবার তখন উন্নয়নশীল দেশের শক্তিশালী হাতিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে আদর্শবাদের অবক্ষয় ঘটেছে। এই শূন্যতা পূরণের বিকল্প হিসেবে সর্বত্র ধর্মাশ্রয়ী চিন্তার প্রসার ঘটেছে। এটাও বলতে হবে, এ সময়ে জাতিসঙ্ঘের সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য এবং একে ঘিরে আরো নানান সংস্থা ও  দেশীয় এনজিওদের ভূমিকায় বাংলাদেশসহ নানা দেশে সামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটেছে যা এসব সূচকে প্রতিফলিত হয়। কিন্তু রাজনীতির, অবক্ষয় ঠেকানো যায় নি।
এই রাজনীতি ক্ষমতা দখলে এবং তার মাধ্যমে সর্বত্র আধিপত্য ও প্রভাব সৃষ্টির প্রয়াস চালায়। গণতন্ত্র এতে সংকুচিত হয়। ধর্মান্ধতা যা জঙ্গিবাদ পর্যন্ত এগুতে পারে, সাম্প্রদায়িকতা যা দাঙ্গা পর্যন্ত গড়াতে পারে, ঘৃণা ও বিদ্বেষ যা সন্ত্রাসের জন্ম দেয়, মিথ্যা ও প্রতারণা যা ইতিহাসকে বিভ্রান্তির কুহকে ঢেকে দেয় ইত্যাদির প্রসার ঘটেছে এ সময়। এসবের পিছু নেয় জবাবদিহিতার অভাব ও অদক্ষতা, ক্ষমতা ও সিদ্ধান্তের কেন্দ্রীভবন। দুর্নীতি ও অপরাধের যুগলবন্দি ভূমিকা গণতন্ত্রের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। পৃথিবীতে আজ ট্রাম্পের উত্থান, মোদীর আশ্চর্যরকম জনপ্রিয়তা এবং সাফল্য, পুতিনের কায়েমি রাজত্বই হল বাস্তবতা। পৃথিবীতে আবার ধর্মান্ধতা ও জাতিগত বৈরিতা প্রবল হয়ে উঠেছে, অন্যায় অমানবিক যুদ্ধ চলছেই এবং অকারণ মৃত্যুর মিছিল থামছে না।
বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। কিন্তু একথা ভুললে চলবে না, মৌলিক চাহিদার একমাত্র অবস্তুগত এবং শেষ বিচারে মানুষের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শিক্ষায় সংখ্যাগত উন্নয়নকে মানের বেহাল অবস্থা বিদ্রƒপ করছে। শিক্ষার মান মূলধারার সর্বস্তরে এমন নেমেছে যে এ সত্য অস্বীকার করার চেষ্টা চললে আমাদের ভবিষ্যতও সংকটাপন্ন হবে। একালে ধর্মাচার বাড়লেও নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সংকট আরো বেড়েছে কারণ মুক্ত জ্ঞানচর্চা ব্যতীত ধর্মান্ধতা  ঠেকানো যায় না, গণতন্ত্রের বিকাশও রুদ্ধ হয়ে যায়, সমাজমানসে যে স্থবিরতা নামে তা নানা বিকার  ও অপরাধকেই প্রশ্রয় দেয়।
আজ বিশ্বের মূলধারা ভোগবাদিতার জয়গান গাইছে, ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যেও বাণিজ্য ও লাভের চিন্তাই প্রবল, সেবা ও দানও আজ বিনিয়োগের খাত। মানুষের জন্ম  থেকে মৃত্যু - সবটা জুড়ে ব্যবসা ও মুনাফার চিন্তা জড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষ কখনো ক্রেতা কখনো বিক্রেতা, কখনো নিজেই পণ্য কখনো ভোক্তা। এর কোনোটিই মানবের মূল সত্তা নয়। তার মূল্য তো নিহিত আছে মনুষ্যত্বের মধ্যে যা অনেক নীতি ও মূল্যবোধের সমন্বয়ে গঠিত হয়।
আজ সে জায়গায় আপস চলছে। একাত্তর কারো কোনো বিনিয়োগ ছিল না, এ থেকে ব্যক্তিগত মুনাফার ভাবনা কারো মধ্যে ছিল না, কেউ একা ছিল না। আমরা ছিলাম সকলে, ব্যক্তি ও তার চিন্তার জগৎ আলাদা হলেও, সামষ্টিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মহত্ত্ব সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন।
বিশ্ব জুড়ে মানুষ যেমন আদর্শ হারিয়েছে তেমনি তার হারিয়েছে মহত্ত্ব। তাই মানুষের জীবন স্থূল ভোগবিলাস ও আচার ধর্মের সহজ লক্ষ্যে বাঁধা পড়ছে।
কথায় কথায় বলা হয়, একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার। মনে রাখতে হবে একাত্তরের মূল হাতিয়ার কিন্তু অস্ত্র নয়, আগ্নেয়াস্ত্র গজরাতে থাকলে খুনোখুনি ও প্রতিহিংসার মহড়াই চলবে, সমাজ রক্তাক্ত হবে, অপরাধ ও দুর্নীতি হাত ধরাধরি করে চলবে।
না, একাত্তরের মূল হাতিয়ার ছিল সেদিনের রাজনীতি - যাতে নীতি ছিল, আদর্শ ছিল, যা মানুষের মুক্তির কথা ভেবেছিল। হ্যাঁ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি প্রধান একটি বিষয়, কিন্তু এটি যেন খোদ মানুষটির বিনিময়ে না আসে।
অথচ আজ সারা বিশ্বে মানুষের পরাজয় ঘটছে - সুউচ্চ দালান আর সুদৃশ্য স্থাপনা সে বারতাকে ঢাকতে পারবে না। যে বিশ্ব ট্রাম্প, পুতিন, মোদী, এরদেয়ানদের সামনে তুলে আনে, দীর্ঘদিন সহ্য করে যায় তার যে নৈতিক শক্তির আকাল চলছে সেটা বুঝতে তো অসুবিধা হয় না।

স্বাধীনতার ছেচল্লিশ বছর পরেও যদি ধর্মান্ধতা ও পশ্চাৎপদ চিন্তার সাথে আপস চলে তাহলে আমাদের রাজনীতি কোন পথে চলেছে সে প্রশ্ন উঠবেই। না, আজ একাত্তরের তুলনায় এক প্রতিকূল বিশ্ব ও প্রতিকূল সময়ে আমরা বাস করছি।

Saturday, March 4, 2017

স্বাধীন কণ্ঠস্বরগুলো একত্রিত হওয়া দরকার

আবুল মোমেন

ফেব্রুয়ারি মাস গিয়ে মার্চ মাস শুরু হয়েছে। এই দুই মাস আমরা জাতীয় জীবনের অনেক অর্জনের ইতিহাস নিয়ে গর্ব করতে পারি। তবে এর মূল কথা একটি - বাঙালির অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনায় জাগরণ ও ঐক্য গঠন এবং পরিশেষে এই ধারার বিজয় অর্জন।
কিন্তু ২০১৭ সনে এসে দেখছি এ তো ইতিহাস! আমাদের বর্তমান সাম্প্রদায়িকতায় আচ্ছন্ন, গণতান্ত্রিক চেতনাও ক্ষয়িষ্ণু, নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এ কথা ঠিক বাংলাদেশের রাজনীতির পশ্চাদাপসরণ শুরু হয়েছে দুই সামরিক শাসকের আমলে। ১৯৯১ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করতে শুরু করে। কিন্তু সেবারে তারা পরাজিত হয়েছিল মূলত অতিআত্মবিশ্বাস ও প্রতিপক্ষকে খাটো করে দেখার কারণে। এর পর থেকে ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সহাবস্থান যে সম্ভব তা প্রমাণ করাই ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের  একটি মিশন। তাতে সফল হয়েই তারা ২০০৮ এর সুষ্ঠু নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জন করেছিল। এটুকু বাস্তবসম্মত এবং যথেষ্ট বলে বিবেচিত হতে পারত।
কিন্তু ২০১৮ এর নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ কেন হেফাজতে ইসলামের মত একটি সংগঠনের সাথে প্রকাশ্যে আপস করছে? এতকাল ইসলামি সমাজের মধ্যেও হেফাজতে ইসলামের গ্রহণযোগ্যতা বিশেষ ছিল না, এরা ছিল কওমি মাদ্রাসার আপন বলয়ে সীমাবদ্ধ গোষ্ঠী। মওলানা ফরিদউদ্দিন মাসুদের মত উদারপন্থী জ্ঞানী আলেমসমাজ কখনো তাদের কট্টরপন্থাকে গ্রহণ করেন নি। কিন্তু কোন পর্যায়ের আপস হলে মূলধারার পাঠ্যবইয়ে তাদেরই প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সংস্কার করা হয়, যার সবটাই সাম্প্রদায়িক কিংবা কট্টরপন্থার বিবেচনা থেকেই  করা?
সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে প্রকারান্তরে জামায়াতে ইসলামিকে কোণঠাসা করলেন। বাস্তবতার বিচারে হয়ত এর মূূল্য হিসেবে মুসলিম ভোটারদের এমন বারতা দেওয়া প্রয়োজন ছিল যে তাঁরা যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিয়েছেন, তবে ইসলামপন্থীদের নয়। কিন্তু সেটা জানানোর তরিকা কি এই, যে সরকার সাম্প্রদায়িকতা ও কট্টরপন্থাকে প্রশ্রয় দেবেন? ইসলাম কি কট্টর সাম্প্রদায়িক ধর্ম, যেমনটা হেফাজতের নেতারা ভাবেন? ইসলামের উদার মানবিক রূপটি হারিয়ে গেলে বাঙালির ঐতিহ্য এবং ইসলাম ধর্ম দুটিই নানা বিভ্রান্তির শিকার হবে।
উন্নয়ন এখন দৃশ্যগোচর, তার জন্যে সরকারকে কৃতিত্বও দেওয়া যাবে, কিন্তু শিক্ষার মান উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে গেছে, রাজনৈতিক চেতনার ধার ধারছে না কেউ। ফলে সমাজে বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠেছে। মানুষ বহু ধারায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে না শুধু, তার ভোক্ত সত্তাটাই সব ছাপিয়ে উঠছে। ফলে সমাজে দ্বন্দ্বের সম্পর্ক বাড়ছে, সংঘাত, অপরাধ, দুর্নীতি বেড়েই চলেছে। গভীর উদ্বেগ ও কষ্ট থেকেই বলতে হবে যে চকমিলানো উন্নয়ন ও ঝকঝকে আলোর মধ্যেও মানুষের চেতনার জগতে অন্ধকারের ছায়া বেড়ে চলেছে। এ যেন মানুষের প্রতি তার নিয়তির এক নিষ্ঠুর পরিহাস। সে বোধ অবশ্য কাজ করছে না, এ নিয়ে রাজনীতিবিদরা একদমই ভাবছেন না, বুদ্ধিজীবীরা অসহায় দর্শকে পরিণত হয়েছেন, মানুষের শুভবোধ অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
মানবসমাজ ভারসাম্যের ওপরই চলে, তাই কোনো নেশাই তার জন্যে কল্যাণকর নয়, না, উন্নয়নের নেশাও নয়। কারণ তাতে ভারসাম্যহীনতা অর্থাৎ বৈষম্য বাড়ার আশংকা তৈরি হয়। শুধু তা নয়, তখন অকারণেই মানুষের ভোগের আকাঙ্ক্ষা বাড়তে থাকে, সে তৃপ্তি বা সন্তুষ্টির সংকটে ভুগতে থাকে। তখন আবার ধর্মব্যবসায়ী, এমনকি ধ্যানব্যবসায়ী কাজে নেমে পড়েন, এবং তাদের দেখেদেখি আরো নানা রকম ব্যবসায়িক ধান্ধা বাড়তে থাকে। তাতে ভারসাম্যের আরো গোলমাল দেখা দেয়। এসব আলামত আমরা সমাজে প্রকট রূপেই দেখতে পাচ্ছি।
রাজনীতি যদি কেবলমাত্র ক্ষমতায় গিয়ে জনগণকে কিছু সেবা দিতে পারে, ক্ষমতার বাইরে থেকে জনগণের পাশে থাকতে বা জনগণকে নিয়ে অন্যায় বা ভ্রান্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অক্ষম হয় তাহলে এ কারণে রাজনীতি ঘিরে অনুদারতা ও অমানবিক বিকারের জন্ম ঠেকানো মুশকিল। বিএনপি ক্ষমতার বাইরে গিয়ে এই ফাঁদে পড়েছে আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে ভবিষ্যতের জন্যে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে গিয়ে একই ফাঁদে পা দিচ্ছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে আজ ক্ষমতা ও এর সুবিধার বাইরে আওয়ামী লীগেরও কোনো রাজনীতি নেই। আওয়ামী লীগকে তো শিক্ষার হেফাজতিকরণের পক্ষেই সাফাই গাইতে হবে, সুন্দরবন ও রামপালের সহাবস্থানের পক্ষেই বলতে হবে। বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলির দূষণ নিয়েও বলতে পারবে না। কারণ কোন বিষয় কীভাবে সরকারকে বিব্রত করবে তার ঠিক নেই। অতএব রাজনৈতিক কণ্ঠটি কেবল বিএনপির বিরুদ্ধেই বাজানো যাবে - সেটাই ইতিহাসের বিষয়। এভাবে আওয়ামী লীগও তামাদি রাজনীতির খপ্পরে পড়ে যাচ্ছে না তো। যদিও এতে খুব ক্ষতি হবে দেশের। কারণ আওয়ামী লীগের চেয়ে রাজনৈতিক চিন্তাচেতনায় এগিয়ে থাকা দলগুলোও তো ছত্রভঙ্গ, দিশাহীন, দুর্বল আজ। তবে বুদ্ধিমানের কাজ হল যত ক্ষীণ হোক, সঠিক সৎ বক্তব্যে কান পাতা, এ থেকেও শেখারটুকু নেওয়া যায়। অবশ্য ক্ষমতার বদহজম হলে এই রুচিও নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আমরা যেন পরিস্থিতির নাজুক ও বিপদের দিকটি দেখতে ভুল না করি। কৃষি উৎপাদনে চমকপ্রদ অর্জন, সড়ক সেতু-স্থাপনার উন্নয়নের নিচে যেন এ সত্য ঢাকা না পড়ে যে এদেশে তার শাশ্বত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের বিপরীতে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে, সাম্প্রদায়িকতার থাবা শক্তিশালী হয়েছে এবং বিএনপি জামায়াতকে এবং আওয়ামী লীগ হেফাজতকে লালন করছে। সরকার বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন আপডেট করতে গিয়ে ১৯২৯ এর ঔপনিবেশিক আইনের চেয়ে একধাপ পিছিয়ে গেল। বাস্তবতা হল, আওয়ামীলীগ দৃশ্যপট থেকে সরে গেলে জামায়াত-হেফাজত কট্টরপন্থা স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করবে ও ধর্মের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের পশ্চাদযাত্রা সম্পন্ন করবে।
এটাকে রূপকথাসুলভ বাস্তবতাও বলা যাবে না - সমাজকে খুবলে রক্তাক্ত করার মত ধ্বংসের শক্তির পদধ্বনি শোনা গেলেও উদ্ধারের রাজপুত্র ও তার সঙ্গিসাথী মন্ত্রিপুত্র, সওদাগরপুত্র-কোটালিপুত্ররা কৈ? তাদের দেখা নেই।
দ্রুত বিকল্প স্বাধীন কণ্ঠস্বরগুলো একত্রিত হওয়া দরকার। নিদেনপক্ষে স্বাধীন অবস্থান ধরে রেখে অনবরত বলে যাওয়া দরকার, যেমন পশ্চিমে চমস্কি একক লড়াই চােিয় যাচ্ছেন। এর মূল্য আছে, কারণ শেষ পর্যন্ত মানুষ, বিশেষত সাধারণ মানুষ ও তরুণসমাজ, সত্যকথা ভালোবাসে, সত্যের সৌন্দর্যের কদর করতে জানে। তারা তাদের মত করে কাজ করবে।
এই শক্তি - যা জায়মান বলে ভাবি - ক্ষমতায় যাবে না, কিন্তু ক্ষমতাসীনদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চাপ দেওয়ার জন্যে আওয়ামী লীগ এখনো বিএনপির চেয়ে শ্রেয়তর বিকল্প। তবে কি বিএনপিকেও এই বারতা দিতে হবে যে দেশে একটি মধ্য বা মধ্যডানপন্থী আধুনিক গণতান্ত্রিক দলের চাহিদা রয়েছে, তারা জামায়াতকে ছেড়ে সে জায়গা নিতে পারে। ক্ষমতার জন্যে আওয়ামী লীগ কি তার মধ্যবাম অবস্থা ছেড়ে যাবে? আওয়ামী লীগের শক্তি ছিল তার সংগঠন, সংগঠন সচল থাকে রাজনীতির জোরে, ক্ষমতা বা বিত্তের জোরে নয়। নিচের থেকে রাজনৈতিক চাপ তৈরি হলে দলের জন্যে ভালো হবে, কারণ স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে ক্ষুদ্র দল ও ব্যক্তির ভূমিকা পালনের সুযোগ তৈরি হয় এবং তার চাপে মূল রাজনীতি ও সংগঠন ক্রমে জনমুখী হওয়ার প্রণোদনাও পায়। টেণ্ডর ও দখল নিয়ে কোন্দলে জড়িত জর্জরিত দল গা-ঝাড়া দিয়ে সক্রিয় হতে পারবে কি? কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কি তেমন আলামতকে বিদ্রোহ ভেবে অংকুরেই থামিয়ে দেবে?
এসবও জরুরিভিত্তিতে ভাবার বিষয়