Sunday, July 12, 2015

ঈদ-রোজার বিবর্তন ও বাজার অর্থনীতি

আবুল মোমেন

টিভি প্রতিবেদক যখন জিজ্ঞেস করল - কেমন ছিল ছোটবেলার ঈদ, আর এখনই বা কেমন দেখছেন উৎসব?
ভাবনা-চিন্তা ছাড়াই ওর সামনে বসেছিলাম। কিন্তু ওর প্রশ্নটা ধাক্কা দিল মনের জানালায় - খুলে গেল স্মৃতির ঝাঁপি। আর সেসব তুলে আনতে গিয়ে একালের পরিবর্তন আর তার কার্যকারণ, ধরণ ইত্যাদি চিন্তার জটিল গ্রন্থিও খুলতে থাকল। সেসবই পাঠকের সাথে ভাগ করে নেওয়া যায়।
সেকালে, অর্থাৎ প্রায় অর্ধশতকেরও বেশি আগেকার কথা, রোজা ছিল ঘরোয়া পরিসরে পালনের বিষয়। তাই ইফতার হত বাড়িতে বাড়িতে। ইফতার পার্টির কোনো স্মৃতি আমার মনে পড়ে না। বাবা তো শহরের গণমান্য ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর সূত্রে অন্তত জানতে পারতাম। না, তেমন কিছু ছিল না। কালেভদ্রে সরকারি কোনো আয়োজন হয়ত হত, তার সাথে সংসারের মানুষের কোনো যোগ ছিল না।
সেকালেও ইফতারে ছোলা-পেঁয়াজি-বেগুনি ছিল, কোনো দোকানের জিলাপির সুনাম থাকলে সেটি হয়ত আসত। তবে বয়েসি খানদানি রোজদারদের পছন্দ ছিল চিড়া-কলা-দই মাখা। একটু ঠাণ্ড হলে ভালো। সেহেরিতে একটা মূল পদ আর সাথে ডালের বেশি নয়। মূল পদটি প্রায়ই কখনও মাংস কখনও ডিম। কেউ কেউ অবশ্য দুধভাত খেতেন, তাতে প্রায়ই কলা থাকত, তবে আমের দিনে আমই কলার জায়গা নিত।
প্রতিবেশী আর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের সাথে ইফতারের আদানপ্রদানটুকু ছিল ঘরের বাইরে রোজার সংযোগ। মাঝে মধ্যে আত্মীয়-বন্ধু দু’চারজনকে ইফতারের আমন্ত্রণ জানানো হত। তাদেরই ডাকা হত যারা এলে ঘরোয়া আমেজ ক্ষুণ্ন হয় না। সবাই জানত রোজায় আড়ম্বর মানায় না। প্রায়ই পরিচিত গরীব আর ভিখিরিদের ডেকে ইফতার দেওয়া হত। এসব ও যাকাত দেয়া হত নীরবে, নিবৃত্তে। বিবাহিত কন্যা ও বৈবাহিকদের বাড়িতে ইফতারের তত্ত্ব পাঠানো হত।
ঈদ ছিল সামাজিক উৎসব। ছোটদের মধ্যে নতুন জামা নিয়ে চাঞ্চল্য ছিল, বেড়ানোর উৎসাহ আর পরিকল্পনা তাতে উত্তেজনা ছড়াত। কিন্তু তা কখনও ঘরের বা বৃহত্তর স্বজনের পরিধি ছাপিয়ে যেত না। সচরাচর একজনের একটার বেশি জামা হত না, ছোটদের আর মেয়েদেরগুলো বাড়ির সেলাইয়ে-পাকা বুবু-খালা-চাচিরাই তৈরি করে দিতেন। ছোটদের কাজ ছিল তাদের কাছে ঘুরঘুর করা, হাবভাবে তাগাদার আর্জি ফুটিয়ে তোলা। ছেলেরা আর বড়রা যেত পাড়ার দর্জির কাছে। ঈদের সকালে প্রতিবেশীদের সাথে সেমাই বিনিময় হত, আমরা প্রতিবেশী ও আত্মীয়বাড়ি বেড়াতাম, আর দুপুরে নিজের বাসায় ভালো খেতাম। পোলাও-মুরগিই হত মূল পদ। তখন খাবারে বা পোশাকে বাড়াবাড়ি মানুষ তেমন জানতই না। পোশাক বা খাবারের জলুসে নয়, বিচার যদি হত তা হত আতিথ্যের, আন্তরিকতার। কাজীবাড়ির চাচি কেমন মায়া করে খাওয়াতেন সে গল্প বাড়ি এসে মাকে বলতাম। স্বাদু খাবারের স্বাদ বাড়ত ছোটনানির স্বতস্ফূর্ত স্নেহের ফল্গুতে।
আমি গৎ বাঁধা ভাবনার মানুষ নই। সেকাল ভালো আর একাল খারাপ - এমন ভাবতে এবং ফতোয়া দিতে অভ্যস্ত নই। জানি যার যার শৈশব-স্মৃতি তার কাছে মধু-মাখা, ভোলার নয়, সেইসব স্মৃতি সততই সুখের। এও আমরা জানি কালে-কালে মানবজীবনে পরিবর্তন ঘটবেই। কথা হল তার কতটা ভালো হচ্ছে, কতটা কীভাবে আমরা নিজেদের মত করে সংস্কার করে নিতে পারতাম। সেদিক থেকে একটু তুলনা এবং ভাবনা চলতে পারে বলেই মনে হয়।
এখন বাজার অর্থনীতির রমরমা, বাজার মানুষের ব্যক্তিগত, এমনকি পবিত্রতম জায়গাতেও ঢুকে পড়ছে। বাজারের সহযোগীর বা উপজাতের ভূমিকা নিচ্ছে গণমাধ্যম। রোজা এলে এখন উপবাসের গুরুত্ব ছাপিয়ে ইফতারের প্রলোভনের পসরা সবটা জাঁকিয়ে বসে। এমনিতেই গণমাধ্যমে ইদানীং জনপ্রিয়তায় শীর্ষ অনুষ্ঠানের একটি হল রান্না অর্থাৎ মুখরোচক খাবার। রসনা ও ভোজনবিলাস মানুষের আদিম রিপু। তবে রোজার নৈতিক অবস্থান হল মানুষের অসংযত রিপুকে সংযত করা। কিন্তু বাজার ও গণমাধ্যমের যোগসাজশে রমজানের সারাটা মাস জুড়ে চেষ্টা চলে মানুষের ভোগের রিপুকে অসংযত করে তোলার - পত্রিকায় প্রতিদিন আর ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে বিপুল আয়োজনে প্রায় সারাক্ষণ এই চেষ্টাই চলতে থাকে।
একজন মানুষ কত খেতে পারে, আর তার কতটা খাওয়া উচিত তার একটা সীমা নিশ্চয় আছে, থাকা উচিত। সারাদিনের উপবাসের পরে কোন ধরনের খাবার খাওয়া উচিত এসব যদি বিবেচনায় আসেও তা আসে কিন্তু প্রলোভনের ফাঁদটা ঢাকার জন্যে, কারণ মূল বিবেচ্য বিষয় কী করে মানুষকে বেশি বেশি খেতে প্রলুব্ধ করা যায়। কাউকে প্রলোভন দেখানো - বিশেষত সংযম শিক্ষা ও পালনের মাসে - উচিত কিনা তা একবার ভেবে দেখা যায় না?
দেখা যাচ্ছে মানুষ নিজের মান রক্ষার মানদ- হিসেবে ধরে নেয় ইফতার আইটেমের সংখ্যা এবং দামের ওপর, ফলে প্রায়ই দেখতে পাই - মাসটা উপবাস ও সংযমের হলেও এটি কাটাতে বাড়তি বাজেট লাগে। ইদানীং ঢাকায় রোস্তোরায় সেহেরি খাওয়ারও ফ্যাশান চালু হয়েছে। মাঝরাতে বা শেষরাতে অভিজাত পাড়ার ছেলেমেয়েরা সেহেরি অভিযানে বেরুচ্ছে। বৈচিত্রের সাথে একটু বাড়তি রোমাঞ্চও যোগ হল, অবশ্যই উচ্চ মূল্যে এবং মাত্রাতিরিক্ত ক্যালরি অর্জনের বিনিময়ে - খারাপ কী!
আজকাল ঈদের কেনাকাটা রোজার অনেক আগে থেকেই শুরু করে মানুষ। বাজারই রুচি, ফ্যাশন তথা কেনাকাটার নির্ধারক। বাড়িতে আবার কেউ জামা সেলাই করে নাকি? সেসবে পারদর্শী বুবু-খালা-চাচিরা বর্তমানে বিলুপ্ত প্রজাতি। অথবা তাঁরাই হয়ত এখন একালের বুটিক মালিক-কাম-ডিজাইনার। এখনকার নীতিকথাও গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপনই নির্ধারণ করে দিয়েছে - আগে ছিলাম বোকা এখন হইছি বুদ্ধিমান। বৈষয়িক উন্নতির পিছনে নিরন্তর বুদ্ধি খাটাতে থাকলে তাতে নিশ্চয় শান পড়ে, এবং বাজারের আঁটঘাঁট বোঝা হয়ে যায়। বুদ্ধির প্যাঁচ এবং চালাকির মারে কেউই পিছিয়ে থাকে না আর। কিন্তু এভাবে চললে বুদ্ধিরই বাড়বাড়ন্ত হবে, আর তার জের ধরে মানুষটার চাতুর্য, শঠতাও বাড়বেই। বিপরীতে কোন জিনিসটা পিছিয়ে যাবে? পিছিয়ে পড়বে বিবেচনা, প্রকৃত বুদ্ধি, যা শুধু ব্যবসাকে নয়, তার পেছনের মানুষটাকেও সমৃদ্ধ করে। কিন্তু বাজারের খপ্পরে পড়ে মূলধন তথা বিনিয়োগের সর্বোচ্চ মুনাফা আদায়ের মন্ত্রে মশগুল মানুষ চালাক-চতুর হওয়ার দৌড়েই এগুতে চায়। সেদিন কোনো চ্যানেলের ঈদ-বাজার পরিক্রমার বিশেষ অনুষ্ঠানে একজন সবাইকে টেক্কা দিলেন দামে, তাঁর দোকানের শাড়ির সর্বনিম্ন মূল্য দেড়লক্ষ টাকা, আর পাঞ্জাবির তিন কি চার হাজার টাকা!
ফলে টিভি প্রতিবেদক যখন আমাকে প্রশ্ন করল আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য কিছু দেখেন কিনা ঈদের আয়োজনে, তখন প্রথমে একটু তাত্ত্বিক কথা বলে পরে আসল কথাটা পাড়লাম। তাত্ত্বিক কথাটা সামান্য। একালে যোগাযোগে সত্যিই একটা বিপ্লব ঘটেছে - তা সড়কে-উড়ালে যেমন তেমনি তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণেও, মানুষের চলাচলও অনেক বেড়ে গেছে। বললাম শিল্প বিপ্লবোত্তর আধুনিকতার একটি বৈশিষ্ট্য হল সর্বজনীনতা (universality) এবং সামান্যিকরণ (generalisation)- অর্থাৎ সবকিছু সবার কাছে পৌঁছায় আর সবার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাযুজ্য তৈরি হওয়ার প্রবণতা জোরদার হতে থাকে। এটা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র এবং বৈশিষ্ট্য রক্ষার ক্ষেত্রে হুমকি স্বরূপ। কিন্তু এটাই ট্রেণ্ড বা চলতি-হাওয়া। ব্যক্তিগত  অভিজ্ঞতা আর গণমাধ্যমের প্রচারণায় মানুষের খাদ্যাভ্যাসের বিশেষত্বেও পরিবর্তন ঘটছে। ফলে ঈদের আয়োজনে বা ইফতারের আয়োজনে সবাই কাছাকাছি চলে আসছে, ব্যক্তির বিশেষত্ব কমছে। মূল কারণ বাজারের কেন্দ্রীয় ভূমিকা। আদতে বাজারই বলে দিচ্ছে এ বছরের ঈদের আয়োজনে কোন কোন আইটেমের কদর বাড়বে। একই কথা খাটে ইফতারের ক্ষেত্রেও। তাই প্রতিবেদকের প্রশ্নের উত্তরে জানাতে হল - এখন পার্থক্য ঘটে ট্যাঁকের শক্তির ওপর। নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশের অধিকাংশ মানুষের ঈদ শপিং-এর ঠিকানা ঢাকায় গাউছিয়া আর চট্টগ্রামে টেরিবাজার, রেয়াজুদ্দিন বাজার। যেগুলো নিয়ে গণমাধ্যম ও মিডিয়া ব্যক্তিরা চেঁচিয়ে মরেন সেখানে হাত দেওয়ার সাধ্যি নেই তাদের। আর দেশে এখনও সংখ্যায় কম নয় দরিদ্র মানুষ - জনসংখ্যার ৩০ ভাগ - যারা নিজের উপার্জনে রোজা বা ঈদের বিশেষ সংস্থান করতে পারে না। তাদেরই ২৭ জন এবারে প্রাণ দিলেন জর্দা-খেকোদের কল্যাণে হঠাৎ-নবাবের বাড়ির দরজায় তাঁরই বড়লোকি অবিমৃষ্যকারিতায়।
শেষ কথা : উপলক্ষের মূল শিক্ষা আর মৌলিক মানবিক নীতিবোধ বাদ দিয়ে কোনো উৎসব, ব্যবসা, উপলক্ষকে মানবিক রাখা মুশকিল। মনে মনে জানি, মুশকিল বললে কম বলা হয়, আদতে অসম্ভব।

***