Thursday, May 15, 2014

সুড়ঙ্গের শেষে আলোর রেখা

আবুল মোমেন

জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। পুলিশ ও র‌্যাব হয়ত নানান পরিসংখ্যান দিয়ে পরিস্থিতির অপেক্ষাকৃত ভালো চিত্র তুলে ধরবে। কিন্তু বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর গুম ও অপহরণের ঘটনা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ভয় ভীতি বেড়ে যাওয়ার কারণ এ ধরনের কোনো ঘটনারই সুষ্ঠু তদন্ত হয়ে অপরাধী ধরা পড়ছে না। ইলিয়াস আলী গুম হওয়ার পরে দু’বছর  অতিবাহিত হল। ঘটনার রহস্য উদঘাটন এবং দোষী শনাক্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছে না। বিচার তো পরের কথা। মেধাবী ছাত্র ত্বকীর মৃতদেহ পাওয়া গেল, নিহতের পরিবার এবং নারায়ণগঞ্জের সুধিজনের দিক থেকে অভিযুক্তের নাম সাঙ্গ-পাঙ্গসহ বারবার উঠল। কিন্তু কোনো অগ্রগতি নেই। বেলার সম্পাদিকা পরিবেশ আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানার স্বামী ব্যবসায়ী সিদ্দিক অপহৃত হয়েও সৌভাগ্যক্রমে ফিরে এলেন। কিন্তু সে মামলারও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে না।
সমাজে নানা কারণে খুন-অপহরণের মত অপরাধ সংঘটিত হয়। তিনটি কারণে তা জনমনে আতঙ্ক ছড়াতে থাকে। এক. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বাভাবিক তৎপরতা ব্যাহত-বিঘিœত হলে এবং পরিণতিতে ঘটনার রহস্য ভেদ না হয়ে দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা না হলে; দুই. সরকারি সংস্থা, সরকারি দলের এ ধরনের  অপরাধে জড়িয়ে পড়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে; তিন. কিশোর ত্বকী বা উকিল মাধবচন্দ্রের মত নিরীহ  মানুষের প্রাণহানী বাড়তে থাকলে। পারস্পরিক দ্বন্দ্বের জের ধরে সংঘটিত অপরাধ বা ঐশীর মত বিপথগামী সন্তানের অপরাধের পরিণতি মানুষকে মর্মাহত, বিচলিত, দু:খিত করে, কিন্তু ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কিত করে না। আজকের দিনে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার কারণ গুম-খুনের মত অপরাধের ধারাবাহিকতা, কোনো মামলার অগ্রগতি না হওয়া এবং সবটা মিলিয়ে বিভিন্ন শহরে ও জনপদে থমথমে অবস্থার সৃষ্টি হওয়া। এসব ব্যাপারে সরকারের নিরপেক্ষতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আন্তরিকতা ও দক্ষতা এবং ন্যায় বিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে অনিশ্চয়তায় ভুগছে মানুষ।
জনজীবনে সৃষ্ট নিরাপত্তাহীনতা কাটানোর জন্যে সরকার মানুষকে আশ্বস্ত করার মত কোনো উদ্যোগ নিতে পারছে না। অন্তত এখনও পর্যন্ত নেওয়া হয় নি। ইলিয়াস আলীর ভাগ্যে কী ঘটেছে তা এতদিনে তাঁর নিকটজন, তাঁর দলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ জনগণকে জানাতে সরকারের সক্ষম হওয়া উচিত ছিল। নয়ত ঘটনার দুই বছর পরে এটাকে ব্যর্থতা বলেই মনে করবে মানুষ, এবং এর দায় নিতে হবে সরকারকেই। ইলিয়াস আলীর নিভের্জাল দলীয় পরিচয় এবং নানা কারণে ভাবমূর্তি বিতর্কিত হলেও ঘটনাটি পুলিশ-র‌্যাব-সরকারের ব্যর্থতার সাক্ষ্যই দিতে থাকবে। বিএনপি নেতার ক্ষেত্রে যদি জনমতের ধারা এরকম হয় তাহলে ত্বকী বা মাধবচন্দ্রের ক্ষেত্রে এ ধারণা কতটা একতরফা এবং তীব্র হবে তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
বৃহত্তর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর ইঙ্গিত  হল ক্ষমতাসীন দল বা এ দলের নেতৃত্ব মনে করছে তাদের জন্যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে স্থায়ীভাবে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে হটিয়ে দেওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। সরকার সম্ভবত মনে করছে সামরিক বাহিনী, জনপ্রশাসন এবং নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশের সমর্থন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এর জোরে শক্ত হাতে শাসনযন্ত্র চালিয়ে জনগণের সামনে থেকে বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিটি নিশ্চিহ্ন কিংবা অকার্যকর পর্যায়ে দুর্বল করে দেওয়া যায়। যদি ক্ষমতাকেন্দ্রিক এই আঁতাত সম্পর্কে সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিশ্চিত থাকে তাহলে তারা একই সাথে বিএনপি ও জামায়াতকে অকেজো করে দেওয়ার চেষ্টা চালাবে। সম্ভবত সে কারণেই জামায়াতবিরোধী অরাজনৈতিক ইসলামি সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সাথে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।
তালি অবশ্য এক হাতে বাজে না, আর পরিস্থিতি সাধারণত একক চেষ্টাতেও অনুকূল হয়ে ওঠে না। অনেকের ভূমিকা ও অবদানে তা গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের নাগরিকসমাজের প্রভাবশালী অংশ মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ক্ষুণœ করতে রাজি নয়, আর এর বাইরের নতুন প্রজন্ম এ বিষয়ে গভীর আবেগপূর্ণ স্পর্শকাতরতা লালন করে থাকে। এরা উভয়েই এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের ভূমিকায় শতভাগ সন্তুষ্ট নয়, কিন্তু বিপরীতে বিএনপির ভূমিকা তাদের হতাশ করেছে। জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ, পাকিস্তানের প্রতি দুর্বল এবং যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট দলের প্রতি এদের পক্ষে সমর্থন জানানো সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ এই পরিস্থিতির সুবিধা পাচ্ছে।
দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র থাকুক, তার মধ্যে ধর্মীয় চেতনাকে প্রাধান্য দিয়ে পরিচালিত দলও থাকতে পারে, কিন্তু সবার নীতি-আদর্শে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিফলন ঘটকু এই প্রত্যাশাটাই স্বাভাবিক। মনে হয় দেশের সচেতন মানুষ এটাই আশা করে। আওয়ামী লীগ কুড়ি বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে ইসলাম ধর্মীয় চেতনার মিশ্রণ বা সহাবস্থান গড়ে তোলার দুরূহ কাজটি করতে পেরেছে। ফলে সেদিক থেকে সে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মূল অস্ত্র অনেকটাই ভোঁতা করে দিতে সক্ষম হয়েছে। এখন আওয়ামী নেতৃত্ব চাইছে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের কালিমায় জামায়াতে ইসলামি দলের পরিচয়টি বিতর্কিত করে হেফাজতের মত ধর্মভিত্তিক অরাজনৈতিক সংগঠনের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে সাধারণ ভোটারের ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট রক্ষা ও প্রতিদ্বন্দ্বী জোটকে রাজনৈতিকভাবে আরও দুর্বল করে দেওয়া।
ক্ষমতার এই খেলাটায় সম্ভবত নাগরিকসমাজ ও তরুণদের অনেকেরই সায় আছে। এ কাজ হয়ত ক্ষমতার জোরে অনেক দূর করাও সম্ভত, কিন্তু এর পরিণতিগুলো সামলানো বেশ কঠিন। এ প্রক্রিয়ায় সরকারকে অতিমাত্রায় বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর - যার মধ্যে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাও অন্তর্ভুক্ত থাকবে - ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়। আর এসবের সদস্যরা যখন এটা বুঝতে পারবে তখন তাদের ক্ষমতার পরিধির বিস্তার অনেক সদস্যকেই-যারা একটু উচ্চাভিলাষী, একটু বেপরোয়া-পরিস্থিতির সুযোগ নিতে প্রলুব্ধ করবে। বেসামরিক জনশাসনের ক্ষেত্রেও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। আর ক্ষমতাসীন দল ও জোটের নেতা-কর্মীদের মধ্যেও ক্ষমতাবান (যুগপৎ বিত্তবানও) হয়ে ওঠার এই দৌড়ে শামিল হওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকবে। বাংলাদেশে বর্তমানে এ ঘটনাই ঘটছে।
 বাস্তবতা হল দেশের অধিকাংশ মানুষ মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিচার চায়, এর চেয়ে সংখ্যায় কিছু কম কিন্তু তা-ও অনেকেই, একাত্তরের ভূমিকার জন্যে জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে বিবেচনা করে, এর চেয়ে কিছু কম তা-ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি অংশ, বিএনপির জামায়াত-সংশ্লিষ্টতা পছন্দ করে না। সেই সাথে এ-ও বাস্তব তাদের এই মনোভাবের পাশাপাশি মাথাচাড়া দিচ্ছে ভয় ও আতঙ্কের বোধ। কেননা অপহরণ-গুম-খুনের ঘটনাগুলো সরাসরি ব্যক্তির জীবনের নিরাপত্তাকেই হুমকিতে ফেলে দিচ্ছে। বর্তমানের বাস্তব, যা অপহরণ-খুন, তদন্ত ও বিচার ব্যর্থতায় জনজীবনকে অনিশ্চিত, অসহায় অবস্থা ও অন্যায় সয়ে নেওয়ার যে শাস্তি দিচ্ছে তা আপাতত তার জন্যে ইতিহাসের ঘটনার চেয়ে জরুরি ভিত্তিতে নিষ্পন্ন হওয়ার বিষয়। এই অসহায় ক্ষোভ ও ক্রোধ থেকে সৃষ্টি হবেÑহয়ত হচ্ছে ওÑক্ষমতাসীনদের সাথে তার ব্যাপক সমর্থক গোষ্ঠীর দূরত্ব, এমনকী বিরোধ।
এমন পরিস্থিতি এড়ানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে সুশাসন নিশ্চিত করা। কিন্তু সরকার তো সুশাসনকে তাদের অগ্রাধিকারে রাখছে না, রাজনৈতিক ফায়দাকেই যে গুরুত্ব দিচ্ছে সেটা মোটামুটি পরিস্কার। এই বক্তব্যের পক্ষে দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায় নির্বাচন কমিশন ও দুদকের ওপর সরকারের ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাব। আর সাম্প্রতিক অপরাধগুলোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর নিস্ক্রিয়তা, মন্থরগতি, উদাসীনতার প্রমাণও হাজির করা যায়।
কিন্তু এই বাস্তবতায় আতঙ্কিত এবং হতাশ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে এবং সরকারের ওপর তাদের আস্থাও কমে যাচ্ছে। এমন চলতে থাকলে নির্বাচন বৈতরণী সফলভাবে পার হওয়া সরকারি জোটের জন্যে কঠিন হবে। তার অর্থ হবে ইতোমধ্যে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে ওঠা ক্ষমতার আঁতাত স্বচ্ছ নিরপেক্ষ নির্বাচনের দিকে যাবে না। দুদককেও স্বাধীন ও শক্তিশালী করবে না। বরং বিচার ব্যবস্থাসহ সম্ভাব্য সকল ক্ষেত্রের ওপর প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ বাড়াতে চাইবে।
এ অবস্থাটা মানুষ চায় না। কিন্তু মানুষ কি জামায়াতের দোসর বিএনপিকে ক্ষমতায় ফেরানোর জন্যে কঠিন আন্দোলনে নামার ঝুঁকি নেবে? আমার মনে হয় নেবে না। ফলে জনগণ সত্যি সত্যি শাঁখের করাতে কাটা পড়ছে। তাকে পরিত্রাণ দেওয়ার পথ বিএনপি দেখাতে পারছে না, সম্ভবত তারেক ও খালেদা জিয়ার তা জানা নেই।
তাহলে কি জনগণের জন্যে এ ত্রাহি অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোনো পথই নেই? আমার মনে হয় আছে। নাগরিকসমাজকেই অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে এ কাজে নামতে হবে। মনে রাখা দরকার, পথ যদি সরকার পরিবর্তনে না মেলে তাহলে ক্ষমতাসীন সরকারের নীতি ও কর্মসূচি পরিবর্তনে নাগরিকসমাজকে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে নাগরিকসমাজেরও অনেক সাফল্য আছে। নীতির ক্ষেত্রে যেমন তেমনি অনেক ইস্যুতেও তা এসেছে। শিশু ও নারীর অধিকার  রক্ষায় নীতি প্রণয়ন এবং সে অনুযায়ী আইন প্রণয়ন ও ব্যবস্থা গ্রহণের দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি আদায় নাগরিক সমাজেরই অর্জন। কথা হল, কাজ অনেক বাকি আছে। দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ, স্থানীয় সরকারকে কার্যকর করা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ভিন্নমতের প্রতি সহিষ্ণুতা, লিঙ্গ-ধর্ম-জাতিগত বৈষম্য দূর করা ইত্যাদি অনেক কাজ আছে যেখানে অগ্রগতি হলে গণতন্ত্র চর্চায়ও তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আসবে। নাগরিকসমাজ যদি সরকার  ও শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধ করে প্রতিষ্ঠান এবং পেশার মর্যাদা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ ও বাধ্য করতে পারতেন তাহলেও আমাদের গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় নতুন গতি সঞ্চার হত।
আমি হতাশার কারণ দেখি না। সত্যি যে আমরা কঠিন দু:সময় পার করছি, যাকে মাঝে মাঝেই বন্ধ্যাকাল এবং অবনতিশীল পরিস্থিতির চূড়ান্ত পরিণতি বলে মনে হয়। কিন্তু আমাদের তরুণ সমাজ, যাতে বড় সংখ্যায় তরুণ নারী সমাজও অন্তর্ভুক্ত, বেশ প্রাণবন্ত, উদ্যমী, এবং সর্বোপরি নি:স্বার্থ ভালো কাজ করার জন্যে উদগ্রীব। আমরা কেন তাদেরই দেশের ভবিষ্যত জেনে তাদেরকে সাথে নিয়ে নাগরিকের দায়িত্বগুলো পালনে সক্রিয় হই না! আমি খুবই আশাবাদী যে সেখানেই সুড়ঙ্গের শেষের আলোর রেখা ফুঠে উঠছে।