Tuesday, August 25, 2015

স্কুল শিক্ষা নিয়ে নতুন ভাবনার সময় এসেছে

আবুল মোমেন

দেশের সামগ্রিক শিক্ষাকে পরীক্ষামুখী মুখস্থবিদ্যার বৃত্ত থেকে কীভাবে বের করে প্রকৃত শিক্ষার বৃহৎ পরিসরে মুক্তি দেওয়া যায় সেটাই আজ শিক্ষামন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলের ভাবনার প্রধান বিষয় হওয়া উচিত। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে - অন্তত শিক্ষার ক্ষেত্রে - সংখ্যাগত দিকটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং তাতে নিঃসন্দেহে আমরা ভালো করেছি। প্রাথমিক পর্যায়ে মেয়েশিশুসহ প্রায় শতভাগ শিশুর স্কুলে ভর্তি হওয়াই একটা বড় অর্জন। মাধ্যমিক পর্যায়ে ঝরে পড়ার হার যথেষ্ট হলেও আমাদের গ্রামগঞ্জের বাস্তবতায় এটাকেও বড় অর্জন বলতে হবে। আর সব ছাত্রের জন্যে বছরের প্রথম দিনে উৎসবের মাধ্যমে বিনামূল্যে সব বই - প্রায় ৩২ কোটি বই - বিতরণ চমকপ্রদ এবং বিস্ময়কর সাফল্য।
২০১৫ তে এমডিজি শেষ হবে এবং তারপর শুরু হবে কৌশলগত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনের পর্ব। এই লক্ষ্য অর্জন আমাদের জন্যে কঠিন হয়ে পড়তে পারে যদি না গুণগত উন্নয়নের চ্যালেঞ্জগুলো সময়মত অনুধাবন করে এখনই যথাযথ পদক্ষেপের কথা ভাবা না হয়। আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর আন্তরিকতা ও সদিচ্ছা এবং যোগ্যতা নিয়ে কারো মনে প্রশ্ন নেই। তাঁর সাথে কথা বলে মনে হয়েছে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষাটি দেশের গ্রামগঞ্জের দরিদ্রমানুষের জন্যে  যাঁরা দেশের জনসংখ্যার গরিষ্ঠাংশ - সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার বিষয়ে ইতিবাচক প্রণোদনার কাজ করেছে। মনে হয় তাঁর পর্যবেক্ষণটি বাস্তবতারই প্রতিফলন। কিন্তু মাঠপর্যায়ে কাজ করে প্রথম থেকেই যারা এই পরীক্ষা প্রচলনের যৌক্তিকতা ও সার্থকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছি, এটাই তাদের প্রশ্নের সদুত্তর কিনা সে বিষয়ে এখনও আমি সংশয় প্রকাশ করব। এডুকেশন ওয়াচের গত ১৯ আগস্ট প্রকাশিত ২০১৪ সনের প্রতিবেদন আমার মত সকলের সংশয়কে যথেষ্ট শক্ত ভিত্তি দেয়। এটি নিয়ে ব্র্যাক-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরিটাস এবং প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে দেশের অগ্রগণ্য বিশেষজ্ঞ ড. মনজুর আহমদ, গত ১৯ আগস্ট ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারে যে নিবন্ধ লিখেছেন তা থেকে কয়েকটি পয়েন্ট তুলে ধরছি। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার মূল্যায়নভিত্তিক এই প্রতিবেদনে উল্লিখিত, ড. মনজুরের ভাষায়, কয়েকটি মূল লক্ষণীয় বক্তব্য হল - এ পরীক্ষা প্রবর্তনের ফলে ১. পরীক্ষাকেন্দ্রিক প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করার প্রবণতা উৎসাহিত হচ্ছে, ২. স্কুলের বাইরে প্রাইভেট পড়ার ওপর নির্ভরতা বাড়ছে, ৩. গাইডবই মূল পাঠ্যবইকে ছাপিয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে, ৪. ছাত্ররা নকল ও অনৈতিক আচরণে আকৃষ্ট হচ্ছে, ৫. এ পদ্ধতিতে শিক্ষার বৈষম্য বাড়ছে।
ওপরের পাঁচটি বক্তব্য নিয়ে বাস্তবতা সম্পর্কে ওয়াকেবহাল কারো মনে সংশয় থাকার কথা নয়। আর যদি আরেকটু গভীরে গিয়ে এ পর্যায়ে শিক্ষার হালচাল সম্পর্কে জানতে চাই তার জন্যে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদনই যথেষ্ট বলে মনে করি। সরকার কেন নিজেদেরই মাঠপর্যায়ের জরীপের প্রতিবেদন উপেক্ষা করছেন তা আমাদের বোধগম্য নয়। মোটের ওপর এ দুই প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে ড. মনজুর সমাপনী পরীক্ষার কারণেই সৃষ্ট প্রাথমিক শিক্ষার পাঁচটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় তুলে ধরেছেন । পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছে - এডুকেশন ওয়াচ -
১. পরীক্ষা কি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনের সুনির্দিষ্ট দক্ষতাগুলো পরিমাপ করতে পারে? প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণেই দেখা যাচ্ছে উচ্চ পাশের হারের বিপরীতে কেবল বাংলা ও গণিতে নির্দিষ্ট দক্ষতা অর্জনের হার মাত্র এক চতুর্থাংশ। বাকি তিন-চতুর্থাংশের অর্জন নানামাত্রায় অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রার নিচে। আমরা জানি তার মধ্যে বেশ বড় অংশের অবস্থা হতাশাজনক।
২. এতে কি শিক্ষাদান ও গ্রহণ প্রক্রিয়ার উন্নতি ঘটে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার মান বাড়ছে? না, এতে মুখস্থের প্রবণতা উৎসাহিত হচ্ছে, ছাত্রের বিষয় বোঝা ও সৃজনশীলতা এবং পাঠক্রমের মূল বিষয়গুলো অনুধাবন উপেক্ষিত হচ্ছে। তদুপরি চিন্তা ও যুক্তিচর্চা নিরুৎসাহিত হচ্ছে।
৩. এটা কি মানসম্পন্ন শিক্ষার আবশ্যিক উপাদান হিসেবে শ্রেণিকক্ষে ছাত্রের বুনিয়াদি মূল্যায়নের সহায়ক, সম্পূরক এবং এ প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করে? বুনিয়াদি মূল্যায়ন শিক্ষকের জন্যে প্রাত্যহিক কাজ যা সমাপনী পরীক্ষার মত সামষ্টিক চূড়ান্ত মূল্যায়নের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় সকলে মিলে এ পরীক্ষাটিকেই প্রাথমিক শিক্ষার এমন এক কেন্দ্রীয় নায়ক করে তোলা হয়েছে যাতে অত্যুৎসাহী অভিভাবক, কোচিং ব্যবসায়ী এবং অযাচিত হস্তক্ষেপে সিদ্ধ গণমাধ্যম (নিয়মিত প্রশ্নোত্তর ছাপিয়ে আর পরীক্ষাভিত্তিক প্রচারণার মাধ্যমে) মিলে প্রায় প্রথম শ্রেণি থেকেই যে কোনো পরীক্ষাতেই নব্বইয়ের ঘরে নম্বর পাওয়াকেই মোক্ষ বানিয়ে ছেড়েছে। বাস্তব অবস্থা জেনে সাক্ষ্য দিচ্ছি অভিভাবক-শিক্ষকরা মিলে ছাত্রদের শৈশব তছনছ করে দিচ্ছে।
৪. এটি কি শিক্ষাব্যবস্থায় সমতা বজায় রেখে মান অর্জনে অবদান রাখছে? সঙ্গত কারণেই যেসব অভিভাবক পাঁচসালা পরিকল্পনা নিয়ে (১ম-৫ম শ্রেণি) সন্তানদের মডেল টেস্টের মুখস্থবিদ্যায় পারঙ্গম করে তুলতে পারেন তারা বেশি ভালো করেছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অপেক্ষাকৃত গরিব ঘরের ছাত্ররা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।
৫. এটি কি শিশুদের জন্যে একটি উন্নয়নমুখী ও সহায়ক বাতাবরণ তৈরির গুরুত্বের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ? ম্যাজিক মান জিপিএ ৫ নিয়ে গণমাধ্যম, অভিভাবকসহ সমাজ, কোচিং ব্যবসায়ী শিক্ষকবৃন্দ মিলে যে প্রচারণার মায়াজাল সৃষ্টি করেছেন তাতে যে অধিকাংশ ছাত্র তুলনায় কম নাম্বার পায় তাদের কল্পনাতীত সামাজিক ও মানসিক দুর্দশা আড়ালে থেকে যায়। আমাদের নিষ্ঠুর অসংবেদনশীল গণমাধ্যম ও অভিভাবকসমাজ শিশুমনের ব্যথা-বেদনা, সংকোচ-সংবেদনার কোনো খবরই রাখে না, তোয়াক্কা করে না।
সকলেই জানেন প্রাথমিক পর্ব হচ্ছে শিশুর শিক্ষার - জীবনব্যাপী অব্যাহত শিক্ষাগ্রহণের - প্রস্তুতি কাল। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় - এ হল সংগ্রহ ও সঞ্চয়ের কাল। এটি কোনো কারণেই ছাত্রের কাছে ফল প্রত্যাশা করার সময় নয়। যা দেখার তা হল তার সংগ্রহ ও সঞ্চয়ের কাজটি বাধাহীনভাবে ঠিকঠাকমতো চলছে কি না, তার সংগ্রহ ও সঞ্চয়ের ভা-ার মানসম্পন্ন সম্ভারে সমৃদ্ধ হয়ে চলেছে কিনা। পরীক্ষা কেবল বাধা নয়, তার ভূমিকা মুখ্য ও প্রধান হয়ে উঠলে ছাত্রের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। সাধে কি মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন একে নাইটমেয়ার বা দুঃস্বপ্ন আখ্যা দিয়েছেন। আমাদের ব্যবস্থার গুণে এখন পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পাওয়াটাই শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। চতুর্থ শ্রেণির ছাত্ররা সাক্ষ্য দিচ্ছে কীভাবে বাবা-মা এবং কোচিং শিক্ষকরা জিপিএ ৫ পাওয়ার জন্যে তাদের ওপর শারীরিক-মানসিক লাঞ্ছনাসহ জুলুম চালায়। তাদের শৈশব হরণ করা হয়েছে। 
পরীক্ষা প্রকৃতিগতভাবে একটি প্রতিযোগিতা। জীবন প্রতিযোগিতাময় এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, এবং এর জন্যে প্রস্তুতির প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে মানবসমাজ গঠন এবং মানবসভ্যতার বিকাশে প্রতিযোগিতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ছিল সহযোগিতা। মানুষের অগ্রগতিকে পাখির উড্ডয়নের সাথে তুলনা করে বলা  যায় দুটি ডানার মত-ই সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতার ভূমিকা এখানে। কিন্তু কেবল প্রতিযোগিতার মানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠলে তাতে স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেষ, অসহিষ্ণুতার বীজ নিয়েই বড় হবে শিশু। আর বৃহত্তর সমাজবাস্তবতায় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে তার ভিতরে পরিপুষ্ট এসব বীজ শক্তি নিয়েই প্রকাশিত হবে। আমাদের সমাজে এটাই ঘটছে। মানবমনের এই গতিপ্রকৃতির সাথে শিক্ষার সংশ্লিষ্টতা বুঝতে হলে শিক্ষা ও মানবজীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে যে ধারণা থাকা প্রয়োজন, দুর্ভাগ্যের বিষয়, তা বাস্তবজীবনে জয়ী হওয়ার জন্যে মরিয়া ও মোহগ্রস্ত বিষয়বুদ্ধি-তাড়িত সমাজের নেই। অথচ হাতেনাতে এর প্রমাণ পাওয়া যায় উচ্চ শিক্ষার ভর্তি পরীক্ষার ফল বিপর্যয়ে। অধিকসংখ্যায় উত্তীর্ণ করাতে এবং উচ্চ শিক্ষায় আসন দিতে কেবলই মান নামানোর নির্দেশনা আসে। তাতে প্রাথমিক-মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরিসংখ্যান চমকপ্রদ দেখায়, কিন্তু মানবিচারের সময় ধরা পড়ে যায় ফাঁক ও ফাঁকি। এভাবে আমরা শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য অর্জন করতে পারব না এবং, আরও রূঢ় বাস্তবতা হল, দুর্নীতির মহামারিসহ সামাজিক অবক্ষয় ঠেকাতে পারব না, সকল প্রতিষ্ঠানের অধোগতি ও অকার্যকরতার অবসান হবে না।
টানা চল্লিশ বছর ধরে শিশুর শিক্ষা ও মানসবিকাশের কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি উত্তরোত্তর পরীক্ষার চাপ বাড়ছে, এবং গত কয়েক বছরে তা শিশু-নিপীড়নের মাত্রাছাড়া পর্যায়ে পৌঁছেছে। সকলকে সতর্ক করে বলব, এর ফল জাতির জন্যে ভালো হবে না। ধর্মান্ধতা, সন্ত্রাস ও মাদকের মত অভিশাপ বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ শৈশবে মানবিক বিকাশের উপযুক্ত রসদের ঘাটতি। আর সমাজে অসহিষ্ণুতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, ক্ষুদ্রতা, নিষ্ঠুরতা এবং শিশু-নারী-দরিদ্র ও  প্রান্তিকজনের প্রতি উপযুক্ত সংবেদনশীলতার অভাবের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা থেকে পরিত্রাণ দূরের কথা, তা আরও প্রকট হয়ে উঠবে। দুর্নীতি এবং অপরাধপ্রবণতা তো গলগ্রহের মত সঙ্গী হয়ে রয়েছে।
সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশেদেশে ইসলামি জঙ্গিদের উত্থান এবং তাদের হাতে মানবজাতির সাংস্কৃতিক সম্পদের যে বেহাল দশা হচ্ছে তার  প্রেক্ষাপটে গত এপ্রিলে প্যারিসে ইউনেস্কোর একটি বৈঠক হয়েছিল। আর তার আলোচনার পটভূমিতে গত ৩১ জুলাই ও ১ আগস্ট ইতালির সংস্কৃতি মন্ত্রীর আহ্বানে মিলান এক্সপো ২০১৫-র হল ঘরে বসেছিল ‘জনগণের মধ্যে সংলাপের উপকরণ হিসেবে সংস্কৃতি’ শীর্ষক সম্মেলন। তাতে বিশ্বের ৮৫টা দেশের সংস্কৃতিমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা যোগ দিয়েছিলেন। আমন্ত্রণপত্রেই গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে যে বর্তমান প্রেক্ষাপটে সংস্কৃতির ভূমিকা উত্তরোত্তর বাড়ছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ উপন্যাস শেষের কবিতায় লিখেছিলেন, কমলাহীরের পাথরটি হল বিদ্যা আর তা থেকে যে আলো ঠিকরে বেরোয় তা হল সংস্কৃতি। আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি পরীক্ষার আতিশয্য ও সামূহিক চাপে খোদ বিদ্যাই অনর্জিত থেকে যাচ্ছে, ফলে আজ শিক্ষিত (আদতে ডিগ্রিপ্রাপ্ত) মানুষের কর্ম ও চিন্তায় আলোর প্রকাশ ঘটে না।
আমরা আমাদের কাজ শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই আশির দশকের গোড়া থেকে স্কুল চালু করে, খানিকটা রবীন্দ্রনাথের ভাবনার অনুসারে, বলে এসেছি শিক্ষার সাথে সংস্কৃতিচর্চার সমন্বয় না হলে তা সার্থক হবে না। বলা প্রয়োজন, আমরা সংস্কৃতি বলতে গান-বাজনা-নাচ-নাট্য অর্থাৎ কেবল কলাচর্চার কথা বলি না, সংস্কৃতি শব্দটির ব্যাপ্ত ও পুঙ্খানুপঙ্খ তাৎপর্যসহ এর সমগ্রতায় ধরতে চাই। এভাবে চর্চা হলে শিশু সাহিত্যশিল্পে দক্ষতার পাশাপাশি সৃজনশীল প্রতিভা ও মানবিক গুণাবলী বিকাশের অবকাশ পাবে। আর শিশু সমৃদ্ধ মন নিয়ে বড় হলে তার প্রভাব সমাজে পড়বেই। তাতে দুর্নীতি, সন্ত্রাস, স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা, নিষ্ঠুরতার মত ক্ষুদ্রতা ও অমানবিকতার সংস্কৃতি ও গ্লানি থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব। শিক্ষা নিয়ে - অন্তত স্কুল শিক্ষা নিয়ে - আমাদের নতুনভাবে ভাবার সময় এসেছে।
                                                                                 ***

Sunday, August 23, 2015

ছাত্রসংগঠনের হাজারিবাগ শাখা কেন?

আবুল মোমেন

শেষ পর্যন্ত সরকার হার্ড লাইনেই গেল। দু’দিনে ছাত্রলীগ-যুবলীগের তিনজন ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেল।
বিচারবহির্ভূত হত্যা বা মৃত্যু সুস্থ মস্তিষ্কে সমর্থন করা যায় না। বোঝা যায় সরকারও আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার ওপর আস্থা রাখতে পারে নি। আশু সমাধানের বেআইনি মর্মান্তিক পথটিই গ্রহণ করল।
দেশে দু’ধরনের সংকটে এমন এক বিষচক্র তৈরি হয়েছে যা ভাঙা সম্ভব হচ্ছে না। পুলিশের দিক থেকে তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া পর্যন্ত একদিকে চলে দুর্নীতি আর অন্যদিকে দুর্নীতি ও অদক্ষতার যোগফল হিসেবে মামলা হয় দুর্বল। দ্বিতীয় সংকট হল, প্রথম সংকটটি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকায় অপরাধীরা মামলা বা আইনি প্রক্রিয়ায় কোনো না কোনো স্তরে প্রভাবিত করার সুযোগ তৈরি করে তা কাজে লাগায়। রাজনীতির অপরাধ-সংশ্লিষ্টতার সংস্কৃতি জোরদার হওয়ার পর থেকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রছায়ায় সংঘটিত কয়টি খুনের সুবিচার নিশ্চিত ও সম্পন্ন হয়েছে? খুনের সংখ্যা তো শয়ের ঘর ছাপিয়ে হাজারের কোঠায় পৌঁছেছে। এই বিচারহীনতার পুঞ্জিভূত পরিণতি নিয়ে আমরা কখনো গভীরভাবে ভাবি নি। বছরের পর বছর, দশকের পর দশক ধরে এমনটা হতে দিয়েছি। অবস্থা এমন হয়েছে যে সর্বোচ্চ আদালত থেকেও বলা হচ্ছে নিচের স্তরে যোগ্য বিচারকের অভাব রয়েছে, সুষ্ঠুভাবে রায় লেখার মত মানুষও কমে যাচ্ছেন। তেমনি দক্ষ আইনজীবীও সেভাবে তৈরি হচ্ছে না। সবটা মিলে সর্বত্র একটা ফাঁপা চাকচিক্যের আড়ালে আমরা আসল বিষয় হারিয়ে ফেলছি। দালানকোঠার বহর বাড়ছে, প্রযুক্তির আড়ম্বর ঘটছে, গাড়ি এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ের বৈভবও বৃদ্ধি পাচ্ছে, কিন্তু বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে চলেছে।
বিচারহীনতা থেকে বিচারবহির্ভূত ‘বিচারের’ ফাঁদ খুব দূরের কিছু নয়। যারা ক্রসফায়ারের শিকার হচ্ছে তারা এতটাই ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিল যে তার সীমা সম্পর্কে ধারণা হারিয়ে ফেলেছিল। ওদের এই ধারণাটা আপনা-আপনি হয় নি, তারা তো আস্কারা পেয়েই এভাবে চলে এসেছে অর্থাৎ তাদের এভাবে চলতে দেওয়া হয়েছে।  তাদের এই ভাবনাটাকে ভিত্তিহীন বলাও মুশকিল। কারণ সত্যিই তো বিচারহীনতা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা এবং সেইসূত্রে ক্ষমতা প্রয়োগ করে বিচারের আওতামুক্ত থাকার চক্রটি বহুদিন ধরেই কার্যকর রয়েছে। হঠাৎ যে সরকার তাদের ইনফর্মাল বাহুবল নিয়ে বিব্রতবোধ করবে বা সমালোচনা থেকে বাঁচার জন্যে এমন বেপরোয়া নির্মমভাবে তাদের শায়েস্তা করা হবে সেটা তারা ভাবতেই পারে নি।
সরকার তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বরং কিছুটা বাহবা নিতে চাইবে - দ্যাখ, আমরা কতটা ন্যায়নিষ্ঠ, নিজের দলের কেউ আইন ভাঙলে তাকেও ছাড়ি না। তবে ক্রসফায়ারে না দিয়েও অনেককে দল থেকে বহিষ্কার করে মামলায় গ্রেপ্তার করে, দীর্ঘমেয়াদে জেলে রেখে সরকারের বারতাটা পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু ক্ষমতা আর লোভ সত্যিই তো অন্ধ - এ হল অন্ধশক্তি। 
ক্রসফায়ারে নিহত ছাত্রলীগ নেতা আরজুর পরিচয় জেনে প্রথমেই প্রশ্ন করতে হয় - হাজারিবাগ থানা ছাত্রলীগ কমিটি থাকবে কেন? ছাত্রলীগ একটি ছাত্রসংগঠন, এর শাখা তো থাকবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ভিত্তিক হবে ছাত্র সংগঠনের শাখা। একটি কেন্দ্রীয় কমিটি থাকবে, তার অধীনে জেলা কমিটি এবং মহানগর কমিটি থাকবে। কিন্তু এলাকাভিত্তিক কমিটি কেন? এরকম কর্মক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্টতাহীন কমিটি হলে তাদের কাজ কী হবে? নির্দিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব না থাকায় এসব শাখায় ভাগ্যান্বেষী অছাত্র তরুণরা এসে ভীড় করবে। ক্ষমতাসীন দলের ক্ষেত্রে তো তাদের ভীড় ঠেকানো যাবে না। ছাত্র সংগঠনের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হলে এগুলোকে অবশ্যই শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যায়ল ও কলেজ-কেন্দ্রিক সংগঠন হতে হবে। তাতে নেতাদের ছাত্রত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সহজ হবে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, দেশে গণতান্ত্রিকব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের নির্বাচনগুলো বন্ধ হয়ে আছে। নির্বাচনহীনতার অর্থ গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি আর এর পরিণতি হল অসহিষ্ণুতা এবং ভিন্ন পথে নেতাদের ক্ষমতাবান হওয়ার ঝোঁক বাড়া। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংগঠনের দখলদারি এবং কায়েমি স্বার্থ প্রতিষ্ঠার কাজটি সম্পন্ন হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি - প্রধান দলগুলোর ক্ষেত্রে - মূলত ভর্তি বাণিজ্য, টেণ্ডারবাজি, নিরীহ ছাত্রদের শোষণ এবং একছত্র কায়েমি ক্ষমতার অন্যান্য অনুষঙ্গ অপতৎপরতার দূষণ ও বিকার সমাজদেহে ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ছাত্র রাজনীতি থেকে আপাতত জাতি কিছুই পায় না।
লক্ষ্যহীন, আদর্শহীন, উদ্দেশ্যহীন এবং সৎকর্মহীন নেতৃত্ব এবং রাজনীতি নানা ধরনের উৎপাত তৈরি করে। দোকানপাটে চাঁদাবাজি, তোলাবাজি, ছিনতাই রাহাজানি, অপহরণ ও মুক্তিপণ ইত্যাদি বলপ্রয়োগের ক্ষমতার চর্চা অপ্রতিহতভাবে চলছে। মানুষ এসব উৎপাতে এতটা অতিষ্ঠ হয়েছে যে ছাত্র-তরুণদের সম্পর্কে সমাজে নেতিবাচক মনোভাব প্রবল। এমনকি ক্রসফায়ার নিয়ে মানুষ বিচলিত নয়। সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগী পরিবার ব্যতীত কেউ মাথাই ঘামায় না। এই অবক্ষয় থেকে বেরুতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এলাকার দখলদারি বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে হবে। বর্তমান ধারার নেতৃত্ব ও কাঠামো থেকেও বেরিয়ে আসতে হবে।
এ জন্যে আমি প্রস্তাব করব - অন্তত এক বছরের জন্যে - ছাত্রসংগঠনগুলোর কার্যক্রম বন্ধ রাখা হোক, সকল কমিটিও ভেঙে দেওয়া হোক। ছাত্রদের রাজনৈতিক অধিকার ও রাজনীতি করার অধিকার বন্ধ হবে না। কিন্তু সংগঠন থাকবে না। এই এক বছরের মধ্যে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান - বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ - স্ব স্ব ছাত্রসংসদের নির্বাচন করবেন। এ নির্বাচনে ছাত্ররা সরাসরি অংশ নেবে, তারা অনানুষ্ঠানিকভাবে প্যানেল তৈরি করতে পারবে। কিন্তু কেবলমাত্র নিয়মিত ছাত্ররাই এতে অংশ নিতে পারবে। একবার এম. এ. পাশ করে আবার অন্য বিষয়ে ভর্তি হলেও তারা নির্বাচনের যোগ্য হবে না। এভাবে প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান প্রচারণা, প্রার্থী নির্বাচন, ভোট, নির্বাচন পদ্ধতি ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে নিয়মাবলী নির্ধারণ করে নেবেন।
আমার ধারণা একবার ছাত্রসংসদের নির্বাচন চালু হলে, প্রথম দু’একবার যদি কিছু কিছু সমস্যা হয়ও, আখেরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ভালো ছাত্র, যোগ্য প্রার্থীদের সামনে আনতে চাইবে সাধারণ ছাত্ররা। অছাত্র, চাঁদাবাজ, দখলদার, অস্ত্রবাজ, মাস্তান, ধর্ষকদের হাত থেকে শিক্ষা, রাজনীতি, ছাত্রসমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জনগণ এবং দেশ ও সমাজকে রক্ষা করার এটাই পথ। সাধারণ ছাত্ররা তাদের মনোবল ফিরে পাবে, নিজেদের সংঘবদ্ধ শক্তির চমকপ্রদ প্রকাশ দেখে উৎসাহিত হবে। পাশাপাশি বিতর্কিত ব্যক্তিরা দখলদার হিসেবে বিতাড়িত হবে।
রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়ে সংলাপে বসতে পারেন। তার আগে জাতীয় সংলাপও হতে পারে । সংসদেও বিষয়টি আলোচিত হওয়া সম্ভব। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই যা চলছে তা আর চলতে দেওয়া উচিত নয়। কে কোন স্বার্থে কোন এলাকায় নিজে নিজে ক্ষমতাসীন দলের কোনো অঙ্গ সংগঠনের শাখা খুলে নিজেই সভাপতি পদ গ্রহণ করে নিজের কোন স্বার্থ হাসিল করবে তা না পারবে বুঝতে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, না তাদের সরকার। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেছেন, ছাত্রলীগে শিবির এবং আওয়ামী লীগে জামায়াতের লোকজন ঢুকে পড়ছে। ঢুকে পড়বেই তো। যদি সংঠনের নাম এবং গণতন্ত্র ও আদর্শ উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোনো কাজ না থাকে তাহলে নেতাদের একমাত্র কাজ তো হবে নিজের অর্থবিত্ত, ক্ষমতাবৃদ্ধি আর সে ক্ষমতার রোয়াব দেখিয়ে আশেপাশের সবাইকে দাবিয়ে রাখা। 
এখন একাজই তো করছে অঙ্গ সংগঠনগুলো। তার মধ্যে ছাত্রলীগ-যুবলীগ তাদের তারুণ্যের কারণে রাখঢাক করে কাজটা সারতে পারছে না। খোদ সরকারের জন্যে কেউ কেউ আপদ-বালাই হয়ে উঠছে। কিন্তু সে বালাই ক্রসফায়ারে দূর করার ব্যবস্থাটি সুবুদ্ধির বা দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করছে না।  এটিকে বলব, সকল বিকল্পের মধ্যে নিকৃষ্ট বিকল্প। কারণ বিচারহীনতার পুঞ্জিভূত সংস্কৃতি আজ আমাদের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে সংস্কৃতিতে নিয়ে আসছে। এরপরের স্তরটি হল জায়গায় জায়গায় মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেবে, যেমনটা সেদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নরসিংদিতে ডাকাত সন্দেহে মোট ছয়জনকে পিটিয়ে খুন করা হল। 
তার পরের ধাপটি হল কাউকে প্রতিপক্ষ মনে হলেই ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পিতভাবে সন্দেহভাজন বানিয়ে গণপিটুনির ব্যবস্থা করা। আমরা বিচারহীনতা ও বিচার বহির্ভূত ক্ষমতার বহুমুখী কুফলও এ সমাজে দেখছি। দুর্নীতি সাথে এই অপরাধপ্রবণতা পাল্লা দিয়ে চলতে থাকলে কোথায় গিয়ে থামব আমরা? তাই আশু পরিবর্তন চাই। প্রথমে ছাত্র সংগঠন থেকেই শুরু হোক। এখানে শৃঙ্খলা ফেরোনো হলে অন্য সব অঙ্গ সংগঠনেও ফেরানো সহজ হবে। বিষয়টা ভাবতে হবে। 
শেষে আবারও বলব, ছাত্রসংগঠনের আবার হাজারিবাগ শাখা কেন?

***

Saturday, August 15, 2015

শূন্যতায় তুমি শোকসভা

আবুল মোমেন


আজকের দিনটি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে বিশেষভাবে স্মরণ করার দিন। ১৯৭৫ সালের এইদিনে ঘাতকদল তাঁকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। তারপর থেকে বাংলাদেশ যেন এক অভিভাবকহীন পরিবার - ছন্নছাড়া, দিগভ্রান্ত।
একাত্তরের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সশস্ত্র আক্রমণ চালালে বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়। সে রাতেই বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে, কিন্তু তাঁরই নেতৃত্বে, মুক্তিযুদ্ধ চলেছিল। পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুদণ্ডের হুমকির মধ্যে তিনি প্রিয় দেশ ও দেশবাসীর কাছ থেকে শারীরিকভাবে অনেক দূরে ছিলেন।
সেদিন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতি সত্ত্বেও তাঁর সহকর্মীদের যোগ্য নেতৃত্ব ও ভারতের সহায়ক সরকারের সহযোগিতায় আমরা অত্যন্ত কঠিন সেই অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম গৌরবের সঙ্গে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।
একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যা সম্ভব হয়েছিল পঁচাত্তরে তাঁর মৃত্যুর পরে তা সম্ভব হয়নি। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, কেন? একাত্তরে তাকে ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল, সেটাই কি কারণ? একাত্তরে তাঁর পক্ষে যোগ্য নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মানুষ ছিলেন, যেমন তাজউদ্দিন আহমদসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ, সেটাই কি কারণ? এ দুটি কারণই সত্য বলে মনে হয়।
কিন্তু তারও চেয়ে সত্য তৃতীয় একটি কারণ। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড কেবল বঙ্গবন্ধু বা তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি অপরাধ ছিল না; এ ছিল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অংশ; খন্দকার মুশতাক এই ষড়যন্ত্রের একজন অংশীদার, বাংলাদেশের ইতিহাসের দ্বিতীয় মীর জাফর।
পটপরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে বায়ান্নো থেকে বিপুল ত্যাগ ও দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে জাতির অর্জিত আদর্শ ও মূলনীতিগুলো বিসর্জন এবং অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক আধুনিক বাংলাদেশের স্বপ্ন তছনছ করে দিয়ে প্রত্যাখ্যাত পাকিস্তানি ধারার ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা ও ধর্মান্ধ  চিন্তাচেতনা ও সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করে। কেবল তা-ই নয়, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল, প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সংস্কৃতিকর্মীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ নির্যাতনও  চালায়। এরই ধারাবাহিকতায় জেনারেল জিয়া সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে মুসলিম ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার প্রাধান্য দিতে শুরু করেন। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী এবং ধর্মান্ধ দলসমূহকে রাজনৈতিকভাবে পুনরুজ্জীবিত ও সেসব দলের নেতৃবৃন্দকে সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করেন। জিয়ার পরে এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আর সংবিধানে ধর্মীয় পরিচয় লাগিয়ে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক চেহারা পাল্টে দিলেন। নব্বইয়ের পরে ক্ষমতায় এসে বেগম জিয়া একই ধারাই অব্যাহত রাখেন।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত দীর্ঘ দু-দশক ধরে বঙ্গবন্ধুর নাম গণমাধ্যমে, পাঠ্যবই ও অন্যান্য প্রচারণা থেকে মুছে দেওয়া হয়, তাঁর ৭ মার্চের ভাষণ নিষিদ্ধ থাকে। অন্যান্য জাতীয় নেতাদের কথাও অনুচ্চারিত থেকে যায়। ফলে এ সময়ে দেশে নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়, যারা এ দেশের প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারেনি। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দিন বা মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভূমিকা তা ঠিকভাবে জানতে পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধে ও স্বাধীনতা অর্জনে কারা ছিল বন্ধুরাষ্ট্র, এ সময় ভারত-সোভিয়েতের ভূমিকা ইত্যাদিও জানা হয়নি তাদের। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচয়, ভূমিকা এবং বিপরীতে রাজাকার-আলবদর ও অন্যান্য দালালদের কী ভূমিকা তা-ও ঠিকভাবে জানানো হয়নি। চীন, সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক ভূমিকার কথাও তারা জানতে পারেনি।
ফলে কুড়ি বছরের বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারের মাধ্যমে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে মানুষের মনে বিভ্রান্তি এবং বিতর্কের জন্ম দেওয়া সম্ভব হয়েছে। আজও আমরা এই বিভ্রান্তি ও বিতর্কের জের টানছি, এবং তার খেসারত দিয়ে যাচ্ছি। এ যেন সত্যিকারের অভিভাবকহীন এক ছন্নছাড়া পরিবারের দিগভ্রান্ত পদচারণা চলছে।
পরিস্থিতি আজ এ রকম যে, একজন দেশদ্রোহী ও যুদ্ধাপরাধীর সঙ্গে সরকার পরিচালনার ব্যর্থতাকে গুলিয়ে ফেলছি আমরা। অপরাধের সঙ্গে অপারগতাকে এক করে ফেলছি। চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতাকে এক কাতারে রাখছি।
আমরা জানি, স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন, এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, নবগঠিত অনভিজ্ঞ সরকার ও প্রশাসন পরিচালনার মতো দুরূহ কাজ করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে একদিকে দেশের অভ্যন্তরে ওঁত পেতে থাকা পরাজিত শক্তির এদেশীয় দোসরদের চক্রান্ত এবং অন্যদিকে অতি-উৎসাহী উচ্চাভিলাষী মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতাও মোকাবিলা করতে হয়েছে। আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরাজিত পাকিস্তান, তার বন্ধুরাষ্ট্র চীন ও সমর্থক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহ মিলে বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল বাংলাদেশকে বিপদগ্রস্ত করার  চেষ্টা করে গেছে। এদেরই অপতৎপরতার ফলে ১৯৭৪-এ দুর্ভিক্ষ হয়েছে, গোলাম আজমগং প্রশ্রয় পেয়েছে ও জামায়াতসহ অসংখ্য ধর্মান্ধ দল শক্তি সঞ্চয় করেছে। এভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক-সামাজিক জীবনে অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা এবং ক্রমে চরম মনোভাবের এক বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। আজকের দিনে বাংলাদেশের এই অস্থির বর্তমান ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে আমরা যে অভাব প্রতিদিন অনুভব করি তা হল একজন যোগ্য নেতার, একজন যথার্থ অভিভাবকের। আর তখন স্বভাবতই মনে পড়ে যায় বঙ্গবন্ধুর কথা। মনে পড়ে যায় কীভাবে ইতিহাসের উজান বেয়ে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এ দেশের মানুষের নয়নমণি, একমাত্র নেতা, পরম নির্ভর অভিভাবক।
তাই বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েই তার আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করতে হবে। মৃত্যুদিবসে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করব জাতির এই চরম সংকটকালে তাঁর কন্যা একজন যোগ্য উত্তরসূরি রাজনৈতিক নেতাই ও রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ওঠেন সেই প্রার্থনা জানিয়ে।
২০০৯ সনে জাতীয় সংসদে বিপুল আসনে বিজয়ী হয়ে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। আমরা লক্ষ করছি শেখ হাসিনা এবারে ক্ষমতায় এসে দেশকে পঁচাত্তর-পরবর্তী পিছুটান থেকে উদ্ধারের ব্রত নিয়েছেন। সত্যি বলতে কি এখন কাজটা বঙ্গবন্ধুর আমলের চেয়েও কঠিন। তখন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থানের কাল, বাঙালির ঐক্য গঠনের কাল। আজ বিশ্বায়ন আর বাজার অর্থনীতির চাপ একদিকে আর অন্যদিকে ধর্মান্ধ জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। কঠিন এই পথ থেকে অবশ্য সরতে রাজি নন বঙ্গবন্ধু-কন্যা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারসহ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া, এসডিজি পূরণ করে এমডিজি পূরণে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা তিনি বজায় রেখেছেন। তবুও বর্তমান আওয়ামী লীগের পক্ষে আগের মত একাট্টা হয়ে আদর্শ ও কর্মসূচি বাস্তবায়নে আন্তরিক থাকা সম্ভব হচ্ছে না। দলের ভিতর থেকেই নানা সংকট তৈরি হচ্ছে, বাইরের সংকট তো আছেই।
তবুও মনে হয় পঁচাত্তরের পিছুটান কাটানোর এটাই শেষ সুযোগ। ফলে শেখ হাসিনাকে সফল হতেই হবে। আর সে পথে বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে সবচেয়ে বড় যে শিক্ষা নিতে পারেন তা হল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা। আজকে দেশে তরুণের সংখ্যা জনসংখ্যার অর্ধেক তারা কোনো দল করে না, আর অর্ধেক যে নারী তারাও অধিকাংশ দলভুক্ত নয়। ফলে ঐক্যের সঠিক বাতাবরণ তৈরি হলে যারা স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী রাজনীতি করছে তারা আবারও একাত্তরের মত জনবিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্রগোষ্ঠীতে পরিণত হবে।

***


Wednesday, August 12, 2015

রাজন রাকিব রবিউল আর হন্তারক সমাজ

আবুল মোমেন

রাজন, রাকিব, রবিউল - তিনটি শিশুরই নামের অদ্যাক্ষর -র। প্রথম জনের খুঁটিতে বাঁধা করুণ কাতর চাহনির মর্মান্তিক ছবিটি মন থেকে তাড়ানো সম্ভব নয়। রাজন আর রাকিবের ছবি দেখেছি, রবিউলের মুখটা অদেখা হলেও কল্পনা করে নিতে পারি। পত্রিকায় মুদ্রিত রাজন-রাকিবের চেহারা দুটি বড় মায়াবী, বড়ই নিষ্পাপ কমনীয়তায় পবিত্র। ভাবি বয়সোচিত দুষ্টুমির সময় কেমন প্রাণবন্ত দেখাত ছেলেদুটিকে। প্রাণচাঞ্চল্য তো এ বয়সেরই ধর্ম। রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের সূত্রে দুষ্টুছেলে ফটিকের সাথে আমরা গভীরভাবে পরিচিত। ফটিক, বলাই, আশু - তাঁর এসব বালক চরিত্রের কাকে ছেড়ে কার কথা ভাবি। এই নিষ্কলুষ বালকেরা সকলেই যেন ছিল এই কলুষ-তামস-ভারাক্রান্ত জগতে অতিথিমাত্র। বড়দের নিষ্ঠুরতায় অকালে ছুটি হয়ে গেছে রাজন, রাকিব, রবিউলের। তবে এ ছুটি ফটিক বা বলাইয়ের পথে হয় নি।
গল্পে বালক দুটির মৃত্যুর পেছনে সমাজ এবং সংসারের উপেক্ষা আর অবহেলা-অনাদরের ভূমিকাই মুখ্য। গিন্নি গল্পে অবোধ নিষ্পাপ প্রাণচঞ্চল বালক আশুর প্রতি সমাজের অভিভাবকদের নিষ্ঠুর পীড়নের দৃষ্টান্ত পাই। এ সমাজে বালক বয়সের দুরবস্থার কথা রবীন্দ্রনাথ সরাসরিই বলেছেন। হঠাৎ শরীরে বেড়ে ওঠে তারা, গলার স্বর পাল্টাতে শুরু করে - ছোটর দলেও পড়ে না বড়র দলেও মানায় না। এদিকে শরীরের অভ্যন্তরে তো হরমোনের রূপান্তর ঘটতে থাকে। বালক শৈশব ছাপিয়ে পৌঁছে যায় বয়:সন্ধিতে। স্বয়ং সন্ত অগাস্টিন তাঁর স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন কী এক অজানা তাড়নার অস্থিরতায় কতই না ভুগেছেন তখন। বাধ্য হয়ে নিজেকে সংযত করতে কত কা-ই না তাঁকে করতে হয়েছে। রুশ ভাষার শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক তলস্তোয়ের নামের আগে ঋষি অভিধা প্রয়োগ করা হয়। ঋষি তলস্তোয় তাঁর বালক বয়সের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বয়:সন্ধির তাড়নায় কীসব অপকীর্তি ঘটাতেন সেসব কথা অকপটেই লিখে গেছেন। বালকমাত্রই অনুসন্ধিৎসু, কৌতূহল তার বয়সোচিত স্বভাবধর্ম। বিধাতা তাকে এভাবে তৈরি করেছেন বলেই সে কিছু অনাসৃষ্টি ঘটিয়ে তবেই সৃষ্টির অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। মার্কিন কথাসাহিত্যিক মার্ক টোয়েন ডানপিটে দূর্ধর্ষ হাকল্কে সাহিত্যে অমর করে গেছেন। সাহিত্যে ডানপিটেদের রাজা হল অলিভার - হতদরিদ্র পরিবারের রাস্তায় বেড়ে ওঠা ছেলে অলিভার টুইস্ট। এসবই বাস্তব থেকে নেওয়া চরিত্র।
বড়রা চিরকালই ছোটদের দুষ্টুমির জন্যে একটু-আধটু শাসন করতেন, তাঁদের এই অধিকার সবাই মেনেই নেয়, এ নিয়ে বালকরাও বিশেষ মাথা ঘামায় না। শিশুদের - মনে রাখতে হবে বালকরাও শিশু - শারীরিক শাস্তি দেওয়া বা অপমানসূচক তিরস্কার করা তাদের মানসিক  (অনেক ক্ষেত্রে শারীরিকও) স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে এবং তা মাত্রা ছাড়ালে ক্ষতি গভীর, এমনকি স্থায়ীও হতে পারে। তাই আধুনিক কালে শিশুদের প্রতি এ ধরনের শাস্তিমূলক আচরণকে দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষণা করা হয়েছে।
কিন্তু সমাজমানস সহজে পাল্টায় না। বাবা-মা, শিক্ষক এবং দুর্ভাগা শিশু শ্রমজীবীদের নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে মনিবগণের দিক থেকে শিশুর অপরাধের জন্যে শাস্তিই - যা প্রায় ক্ষেত্রে চরম অপমানসূচক তিরস্কার দিয়ে শুরু হয়ে তাতেও গায়ের ও মনের ঝাল না মিটলে পিটুনির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয় - বরাদ্দ এ সমাজে। এ যেন সমাজ-সংস্কৃতির অচ্ছেদ্য ঐতিহ! শুনেছি প্রায় সব স্কুলেই মার অব্যাহত রয়েছে, পরিবারেও প্রহার-সংস্কৃতির প্রতাপ থামে নি।
রাজন, রাকিব বা রবিউলের ওপর প্রযুক্ত শাস্তি কোনো ব্যক্তি রাগের মাথায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আকস্মিকভাবে ঘটান নি। তিন ক্ষেত্রেই শাস্তি দেওয়া হয়েছে পরিকল্পিতভাবে, অনেকক্ষণ সময় নিয়ে এবং মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত। মনস্তাত্ত্বিক হয়ত বলবেন, ক্রোধের সাথে অহঙের যোগে এসব মাত্রাছাড়া নৃশংসতা ঘটছে। হত্যাকারীরা এই শিশুগুলোর ওপর চরম নির্যাতন চালিয়ে তিলেতিলে অসীম যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে খুন করেছে। তাদের কৃতকর্মে এও বোঝা যায় যে এই পৈশাচিকতা তারা উপভোগ করেছিল। হত্যার মূল অভিপ্রায় হয়ত একজনেরই ছিল, কিন্তু অপরাধীর শাস্তি বিধানে ‘দায়িত্বশীল’ আরও ‘অভিভাবক’ প্রতিটি ঘটনাতেই স্বত:প্রণোদিত হয়ে জুটে গিয়েছিল। ফলে বোঝা যায় এ সমাজে নিষ্ঠুরতা, অপরাধপ্রবণতা এবং বিবেকহীনতার এক মারাত্মক অমানবিক সংস্কৃতি বহমান রয়েছে। এসব ঘটনা এমনি ঘটছে না, আমাদের প্রশ্রয়ে, আমাদেরই সাহচর্যে-সহযোগিতায়, সবার সমন্বিত যোগসাজশে একাত্তরের বীর বাঙালির অপমৃত্যু ঘটিয়েছি আমরা। কারণ প্রকৃত কাপুরুষই পারে শিশুর ওপর নিষ্ঠুর প্রতিশোধ চরিতার্থ করতে। আজ শিশু-নারী, আদিবাসী, দরিদ্র, দুর্বলমাত্রই এ সমাজে সবলের শাসন-শোষণের শিকার হচ্ছে। আমরা সমাজ হিসেবেই মনুষ্যত্বের গভীর সংকটে তলিয়ে যাচ্ছি।
বিচারহীনতা ও অপরাধীর শাস্তি না হওয়ার একটা পরিণতি এক্ষেত্রে অবশ্যই যুক্ত হচ্ছে। রাজন, রাকিব, রবিউলদের হত্যাকারীদের বিচার ও কঠিন শাস্তি অবশ্যই হতে হবে। এটি রাষ্ট্রের করণীয়। রাষ্ট্র অবশ্য সমাজেরই সৃষ্টি এবং তারই প্রতিফলন মাত্র। ফলে বিবেকহীনতা ও অপরাধের সাথে সহবাস এরও মজ্জাগত রোগ।
সমাজে পচন ব্যাপক ও গভীর সে কথা আমরা সকলেই জানি। তবুও একদম বসে পড়ছে না তার কারণ দুটি - এত কিছুর মধ্যেও শুভবোধসম্পন্ন মানুষ, তা যত অঙ্গুলিমেয়ই হোক, সমাজে টিকে আছেন। তাঁরা সংখ্যালঘু হলেও বিবেকের কণ্ঠস্বর ও সচ্চরিত্রের মহিমা কাপুরুষ বিবেকহীনদের কিছুটা হলেও দমাতে পারে। দ্বিতীয় কারণ হল, এ সমাজে তথাকথিত বিবেকহীন অভিভাবকদের চেয়ে ভুক্তভোগী রাজন-রাকিব-রবিউলরাই সংখ্যায় বেশি। তাদের চেয়ে একটু বড় বালক ও তরুণরাও সমাজে বিবেকহীনদের চেয়ে বেশি পরিমাণেই রয়েছে। নষ্ট সমাজ এদের পীড়ন করলেও এবং বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট করার সব আয়োজন চালিয়ে গেলেও, মনে হয়, প্রাণশক্তিতে ভরপুর সজীব প্রাণ এত সহজে পরাজিত হয় না।
আজ প্রয়োজন শুভশক্তির কাছ থেকে সমাজের শুভবোধকে জাগানোর জন্যে নিরন্তর উচ্চারণ এবং ধারাবাহিক কাজ। সে কাজের শ্রেষ্ঠ উপায় হল বালক-বালিকা, তরুণ-তরুণীদের সাথে সেতুবন্ধন রচনা। অর্থাৎ তাদের সাথে কথা বলার অসংখ্য সুযোগ তৈরি করা এবং তা অব্যাহত রাখা। এ কাজে বাহন হতে পারে শিল্পকলা ও সংস্কৃতিচর্চা। ধরা যাক, পাঠচক্র তৈরি করলেন বড়রা, তাতে সেরা সাহিত্যের সাথে লিঙ্গ-নির্বিশেষে শিশু-কিশোর-বালকদের পরিচয় ঘটানো হবে। তাদের পরিচয় ঘটাতে হবে জীবনের বিচিত্র সব সম্ভারের সাথে। বুঝতে হবে জীবন কেবল সংগ্রাম এবং যাপনের বিষয় নয়, নয়  কেবল ভোগ ও প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার মঞ্চ, এ হল উপভোগ এবং উদযাপনের  ক্ষেত্র। উপভোগ করতে হলে সে কেবল নিষ্ক্রিয় শ্রোতা বা পাঠক থাকলেও হবে না, তাতে কিছু উপকার নিশ্চয় হবে, কিন্তু সবচেয়ে ফলপ্রসূ পথ হচ্ছে শিশুরা যদি সক্রিয় অংশীদার হয়ে চর্চা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জীবনকে উপভোগ ও উদযাপন করতে শেখে। তাই প্রয়োজন সাহিত্য পাঠকে অগ্রাধিকার দিয়ে আবৃত্তি, নাটক, গান, নাচ ইত্যাদি যার যার সামর্থ্য ও অভিরুচি অনুযায়ী চর্চার সুযোগ করে দেওয়া। এতেও শেষ নয়, কারণ বড়দের ভুলে গেলে চলবে না, শৈশব-কৈশোরে তাঁদের মনেও ছিল অফুরন্ত বিস্ময়বোধ - যা সামান্যের ছোঁয়ায় সাড়া দিতে সক্ষম, ছিল অসীম কৌতূহল - যা তুচ্ছকেও জানতে চায়। আর এ বয়সে নগণ্যের মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পায় শিশু। সে ভালোবাসে অভিযান, রোমাঞ্চ এবং নানা রকম চ্যালেঞ্জ। ফলে কেবল ঘরবন্দী জীবন তার নয়। প্রাসঙ্গিক হতে পারে ভেবে জানাই, একবার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা আমাকে বলেছিল - মানুষ আসলে অন্যান্য প্রাণীদের মতই বহিরঙ্গন (ওরা বলেছিল আউটডোর) প্রাণী, ভুল করে ঘরে ঢুকে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন বিশ্বপ্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে বিশ্বশিশুর নিত্য খেলা চলে। ‘আবরণ’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি শৈশবে দিগম্বর শিশুকে ধূলোবালিতে ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। কবির দু:সাহস অনেক, লিখেছেন সাত বছর পর্যন্ত পোশাকের বালাই দিয়ে ওকে কষ্ট না দিলেও চলে। হায়, যেদেশে দু-তিন বছরের শিশুকন্যাও ধর্ষিতা হয় সেখানে এ সৎসাহস কবে বিদায় নিয়েছে, কবি কীভাবে বুঝবেন!
সমাজের অঙ্গনে আমাদের অনেক কাজ। নারীদের মধ্যেও শিশু উৎপীড়ক ও নির্যাতক বেড়ে চললেও মূলত পুরুষ সম্প্রদায়ের মধ্যে সত্যিকারে পৌরুষের অভাব থেকেই সমস্যা বাড়ছে। সৎসাহস হারিয়ে কে-ই বা পুরুষ থাকতে পারে? রবীন্দ্রনাথ অবিস্মরণীয় বাঙালি বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলেছিলেন, তাঁর চরিত্রের প্রধান গৌরব ‘তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব’।
হ্যাঁ অজেয় পৌরুষ ও অক্ষয় মনুষ্যত্বের সাধনাই করতে হবে - নারীমাত্র দর্শনেই যে পৌরুষ লালসা কাতর হয়, অন্যের আত্মসম্মানবোধে যে মনুষ্যত্ব ক্ষয় পায় তার হাত থেকে সমাজকে উদ্ধার করতে হবে।
এ কাজে প্রথমে আমাদেরই দোষ স্বীকার করতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে রাজন-রাকিব-রবিউল কিংবা ত্বকীদের অপমৃত্যুর দায় সমাজের অংশ হিসেবে আমরা কেউ এড়াতে পারি না। আমরা সকলেই শিশুহত্যার অংশীদার! ব্যক্তি পর্যায়ে এই উপলব্ধি ঘটলে পরিবর্তনের কাজ কিছুটা সহজ হবে। কাজ হতে হবে দুই ক্ষেত্রে - পরিবারে এবং স্কুলে। আপাতত এক্ষুনি সরকার স্কুলে স্কুলে মূল শিক্ষাক্রমের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক শিক্ষা চালু করে দিতে পারেন।
সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা ও সাংস্কৃতিক পাঠ নিয়ে সত্তর বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রইল। এখন এ মুহূর্তে চাই রাজন-রাকিব-রবিউলসহ গত সাড়ে তিন বছরে যে প্রায় এক হাজার শিশুহত্যার ঘটনা ঘটেছে এ সম্পর্কে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হোক, প্রত্যেকটি মামলা পরিচালনার দায়িত্ব রাষ্ট্র নিক এবং দ্রুতবিচার আইনে অভিযুক্তদের অপরাধ প্রমাণ ও শাস্তির বিধান করা হোক।

***

Sunday, August 2, 2015

ছাত্রলীগের সম্মেলনের সূত্রে

আবুল মোমেন
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের দু’দিনব্যাপী জাতীয় সম্মেলন গতকাল (২৬ জুলাই) শেষ হয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেবল প্রধান অতিথি হিসেবে ছাত্রসংগঠনের এ সম্মেলন উদ্বোধন করেন নি, বক্তৃতায় সংগঠনটির অভিভাবক হিসেবে দায় ও দায়িত্ব নিয়ে কথা বলেছেন। আমরা জানি জিয়াউর রহমান প্রবর্তিত নিয়ম অনুযায়ী সব ছাত্র সংগঠনই কোনো-না-কোনো রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন। এই বিধানের অনেক সমালোচনা থাকলেও দেশের আরও কয়েকটি খারাপ বিধানের মত স্বৈরাচার-প্রণীত এ বিধানটিও রয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগ করেছেন এবং প্রাক্তনী হিসেবে তাঁর পক্ষপাত থাকাও স্বাভাবিক। কিন্তু মুশকিল হল তিনি প্রধানমন্ত্রী, দলমত-নির্বিশেষে সবার প্রতি - অবশ্যই অপরাধী বা দেশদ্রোহী ব্যতীত - তাঁর আচরণ ও ভূমিকায় সমতাই কাম্য। এমন উন্নত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিচয় আমরা কি কোনো পর্যায় থেকেই কখনোই পাব না?
আরও মুশকিল হল প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী এবং ছাত্রলীগের সভাপতি ও অন্যান্য নেতার বক্তৃতায় অতীতের সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র ছাত্রলীগের গৌরবময় ভূমিকার কথাই  বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। প্রত্যেকের বাগ্মিতার নানা পর্যায়ে এ মনোভাবই ফুটে উঠেছে।
এ প্রসঙ্গে দুটি কথা বলা যায়। প্রথমত, ঐতিহাসিকভাবে কথাটা সত্য নয়; দ্বিতীয়ত, তাই যদি সত্য হবে তবে ছাত্রলীগের এই একলা চলোরে নীতি কি সমর্থনযোগ্য? পঞ্চাশের দশক থেকেই গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে আরও বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠন মাঠে সক্রিয় ছিল। কখনও তাদের সমর্থকের সংখ্যাগত আয়তন ছাত্রলীগকে ছাপিয়েছে, তারও চেয়ে বড় কথা দীর্ঘদিন এমন বেশ কয়েকটি সংগঠনের সাথে ছাত্রলীগ কাঁধ মিলিয়ে কাজও করেছে। এসব কথা অস্বীকৃত হলে, অনুচ্চারিত থাকলে এখনকার ছাত্র-তরুণরা ভুল বারতা পাবে, আর এখনকার ছাত্রলীগ কর্মীরা নিজেদের এককভাবে সফল গৌরবের অধিকারী ভাববে। বর্তমান বাস্তবতায় এটা ক্ষমতার নানা বিকারে আক্রান্ত ছাত্রলীগের জন্যে যথাযথ পথনির্দেশক বক্তব্য হয়েছে বলে মনে করা কঠিন।
বাংলাদেশের রাজনীতির - এমনকি গণতান্ত্রিক রাজনীতিরও - যেসব দুর্বলতা ও মন্দ দিক আছে তার মধ্যে কয়েকটি বরাবর প্রকটভাবেই ধরা পড়ে। নিজের দল সম্পর্কে ফাঁপিয়ে বলা, অন্যদের বাদ দিয়ে অতীতের সব কৃতিত্ব নিজেদের ভাগে রাখা, এবং সর্বশেষ না হলেও নিকৃষ্ট একটি হল, নিজ দলের আচরণ, ভোগদখল তথা অধিকার ও কায়েমি স্বার্থের অবস্থানকেই প্রাধান্য দেওয়া। তাতে কোনো রকম গণতান্ত্রিকতা চালিয়ে নেওয়া মুশকিল। কাছাকাছি মতাদর্শের রাজনৈতিক শক্তি, যেগুলো জাতীয় পর্যায়ে না হলেও স্থানীয়ভাবে অন্তত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-কেন্দ্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাত্রলীগের সমকক্ষ বা তাদের ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রাখে সেগুলোকে দমানোকে বহুকাল ধরে ছাত্রলীগ অগ্রাধিকার দিয়ে এসেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এভাবে সুদিনে ছাত্রলীগ  বরাবর একাকীই থেকেছে, কেবল যখন সামরিক স্বৈরাচারের আমলে চরম প্রতিকূলতায় পড়েছে, তখন সর্বদলীয় কমিটি করেছে। কিন্তু অনুকূল পরিবেশে এবং নির্বাচনের সময় বিরুদ্ধতায় যথেষ্ট কঠোর থেকেছে যাতে তাদের একক আধিপত্য বজায় থাকে।
কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হল, দেশে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতির অনেক প্রতিপক্ষ মাঠে সক্রিয় যাদের অনেকেই সম্ভবত আজ আন্তর্জাতিক জঙ্গি সন্ত্রাসবাদের সাথেও যুক্ত আছে। এমনিতেই মুসলিম-প্রধান দেশে পঁচাত্তর পরবর্তীকালে দুই  স্বৈরাচার ও বেগম জিয়ার দুই দফা শাসনের সুবাদে মুসলিম জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছে দেশে। বৃহৎ শক্তির বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারণে সাধারণভাবেই মুসলিমমানসে ক্ষোভ ও ক্রোধ তৈরি হয়েছে। এর রাজনৈতিক বহি:প্রকাশ যে কোনো সুযোগে ঘটতেও পারে। এক কথায় বলা যায় আইউব-জিয়া-এরশাদের মত সামরিক শাসকদের আমলের চেয়েও বর্তমান বাস্তবতা অনেক জটিল এবং কঠিন অনিশ্চয়তায় ভরা। বেগম জিয়ার বিএনপির রাজনীতি আওয়ামী লীগ ও প্রগতির শক্তির বিরুদ্ধে এই সম্ভাব্য অপশক্তিকে কাজে লাগাতে পারে - অন্তত অতীতের অভিজ্ঞতা তাই বলে।
ফলে সমাজে গণতন্ত্রের সংগ্রাম অনেক বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন আজ। অতীতে এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টির সাথে সাথেই ছাত্রলীগসহ অন্যান্য প্রগতিশীল দল জোটবদ্ধ আন্দোলনে নেমেছিল বলেই স্বাধীনতা অর্জনসহ অন্যান্য সাফল্য এসেছিল।
জিয়া-এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছিলেন এবং তা ধরে রাখার জন্যে জবরদস্তি ও দখলদারির রাজনীতি চালু করেছিলেন। এর বিরুদ্ধে প্রায় একই কৌশলেই এগুতে হয়েছে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগকে। কিন্তু তখন ছাত্রলীগ সমমনা প্রগতিশীল দলগুলোকে কোনো অবস্থাতেই ছাত্রসংসদের নির্বাচনে বিজয় অর্জনের সুযোগ দিতে চায় নি। বিপক্ষশক্তি তো এ কৌশলেই এগুতে চেয়েছে, আখেরে ছাত্রলীগসহ সকলের সংগঠন নষ্ট হয়েছে, সামগ্রিকভাবে ছাত্ররাজনীতি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। একটা সময়ের পর থেকে এদেশে আর কোনো পর্যায়েই ছাত্রসংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হচ্ছে না। যে পর্যায় থেকে নাগরিকরা গণতন্ত্রের সবক নেবেন, নেতা হওয়ার প্রশিক্ষণ পাবেন সেখানে গণতন্ত্রের চাকাই রুদ্ধ হয়ে গেল। যত স্বচ্ছ ব্যালেট বাক্সের ব্যবস্থা হোক না কেন একেবারে সাধারণ সদস্যদের নির্ভেজাল মতামতের ভিত্তিতে দলের কর্মকর্তা নির্বাচিত হওয়া সম্ভব বলে কারও বিশ্বাস হয় না।
অথচ বর্তমান জঙ্গিবাদ, ধর্মান্ধ রক্ষণশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে ওঠার আশংকার তলা থেকে দেশকে ধর্ম ও মত চর্চার সুস্থ আবহসহ একটি যথাযথ গণতান্ত্রিক বাতাবরণ উপহার দেওয়া জরুরি অগ্রাধিকার কর্ম বলে মনে করি। আর তা শুরু হতে পারত বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্রসংসদের নির্বাচন দিয়ে। কেবল একটি বিধান জারি করা দরকার যে, কোনো ছাত্রসংগঠন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার নীতি ও কর্যক্রম নিয়ে বৈধতা পাবে না। ফৌজদারি অপরাধে আদালতে শাস্তিপ্রাপ্তদের জন্যে নিষেধাজ্ঞা তো এখনও রয়েছে। সঙ্গে যুক্ত করতে হবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যে সর্বস্তরে নিয়মিত ছাত্র হতে হবে এবং তাই প্রার্থীর বয়স কখনও ২৫ এর বেশি হতে পারবে না।
ছাত্রলীগকে মাত্র দুটি বিষয় শিখতে হবে - প্রয়োজনে সমমনা দলগুলোর সাথে আধিপত্য নয়, সমতার ভিত্তিতে জোট গঠন করে নির্বাচন করা এবং সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনে পরাজয় মর্যাদার সঙ্গে গ্রহণ করা।
সেই সাথে ছাত্রলীগ এবং অন্যান্য সকল দলকে দুটি বিষয় ভুলতে হবে - কোনো পর্যায়ে কোনো অবস্থাতে দখলদারির মানসিকতা দেখানো এবং দখল বা কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্যে কোনো রকম অবৈধ পন্থা - জবরদস্তি বা সন্ত্রাসে জড়ানো - বন্ধ করতে হবে। তাহলে এ পর্যায়ে অন্তত গণতন্ত্রের পথ সুগম হবে। স্বভাবতই এর প্রভাব বৃহত্তর জাতীয় প্রেক্ষাপটেও শুভই হবে।
আমার মনে হয় কাজটা কঠিন নয়। কেবল ধারা পাল্টানোর ব্যাপার। বুঝি, শেখ হাসিনাকেই এটা চাইতে হবে, সূচনা করতে হবে।

***