আবুল মোমেন
১.
বঙ্গবন্ধুর
জীবন ও কর্মকে কেবল ইতিহাসের পটে রেখে স্মরণ করলে তাঁকে আংশিক পাওয়া যাবে। তাঁকে পাওয়া
ও বোঝা পূর্ণতা পাবে একই সাথে তাঁর অর্জন ও অবদানকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করলে।
আমরা সংক্ষেপে এই দু’ভাবেই তাঁকে বোঝার চেষ্টা করতে পারি।
গ্রামবাংলার
সাধারণ ঘরের একটু রগচটা বালকটির (তাঁর ভাষায় মাথা গরম) মধ্যে কিছু অসাধারণ গুণ দেখতে
পাই। ছেলেটি সে বয়সেই পরের হিতৈষী ছিল, অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সাহস ছিল তার, প্রয়োজনে
দলবল নিয়ে প্রতিকারের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্দীপনাও তার ছিল। এসব ঘটনায় প্রকাশ পাওয়া
চারিত্রিক গুণাবলি তার ভবিষ্যত পরিণতির ইঙ্গিত দেয়। ছেলেটা সাহসী, নেতৃত্ব গুণের অধিকারী,
ন্যায়ের প্রতি তার পক্ষপাত সহজাত এবং সাধারণ মানুষের প্রতি দায়বোধে সে আন্তরিক। পরে
আমরা দেখতে পাই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায়ও তিনি সমসাময়িক
অনেকের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন ।
জুন ১৯৬৬ থেকে
মার্চ ১৯৭১ - এই ন্যূনধিক পাঁচ বছরে দক্ষ সংগঠক ও তরুণ নেতা হিসেবে খ্যাত শেখ মুজিব তাঁর চেয়ে বয়সে প্রবীণ, প্রাতিষ্ঠানিক
শিক্ষায় অগ্রসর কিংবা জেলজুলুম খাটা ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া সকল নেতাকে ছাপিয়ে
পূর্ববাংলার জনগণের অবিসংবাদী নেতা হয়ে উঠেছিলেন। ’৪৭ থেকে ছয়দফার আন্দোলনের পূর্ব
পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও পূর্ব পাকিস্তনের প্রাদেশিক রাজনীতির নানা উত্থানপতনে
জর্জরিত ইতিহাস রাজনীতিকদের সম্পর্কে জনমনে অনাস্থা ও হতাশার জন্ম দিয়েছিল। বিপরীতে
শেখ মুজিবের উত্থানপর্বের ইতিহাসে দেখি জনমানুষ রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ফিরে
পেলো, রাজনীতিকে ঘিরে আশার আলো দেখতে শুরু করল। এভাবে জনগণের ঐকান্তিক ভালোবাসায় শেখ
মুজিব কেবল বঙ্গবন্ধু উপাধি পেলেন তা নয়, তিনিই জন-ইতিহাসের নেতা ও নায়ক হয়ে উঠলেন।
একাত্তরের ফেব্রুয়ারি
মাস থেকে যখন রাজনৈতিক হাওয়া তপ্ত হতে শুরু করে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার নির্বাচনের
রায়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে কিনা সে সন্দেহ জোরদার হতে থাকে এবং পূর্ববাংলার ছাত্র-তরুণদের
মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা পাকিস্তান-বিরোধী স্বাধীনতার চেতনায় রূপ নিতে থাকে
তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্ব আরো পোক্ত ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। তিনি হয়ে
উঠলেন জাতির আশা ও সংগ্রামের প্রতীক। তাঁর নেতৃত্বের প্রতি মানুষের আস্থা এত প্রগাঢ়
হয়েছিল যে একদিকে স্বভাবত কোন্দলপ্রবণ বাঙালি সব বিবাদ ও ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে ঐক্যবদ্ধ
জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। অন্যদিকে, তাঁর নেতৃত্বে আস্থা রাখতে পেরে মানুষ এতটাই উজ্জীবিত
হয়েছিল যে সহজাত শান্তিপ্রিয় ও ঘরকুনো প্রকৃতির বাঙালি রূপান্তরিত হল এক বীরের জাতিতে।
প্রকৃত বীরের মতই তারা লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারেও প্রস্তুত ছিল, ঠিক
যেমন তাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবেরও প্রস্তুতি ছিল জাতির কল্যাণে দেশের স্বাধীনতার
জন্যে সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের।
নেতা ও জনতার
এই সম্মিলনের ফল মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ।
২.
স্বাধীনতার
পরে পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাতে শুরু করল - জনমনের পরিবর্তনের বিবেচনায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে
তা ঘটেছিল খারাপের দিকে। পাকিস্তানের নির্জন কারাবাস থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসা বঙ্গবন্ধু
আর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এক সম্পূর্ণ নতুন গৌরবের অভিজ্ঞতায় পোড় খাওয়া তাঁর জনগণের
মধ্যে যেন নয়মাসে এক অদৃশ্য ব্যবধান বা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেল। ক্রমে সেটা দৃশ্যমান হতে
থাকল। এক দল স্বাধীনতার মাধ্যমে জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের সুযোগকে নিজেদের পাতে টানবার
চেষ্টায় প্রায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। তারা স্বভাবতই স্বাধীনতার কৃতিত্ব, মুক্তিসংগ্রামের
উত্তরাধিকার ও ক্ষমতার প্রসাদের ভাগ নিতে ক্ষমতাসীন দলেই আশ্রয় নিল।
আরেক দল স্বাধীনতার
মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজের বিপ্লবী পরিবর্তনের জন্যে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারকে অংকুরেই
চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বিপ্লবের স্বপ্ন বাস্তবায়নে নেমে পড়েছিল। একাত্তরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে
বঙ্গবন্ধু নিশ্চয় জাতীয় ঐক্য দেখতে পেয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় প্রবাসে আওয়ামী
লীগের বিভক্ত বিবদমান অধিকাংশ নেতা-কর্মীদের এড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ক্ষুদ্র
একটি দলকে নিয়ে ভারতীয় ঝানু আমলা ও কূটনীতিকদের সহযোগিতায় যেভাবে কঠিন সময় সফলভাবে
পাড়ি দিয়েছেন এবং এই সময়ে সমমনা দলের সমন্বয়ে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে জাতীয় ঐক্যের
ছাতাটি বহাল রাখার ব্যবস্থা করেছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে সে অভিজ্ঞতা সকলের
অনুধাবনের অবকাশ যেন বঙ্গবন্ধুসহ অনেকেই পাননি। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সেই ঐক্যের
ধারাকে বজায় রেখে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার যে সুযোগ তৈরি করেছিল সেটার চেয়ে তিনি ১৯৭০-এর
নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি সংসদীয় গণতন্ত্রের ওপরই আস্থা রাখলেন। চিরকালের গণতান্ত্রিক
নেতার পক্ষে সমাজের বিপ্লবী ক্রান্তিকালের চাহিদা অনুধাবন ও অনুসরণ সম্ভবত স্বাভাবিক
ছিল না। বিভাজনে সৃষ্ট আস্থার সংকট ও অস্থিতিশীলতা
সুযোগসন্ধানী ষড়যন্ত্রীদের সক্রিয়তার সহায়ক হয়েছিল। বাহাত্তরের ভুল বঙ্গবন্ধু পঁচাত্তরে
সংশোধন করতে চেয়েছিলেন বাকশাল গঠন করে। যে নেতা রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রদানে বরাবর সময়
নির্বাচনে তুখোড় ছিলেন তাঁর যেন এবার রাজনৈতিক চালে দেরি হয়ে গেল। ষড়যন্ত্রকারীরা প্রত্যাঘাত
হানতে এই সুযোগটাকেই কাজে লাগিয়েছিল।
পচাত্তরের আগস্টের
ধ্বংস্তূপ থেকে উঠে এসেছিল ষাটের দশকে প্রত্যাখ্যাত ও একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তানি
ধর্মীয় প্রতিক্রিয়াশীলতার রাজনীতি। তার মুখপাত্র হলেন প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতা খন্দকার
মোশতাক এবং পরে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ জিয়াউর রহমান। এ দু’জনের বাহ্য পরিচয় এবং ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে
তাদের ভূমিকার সাথে বাংলাদেশের পরবর্তী দশকগুলোর রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনাপ্রবাহ বিচার
করে বোঝা যায় পাকিস্তান আমলে রাজনৈতিক ঘটনাবলি এত দ্রুততার সাথে এগিয়েছিল যে, তার সাথে
জনগণ ও সমাজমানসের পরিবর্তন তাল মেলাতে পারে নি। চোখের সামনে এদেশেবাসীর সবচেয়ে বড়
অর্জন গণমুখী দেশপ্রেমিক রাজনীতি ক্রমে ক্ষমতার বৃত্তে বাঁধা পড়ে গেল, আদর্শ ও নৈতিকতার
অবক্ষয় ঘটে কালো টাকা ও পেশিশক্তির সাথে গাঁটছাড়া বাঁধল। সমাজে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষতার
বাতাবরণ নষ্ট হয়ে গেল, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার ও ভূমিকা প্রাধান্য পেতে থাকল, ধীরে
ধীরে পরমতসহিষ্ণুতার পরিবেশও আর থাকল না।
৩.
এই পরিবর্তন
ঘটতে ঘটতে এবং বুঝতে বুঝতে ইতিহাসের পটে পরিস্কার হয়ে ওঠে যে পঁচাত্তর আমাদের জাতীয়
জীবনে এক বিভাজন-রেখা। এরপরে, বিশেষত গত এক দশকে, অর্থনৈতিক উন্নতি ভালোই হচ্ছে, কিন্তু
রাজনৈতিক অবনতি ও অবক্ষয় সেই থেকেই চলছে। পঁচাত্তরেই রাজনৈতিক পটভূমি থেকে আমাদের রাজনীতির
সবচেয়ে সাংগঠনিক-প্রতিভা দূরদর্শী তাজউদ্দিন হারিয়ে গিয়েছিলেন, আর সে বছর নভেম্বরে
তিনি ও অপর তিন জ্যেষ্ঠ নেতার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ অনেকটাই নেতৃত্বশূন্য
হয়ে যায়। তৎকালীন অপরাপর জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেক দোলাচল আমরা দেখেছি, দু:সময়ে বেগম জোহরা
তাজউদ্দিনের সাহসী ভূমিকাও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে লক্ষ্য করেছি। কিন্তু তখন দিনে দিনে এটিও
পরিস্কার হয়ে ওঠে যে কেবল আওয়ামী লীগ নয় দেশের প্রকৃত গণতান্ত্রিক সংগ্রামে এদেশের
মানুষের প্রেরণার উৎস একজনই - তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
বঙ্গবন্ধু সংগঠনের
কর্মী থেকে নেতা হয়েছিলেন, কিন্তু সেখানেই যতি টানেননি, হয়ে উঠেছিলেন জাতির নেতা, জনগণের
নায়ক, কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ইতিহাসের দায় - তার জন্যে জীবনের ঝুঁকি নিতে কুণ্ঠিত হননি।
তাঁর ভূমিকা বিশাল ও বৈচিত্র্যময়, তাঁর ব্যক্তিত্ব বহুমাত্রিক, তাঁর চিন্তা ও কর্ম
ছিল লক্ষ্যাভিমুখী এবং ক্রমেই তাঁর রাজনীতি দেশ ও
জাতির সামগ্রিকতায় বিকশিত হয়েছে। হিন্দু মুসলিম, ধনী-দরিদ্র, উচ্চশিক্ষিত-শিক্ষাবঞ্চিত,
উন্নতরুচির শিল্পী সাহিত্যিক-স্থূলরুচির ব্রাত্যজন, নারী-পুরুষ, শিশু-বয়স্ক সকল মানুষ
তাঁর মধ্যে আস্থার একজনকে পেয়েছে, তাঁর সাথে প্রেম-প্রীতি-স্নেহের বন্ধন বোধ করেছে।
দিনে দিনে তাঁর জীবনকালের অপারগতা-অপূর্ণতার দায় ইতিহাস মুছে মুছে উজ্জ্বল করে তুলেছে
বঙ্গবন্ধুর ইতিবাচক অবদানসমূহ।
ক্ষমতার লড়াই
ক্রমশ রাজনীতির পরিসর সংকীর্ণ করে তোলে, ক্রমেই স্বার্থ তথা তাৎক্ষণিক লাভ-ক্ষতির বিচারের
উর্দ্ধে জাতীয় ও চিরায়ত চেতনা - যাকে আমরা আদর্শ ও নীতি বলে থাকি - হারিয়ে ফেলে। রাজনীতি
ক্ষমতা, বিত্ত, প্রতিপত্তির বেশি কিছু দেওয়ার শক্তিও হারিয়ে ফেলে। অথচ জাতির চেতনার
সংকটই তো গভীর, ক্রমে গভীরতর হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, বৈষম্য - এসবের বিরুদ্ধে
সোচ্চার হবে কে রাজনীতি ছাড়া? আত্মকেন্দ্রিকতা, জঙ্গিবাদ, ভোগসর্বস্বতা, মাদক ও নেশার
সর্বনাশ কি পুলিশ প্রশাসন তাড়াতে সক্ষম সুস্থ সঠিক গঠনমূলক রাজনীতি ছাড়া?
জনগণের রাজনীতি
করেছিলেন বঙ্গবন্ধু, দেশের রাজনীতি করেছিলেন তিনি, জাতির ভাগ্য নির্মাণের ক্ষমতা ছিল
সে রাজনীতির, তাতে রাজনীতিকদের দলীয় সংকীর্ণতার উর্দ্ধে ওঠা সম্ভব ছিল, বর্তমানের অর্জন
ও বাস্তবতা ছাপিয়ে ভবিষ্যতের সম্ভাবনার বিকাশ ঘটানোর ঔদার্য ছিল সে রাজনীতির।
আজ আর্থিক সংকট
খানিকটা ঘুচলেও মানবিক সংকট বাড়ছে। এ সময়ে দলের ও দলের বাইরে সতীর্থ রাজনীতিবিদদের
আলোকোজ্জ্বল বলয়ের মধ্যমণি বঙ্গবন্ধুর হাস্যোজ্জ্বল মুখাবয়বের কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে।
***