আবুল মোমেন
১.
একুশে উদযাপনের
ধরণ ও তাৎপর্য উভয়ই যেন বদলে গেছে। গোড়ায় লক্ষ্যটা কেন্দ্রীভূত ছিল রাষ্ট্রভাষা
হিসেবে বাংলার অধিকার আদায়ে। সেই সংগ্রামের চেতনার উৎস ছিল এই দিনটি যা তখনও শহীদ
দিবস হিসেবেই অভিহিত হত। কিছুদিনের মধ্যে ভাষা থেকে সাহিত্য এবং সাহিত্য থেকে
সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে পড়ল এ চেতনার প্রভাব। কারণ সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের প্রশ্ন
জরুরি হয়ে দেখা দিলে একুশেই হল সেই চেতনার প্রতীক। ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির
সম্মিলনে জনমনে জোরদার হল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা। বলাই বাহুল্য, এই চেতনারও
অনুপ্রেরণা এলো একুশে ফেব্র“য়ারি থেকেই। ফলে কালক্রমে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সকল উদ্দীপনার উৎস হল একুশ যার প্রতীক ছিল শহীদ মিনার। এভাবে
একুশে ফেব্র“য়ারি হয়ে উঠল আমাদের জাতীয় দিবস এবং জাতীয় জীবনে তাৎপর্যবাহী দিন আর
শহীদ মিনার তারই প্রতীক।
গোড়া থেকেই একুশে
পালনের মূল অনুষঙ্গ ছিল দেশপ্রেম ও উদ্দীপনার গান আর জাতীয় চেতনা লালন ও বিকাশের
উপযোগী সাহিত্য। এক সময় একুশের স্মরণিকা প্রকাশ আর প্রভাতফেরী ও বৈকালিক অনুষ্ঠানে
সঙ্গীত পরিবেশন ছিল আবশ্যিক কাজ। জাতির মননের প্রতীক বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা
একুশের চেতনারই সম্প্রসারণ। এ প্রতিষ্ঠান তাই বরাবর দিনটি সেমিনার ও সাংস্কৃতিক
অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করে এসেছে। স্বাধীনতার পরে এর পরিসর ও ব্যাপ্তি বেড়েছে।
ক্রমে একুশের সাথে বইমেলা এবং বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশনার যোগ ঘটে গেল। এখন
একুশের মাস জুড়ে বাংলা একাডেমির বইমেলা, সেমিনার আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রভাব
দেশব্যাপী ছড়িয়ে গেছে। এটিই জাতীয়ভাবে একুশের মুখ্য অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছে। এর প্রভাব
সারা দেশে পড়েছে, প্রায় সব জেলাশহরে আজ ছোট আঙ্গিকে হলেও বইমেলা আয়োজিত হচ্ছে,
সর্বত্র কিছু কিছু প্রকাশনাও হয়ে চলেছে।
আজকে একথা
নির্দ্বিধায় বলা যায়, একুশে ফেব্র“য়ারিকে কেন্দ্র করে দেশে প্রকাশনা
শিল্পের এতটাই বিস্তার ঘটেছে যে একে প্রকাশনা শিল্পের বিপ্লবও বলা যাবে। প্রতিদিন
বাংলা একাডেমির বই মেলায় কত যে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়, আজকাল সারা মাসে অন্তত
হাজার পাঁচেক নতুন বই প্রকাশিত হয়। দেশে প্রকাশনার সংখ্যাও বেড়েছে, কেবল বাংলা একাডেমির
মেলাতেই পাঁচ শতাধিক সংস্থা তাদের বই নিয়ে অংশ নিচ্ছে, এর মধ্যে শ’খানেকের ব্যবসাও
খারাপ নয়। প্রকাশকবৃন্দ প্রায় সারা বছরই এই মেলাকে কেন্দ্র করেই তাঁদের প্রকাশনার
পরিকল্পনা করেন। আমাদের প্রকাশনা-শিল্প মূলত একুশে-কেন্দ্রিক।
বাংলা একাডেমির
পাশাপাশি শিল্পকলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট,
আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ, জাতীয় ও আঞ্চলিক নানা সংগঠন ব্যাপক আয়োজনে একুশে উদযাপন করে
থাকে। বিভিন্ন নগরে কর্পোরেশন কিংবা নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী সম্প্রদায়গুলো
একুশে উদযাপনে সোৎসাহে অংশ নিচ্ছে, নিজেদের স্বতন্ত্র আয়োজনও করছে। বর্তমান
সরকারের আমলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ দিন আর নিছক ছুটি থাকে না, তারাও নানা অনুষ্ঠান
করে শহীদ মিনারে ফুল দেয়। এমনকি সাহেবিয়ানায় অভ্যস্ত ক্লাবগুলো কিংবা ইংরেজিমাধ্যম
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সাড়ম্বরে একুশে উদযাপনে মেতে
উঠছে!
২.
ব্যাপক মানুষের
অংশগ্রহণে দেশব্যাপী নানা আয়োজনে উদযাপনের মাধ্যমে একুশে আজ যেন জাতীয় উৎসবে
রূপান্তরিত হয়েছে। একুশেকে কেন্দ্র করে দেশের প্রকাশনা শিল্পের বিস্তার যেমন ঘটেছে
তেমনি এর ব্যবসায়িক দিকটি মূলত একুশের ওপর নির্ভরশীল। একুশে এখন মূলত উৎসব
এবং বাণিজ্যের ভিত্তিতেই মূল্যায়িত হচ্ছে। প্রকাশকরা বলছেন এ বছর ব্যবসায় ভালো
হয়েছে কিংবা বলেন ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দিয়েছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনও বাদ নেই, এখানেও
ব্যবসায়ের প্রভাব বাড়ছে। এছাড়া বুটিক, তৈরি পোশাক, খাবারদাবারসহ আনুষঙ্গিক আরও
ব্যবসায়ের আওতা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে।
নিশ্চিন্তে বলা
যায়, যেহেতু বাণিজ্য প্রসারিত হচ্ছে, লক্ষ্মীর স্পর্শে ধন্য হয়েছে একুশে তাই এর
বাড়বাড়ন্ত অব্যাহত থাকবে। আশার কথা, এই বাণিজ্যের মূল ভিত্তি এখনও সারস্বতসাধনা।
লক্ষ্মী-সরস্বতীর যুগল সম্মিলনে একুশের অগ্রযাত্রা ভালোভাবে চলবে এ আশাবাদকে উড়িয়ে
দেওয়া যাবে না।
হয়ত প্রশ্ন উঠতে
পারে লক্ষ্মী না সরস্বতী কার প্রভাব বাড়ছে বেশি? তাছাড়া একুশে কেবল সরস্বতীর
সাধনার বিষয়ও ছিল না, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংগ্রামের সাথে সাথে এতে
সংগ্রাম ও সৃষ্টির ব্যাপারটা হয়ে উঠেছিল মুখ্য।
৩.
একুশে উদযাপনের
ব্যাপ্তি এখন বিশ্বময়, অন্তত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে দিনটির স্বীকৃতি
আসার পর থেকে। কিন্তু এ দেশে মাতৃভাষা বাংলা তো আজ কাক্সিক্ষত আদৃত ভাষা নয়। সবাই
তো ছুটছেন ইংরেজির পেছনে, ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের রমরমা বাড়ছে, ব্যবসাসফল বেসরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাচর্চার বাহন ইংরেজি, সেদিকেই ঝুঁকছে বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী।
কম্প্যুটার আর মোবাইলেও ভাঙাচোরা ক্ষতবিক্ষত ইংরেজির চর্চা হচ্ছে। একসময় রোমান
হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল এ জাতি, আজ তাদের
উত্তরসুরীরা স্বেচ্ছায় সাগ্রহে বাংলা লিখছে সেভাবে কিংবা তারই সাঁটভাষ্যে
আলাপচারিতা চালাচ্ছে। রেস্তোঁরা, ক্যাম্পাস, মিলনায়তন, বাজার, পথঘাটে কান পাতলে
তরুণ ও কিশোর, এমনকি শিশুদের কণ্ঠে ইংরেজি অথবা বাংলিশ কথোকথন কানে আসবে। যেটুকু
বাংলা বলছে তাও আঞ্চলিক কিংবা আঞ্চলিকের খিচুড়ি ভাষা। খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের
মধ্যেই রয়েছে একুশের মেলায় প্রকাশিত বইয়ের গর্বিত লেখক, একুশে উপলক্ষে পুরস্কৃত
কবি, টকশো মাতানো কথাকার, সেমিনারের চিন্তাশীল বক্তার সন্তান বা পৌত্র-দৌহিত্র,
পৌত্রী-দোহিত্রীরাই যারা ইংরেজি-বাংলিশে বাৎচিৎ করে কান ঝালাপালা করছে।
যদি প্রকাশিত
বইগুলো ভালোভাবে মনোযোগ দিয়ে পড়ি বা পড়ার চেষ্টা করি তাহলে প্রথম ঘা খেতে হবে
অধিকাংশ লেখকের ভাষাগত দুর্বলতায়, তারপর অতৃপ্তির কারণ হবে লেখায় চিন্তার
মৌলিকত্বের অভাব। মাতৃভাষার ব্যবহারে এক ধরনের অরাজক অবস্থা চলছে, অপরিণত বুদ্ধির
ছাপ যত্রতত্র।
এদেশে
সাহিত্যচর্চার দিকে ঝোঁক বেড়েছে, বই প্রকাশের হিড়িক পড়েছে, কবিতা ও উপন্যাসের
কমতি নেই। নব্য লেখকদের অনেকেরই প্রথম লেখাই বই আকারে বেরুচ্ছে, কোনো কোনো নব্য
লেখক একসাথে এক ডজন বইও প্রকাশ করছেন। একুশে উপলক্ষে যত বই বেরুচ্ছে তার অর্ধেকের
বেশি লেখক নিজের টাকায় বের করেন। এতে নৈরাজ্যের নদে কূলপ্লাবী জোয়ার বইছে। দুটি
কারণে এই নৈরাজ্য ঘটে চলেছে - দেশে লেখক বাড়লেও প্রকৃত সম্পাদক ও সমালোচক তৈরি
হচ্ছে না। কিংবা লেখকদের দাপটে সম্পাদক ও সমালোচকরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এঁরা তো
হলেন ভাষা ও সাহিত্যের অভিভাবক ও পাহারাদার। এ সমাজ সবক্ষেত্রেই মুক্তকচ্ছ থাকতে
চাইছে, নব্যধনী যেমন আইন-আদালতের তোয়াক্কা করে না, সবই নিজের কব্জায় রাখতে চায়,
তেমনি নব্য লেখককূলও প্রশংসা-স্বীকৃতির দায় নিজেদেরই আওতায় রাখতে চান। এ প্রভাব
ক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার-স্বীকৃতি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে।
এ অবস্থায়
বাংলাদেশে আজ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের খাঁটি অভিভাবক এবং যোগ্য পাহারাদার
নেই। ভাষার প্রতি সুবিচার করতে পারছি না আমরা, ভাষা চর্চায় কোনো নীতি মানছি না।
যখন আমাদের পূর্বসুরীরা ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তখন কেবল বাংলার রাষ্ট্রীয়
স্বীকৃতির অভাব ছিল, কিন্তু কি শিক্ষা কি গণমাধ্যম কি সমাজজীবন সবখানে বাংলারই
রাজ্যপাট ছিল রমরমা। আজ সাংবিধানিক স্বীকৃতি আছে বাংলার, এমনকি একুশের কপালে
বৈশ্বিকে স্বীকৃতিও জুটেছে, কিন্তু এ ভাষা শিক্ষাসহ সমাজ-জীবনের সবখানে দুয়োরানি
হয়ে আছে।
ব্যবসায়িকভাবে সফল
হয়ে ওঠায় একুশে উদযাপন নিয়ে আর ভয় নেই, কোনো শক্তিই এই টাকার টঙকারের প্রতি বধির
হবে না। কিন্তু সরস্বতীর কী হবে? সারস্বতসাধনাই যদি সংকটে থাকে তাহলে একুশের আর
থাকে কি?
###