আবুল
মোমেন
বাঙালির
রাষ্ট্রচিন্তার মধ্যে এমন কতকগুলো গ্রন্থি আছে যা মোচন করা কঠিন, এবং মোচন ব্যতীত এগুনোও
কঠিন। অবিভক্ত ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার উত্থান-পর্বে বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তার একদিকে
ছিল ভারতভিত্তিক ভাবনা অন্যদিকে ধর্মভিত্তিক স্বাতন্ত্র্যের চেতনা। ব্রিটিশ উপনিবেশিক
আমলে তখনকার মত ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার রাজনীতি জয়ী হয়েছিল। আবার যখন পাকিস্তানি অপশাসন
ও উৎপীড়নে অতিষ্ঠ পূর্ব বাংলার শিক্ষিত জনগোষ্ঠী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়েছিল
সেই জাগরণকে তখনকার বৈশ্বিক ও জাতীয় পরিমণ্ডলের সুস্থ ও শক্তিশালী বামপ্রগতিশীল চিন্তার
প্রভাবে অসাম্প্রদায়িক পথে পরিচালিত করা গিয়েছিল। জাতীয়তাবাদী জাগরণ অনেকটাই ভাবাবেগের
ওপর নির্ভর করে রীতিমত বিপ্লবী পরিণতি ঘটাতে সক্ষম, কিন্তু রাষ্ট্র গঠন ও পরিচালনা
একটি দীর্ঘস্থায়ী বাস্তবসম্মত কার্যক্রম। এর নীতি-আদর্শিক ভিত্তিগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট
ও দৃঢ় করে নিতে হয়। আমার ধারণা ভাবাবেগের ওপর নির্ভর করে আমরা স্বাধীনতার মত অনেক বড়
অর্জন সাধনে সক্ষম হয়েছি বটে, কিন্তু বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার আদর্শিক নীতিগুলোকে
প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দিতে পারি নি।
পূর্ববঙ্গবাসীর
জন্যে পাকিস্তান থেকে পৃথক হওয়া অবধারিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তারা কী ধরনের রাষ্ট্র
গঠন করবে সে বিষয়ে ভাসা ভাসা কথা কিংবা আপ্তবাক্য উচ্চারণের বেশি যথার্থ যুক্তি বিচার
দিয়ে বিশ্লেষণ করে বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশ ঘটে নি। এ অবস্থায় অসাম্প্রদায়িক অবস্থান
সম্পর্কে সহজেই ভারতপন্থী বা হিন্দুঘেঁষা রাজনীতির অপবাদ দেওয়া সম্ভব হয়েছে, আবার দেশের
সিংহভাগ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে একেবারে কট্টর ইসলামপন্থী পশ্চাৎপদ অগণতান্ত্রিক
রাষ্ট্রচিন্তাও মাথাচাড়া দিচ্ছে। একটি আধুনিক বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে
বাংলাদেশের সাফল্যের জন্যে জনগণের মনে সঠিক লক্ষ্যাদর্শের বীজ বপন করা জরুরি।
একটা
বিষয় সহজেই লক্ষ্য করা যায়, ভাষা আন্দোলন থেকে ধাপে ধাপে জাতীয় জাগরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের
অভ্যুদয় ঘটেছে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যেই। এই নীতি-আদর্শের
সাথে যুক্ত বিভিন্ন উপাদানকে ভালোভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হয় নি বলে এর একটা দুর্বলতা
থেকে গেছে বলে মনে হয়। কিন্তু এ থেকেও আমরা বাংলাদেশের কেমন লক্ষ্যাদর্শ হওয়া উচিত
তার একটা উত্তর খুঁজতে পারি। যদি আমরা এ অঞ্চলের ইতিহাসের দিকে নজর দিই তাহলে দেখব
বাঙালি কোনো কালে শাস্ত্রপন্থী কট্টর জনগোষ্ঠী ছিল না, একটা কৃষিজীবী সমাজ যেভাবে মাটি-জল
ও প্রকৃতির সাথে মিশে মানুষে মানুষে পারস্পরিক সহযোগিতার বন্ধনে থেকে সফল হয় এখানে
পরিবেশ তেমনটাই ছিল। এখানকার প্রকৃতি পরিবর্তমান হলেও মানুষের জন্যে অত্যন্ত উদার ও
সম্পন্ন ছিল। এ মানুষ প্রকৃতিলগ্ন, ভাববাদী এবং মানবিক। বাঙালির একান্ত অধ্যাত্ম সাধনা
- যেমন হিন্দুর গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলন, মুসলিমদের বিভিন্ন ধারার সুফি সাধনা, বৌদ্ধদের
তান্ত্রিক ধারাসমূহ, এবং এ অঞ্চলের নিজস্ব আউলবাউল সহজিয়া সাধনা - বিচার করলে তাতেও
পাওয়া যাবে এর প্রকৃতিলগ্নতা , ভাববাদ ও মানবিক আবেদন ইত্যাদি। ষোড়শ শতকের বৈষ্ণব কবির
সবার উপরে মানুষ সত্য এ ঘোষণার ঔদার্য দেখে যেমন তেমনি সপ্তদশ শতকের মুসলিম কবির মাতৃভাষা-প্রেমের
আগুন দেখেও চমকে যেতে হয়। এই ইহজাগতিক মানবিক উদার ঐতিহ্যের ধারা থেকেই বাংলাদেশে একটি
অসম্প্রদায়িকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রণোদনা পাওয়া সম্ভব। বাঙালি জাতীয়তাবাদের
অন্তর্নিহিত প্রবণতা এই সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে মানবিক উদার হওয়াটাই স্বাভাবিক
ছিল।
সাংস্কৃতিক
উত্তরাধিকার ছাড়াও আমরা যদি পাকিস্তান আমলের রাজনৈতিক গতিধারা লক্ষ্য করি তাহলেও দেখব
বায়ান্ন, চুয়ান্ন, বাষট্টি (ছাত্র আন্দোলন), ছেষট্টি, ঊনসত্তর (গণ-অভ্যূত্থান), সত্তর
(নির্বাচন) ও সবশেষে একাত্তরের রাজনৈতিক প্রেরণা ছিল এই একইভাবে একটি অসাম্প্রদায়িক
উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সেভাবেই স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে বাহাত্তরের
সংবিধান রচিত হয়েছিল।
বায়ান্ন
থেকে উপরিকাঠামোয় বা বহিরঙ্গে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক জাগরণের ঘটনাগুলো এত দ্রুত ঘটেছে
যে ইতিহাসে জমে ওঠা বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক ইস্যুর গ্রন্থিমোচন করার অবকাশ যেন পাওয়া যায়নি।
কিংবা সে রকম প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা আমাদের নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবীসমাজ দেখাতে পারে নি।
বাংলাদেশের
রাজনীতিতে যে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে তার একেবারে ওপরে আছে ক্ষমতা ও বিত্তের
প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এটা লুটেরা ধনী ও সাধারণ লুটেরা শ্রেণীর দ্বারা রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের
প্রক্রিয়া। কিন্তু তা প্রশ্রয় পেয়েছে যখন স্বাধীন বাংলাদেশকে তার অর্জিত অসাম্প্রদায়িক
গণতান্ত্রিক এবং উদার মানবিকতার ধারা থেকে সরিয়ে এনে ধর্মভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদে
রূপান্তরের চেষ্টা শুরু হয় তখন থেকে। মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকে ব্যর্থ করার এই চেষ্টা
যে বিফল হয় নি তারও দুটি কারণ আছে। একদিকে রয়েছে স্বাধীনতার অর্জনকে যথার্থভাবে উপলব্ধি
ও ব্যবহারে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা, বামপ্রগতিশীল শিবিরের বিভক্তি অবক্ষয়,
পশ্চিমের উদার গণতান্ত্রিক দেশসহ বিশ্বব্যাপী রক্ষণশীলতার উত্থান, বাজার অর্থনীতির
সুবাদে ভোগবাদী মানসিকতার প্রবল জোয়ার, সর্বোপরি মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম জাতি সম্পর্কে
পশ্চিমের ভ্রান্তনীতি মিলে ক্রমে ক্রমে পঁচাত্তরের পরে সূচিত রূপান্তরণের রাজনীতি শক্তিশালী
হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে এই বাহ্য ঘটনাবলীর পাশাপাশি বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তায় অস্পষ্টতা
ও বিভ্রান্তির ফলে সৃষ্ট অন্তর্নিহিত দুর্বলতার কথাও আমাদের মনে রাখতে হবে।
এই দুর্বলতা
রেখে দিয়ে উন্নয়ন সম্ভব হলেও গণতান্ত্রিক বিকাশে কোনো জাতি এগুতে পারে না। এর ফলে ক্ষমতা
ও বিত্তকে কেন্দ্র করেই মূল রাজনীতি ঘুরপাক খাচ্ছে, মানুষের অধিকার, আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক
প্রতিষ্ঠানসমূহের শক্ত ভিত্তি ইত্যাদি চর্চা ও বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া বাইরে থেকে যাচ্ছে।
এভাবে দেশে কাঠামোগত ও ভোগবিচারে উন্নয়ন ঘটলেও মানবিক বিকাশ ও প্রকৃত মুক্তির পথ সংকুচিত
হয়ে আসে।
আমরা
১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধ করেছি - যুগপৎ স্বাধীনতা ও মুক্তি চেয়েছি। স্বাধীনতা দেশের হয়,
তা হয়েছে, মুক্তি লাভ করে মানুষ, তা এখনও অধরা থেকে গেছে। স্বাধীনতাকে সব মানুষের জন্যে
অর্থবহ করতে হলে অবশ্যই অর্থনৈতিক উন্নয়ন জরুরি, তা আবার মানুষের জন্যে প্রকৃত মুক্তির
পথও অনেকটা সুগম করে দেয়। কিন্তু তারপরেও আরও কাজ বাকি থাকে। মানুষকে চিন্তা করার ও
মত প্রকাশের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। এটা কঠিন কাজ। রাষ্ট্র আইন করে বা শাস্তির বিধান
দিয়েও তা বাস্তবে ঘটাতে পারবে না। এর জন্যে চাই সমাজ সংস্কারের আন্দোলন, সাংস্কৃতিক
জাগরণ। শেখ হাসিনা যদি সত্যিই তাঁর পিতার এবং লক্ষ লক্ষ শহীদের স্বপ্নের বাংলাদেশ কায়েম
করতে চান তবে তাঁকে আজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই কাজটিই করতে হবে। সে কাজ শুরু করার জন্যে
একুশে ফেব্রুয়ারি যথার্থ উপলক্ষ হতে পারে।
No comments:
Post a Comment