Monday, February 22, 2016

একুশের বিকাশ কোন্ পথে ঘটছে?

আবুল মোমেন

১.
একুশে উদযাপনের ধরণ ও তাৎপর্য উভয়ই যেন বদলে গেছে। গোড়ায় লক্ষ্যটা কেন্দ্রীভূত ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অধিকার আদায়ে। সেই সংগ্রামের চেতনার উৎস ছিল এই দিনটি যা তখনও শহীদ দিবস হিসেবেই অভিহিত হত। কিছুদিনের মধ্যে ভাষা থেকে সাহিত্য এবং সাহিত্য থেকে সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে পড়ল এ চেতনার প্রভাব। কারণ সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের প্রশ্ন জরুরি হয়ে দেখা দিলে একুশেই হল সেই চেতনার প্রতীক। ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির সম্মিলনে জনমনে জোরদার হল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা। বলাই বাহুল্য, এই চেতনারও অনুপ্রেরণা এলো একুশে ফেব্রয়ারি থেকেই। ফলে কালক্রমে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সকল উদ্দীপনার উৎস হল একুশ যার প্রতীক ছিল শহীদ মিনার। এভাবে একুশে ফেব্রয়ারি হয়ে উঠল আমাদের জাতীয় দিবস এবং জাতীয় জীবনে তাৎপর্যবাহী দিন আর শহীদ মিনার তারই প্রতীক।
গোড়া থেকেই একুশে পালনের মূল অনুষঙ্গ ছিল দেশপ্রেম ও উদ্দীপনার গান আর জাতীয় চেতনা লালন ও বিকাশের উপযোগী সাহিত্য। এক সময় একুশের স্মরণিকা প্রকাশ আর প্রভাতফেরী ও বৈকালিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন ছিল আবশ্যিক কাজ। জাতির মননের প্রতীক বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা একুশের চেতনারই সম্প্রসারণ। এ প্রতিষ্ঠান তাই বরাবর দিনটি সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করে এসেছে। স্বাধীনতার পরে এর পরিসর ও ব্যাপ্তি বেড়েছে। ক্রমে একুশের সাথে বইমেলা এবং বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশনার যোগ ঘটে গেল। এখন একুশের মাস জুড়ে বাংলা একাডেমির বইমেলা, সেমিনার আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রভাব দেশব্যাপী ছড়িয়ে গেছে। এটিই জাতীয়ভাবে একুশের মুখ্য অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছে। এর প্রভাব সারা দেশে পড়েছে, প্রায় সব জেলাশহরে আজ ছোট আঙ্গিকে হলেও বইমেলা আয়োজিত হচ্ছে, সর্বত্র কিছু কিছু প্রকাশনাও হয়ে চলেছে।
আজকে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, একুশে ফেব্রয়ারিকে কেন্দ্র করে দেশে প্রকাশনা শিল্পের এতটাই বিস্তার ঘটেছে যে একে প্রকাশনা শিল্পের বিপ্লবও বলা যাবে। প্রতিদিন বাংলা একাডেমির বই মেলায় কত যে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়, আজকাল সারা মাসে অন্তত হাজার পাঁচেক নতুন বই প্রকাশিত হয়। দেশে প্রকাশনার সংখ্যাও বেড়েছে, কেবল বাংলা একাডেমির মেলাতেই পাঁচ শতাধিক সংস্থা তাদের বই নিয়ে অংশ নিচ্ছে, এর মধ্যে শখানেকের ব্যবসাও খারাপ নয়। প্রকাশকবৃন্দ প্রায় সারা বছরই এই মেলাকে কেন্দ্র করেই তাঁদের প্রকাশনার পরিকল্পনা করেন। আমাদের প্রকাশনা-শিল্প মূলত একুশে-কেন্দ্রিক।
বাংলা একাডেমির পাশাপাশি শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, জাতীয় ও আঞ্চলিক নানা সংগঠন ব্যাপক আয়োজনে একুশে উদযাপন করে থাকে। বিভিন্ন  নগরে কর্পোরেশন কিংবা নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী সম্প্রদায়গুলো একুশে উদযাপনে সোৎসাহে অংশ নিচ্ছে, নিজেদের স্বতন্ত্র আয়োজনও করছে। বর্তমান সরকারের আমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ দিন আর নিছক ছুটি থাকে না, তারাও নানা অনুষ্ঠান করে শহীদ মিনারে ফুল দেয়। এমনকি সাহেবিয়ানায় অভ্যস্ত ক্লাবগুলো কিংবা ইংরেজিমাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সাড়ম্বরে একুশে উদযাপনে মেতে উঠছে!
২.
ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণে দেশব্যাপী নানা আয়োজনে উদযাপনের মাধ্যমে একুশে আজ যেন জাতীয় উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে। একুশেকে কেন্দ্র করে দেশের প্রকাশনা শিল্পের বিস্তার যেমন ঘটেছে তেমনি এর ব্যবসায়িক দিকটি মূলত একুশের  ওপর নির্ভরশীল। একুশে এখন মূলত উৎসব এবং বাণিজ্যের ভিত্তিতেই মূল্যায়িত হচ্ছে। প্রকাশকরা বলছেন এ বছর ব্যবসায় ভালো হয়েছে কিংবা বলেন ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দিয়েছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনও বাদ নেই, এখানেও ব্যবসায়ের প্রভাব বাড়ছে। এছাড়া বুটিক, তৈরি পোশাক, খাবারদাবারসহ আনুষঙ্গিক আরও ব্যবসায়ের আওতা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে।
নিশ্চিন্তে বলা যায়, যেহেতু বাণিজ্য প্রসারিত হচ্ছে, লক্ষ্মীর স্পর্শে ধন্য হয়েছে একুশে তাই এর বাড়বাড়ন্ত অব্যাহত থাকবে। আশার কথা, এই বাণিজ্যের মূল ভিত্তি এখনও সারস্বতসাধনা। লক্ষ্মী-সরস্বতীর যুগল সম্মিলনে একুশের অগ্রযাত্রা ভালোভাবে চলবে এ আশাবাদকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
হয়ত প্রশ্ন উঠতে পারে লক্ষ্মী না সরস্বতী কার প্রভাব বাড়ছে বেশি? তাছাড়া একুশে কেবল সরস্বতীর সাধনার বিষয়ও ছিল না, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংগ্রামের সাথে সাথে এতে সংগ্রাম ও সৃষ্টির ব্যাপারটা হয়ে উঠেছিল মুখ্য। 
৩.
একুশে উদযাপনের ব্যাপ্তি এখন বিশ্বময়, অন্তত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে দিনটির স্বীকৃতি আসার পর থেকে। কিন্তু এ দেশে মাতৃভাষা বাংলা তো আজ কাক্সিক্ষত আদৃত ভাষা নয়। সবাই তো ছুটছেন ইংরেজির পেছনে, ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের রমরমা বাড়ছে, ব্যবসাসফল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাচর্চার বাহন ইংরেজি, সেদিকেই ঝুঁকছে বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী। কম্প্যুটার আর মোবাইলেও ভাঙাচোরা ক্ষতবিক্ষত ইংরেজির চর্চা হচ্ছে। একসময় রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল এ জাতি, আজ তাদের উত্তরসুরীরা স্বেচ্ছায় সাগ্রহে বাংলা লিখছে সেভাবে কিংবা তারই সাঁটভাষ্যে আলাপচারিতা চালাচ্ছে। রেস্তোঁরা, ক্যাম্পাস, মিলনায়তন, বাজার, পথঘাটে কান পাতলে তরুণ ও কিশোর, এমনকি শিশুদের কণ্ঠে ইংরেজি অথবা বাংলিশ কথোকথন কানে আসবে। যেটুকু বাংলা বলছে তাও আঞ্চলিক কিংবা আঞ্চলিকের খিচুড়ি ভাষা। খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের মধ্যেই রয়েছে একুশের মেলায় প্রকাশিত বইয়ের গর্বিত লেখক, একুশে উপলক্ষে পুরস্কৃত কবি, টকশো মাতানো কথাকার, সেমিনারের চিন্তাশীল বক্তার সন্তান বা পৌত্র-দৌহিত্র, পৌত্রী-দোহিত্রীরাই যারা ইংরেজি-বাংলিশে বাৎচিৎ করে কান ঝালাপালা  করছে।
যদি প্রকাশিত বইগুলো ভালোভাবে মনোযোগ দিয়ে পড়ি বা পড়ার চেষ্টা করি তাহলে প্রথম ঘা খেতে হবে অধিকাংশ লেখকের ভাষাগত দুর্বলতায়, তারপর অতৃপ্তির কারণ হবে লেখায় চিন্তার মৌলিকত্বের অভাব। মাতৃভাষার ব্যবহারে এক ধরনের অরাজক অবস্থা চলছে, অপরিণত বুদ্ধির ছাপ যত্রতত্র। 
এদেশে সাহিত্যচর্চার দিকে ঝোঁক বেড়েছে, বই প্রকাশের হিড়িক পড়েছে, কবিতা ও উপন্যাসের কমতি নেই। নব্য লেখকদের অনেকেরই প্রথম লেখাই বই আকারে বেরুচ্ছে, কোনো কোনো নব্য লেখক একসাথে এক ডজন বইও প্রকাশ করছেন। একুশে উপলক্ষে যত বই বেরুচ্ছে তার অর্ধেকের বেশি লেখক নিজের টাকায় বের করেন। এতে নৈরাজ্যের নদে কূলপ্লাবী জোয়ার বইছে। দুটি কারণে এই নৈরাজ্য ঘটে চলেছে - দেশে লেখক বাড়লেও প্রকৃত সম্পাদক ও সমালোচক তৈরি হচ্ছে না। কিংবা লেখকদের দাপটে সম্পাদক ও সমালোচকরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এঁরা তো হলেন ভাষা ও সাহিত্যের অভিভাবক ও পাহারাদার। এ সমাজ সবক্ষেত্রেই মুক্তকচ্ছ থাকতে চাইছে, নব্যধনী যেমন আইন-আদালতের তোয়াক্কা করে না, সবই নিজের কব্জায় রাখতে চায়, তেমনি নব্য লেখককূলও প্রশংসা-স্বীকৃতির দায় নিজেদেরই আওতায় রাখতে চান। এ প্রভাব ক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার-স্বীকৃতি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশে আজ বাংলা ভাষা  ও সাহিত্যের খাঁটি অভিভাবক এবং যোগ্য পাহারাদার নেই। ভাষার প্রতি সুবিচার করতে পারছি না আমরা, ভাষা চর্চায় কোনো নীতি মানছি না। যখন আমাদের পূর্বসুরীরা ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তখন কেবল বাংলার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির অভাব ছিল, কিন্তু কি শিক্ষা কি গণমাধ্যম কি সমাজজীবন সবখানে বাংলারই রাজ্যপাট ছিল রমরমা। আজ সাংবিধানিক স্বীকৃতি আছে বাংলার, এমনকি একুশের কপালে বৈশ্বিকে স্বীকৃতিও জুটেছে, কিন্তু এ ভাষা শিক্ষাসহ সমাজ-জীবনের সবখানে দুয়োরানি হয়ে আছে।
ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়ে ওঠায় একুশে উদযাপন নিয়ে আর ভয় নেই, কোনো শক্তিই এই টাকার টঙকারের প্রতি বধির হবে না। কিন্তু সরস্বতীর কী হবে? সারস্বতসাধনাই যদি সংকটে থাকে তাহলে একুশের আর থাকে কি?

###

Wednesday, February 10, 2016

এবার চাই সাংস্কৃতিক জাগরণ

আবুল মোমেন
বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে এমন কতকগুলো গ্রন্থি আছে যা মোচন করা কঠিন, এবং মোচন ব্যতীত এগুনোও কঠিন। অবিভক্ত ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থান-পর্বে বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তার একদিকে ছিল ভারতভিত্তিক ভাবনা অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক স্বাতন্ত্র্যের চেতনা। ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে তখনকার মত ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার রাজনীতি জয়ী হয়েছিল। আবার যখন পাকিস্তানি অপশাসন ও উৎপীড়নে অতিষ্ঠ পূর্ব বাংলার শিক্ষিত জনগোষ্ঠী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছিল সেই জাগরণকে তখনকার বৈশ্বিক ও জাতীয় পরিমণ্ডলের সুস্থ ও শক্তিশালী বামপ্রগতিশীল চিন্তার প্রভাবে অসাম্প্রদায়িক পথে পরিচালিত করা গিয়েছিল। জাতীয়তাবাদী জাগরণ অনেকটাই ভাবাবেগের ওপর নির্ভর করে রীতিমত বিপ্লবী পরিণতি ঘটাতে সক্ষম, কিন্তু রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনা একটি দীর্ঘস্থায়ী বাস্তবসম্মত কার্যক্রম। এর নীতি-আদর্শিক ভিত্তিগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট ও দৃঢ় করে নিতে হয়। আমার ধারণা ভাবাবেগের ওপর নির্ভর করে আমরা স্বাধীনতার মত অনেক বড় অর্জন সাধনে সক্ষম হয়েছি বটে, কিন্তু বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার আদর্শিক নীতিগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিতে পারি নি।
পূর্ববঙ্গবাসীর জন্যে পাকিস্তান থেকে পৃথক হওয়া অবধারিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তারা কী ধরনের রাষ্ট্র গঠন করবে সে বিষয়ে ভাসা ভাসা কথা কিংবা আপ্তবাক্য উচ্চারণের বেশি যথার্থ যুক্তি বিচার দিয়ে বিশ্লেষণ করে বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ ঘটে নি। এ অবস্থায় অসাম্প্রদায়িক অবস্থান সম্পর্কে সহজেই ভারতপন্থী বা হিন্দুঘেঁষা রাজনীতির অপবাদ দেওয়া সম্ভব হয়েছে, আবার দেশের সিংহভাগ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে একেবারে কট্টর ইসলামপন্থী পশ্চাৎপদ অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তাও মাথাচাড়া দিচ্ছে। একটি আধুনিক বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সাফল্যের জন্যে জনগণের মনে সঠিক লক্ষ্যাদর্শের বীজ বপন করা জরুরি।
একটা বিষয় সহজেই লক্ষ্য করা যায়, ভাষা আন্দোলন থেকে ধাপে ধাপে জাতীয় জাগরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যেই। এই নীতি-আদর্শের সাথে যুক্ত বিভিন্ন উপাদানকে ভালোভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয় নি বলে এর একটা দুর্বলতা থেকে গেছে বলে মনে হয়। কিন্তু এ থেকেও আমরা বাংলাদেশের কেমন লক্ষ্যাদর্শ হওয়া উচিত তার একটা উত্তর খুঁজতে পারি। যদি আমরা এ অঞ্চলের ইতিহাসের দিকে নজর দিই তাহলে দেখব বাঙালি কোনো কালে শাস্ত্রপন্থী কট্টর জনগোষ্ঠী ছিল না, একটা কৃষিজীবী সমাজ যেভাবে মাটি-জল ও প্রকৃতির সাথে মিশে মানুষে মানুষে পারস্পরিক সহযোগিতার বন্ধনে থেকে সফল হয় এখানে পরিবেশ তেমনটাই ছিল। এখানকার প্রকৃতি পরিবর্তমান হলেও মানুষের জন্যে অত্যন্ত উদার ও সম্পন্ন ছিল। এ মানুষ প্রকৃতিলগ্ন, ভাববাদী এবং মানবিক। বাঙালির একান্ত অধ্যাত্ম সাধনা - যেমন হিন্দুর গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন, মুসলিমদের বিভিন্ন ধারার সুফি সাধনা, বৌদ্ধদের তান্ত্রিক ধারাসমূহ, এবং এ অঞ্চলের নিজস্ব আউলবাউল সহজিয়া সাধনা - বিচার করলে তাতেও পাওয়া যাবে এর প্রকৃতিলগ্নতা , ভাববাদ ও মানবিক আবেদন ইত্যাদি। ষোড়শ শতকের বৈষ্ণব কবির সবার উপরে মানুষ সত্য এ ঘোষণার ঔদার্য দেখে যেমন তেমনি সপ্তদশ শতকের মুসলিম কবির মাতৃভাষা-প্রেমের আগুন দেখেও চমকে যেতে হয়। এই ইহজাগতিক মানবিক উদার ঐতিহ্যের ধারা থেকেই বাংলাদেশে একটি অসম্প্রদায়িকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রণোদনা পাওয়া সম্ভব। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্তর্নিহিত প্রবণতা এই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে মানবিক উদার হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল।
সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ছাড়াও আমরা যদি পাকিস্তান আমলের রাজনৈতিক গতিধারা লক্ষ্য করি তাহলেও দেখব বায়ান্ন, চুয়ান্ন, বাষট্টি (ছাত্র আন্দোলন), ছেষট্টি, ঊনসত্তর (গণ-অভ্যূত্থান), সত্তর (নির্বাচন) ও সবশেষে একাত্তরের রাজনৈতিক প্রেরণা ছিল এই একইভাবে একটি অসাম্প্রদায়িক উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সেভাবেই স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে বাহাত্তরের সংবিধান রচিত হয়েছিল।
বায়ান্ন থেকে উপরিকাঠামোয় বা বহিরঙ্গে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জাগরণের ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটেছে যে ইতিহাসে জমে ওঠা বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক ইস্যুর গ্রন্থিমোচন করার অবকাশ যেন পাওয়া যায়নি। কিংবা সে রকম প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা আমাদের নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবীসমাজ দেখাতে পারে নি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে তার একেবারে ওপরে আছে ক্ষমতা ও বিত্তের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এটা লুটেরা ধনী ও সাধারণ লুটেরা শ্রেণীর দ্বারা রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের প্রক্রিয়া। কিন্তু তা প্রশ্রয় পেয়েছে যখন স্বাধীন বাংলাদেশকে তার অর্জিত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক এবং উদার মানবিকতার ধারা থেকে সরিয়ে এনে ধর্মভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদে রূপান্তরের চেষ্টা শুরু হয় তখন থেকে। মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে ব্যর্থ করার এই চেষ্টা যে বিফল হয় নি তারও দুটি কারণ আছে। একদিকে রয়েছে স্বাধীনতার অর্জনকে যথার্থভাবে উপলব্ধি ও ব্যবহারে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা, বামপ্রগতিশীল শিবিরের বিভক্তি অবক্ষয়, পশ্চিমের উদার গণতান্ত্রিক দেশসহ বিশ্বব্যাপী রক্ষণশীলতার উত্থান, বাজার অর্থনীতির সুবাদে ভোগবাদী মানসিকতার প্রবল জোয়ার, সর্বোপরি মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম জাতি সম্পর্কে পশ্চিমের ভ্রান্তনীতি মিলে ক্রমে ক্রমে পঁচাত্তরের পরে সূচিত রূপান্তরণের রাজনীতি শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে এই বাহ্য ঘটনাবলীর পাশাপাশি বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তায় অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তির ফলে সৃষ্ট অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে।
এই দুর্বলতা রেখে দিয়ে উন্নয়ন সম্ভব হলেও গণতান্ত্রিক বিকাশে কোনো জাতি এগুতে পারে না। এর ফলে ক্ষমতা ও বিত্তকে কেন্দ্র করেই মূল রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে, মানুষের অধিকার, আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের শক্ত ভিত্তি ইত্যাদি চর্চা ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বাইরে থেকে যাচ্ছে। এভাবে দেশে কাঠামোগত ও ভোগবিচারে উন্নয়ন ঘটলেও মানবিক বিকাশ ও প্রকৃত মুক্তির পথ সংকুচিত হয়ে আসে।

আমরা ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধ করেছি - যুগপৎ স্বাধীনতা ও মুক্তি চেয়েছি। স্বাধীনতা দেশের হয়, তা হয়েছে, মুক্তি লাভ করে মানুষ, তা এখনও অধরা থেকে গেছে। স্বাধীনতাকে সব মানুষের জন্যে অর্থবহ করতে হলে অবশ্যই অর্থনৈতিক উন্নয়ন জরুরি, তা আবার মানুষের জন্যে প্রকৃত মুক্তির পথও অনেকটা সুগম করে দেয়। কিন্তু তারপরেও আরও কাজ বাকি থাকে। মানুষকে চিন্তা করার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। এটা কঠিন কাজ। রাষ্ট্র আইন করে বা শাস্তির বিধান দিয়েও তা বাস্তবে ঘটাতে পারবে না। এর জন্যে চাই সমাজ সংস্কারের আন্দোলন, সাংস্কৃতিক জাগরণ। শেখ হাসিনা যদি সত্যিই তাঁর পিতার এবং লক্ষ লক্ষ শহীদের স্বপ্নের বাংলাদেশ কায়েম করতে চান তবে তাঁকে আজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই কাজটিই করতে হবে। সে কাজ শুরু করার জন্যে একুশে ফেব্রুয়ারি যথার্থ উপলক্ষ হতে পারে।