Thursday, January 23, 2014

নিছক কূটকৌশলে বিএনপি কি পরীক্ষায় উৎরাবে?

আবুল মোমেন

বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিধারা বুঝে ওঠা অনেকের জন্যেই কঠিন হচ্ছে। যারা খাঁটি গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের রাজনীতিকে বিচার করতে চান তাঁদের কাছ থেকে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর কেউই পাশ মার্ক পাচ্ছেন না। সত্যিই তো পাবেন কি করে, কোনো পক্ষই তো পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করছেন না। উভয় পক্ষই কেবল রাষ্ট্র ক্ষমতাকে মাথায় রেখেই রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করে চলেছেন। সেভাবেই একসময় আওয়ামী লীগ কৌশলগত কারণে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির বিরোধী রাজনীতিতে জামায়াতকে সঙ্গে রেখেছিল। সকলেই বুঝতে পারেন, জামায়াতের সাথে আওয়ামী লীগের নৈতিক-আদর্শিক সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক নয়। এ কারণেই এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আবার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে বিএনপি যখন জামায়াতকে ত্যাগ করে জোটের রাজনীতি সাজাতে চাইছে তখন প্রশ্ন উঠছে সেটা তাদের কৌশলগত পদক্ষেপ নাকি আদর্শিক অবস্থান?
এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া অবশ্য কঠিন কোনো কাজ নয়। ইতিহাসের ঘটনা পরম্পরা মিলিয়ে নিলে সহজেই এর উত্তর পাওয়া যাবে। স্বাধীনতার পর আদর্শিক অবস্থান থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিল, নিষিদ্ধ হয়েছিল জামায়াতে ইসলামিসহ আরও কিছু দল। বিপরীতে ১৯৭৫-এর নভেম্বরে ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমান তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে দুটি বিষয় গ্রহণ করেছিলেন। প্রথমত, তখন বাকশাল-উত্তর বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চাহিদা তৈরি হয়েছিল এবং জিয়া তা পূরণের উদ্যোগ নেন। তাঁর বহুদলীয় গণতন্ত্রের মতাদর্শে জিয়া ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বাধা সরিয়ে দেন। এভাবে জামায়াতে ইসলামির জন্য সাংগঠনিক পুনরুজ্জীবনের সুযোগ তৈরি হয়। দ্বিতীয়ত, জিয়াউর রহমান নিজের সংগঠনের মাধ্যমে যে জাতীয়তাবাদের রাজনীতি প্রবর্তন ও জনপ্রিয় করতে চাইলেন তাতে মুসলিম-ধর্মীয় চেতনাকে মুখ্য অবস্থানে রাখলেন। জিয়ার এই নৈতিক আদর্শিক অবস্থান তখনকার বাস্তবতার আলোকে বুঝে নিলে তৃতীয় একটি বিষয়ও নজরে আসবে।
এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে জিয়া একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পটভূমিতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আর একজন সেনাপতি হিসেবে তিনি এমনভাবে তাঁর রাজনৈতিক দলটি গঠন করলেন যাতে এর সর্বাধিনায়ক হয়ে তিনিই দল পরিচালনার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। এর ফলে যা দাঁড়াল তা হল, যে ব্যক্তি দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনে ভূমিকা রাখতে চান তিনিই নিজ দলে গণতন্ত্র চর্চার পথ রুদ্ধ করে রাখলেন। ফলে তাঁর হাতে রাষ্ট্র ও দলের সর্বময় ক্ষমতা পুঞ্জিভূত হয়ে যায়। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও জিয়া কিন্তু নিশ্চিত ছিলেন না প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার সামর্থ্য নিয়ে। এই মোকাবিলার কৌশল নির্ধারণ করতে গিয়ে জিয়া তাঁর আদর্শিক-নৈতিক অবস্থানের প্রায়োগিক ফর্মুলা তৈরি করেছেন। এটি জিয়া ও তাঁর দল বিএনপির রাজনীতির তৃতীয় বৈশিষ্ট্য।
দেখা গেল প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতি তৈরি করতে গিয়ে জেনারেল জিয়া  মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনীতি ফিরিয়ে আনলেন, যা এ দলকে পুরনো এবং প্রত্যাখ্যাত মুসলিম লীগের শূন্যস্থানেই যেন বসিয়ে দিল। দলে তাঁর প্রভাবে কিছু মুক্তিযোদ্ধা যোগ দিলেও মুসলিম লীগ ও এই ঘরানার পুরোনো লোকজন বিএনপিতে শরিক হয়েছেন। এঁদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় খুন-লুণ্ঠন-ধর্ষণসহ গুরুতর অভিযোগ ছিল, যেমন তাঁর মন্ত্রী বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত আবদুল আলীম। আওয়ামী লীগের রাজনীতির ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে আমজনগণ হয়ত এই বিচ্যুতিকেও মেনে নিত, কিন্তু তিনি সর্বময় ক্ষমতা ভোগ করে এমন দুটি কাজ করলেন যা তাঁর রাজনীতিকে প্রায় স্থায়ীভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলল। প্রথমত, যে পট-পরিবর্তনের মাধ্যমে জিয়া ক্ষমতার পটে আবির্ভূত হয়েছিলেন তার কুশীলব বঙ্গবন্ধু ও চারনেতার স্ব-স্বীকৃত ঘাতকদের তিনি কেবল বিচার থেকে মুক্তি দিয়ে দেশত্যাগে সাহায্য করেন নি, তাদেরকে স্বত:প্রণোদিত হয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকুরিতে বহাল করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, বিপুল ত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে এদেশের মানুষের অর্জিত স্বাজাত্যবোধের - যার প্রকাশ ঘটেছিল রেডিও পাকিস্তানের নাম বাংলাদেশ বেতার করা এবং এরকমভাবে ব্যাংক-বীমা-তেল কোম্পানিসহ সর্বত্র বাংলাভাষা ও বাঙালিদের প্রতি রাষ্ট্রীয় পক্ষপাতের মাধ্যমে - বিপরীতে প্রায় প্রত্যাখ্যাত পাকিস্তানি ধারাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু করলেন। রাজনীতিতে এই পাকিস্তানি সংস্কৃতির ছাপ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা দেশের মূলধারার চিন্তাবিদ, পেশাজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের মনে দলটি সম্পর্কে গভীর সংশয় সৃষ্টি করেছিল।  এভাবে বিএনপির জন্মদাতা নিজেই দলকে একদিকে আদর্শিকভাবে জামায়াত, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট করে তুলেছিলেন আর অন্যদিকে দেশের মূলধারার চিন্তাবিদ, পেশাজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের তাঁর দল সম্পর্কে শংকিত করে তুলেছিলেন। কিন্তু এঁরা আদতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। বরং তাদেরই সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে মোটামুটি একটি প্রভাবশালী বাম প্রগতিশীল রাজনীতির ধারা বরাবর বহমান ছিল।
কিন্তু ক্রমেই এই ধারাটি যে ক্ষীয়মান হল, এমনকি বর্তমানে কোনো কোনো ক্ষুদ্র দল আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতায় শরিক হচ্ছে তার কারণ জিয়ার পরবর্তীকালে তাঁর উত্তরসুরী স্ত্রী খালেদা জিয়া ও পুত্র তারেকের নেতৃত্বে বিএনপি দিনে দিনে জামায়াত ও ধর্মবাদী দলের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠায় দেশের ভবিষ্যত নিয়ে এরা সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
আওয়ামী লীগের জবরদস্তি, দখলদারি, গা-জোয়ারির যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাতে অসন্তুষ্ট এবং পুরোপুরি আস্থা নেই মধ্যবর্তী সচেতন মানুষগুলোর। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্ব কখনও তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়নি। সমাজের এই অংশ নীতি-আদর্শের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাদের বিবেচনায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি নীতি-আদর্শের দিক থেকে অনেকাটাই ঠিক কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় অহমিকা-জবরদস্তি-দখলদারি মানসিকতার কারণে বাস্তবে তার যথার্থ প্রতিফলন ঘটে না। অর্থাৎ রাজনৈতিক কৌশলে গণতান্ত্রিক আচরণ ক্ষুণœ হতে থাকায় আওয়ামী লীগ নিয়ে অসন্তুষ্টির কারণ ঘটে, বিশেষত এতদিনে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক উত্তরণে দেশ ও সমাজের যে অগ্রগতি হতে পারত তা না হওয়ায় চরম অতৃপ্তিতে ভোগেন তারা। এভাবে দেশে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আরও একটি রাজনৈতিক শক্তির চাহিদা তৈরি হয় যা রাজনীতিতে কাক্সিক্ষত নীতি-আদর্শের প্রয়োগ ঘটিয়ে আওয়ামী লীগকেও ছাপিয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতির এই চাহিদাটি বিএনপি নেতৃত্ব কখনওই অনুধাবন করতে পারে নি। জিয়াউর  রহমানের উত্তরসুরী হিসেবে বেগম জিয়া এবং পুত্র তারেক বিএনপিকে কেবল নীতি-আদর্শের দিক থেকে আরও পিছিয়ে নেয় নি দলকে নতুন আরও নেতিবাচক বিতর্কেও জড়িয়েছে। এর অন্যতম হল একুশে আগষ্টের গ্রেনেড হামলা। অতীতে জিয়ার নেতৃত্বে এ দল স্বেচ্ছায় বঙ্গবন্ধু হত্যায় সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ গায়ে মেখেছে, আর বর্তমানে একুশে আগষ্টের হামলাকারীদের আড়াল করতে গিয়ে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার হত্যা প্রচেষ্টাকারীদের সাথে সংশ্লিষ্টতার সন্দেহের কারণ হল। বিএনপির রাজনীতি সম্পর্কে জন-ধারণা (পাব্লিক পার্সেপশন) ক্রমশই এরকম দাঁড়িয়েছে যে এদল নীতি-আদর্শের দিক থেকে জামায়াত-হেফাজত-খেলাফত প্রমুখ পশ্চাৎপদ চিন্তার ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ী দলের ঘনিষ্ঠ। ফলে বর্তমানে বিএনপি যদি কেবলমাত্র জামায়াতকে দূরে রেখে তার এই পশ্চাৎপদ রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা অস্বীকার করতে চায় তবে তাকে মানুষ নিছক একটি রাজনৈতিক কৌশল মনে করলে তাদের দোষ দেওয়া যাবে না।
বিএনপি যদি তাদের এই অবস্থানকেই সঠিক মনে করে তবে আওয়ামী লীগের প্রতি সন্দিগ্ধ ও অসন্তুষ্ট থেকেও বামপ্রগতিশীল দলগুলো দ্বিদলীয় টানাপোড়েনে, অন্তত মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ ঠেকানোর কৌশল হিসেবে, আওয়ামী লীগের সাথে জোট বাঁধতে পিছপা হবে না। বিভিন্ন ঘটনাবলীতে এ ধারণা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে যে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে আগে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ মুক্ত করতে হবে। সে কাজে একটি বৃহত্তর ঐক্য দরকার। তারই অংশ হিসেবে আজ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে জাসদ বা ওয়ার্কার্স পার্টিকে দেখা যাচ্ছে। আমার মত অনেকের প্রত্যাশা ছিল সিপিবিও এতে শরিক হবে। জোটে থেকেও বাম দলগুলোর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখা কেন জরুরি তা নিয়ে পরে স্বতন্ত্র কলাম লিখব।
যা হোক, এই ধারাকেই আপাতত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারা বলা যায়। এটি বর্তমানে আরেকটু জোরদার হল দুটি কারণে, প্রথমত, গণজাগরণ মঞ্চের উত্থানের ফলে দেশের তরুণসমাজ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কিন্তু রাজনৈতিকভাবে কিছুটা হতাশ ও নিষ্ক্রিয় মানুষজন মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ ঠেকানোর জন্য আবার সরব ও সক্রিয় হয়েছেন। দ্বিতীয়ত, বিএনপি দশম সংসদের নির্বাচন সামনে রেখে যে রাজনীতি করেছে তাতে তার আদর্শিক-নৈতিকভাবে জামায়াত-ঘনিষ্ঠতা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। ফলে মূলত আন্তর্জাতিক চাপে বিএনপি যখন জামায়াতকে ছাড়ার কৌশল নেয় তখন তা নীতি-আদর্শ নয় নিছক কূটকৌশল বলেই বিবেচিত হচ্ছে। লন্ডনে বসে তারেক জিয়ার তৎপরতা, ফোনালাপ ইত্যাদি সম্পর্কে যতটুকু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতেও একথাই প্রমাণিত হয় ভালোভাবে।
আপাতত কিছুদিন রাজনীতি এই ধারাতেই ঢিমিয়ে ও ঝিমিয়ে চলবে বলে মনে হয়। কারণ গত দু’মাসে বিএনপি ও জামায়াত ব্যাপকভাবে ধক্ষংস ও বীভৎস হত্যার রাজনীতি করে এবং অবরোধ হরতালের আধিক্য ঘটিয়ে কর্মী ও জনগণকে ক্লান্ত ও রাজনীতিবিমুখ করে ফেলেছে। স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার জন্যে বর্তমানে কিছুদিন সবারই বিশ্রাম ও সময় দরকার।