Wednesday, June 19, 2013

আমরা যেন উদ্বাস্তুতে রূপান্তরিত হয়ে চলেছি


আবুল মোমেন

বর্ষার দু’এক পশলা ঝরতেই গ্রামবাংলার নিসর্গের লাবণ্য চোখ ও মনকে সজীব করে তোলে। চারিদিকে সবুজের সমারোহ- ঘন স্বচ্ছ সজীব প্রাণবন্ত এই শ্যামলিমার মজ্জাগত শক্তি আশাবাদ আর ইতিবাচকতা। এ কথা লিখেই চমকে ভাবতে হয় কোথায় আশাবাদ, কোথায়বা ইতিবাচকতা? এসবই মরীচিকার মত অধরা নয় কি? বাংলাদেশের মানুষের মনে হতাশার বীজ মহীরুহ হয়ে উঠেছে - নয় কি? সেই সাথে বিদ্বেষ হিংসা আর লোভের মহীরুহের পরিচয়ও পাচ্ছি। প্রকৃতিতে প্রাণের এমন উজ্জ্বল জৌলুষ ব্যক্তির প্রাণে ব্যর্থ হয়ে ফিরছে।
এর কারণটা কি?
বোধহয় কারণ এই যে আমরা প্রায় আমাদেরই অজান্তে মানসিক উদ্বাস্তুতে রূপান্তরিত হচ্ছি। আমরা দেশকে মনেপ্রাণে পেয়েছিলাম একাত্তরে, তাই প্রায় গণহারে উদ্বাস্তু হলেও তা ছিল বাহ্য তখন, হৃদয়ে জাগ্রত ছিল বাংলাদেশ। আজ সে সলতে নির্বাপিত। তাই যত পরিবর্তন, যত আয়োজন, যত অর্থলগ্নী হোক তা আমাদের অন্তরের দারিদ্র্য দূর করতে পারে না। আমাদের উন্মূলতা তথা উদ্বাস্তুপ্রবণতার আগুনে এসবই আরও ঘৃতাহুতি দেয়। কারণ উদ্বাস্তুর জীবনে ব্যক্তিগত ক্ষুধাই সব, সবই তার ভোজে লাগে।
কীভাবে আমরা উদ্বাস্তুতে রূপান্তরিত হলাম এবং হয়ে চলেছি, তার খোঁজ করা কি দরকার নয়? স্বাধীনতার পর থেকেই আমাদের ভুল হচ্ছিল, ব্যর্থতার শেষ ছিল না, কিন্তু সম্ভাবনার পথও তৈরি হচ্ছিল, রুদ্ধ তো হয়ই নি। কারণ তখনও হৃদয়েমনে বাংলাদেশ স্বপ্ন হয়ে, আশা হয়ে বেঁচে ছিল। বাংলাদেশ তো উত্থানপতনে জীবন্ত ইতিহাস, ঐতিহ্যসমৃদ্ধ চলমান সংস্কৃতি। এই ইতিহাস ও সংস্কৃতির রূপকার ও ফসল এক জনগোষ্ঠীর নাম বাঙালি। ইতিহাস তার মনোভূমির বীজতলা আর সংস্কৃতি তাতে জন্ম নেওয়া চারাগাছ। সবটাই প্রাণ আর প্রত্যাশা, স্বপ্ন আর সম্ভাবনার বিষয়। এই যায়গায় বিপর্যয় ঘটলে বা আকাল দেখা দিলে মানুষের দেউলিয়াত্বের সূচনা হয়, যার পরিণতি মানসিক উদ্বাস্তুতে রূপান্তর।
উদ্বাস্তু কেবল বর্তমান নিয়ে বাঁচে, স্বার্থটাই প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে ওঠে তার, খাওয়া-পরা ও বাঁচার জন্যে লোভ তার প্রধান রিপু। লোভের পিছু পিছু আসে প্রতিহিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ এবং ক্রমে প্রয়োজনে আরও পাশববৃত্তির জাগরণ ঘটে - যুক্তিবিবেচনা লোপ পেয়ে পেশী শক্তির প্রয়োগের প্রবণতা বাড়তে থাকে। এই রিপুর মুক্ততাড়নায় চাহিদার কোনো সীমা টানা যায় না। যার মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে সে প্রাসাদ চায়, চাকুরি থাকলে উপরি চায়, একটা বাহন থাকলে একাধিক বা নতুন মডেলের চায়, অভ্যাসবশত অকারণে বাজার করবে, এক নারী নিয়ে সংসার বেঁধে আরও নারী চায়। এ পথের শেষ কোথায়? - শেষ নাহি যে শেষ কথা কে বলবে?
উদ্বাস্তু-মানুষের সমাজ থাকে না, ওরা তো বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি - নিজ নিজ স্বার্থের দায় মেটাচ্ছে, কামনা চরিতার্থ করছে, যে কোনো সুযোগের সর্বোচ্চ (সর্বোত্তম নয়) ব্যবহার করে নিচ্ছে। এ সময়ে মানুষ আর পশুতে তফাৎ বিশেষ থাকে না। আজ বাংলাদেশে মানুষ মতভিন্নতা জানে না, কেবল বোঝে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, তা থেকে সহজেই প্রতিপক্ষ তৈরি হয়। প্রতিপক্ষের প্রতি অন্ধ ঘৃণা আর ক্রোধে রিপু-ই সক্রিয় হয়ে ওঠে। মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলে ধিকি ধিকি সবসময়। তাই মানুষ গুম হয়, খুন হয়, আঠারো টুকরায় খণ্ডিত হয়। সংখ্যালঘু চরম নির্যাতনের শিকার হয়, নারী ধর্ষিতা হয়। পাশাপাশি সেবক প্রভু হয়, বিচারকও ঘুষ খায়। আপন স্বার্থ ও রিপুর তাড়নায় আস্তে আস্তে সমাজ ভেঙে যেতে থাকে। একাত্তরে যখন আমরা কোটি মানুষ দেশছাড়া হয়ে সর্বার্থে উদ্বাস্তু, আরও কোটি মানুষ নিজ দেশে পরবাসী উদ্বাস্তু তখন কিন্তু আমরা অমানুষ হই নি। মানবেতর জীবন কাটিয়ে, ঝুপড়িতে, পাইপের মধ্যে বাস করে, একবেলা খেয়ে সামান্য পেয়ে, অনেকেই সর্বস্ব হারিয়ে সর্বক্ষণ মৃত্যুর থাবার নিচে থেকে, বর্বর অত্যাচারের শিকার হয়েও অমানুষ হই নি। আমরা তখন ত্যাগের জন্যে মরিয়া, আমাদের কণ্ঠে গান ছিল, হৃদয়ে ভালোবাসা, দেশের জন্যে প্রাণপাত করার পণ। ওই উদ্বাস্তু জীবনে আমাদের মধ্যে প্রতিবেশীর সহৃদয়তা, সহযাত্রীর সহমর্মিতাসহ কী মানবিক সম্পর্ক সব গড়ে উঠেছিল! সেই উদ্বাস্তু শিবিরে উদ্বাস্তুজীবনে আমরা মানুষ ছিলাম, সমাজ গড়ে তুলেছিলাম, এমনকি দক্ষতা ও সততার সাথে সরকার ও প্রশাসন চালিয়েছি, সবচেয়ে বড় কথা আমরা মুক্তির জন্যে যুদ্ধ করেছিলাম, আমরা স্বাধীনতা এনেছিলাম।
আজ স্বাধীন দেশে আমরা অমানুষ হয়ে পড়ছি, সততার আকাল চলছে, দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে, দক্ষতাও    অন্তর্হিত। আমরা পারছি না এখন।
তখন পেরেছিলাম আর এখন পারছি না - কারণ তখন দেশছাড়া হয়েও আমরা মানসিকভাবে উদ্বাস্তু হই নি, আমাদের হৃদয়ে ছিল জাগ্রত বাংলাদেশ। আর আজ দেশজুড়ে আমরা আধিপত্য করছি, কারণ হৃদয়ের বাংলাদেশের সলতে নিভেছে। আমরা মানসিক উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছি। মানসিক উদ্বাস্তু কেবল ব্যক্তিস্বার্থই চরিতার্থ করে, সে দখল করতে জানে, ভোগ করে, ভাগ করে নিতে ও পেতে জানে না। ফিলিস্তিনের জনগণ উদ্বাস্তু  শিবিরে থেকেও মানবিক ও সামাজিক জীবন যাপন করছে, প্রতিটি মৃত্যুতে (ইজরায়েলিদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড) তারা মাতম করে সাড়া দেয়। প্রতিটি জীবন তারা দেশের জন্যে স্বাধীনতার জন্যে উৎসর্গ করতে পারে। কারণ ওরা উদ্বাস্তু শিবিরে থেকেও উদ্বাস্তু নয়, দেশপ্রেমিক মানুষ। যেমনটা আমরা ছিলাম একাত্তরে।
দেশ জিনিসটা তো কথার কথা নয়, বক্তৃতায় মুখে ফেনা তুলবার বিষয়মাত্র নয়। এতো জানা-বোঝা এবং চর্চার বিষয়, তারপর দেশচেতনা ও ভালোবাসার কথা উঠবে। স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনীতি দিনে দিনে সেই চর্চার ও ভালোবাসার দেশটাকে ঝাপসা করে দিলো।
আমাদের প্রকৃতিই আবার আশাবাদী হতে শোখায়। আমরা দাবি করে বলতে পারি, সভ্যতার বিচারে আমাদের ঐতিহ্য সত্যিই চমকপ্রদ, গৌরবময়। আমাদের রয়েছে পালযুগের চিত্রকলা, বৈষ্ণব পদাবলী, বাউল গান, সুফিধারার মরমি সঙ্গীত, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন এবং এভাবে মানবকৃষ্টির অসংখ্য শ্রেষ্ঠ কৃতী। না, সভ্যতার নিরিখে পিছিয়ে পড়িনি আমরা এখনও। তবে উদ্বাস্তু জীবন আরও কিছুকাল চলতে থাকলে সত্যিই পিছিয়ে পড়ব। কারণ মানুষ তার প্রাণের কণ্ঠ শুনতে পেলে তবেই জেগে ওঠে, সৃষ্টিশীলতাও তখন শুরু হয়। ফলে আমরা অনেক পথ পাড়ি দিয়ে বিস্তর অর্জন সত্ত্বেও আজ মুখ থুবড়ে পড়েছি। তার কারণ আমাদের প্রাণভোমরায় হাত পড়েছে। রূপকথার গল্পে দৈত্যের প্রাণ থাকত কৌটোতে রাখা পতঙ্গের মধ্যে। সেটা মারলে দৈত্যও মরে। মানবের প্রাণভোমরা তার সংস্কৃতি। সেখানে হাত পড়েছে, সেটা না সরিয়ে হাজার টাকা পয়সা ঢেলে উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জিত হবে না। এই প্রাণ বাঁচে ইতিহাসে-সংস্কৃতিতে। আজকাল উন্নয়নপন্থীদের উগ্রতা এমন পর্যায়ে গেছে যে তারা ইতিহাস আর সংস্কৃতির কথা বললে রাগ করেন। রাগ করে বলেন কেবল পিছনে টানা, পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটা, কেবল বিবাদ টেনে আনা! অথচ সংস্কৃতির ভাণ্ডার থেকেই তার জীবনদর্শন নীতিনৈতিকতার মানদণ্ড তৈরি হবে। ফলে সংস্কৃতি গেলে মনুষ্যত্বও যাবে।
কিন্তু যে মানুষ  ইতিহাস চেতনাহীন তার কোনো সংস্কৃতির বাতাবরণ তৈরি হয় না, স্বার্থ ও বর্তমানের ভোগের চিন্তা ছাড়া। এই হল প্রকৃত উদ্বাস্তু, ব্যক্তিস্বার্থের জোয়ালে বাঁধা, যে পারে চুরি করতে, ঘুষ খেতে আর দখল করতে। এ সবের পিছু পিছু আসে সন্ত্রাস, হানাহানি, খুন-জখম, দুনিয়ার অমানবিকতা। বাংলাদেশে এসবই চলছে। উদ্বাস্তুর দেশে এর বেশি আর কী হবে।
কথা হল, আমরা কি উদ্বাস্তু হয়েই থাকব? উদ্বাস্তু হতেই থাকব? নাকি সেই একাত্তরের সোনালি উদ্বাস্তুজীবনের স্মৃতি হাতড়ে আরেকবার হৃদয়ে বাংলাদেশকে ধারণ করে গৌরবের অধ্যায়কে ফিরিয়ে আনব? এছাড়া এদেশের বেঁচে ওঠার আর কোনো পথ নেই। বিকল্প যে পথটিতে এখন আমরা হাঁটছি তার নিদর্শন আঠারো টুকরোর লাশ, সাভার ট্র্যাজেডি, খুন-গুম-ধর্ষণ, হলমার্ক-ডেস্টিনি কেলেংকারি, সহিংসতা ও সন্ত্রাস, রামুর ধ্বংসযজ্ঞ, আশুলিয়ার দখল, সংসদের অচলতা, ক্ষমতাবানদের নির্লজ্জ ভোগবিলাসের ব্যসন, ঋণখেলাপী সংস্কৃতি... এভাবে লুটপাট দখলভোগ, খুনজখম ধ্বংস-বিপর্যয়, অন্ধকার তমশা অমানিশা এবং জীবনানন্দের সেই অদ্ভুত আঁধার... যারা অন্ধ তারা চোখে দেখে বেশি... যারা রাজাকার তারাই দেশপ্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধা তাদের তোষামোদকারী... বলি, ধ্বংস ও চূড়ান্ত বিপর্যয় আর কতদূর?



Sunday, June 16, 2013

পেশাদারী জীবনে বরাবর কলাম লিখে এসেছি। চাকুরি ছাড়ার পর ভাবছি কলাম নিয়ে প্রথাগত পথেই চলব নাকি প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে নতুন পথে এগুব। ভাবতে ভাবতেই অভ্যাসবশত সমকালীন প্রসঙ্গ নিয়ে এই লেখা। আপাতত ফাঁকা সময়ে প্রযুক্তির দারস্থ হলাম। দেখা যাক, পাঠকের কাছে পৌঁছানো যায় কিনা।

তবে জানিয়ে রাখি নানা বয়সের আগ্রহীদের জন্যে বিচিত্র বিষয় নিয়ে একটু শিক্ষামূলক একটা ব্লগ চালু করতে যাচ্ছি, বিশ্ববিদ্যা চর্চা প্রকল্প নামে। তাতে আমার সাথে যোগ্যতর আরও কেউ কেউ থাকবেন। সেটি এই বুধবার থেকে চালু হবে। আগ্রহী সকলকে আমন্ত্রণ।

আশরাফুল প্রসঙ্গ প্রতিভার পরিচর্যা

আশরাফুল প্রসঙ্গ
প্রতিভার পরিচর্যা
আবুল মোমেন

আশরাফুল প্রসঙ্গ আপাতত চাপা আছে। আকসু প্রতিবেদন বিসিবির হাতে এলে তা আবার আলোচনায় উঠে আসবে। ক’দিন ধরে পত্রপত্রিকায় আশরাফুলের স্বীকারোক্তি, ক্ষমা প্রার্থনা এবং বিভিন্ন জনের প্রতিক্রিয়া অনেকেই পড়েছি। নায়কের আসন থেকে তার ছিটকে পড়ার দৃশ্য কারুর ভালোলাগার কথা নয়। আশরাফুলও বুঝতে পেরেছেন কাজটা তিনি ঠিক করেন নি, ভুল এবং অন্যায় হয়েছে। ভুল ও অপরাধের উপলব্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ন্যায়ের ঝাণ্ডা ওড়াতে গিয়ে এসব বিবেচ্য বিষয় সংশ্লিষ্টদের মনে যেন থাকে।
এই দুঃখজনক ঘটনার সূত্র ধরে চলে আসে আরও কয়েকটি বিষয়। প্রতিভার পরিচর্যা করার দায়িত্ব সমাজের। মানবসমাজে বিরল প্রতিভাধর কেউ কেউ কিছু বিধিদত্ত বিস্ময়কর ক্ষমতা ও পারদর্শিতা নিয়েই জন্মান। যথাযথ পরিচর্যার অভাবে অনেক সময় সেসব ভালোভাবে বিকশিত হয় না। আবার প্রাথমিক বিকাশের পর প্রচার, জনপ্রিয়তা, প্রতিষ্ঠা, বিত্ত মিলিয়ে যে জটিল কিন্তু পিচ্ছিল বৃহত্তর জগতে তাদের পদার্পণ করতে হয় তাতে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার তথা এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা পাওয়া জরুরি। নয়ত নক্ষত্রের পতন ঠেকানো যায় না। কেউ অল্প মাশুল গুণে ভুল উপলব্ধি করেন, নিজেকে শোধরানোর সুযোগ পান, অনেকে বড় মাশুল চুকিয়ে হারিয়ে যান। গুণি প্রতিভাধর মানুষের এরকম পরিণতি সমাজের জন্যে ভয়ানক ক্ষতিকর। ফলে গুণির ও প্রতিভাবানের পরিচর্যায় সমাজের দায়িত্বের কথা ভুলে গেলে চলবে না।
সমাজ কথাটা একটু অস্পষ্ট থেকে গেল, এটা স্পষ্ট করা দরকার। নানা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সামাজিক দায়িত্ব পালিত হয়। এর মধ্যে প্রাথমিক দায়িত্ব হল পরিবারের, তারপর স্কুলের। সবার জন্যে এ দুটি সত্য। তারপর ক্ষেত্রবিশেষে দায়িত্ব ভাগ হয়ে যাবে। আশরাফুলের ক্ষেত্রে এ দায়িত্ব পড়বে তাঁর উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপির ওপর। তারপর এদেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা বিসিবি, তাঁর ক্লাব ও জেলার ব্যবস্থাপনা কমিটি, যে অসংখ্য ট্যুরে তিনি গেছেন তার কোচ ও ব্যবস্থাপকবৃন্দ ইত্যাদি। আশরাফুলের পরিণতির দায় এঁরা এড়াতে পারেন না।
আমরা জানি আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় ব্যাধির নাম দুর্নীতি। আর সাধারণভাবে এ সমাজের মানুষের দুর্বল জায়গা হল নৈতিকতার মান। এটা বেশ খারাপ বলেই দুর্নীতি এ সমাজের গভীরে বাসা বেঁধেছে। ব্রিটিশ আমল থেকেই সমাজের সর্বক্ষেত্রে এর চর্চা চলছে। আরেকটা সমস্যা হল, দীর্ঘ দুইশত বছরের বেশি (১৭৫৭-১৯৭১) উপনিবেশ হিসেবে পদানত থাকায় শিক্ষিত মানুষের মধ্যেও আত্মসম্মান ও মর্যাদাবোধে ঘাটতি থেকে গেছে। এরকম সমাজের নৈতিকতার মানদণ্ড খুবই নড়বড়ে হয়। মানুষ অনৈতিকতার সাথে আপোস করে চলে। আবার সমাজের নানা বৈষম্য দিনে দিনে বাড়তে থাকায় বঞ্চিত মানুষ কেবল অস্থির হচ্ছে না, বেঁচে থাকার কৌশল হিসেবেও দুর্নীতির পথে পা বাড়াচ্ছে। বঞ্চিত মানুষ দরিদ্রও বটে, কথাটা বিপরীতভাবেও সত্য। দুটোর যোগফল দুর্নীতি ও নৈতিকতার গভীর সংকট। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, দুর্নীতির রয়েছে বৈষম্য হ্রাসের ক্ষমতা। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, এ সমাজে পরিচিতকে নিয়ম ভেঙে খাতির করার রেওয়াজ চালু আছে। ফলে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ ক্লিনিকে, রেল স্টেশনে, চাকুরির বাজারে একজন সুবিধাভোগী পরিবারের সন্তানের চেয়ে পিছিয়ে থাকেন। তখন এই ঘাটতি পুষিয়ে সম অবস্থানে এসে অন্তত কিছুটা সেবা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্যে তাকে দুর্নীতির পথ ধরতে হয়। আবার খ্যাতি-প্রতিষ্ঠা দরিদ্র বঞ্চিত জনের জন্যে নিয়ম-ভাঙার ও ভেঙে আয়বৃদ্ধির সুযোগ খুলে দেয়। অনেকে সেই ফাঁদে পা দেন। আশরাফুলের ক্ষেত্রে এরকম কিছু ঘটতে পারে। সেক্ষেত্রে অপরাধের সামাজিক প্রেক্ষাপটও বিবেচনায় আনা উচিত - বিচ্ছিন্নভাবে কেবল ব্যক্তির নৈতিকতার মানদণ্ড প্রয়োগে সুবিচার পাওয়া যাবে না। বৈষম্য-বঞ্চনা-দারিদ্র পীড়িত সমাজে দুর্নীতি লালিত হয় আর তাতে ভিতরে ভিতরে সমাজের নৈতিকতার ভিত্ নড়বড়ে হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ চমৎকারভাবে কবিতায় প্রসঙ্গটি তুলে ধরেছেন - যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে, / পশ্চাতে রেখেছে যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
যে সমাজে অন্যকে অন্যায়ভাবে পিছনে ঠেলে দেওয়ার কাণ্ড নিয়মিত ব্যাপার সে সমাজের পিছিয়ে থাকাই স্বাভাবিক। আমরা দেখছি আমাদের সমাজ কেবল নৈতিকভাবে দুর্বল তা নয়, এটি অপরাধপ্রবণ সমাজ, অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ও দিয়ে থাকে। সবকিছুর নিয়ামক হল ব্যক্তিগত পরিচয় আর ব্যক্তি-স্বার্থ। এর ফলে এ সমাজ প্রায় সবসময় পক্ষপাতদুষ্ট এবং কখনও নিরপেক্ষ হতে পারে না। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধের কোন সুষ্ঠু বিচার হয় না, অপরাধী পার পেয়ে যায়। আবার কখনও কখনও পক্ষপাত ও স্বার্থের বিবেচনা থেকেই ন্যায়বিচার ক্ষুণœ হয়।
এ অবস্থায় সাধারণভাবে সমাজের সত্য-মিথ্যা ন্যায়-অন্যায় পাপ-পুণ্যের ধারণাগুলো বেশ অস্পষ্ট, আত্মপক্ষ জোরদার করার জন্যে এখানে কুতর্ক কুযুক্তির অবতারণা খুবই সাধারণ ব্যাপার। ভয়ঙ্কর সব অপরাধেও আপোসের জন্যে চাপ তৈরি করতে পারেন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিও। আর একটি অপরাধকে ঢাকতে বা সে অপরাধের শাস্তি ঠেকাতে উত্তরোত্তর আরও গুরুতর অপরাধ ঘটাতে বাধে না কারো। এরকম একটি বিষচক্রের ভয়ঙ্কর বাস্তবতায় বাস করছি আমরা।
আমরা সকলেই চাইব একটি স্বচ্ছ, স্পষ্ট ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হোক, যেটা আইন, নিয়ম, বিধিবিধানকে মান্য করে চলবে। সেটা রাতারাতি হবে না, কিন্তু সেভাবেই পথচলা শুরু করা দরকার। সেদিক থেকে আশরাফুলের ভুল বা অপরাধের শাস্তি হবে সেটা স্বাভাবিক। তবে প্রথমত ব্যক্তি আশরাফুলের বেড়ে ওঠার সঙ্গে যুক্ত সকল প্রতিষ্ঠানের দায়ের কথা মাথায় রাখা উচিত এবং দ্বিতীয়ত তিনি যে সমাজে বেড়ে উঠেছেন তার নীতিনৈতিকতার বাস্তবতাও বিবেচনায় নিতে হবে। তাদের সামনে অহরহ যেসব সফল মানুষের দৃষ্টান্ত এ সমাজ তুলে ধরেছে তারা উন্নত নৈতিকতার কোন মানদণ্ড তুলে ধরেন নি। চারিদিকে ওরা দুর্নীতি, স্বজনতোষণ ও পক্ষপাত, চরম অবিচার ঘটে যেতে দেখেছে। আর বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদতেও দেখেছে তারা। অর্থাৎ সমাজ সবসময় ভুল বারতা দিয়েছে।
একই রকমের ইতিহাসের অংশীদার উপমহাদেশের অপর দুই দেশ পাকিস্তান ও ভারতের ক্রিকেটের দুর্নীতির চিত্র আরও ভয়াবহ। পাকিস্তানের তিন ক্রিকেটার সরাসরি আইসিসির মাধ্যমে ইংল্যাণ্ডে বিচার প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হওয়ায় কারাভোগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তার আগে তাদের একজন অধিনায়কও স্বদেশে জেল খেটেছেন, আজীবন নিষিদ্ধ হয়েছেন। ভারত-পাকিস্তানে বেশ কিছু খেলোয়াড় নানা মাত্রায় নিষিদ্ধ হওয়ার মত শাস্তি পেয়েছেন। কিন্তু তাতেও তাদের ক্রিকেটাঙ্গন পুরোপুরি অপরাধমুক্ত হতে পারে নি। ফলে বিচারের আওতায় খেলোয়াড় ছাড়াও সংগঠক, মালিক, বুকি, রেফারিসহ অনেকেই আসছেন।
সব সমাজেই অপরাধীরা ছিল, এখনও আছে। বর্তমান আধুনিক বিশ্বে ক্রীড়াজগতকে ঘিরে বিপুল অর্থের বাণিজ্য হয়। এর সাথে যুক্ত হয় ব্যক্তি খেলোয়াড়ের সাফল্য, গণমাধ্যমে তার ভাবমূর্তি, সামাজিক প্রতিষ্ঠা এবং অর্থবিত্তের বিষয়গুলো। অপরাধ জগতের ব্যক্তিদের কাছে সমাজের সফল মানুষদের আলাদা মূল্য আছে। তবে অন্যদের চাইতে খেলায়োড় ও চলচ্চিত্র জগতের নায়কদের (এবং নায়িকাদেরও) জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। আর তাৎক্ষণিক ফলাফল-নির্ভর বলে খেলাধূলায় জুয়া খেলার সুযোগটা বেশি। কোন কোন খেলায় কিছু মাত্রায় জুয়া বোধহয় সবসময় ছিল, ক্রিকেটে তা মাত্রা ছাড়িয়েছে ওয়ানডে আসার পর, আর তা মহামারীর রূপ নিয়েছে টিটুয়েন্টি টুর্নামেন্ট চালু হওয়ার পর থেকে।
টিটুয়েন্টি চালু রাখতে হলে আইসিসিকে সদস্য সংস্থাগুলোকে নিয়ে কঠোর বিধান তৈরি করতে হবে। খেলোয়াড়দের নীলাম বন্ধ করে পূর্ববর্তী বছরের পারফর্মেন্সের ওপর মূল্য নির্ধারিত হলেও টাকার পিছনে ছোটার প্রবণতা কিছু কমবে কারণ পারফর্মেন্স ঠিক থাকলেই মূল্য তথা অর্থপ্রাপ্তি ঠিক থাকবে। এছাড়া প্রত্যেক জাতীয় খেলোয়াড়ের দেখভাল করার জন্যে স্ব স্ব দেশের ক্রিকেট সংস্থাকে দায়িত্ব নিতে হবে।
তবে শিক্ষা, আর্থিক উন্নতি, প্রকৃত গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানবাধিকার নিশ্চিত করে যদি সমাজের সাধারণ নৈতিকতার মান উন্নত করা না যায় তবে বিচ্ছিন্নভাবে কোন একটি ক্ষেত্রে পরিস্থিতির চমকপ্রদ উন্নয়ন ঘটানো দুষ্কর হবে। ব্যক্তি অপরাধীর বিচার করা কঠিন নয়, কিন্তু সমাজকে ঠিক না করে তার সুবিচার করা বেশ মুষ্কিল। কারণ মানুষ তো সমাজেরই ফসল, সমাজের দোষক্রুটির বাহক সে। তাকে অপরাধপ্রবণ বাস্তবতায় রেখে সর্বোচ্চ নৈতিকতা আশা করা যায় না। তবে হ্যাঁ ব্যক্তির সমন্বয়েই গড়ে ওঠে সমাজ। তাই ব্যক্তিকে শুদ্ধ করার মাধ্যমেই সমাজকে রোগমুক্ত করতে হবে। তাতে ব্যাপকভিত্তিতে ফল পেতে চাইলে পরিবারে, শিক্ষায় এবং সকল প্রতিষ্ঠানে ও সংস্থায় প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সঠিক শিক্ষার সাথে সাথে দুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
আশরাফুল একজন ব্যক্তি, পরিণত বুদ্ধির মানুষ হওয়ার আগেই অপরিণত বয়সে খ্যাতিপ্রতিপত্তির জগতে এসেছেন। ক্রিকেটপাগল জাতির প্রথম নায়ক। তার খলনায়কোচিত কাজের আর্থসামাজিক যেসব কারণ আছে সেসব থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা ঠিক হবে না। যেসব কারণে আশরাফুল খলনায়ক হয়েছেন তা সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করলে সম্ভবত এই পরিচয়ে আচ্ছন্ন না হয়ে তার ভিতরকার হারিয়ে যেতে-বসা নায়ককেও খুঁজে পাওয়া যাবে। তার পক্ষে জোরালো প্রমাণ হবে তার সরল স্বীকারোক্তির সাহস। এতে সে নিশ্চয় সততা ও নৈতিকতা অনেকখানি ফিরে পেয়েছে। বাকিটুকু রয়েছে তার এককালের ভক্ত গুণগ্রাহীদের হাতে। তাঁরা এ ব্যাপারে মানবিক ও উদার হবেন নাকি কঠোর নৈতিকতার মানদণ্ড নিয়ে অনড় থাকবেন তার ওপর অনেকটা নির্ভর করছে আশরাফুলের ভবিষ্যত।