Thursday, January 23, 2014

নিছক কূটকৌশলে বিএনপি কি পরীক্ষায় উৎরাবে?

আবুল মোমেন

বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিধারা বুঝে ওঠা অনেকের জন্যেই কঠিন হচ্ছে। যারা খাঁটি গণতান্ত্রিক নীতি-আদর্শের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের রাজনীতিকে বিচার করতে চান তাঁদের কাছ থেকে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর কেউই পাশ মার্ক পাচ্ছেন না। সত্যিই তো পাবেন কি করে, কোনো পক্ষই তো পরিচ্ছন্ন রাজনীতি করছেন না। উভয় পক্ষই কেবল রাষ্ট্র ক্ষমতাকে মাথায় রেখেই রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করে চলেছেন। সেভাবেই একসময় আওয়ামী লীগ কৌশলগত কারণে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির বিরোধী রাজনীতিতে জামায়াতকে সঙ্গে রেখেছিল। সকলেই বুঝতে পারেন, জামায়াতের সাথে আওয়ামী লীগের নৈতিক-আদর্শিক সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক নয়। এ কারণেই এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আবার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে বিএনপি যখন জামায়াতকে ত্যাগ করে জোটের রাজনীতি সাজাতে চাইছে তখন প্রশ্ন উঠছে সেটা তাদের কৌশলগত পদক্ষেপ নাকি আদর্শিক অবস্থান?
এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া অবশ্য কঠিন কোনো কাজ নয়। ইতিহাসের ঘটনা পরম্পরা মিলিয়ে নিলে সহজেই এর উত্তর পাওয়া যাবে। স্বাধীনতার পর আদর্শিক অবস্থান থেকেই আওয়ামী লীগ সরকার রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিল, নিষিদ্ধ হয়েছিল জামায়াতে ইসলামিসহ আরও কিছু দল। বিপরীতে ১৯৭৫-এর নভেম্বরে ক্ষমতায় এসে জিয়াউর রহমান তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে দুটি বিষয় গ্রহণ করেছিলেন। প্রথমত, তখন বাকশাল-উত্তর বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চাহিদা তৈরি হয়েছিল এবং জিয়া তা পূরণের উদ্যোগ নেন। তাঁর বহুদলীয় গণতন্ত্রের মতাদর্শে জিয়া ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বাধা সরিয়ে দেন। এভাবে জামায়াতে ইসলামির জন্য সাংগঠনিক পুনরুজ্জীবনের সুযোগ তৈরি হয়। দ্বিতীয়ত, জিয়াউর রহমান নিজের সংগঠনের মাধ্যমে যে জাতীয়তাবাদের রাজনীতি প্রবর্তন ও জনপ্রিয় করতে চাইলেন তাতে মুসলিম-ধর্মীয় চেতনাকে মুখ্য অবস্থানে রাখলেন। জিয়ার এই নৈতিক আদর্শিক অবস্থান তখনকার বাস্তবতার আলোকে বুঝে নিলে তৃতীয় একটি বিষয়ও নজরে আসবে।
এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে জিয়া একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পটভূমিতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। আর একজন সেনাপতি হিসেবে তিনি এমনভাবে তাঁর রাজনৈতিক দলটি গঠন করলেন যাতে এর সর্বাধিনায়ক হয়ে তিনিই দল পরিচালনার সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। এর ফলে যা দাঁড়াল তা হল, যে ব্যক্তি দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনে ভূমিকা রাখতে চান তিনিই নিজ দলে গণতন্ত্র চর্চার পথ রুদ্ধ করে রাখলেন। ফলে তাঁর হাতে রাষ্ট্র ও দলের সর্বময় ক্ষমতা পুঞ্জিভূত হয়ে যায়। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও জিয়া কিন্তু নিশ্চিত ছিলেন না প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার সামর্থ্য নিয়ে। এই মোকাবিলার কৌশল নির্ধারণ করতে গিয়ে জিয়া তাঁর আদর্শিক-নৈতিক অবস্থানের প্রায়োগিক ফর্মুলা তৈরি করেছেন। এটি জিয়া ও তাঁর দল বিএনপির রাজনীতির তৃতীয় বৈশিষ্ট্য।
দেখা গেল প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতি তৈরি করতে গিয়ে জেনারেল জিয়া  মুসলিম জাতীয়তাবাদের রাজনীতি ফিরিয়ে আনলেন, যা এ দলকে পুরনো এবং প্রত্যাখ্যাত মুসলিম লীগের শূন্যস্থানেই যেন বসিয়ে দিল। দলে তাঁর প্রভাবে কিছু মুক্তিযোদ্ধা যোগ দিলেও মুসলিম লীগ ও এই ঘরানার পুরোনো লোকজন বিএনপিতে শরিক হয়েছেন। এঁদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় খুন-লুণ্ঠন-ধর্ষণসহ গুরুতর অভিযোগ ছিল, যেমন তাঁর মন্ত্রী বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত আবদুল আলীম। আওয়ামী লীগের রাজনীতির ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতার কারণে আমজনগণ হয়ত এই বিচ্যুতিকেও মেনে নিত, কিন্তু তিনি সর্বময় ক্ষমতা ভোগ করে এমন দুটি কাজ করলেন যা তাঁর রাজনীতিকে প্রায় স্থায়ীভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলল। প্রথমত, যে পট-পরিবর্তনের মাধ্যমে জিয়া ক্ষমতার পটে আবির্ভূত হয়েছিলেন তার কুশীলব বঙ্গবন্ধু ও চারনেতার স্ব-স্বীকৃত ঘাতকদের তিনি কেবল বিচার থেকে মুক্তি দিয়ে দেশত্যাগে সাহায্য করেন নি, তাদেরকে স্বত:প্রণোদিত হয়ে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকুরিতে বহাল করেছিলেন। দ্বিতীয়ত, বিপুল ত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে এদেশের মানুষের অর্জিত স্বাজাত্যবোধের - যার প্রকাশ ঘটেছিল রেডিও পাকিস্তানের নাম বাংলাদেশ বেতার করা এবং এরকমভাবে ব্যাংক-বীমা-তেল কোম্পানিসহ সর্বত্র বাংলাভাষা ও বাঙালিদের প্রতি রাষ্ট্রীয় পক্ষপাতের মাধ্যমে - বিপরীতে প্রায় প্রত্যাখ্যাত পাকিস্তানি ধারাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু করলেন। রাজনীতিতে এই পাকিস্তানি সংস্কৃতির ছাপ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা দেশের মূলধারার চিন্তাবিদ, পেশাজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের মনে দলটি সম্পর্কে গভীর সংশয় সৃষ্টি করেছিল।  এভাবে বিএনপির জন্মদাতা নিজেই দলকে একদিকে আদর্শিকভাবে জামায়াত, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলের সাথে সংশ্লিষ্ট করে তুলেছিলেন আর অন্যদিকে দেশের মূলধারার চিন্তাবিদ, পেশাজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের তাঁর দল সম্পর্কে শংকিত করে তুলেছিলেন। কিন্তু এঁরা আদতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। বরং তাদেরই সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে মোটামুটি একটি প্রভাবশালী বাম প্রগতিশীল রাজনীতির ধারা বরাবর বহমান ছিল।
কিন্তু ক্রমেই এই ধারাটি যে ক্ষীয়মান হল, এমনকি বর্তমানে কোনো কোনো ক্ষুদ্র দল আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতায় শরিক হচ্ছে তার কারণ জিয়ার পরবর্তীকালে তাঁর উত্তরসুরী স্ত্রী খালেদা জিয়া ও পুত্র তারেকের নেতৃত্বে বিএনপি দিনে দিনে জামায়াত ও ধর্মবাদী দলের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠায় দেশের ভবিষ্যত নিয়ে এরা সত্যিই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।
আওয়ামী লীগের জবরদস্তি, দখলদারি, গা-জোয়ারির যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তাতে অসন্তুষ্ট এবং পুরোপুরি আস্থা নেই মধ্যবর্তী সচেতন মানুষগুলোর। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্ব কখনও তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেয়নি। সমাজের এই অংশ নীতি-আদর্শের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তাদের বিবেচনায় আওয়ামী লীগের রাজনীতি নীতি-আদর্শের দিক থেকে অনেকাটাই ঠিক কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় অহমিকা-জবরদস্তি-দখলদারি মানসিকতার কারণে বাস্তবে তার যথার্থ প্রতিফলন ঘটে না। অর্থাৎ রাজনৈতিক কৌশলে গণতান্ত্রিক আচরণ ক্ষুণœ হতে থাকায় আওয়ামী লীগ নিয়ে অসন্তুষ্টির কারণ ঘটে, বিশেষত এতদিনে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক উত্তরণে দেশ ও সমাজের যে অগ্রগতি হতে পারত তা না হওয়ায় চরম অতৃপ্তিতে ভোগেন তারা। এভাবে দেশে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আরও একটি রাজনৈতিক শক্তির চাহিদা তৈরি হয় যা রাজনীতিতে কাক্সিক্ষত নীতি-আদর্শের প্রয়োগ ঘটিয়ে আওয়ামী লীগকেও ছাপিয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতির এই চাহিদাটি বিএনপি নেতৃত্ব কখনওই অনুধাবন করতে পারে নি। জিয়াউর  রহমানের উত্তরসুরী হিসেবে বেগম জিয়া এবং পুত্র তারেক বিএনপিকে কেবল নীতি-আদর্শের দিক থেকে আরও পিছিয়ে নেয় নি দলকে নতুন আরও নেতিবাচক বিতর্কেও জড়িয়েছে। এর অন্যতম হল একুশে আগষ্টের গ্রেনেড হামলা। অতীতে জিয়ার নেতৃত্বে এ দল স্বেচ্ছায় বঙ্গবন্ধু হত্যায় সংশ্লিষ্টতার সন্দেহ গায়ে মেখেছে, আর বর্তমানে একুশে আগষ্টের হামলাকারীদের আড়াল করতে গিয়ে তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার হত্যা প্রচেষ্টাকারীদের সাথে সংশ্লিষ্টতার সন্দেহের কারণ হল। বিএনপির রাজনীতি সম্পর্কে জন-ধারণা (পাব্লিক পার্সেপশন) ক্রমশই এরকম দাঁড়িয়েছে যে এদল নীতি-আদর্শের দিক থেকে জামায়াত-হেফাজত-খেলাফত প্রমুখ পশ্চাৎপদ চিন্তার ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ী দলের ঘনিষ্ঠ। ফলে বর্তমানে বিএনপি যদি কেবলমাত্র জামায়াতকে দূরে রেখে তার এই পশ্চাৎপদ রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা অস্বীকার করতে চায় তবে তাকে মানুষ নিছক একটি রাজনৈতিক কৌশল মনে করলে তাদের দোষ দেওয়া যাবে না।
বিএনপি যদি তাদের এই অবস্থানকেই সঠিক মনে করে তবে আওয়ামী লীগের প্রতি সন্দিগ্ধ ও অসন্তুষ্ট থেকেও বামপ্রগতিশীল দলগুলো দ্বিদলীয় টানাপোড়েনে, অন্তত মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ ঠেকানোর কৌশল হিসেবে, আওয়ামী লীগের সাথে জোট বাঁধতে পিছপা হবে না। বিভিন্ন ঘটনাবলীতে এ ধারণা ক্রমেই জোরালো হচ্ছে যে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে আগে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ মুক্ত করতে হবে। সে কাজে একটি বৃহত্তর ঐক্য দরকার। তারই অংশ হিসেবে আজ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটে জাসদ বা ওয়ার্কার্স পার্টিকে দেখা যাচ্ছে। আমার মত অনেকের প্রত্যাশা ছিল সিপিবিও এতে শরিক হবে। জোটে থেকেও বাম দলগুলোর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখা কেন জরুরি তা নিয়ে পরে স্বতন্ত্র কলাম লিখব।
যা হোক, এই ধারাকেই আপাতত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারা বলা যায়। এটি বর্তমানে আরেকটু জোরদার হল দুটি কারণে, প্রথমত, গণজাগরণ মঞ্চের উত্থানের ফলে দেশের তরুণসমাজ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কিন্তু রাজনৈতিকভাবে কিছুটা হতাশ ও নিষ্ক্রিয় মানুষজন মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ ঠেকানোর জন্য আবার সরব ও সক্রিয় হয়েছেন। দ্বিতীয়ত, বিএনপি দশম সংসদের নির্বাচন সামনে রেখে যে রাজনীতি করেছে তাতে তার আদর্শিক-নৈতিকভাবে জামায়াত-ঘনিষ্ঠতা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। ফলে মূলত আন্তর্জাতিক চাপে বিএনপি যখন জামায়াতকে ছাড়ার কৌশল নেয় তখন তা নীতি-আদর্শ নয় নিছক কূটকৌশল বলেই বিবেচিত হচ্ছে। লন্ডনে বসে তারেক জিয়ার তৎপরতা, ফোনালাপ ইত্যাদি সম্পর্কে যতটুকু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তাতেও একথাই প্রমাণিত হয় ভালোভাবে।
আপাতত কিছুদিন রাজনীতি এই ধারাতেই ঢিমিয়ে ও ঝিমিয়ে চলবে বলে মনে হয়। কারণ গত দু’মাসে বিএনপি ও জামায়াত ব্যাপকভাবে ধক্ষংস ও বীভৎস হত্যার রাজনীতি করে এবং অবরোধ হরতালের আধিক্য ঘটিয়ে কর্মী ও জনগণকে ক্লান্ত ও রাজনীতিবিমুখ করে ফেলেছে। স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার জন্যে বর্তমানে কিছুদিন সবারই বিশ্রাম ও সময় দরকার। 

Saturday, January 18, 2014

সাম্প্রদায়িকতা : মুসলমানকেই দায়িত্বশীল দূরদর্শী ভূমিকা নিতে হবে



দেশের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ মানুষ মনে করেন বাংলাদেশে কোনো সাম্প্রদায়িকতা নেই। দৃষ্টান্ত দিয়ে তাঁরা প্রতিবেশী ভারতের চিত্র তুলে ধরেন-সেখানে ১৯৪৭-এ দেশ ভাগের পর অসংখ্যবার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছে এবং বহু প্রাণহানি ঘটেছে। বলাবাহুল্য নিহত বেশির ভাগ সে দেশের সংখ্যালঘু অর্থাৎ মুসলমান। কিন্তু সে তুলনায় বাংলাদেশে রক্তপাতের ঘটনা কম। কথাটা সত্য।
কিন্তু এতে আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাস্তবতার পুরো ও প্রকৃত চিত্র ধরা পড়ে না। ফলে মূল্যায়ন যথার্থ হয় না। যথার্থ মূল্যায়নে কী চিত্র উঠে আসে তা জানা দরকার।
সবাই জানি সাতচল্লিশে দেশভাগ হয়েছিল দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে, তবে এর ফলে পাকিস্তানই ধর্মভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র হতে চেয়েছে, ভারত চেয়েছে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে। দেশভাগে মূলত বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ হয়েছে, এবং তা হয়েছে দেশের বিভিন্ন জেলার জনসংখ্যার ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে। তবে বাংলার যেসব জেলা পাকিস্তানে পড়েছে তার মধ্যে কোনো কোনোটিতে হিন্দু-মুসলিম অনুপাত খুবই কাছাকাছি ছিল, যেমন খুলনা, ফরিদপুর প্রভৃতি। আর সামগ্রিকভাবে হিন্দু-মুসলিম অনুপাত ছিল ৩০:৬৫। বাকি ৫ ভাগ বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্র্মাবলম্বী।
ৎআর ৬০ বছর পরে হিন্দু জনসংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে গেছে, তা নেমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৯ ভাগে। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছাড়া এত হিন্দু কেন দেশত্যাগ করল, সেটা বোঝা দরকার।
বাংলার কলকাতা-কেন্দ্রিকতা : সোয়া তিনশ বছর আগে জব চার্নক কলকাতা শহরের পত্তন করার পর থেকে এ শহর বাংলার বাণিজ্যকেন্দ্র, শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র এবং বাংলা ও ভারতবর্ষের প্রশাসনিককেন্দ্র হিসেবে ক্ষমতা ও সম্পদের মূল ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। ফলে বাংলার বর্ধিষ্ণু এবং উচ্চাভিলাষী মানুষ এ শহরেই বসতি করেছেন। কলকাতার প্রয়োজন ও আকর্ষণ হিন্দু-মুসলিম কেউই ছাড়তে পারেন নি। তাই হিন্দুদের মধ্যে বিত্তবান ও শিক্ষিত পরিবারগুলো বেশির ভাগই দেশভাগের সময় ভারতে বসবাসের অপশন দিয়েছিলেন। তাতে দেশভাগকে কেন্দ্র করে বর্ধিষ্ণু হিন্দুর ব্যাপক দেশত্যাগ ঘটে। ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম জনজরিপে দেখা যায় হিন্দু জনসংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে শতকরা ২২ ভাগে।
শূন্যতা ও সুযোগ : সেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের (১৭৯২) পর থেকে বাংলায় হিন্দুদের হাতেই ছিল বেশির ভাগ জমিদারি তথা জমি। সাদা চোখে দেখেই বলা যায় ঐ সময় ৩৫ ভাগ হিন্দুর হাতে ৬০ ভাগ মুসলমানের চেয়েও বেশি স্থাবর-সম্পদ ছিল।
জমিদারি আর বিত্তের জোরে অধিকাংশ জমির মালিক ছিলেন এরা। দীর্ঘকাল তাদের শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়েছে কৃষক মুসলমান এবং নিম্নবর্ণের তপশিলি হিন্দুসম্প্রদায়। মূলত এই শোষণ থেকে মুক্তির জন্য এরা পাকিস্তান সমর্থন করেছিল।
পাকিস্তানের জন্ম আকস্মিকভাবে তাদের কেবল মুক্তি দেয় নি, একটু বেপরোয়া উচ্চাভিলাষীদের জন্য জোর খাটিয়ে বা পানির দামে স্থাবর সম্পত্তির মালিক হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছিল। এ কাজে সরকারের সহায়তা ছিল এবং ১৯৬৫’র পাক-ভারত যুদ্ধের পর ‘শত্রুসম্পত্তি আইন’ চালু করে সরকার প্রায় জবরদখল ও লুণ্ঠনের সুযোগ করে দিয়েছিল।
ফলে পাকিস্তানের শেষ পর্যায়ে হিন্দু জনসংখ্যা শতকরা ১৫ ভাগের নিচে নেমে যায়। বিষয়টি আরও স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য পাক সরকারের নীতি একটু আলোচিত হওয়া দরকার।
পাক-সরকারের সাম্প্রদায়িক নীতি : পাকিস্তানের স্রষ্টা জিন্নাহ দেশটিকে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে চাইলেও তাঁর সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি মূলত তাঁর অকাল-মৃত্যু এবং পাঞ্জাবি-চক্রের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে যাওয়ায়। এই চক্র পাকিস্তানকে ধর্মীয় ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে চাইল। রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা খাড়া করল ভারত ও হিন্দুকে। ফলে পাকিস্তানে হিন্দু সম্প্রদায় বরাবর সন্দেহভাজন নাগরিক হিসেবে গণ্য হয়েছে।
চাকুরিতে তাদের পদোন্নতি সীমিত রাখা হল যাতে কোনো দপ্তরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার দায়িত্ব তাদের হাতে না যায়। যেমন হিন্দু সামরিক বাহিনীতে মেজরের ওপরে যাবে না, প্রকৌশলী হলে নির্বাহী পর্যন্ত গেলেও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হতে পারবে না। কলেজে অধ্যক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, জেলা প্রশাসক, পুলিশের সুপার হতে পারবে না, প্রশাসনে উপসচিবের উপরে যাবে না ইত্যাদি। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ ছিল। এভাবে চাকুরে এবং ব্যবসায়ী হিন্দু উভয়ের জন্যই উন্নতি ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে দিয়েছিল পাকিস্তান।
রাষ্ট্র স্বয়ং সাম্প্রদায়িক নীতিতে পরিচালিত হলে যে পক্ষপাত সৃষ্টি হয় তাতে এর নিজস্ব প্রক্রিয়াতেই সমাজে শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। উন্নতি ও ভবিষ্যতের পথ রুদ্ধ হলে মানুষের নৈতিক বল ভেঙে যায়। একে অসম শক্তি, তার ওপরে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষপাত, ফলে হিন্দুর পক্ষে পক্ষপাতপুষ্ট সংখ্যাগুরুর সাথে পাল্লা দেওয়ার কোনো বাস্তবতা ছিল না।
দুর্ভাগ্যের বিষয় স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ধর্মীয় পক্ষপাত থেকে মুক্ত হবে বলে ভাবা হলেও ’৭৫-এর পর জিয়ার নেতৃত্বে ফের পাকিস্তানি রাষ্ট্রীয় নীতিই এদেশে চালু হয়। তার ওপর রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ও সমাজনীতি জোরদার হতে থাকে। এই ধারা ১৯৯৬ পর্যন্ত চলেছে অর্থাৎ ’৪৭-এর পর বিগত ৬৪ বছরের মধ্যে ৪৪ বছরই (১৯৪৭ থেকে ১৯৭১= ২৪+১৯৭৫ থেকে ১৯৯৫=২০ বছর) পাকিস্তানি সাম্প্রদায়িক ধারায় দেশ চলেছে। এর ফল হিসেবে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা হ্রাসসহ সংখ্যালঘুসমাজের ক্রমাগত অবক্ষয় ঘটেছে। ১৯৭৪ সনের প্রথম জনজরিপে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ১৩.৫ ভাগ যা এখন ৯ ভাগের নিচে নেমে গেছে।
দুই সম্প্রদায়ের মনোজগৎ : বাইরের ঘটনাবলী মানুষের সামাজিক জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, যার সবটারই প্রভাব পড়ে মনে। যে প্রক্রিয়ায় বিত্তবান হিন্দু সম্পদ হারিয়েছে তা কেবল রাষ্ট্রীয় জবরদস্তির ফল নয়, সাধারণত স্থানীয়ভাবে কোনো উদ্যোগী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জবরদস্তির মাঠপর্যায়ের তৎপরতায়। এই জবরদস্তিতে ত্রাস সৃষ্টি বড় উপাদান, যার জন্য অগ্নিসংযোগ, ডাকাতি এবং অবশ্যই নারী নির্যাতন, মিথ্যা মামলা ও অন্যায়ভাবে হয়রানি ও অবমাননা অন্তর্ভুক্ত। এভাবে দিনের পর দিন একতরফা নির্যাতনের শিকার হয়ে কোনো জনগোষ্ঠী ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরে থাকতে পারে না।
মানুষ অতীতের কথা ভেবে তার বর্তমানকে বিপদগ্রস্ত করে রাখতে ও ভবিষ্যতকে জলাঞ্জলি দিতে পারে না। সন্তানের ভবিষ্যৎ, নারীর সম্ভ্রম, পৈত্রিক সম্পদ রক্ষায় অপারগ হলে, অন্যায় অবিচারের প্রতিকার না পেলে, রাষ্ট্রযন্ত্র স্পষ্টভাবে নিরপেক্ষ না হলে চোখের জল মুছে তাকে জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটি নিতে হয়। তার পরেও প্রধানত নিরাপত্তা ও শেষ দেখার আশা থেকে তারা প্রথমে গ্রাম ছেড়ে শহরে আস্তানা গাড়ে, তারপর সন্তানদের নিরাপদ জায়গায় স্থানান্তর করে, এরপর পরিবারকে দেশান্তরে পাঠায়, শেষে উপায়ন্তর না দেখে লোলুপ প্রতিবেশী বা কোনো শঠব্যক্তির কাছে পানির দামে সম্পদ ছেড়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস চেপে চোখের জল ফেলতে ফেলতে চৌদ্দপুরুষের ভিটেমাটি জন্মভূমির মায়া ছাড়তে বাধ্য হয়। এটা ঠিক, পাশেই ভারতবর্ষ, বিশেষত বাঙালি অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ থাকায় তাদের জন্য দেশত্যাগ কিছুটা সহজ হয়েছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হল সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগোষ্ঠীই সুবিধাভোগী সম্প্রদায় হিসেবে সংখ্যালঘুর এই নীরব দেশত্যাগ ও রক্তপাতহীন সাম্প্রদায়িকতার শিকার হওয়ার জন্য দায়ী হলেও তাদের মধ্যে সচেতন বলে পরিচিত অংশও এ ব্যাপারে সচেতনও নন, সংবেদনশীল তো ননই। বরং অন্যায়ে ভুক্তভোগীর কাটা ঘায়ে নূনের ছিটার মত প্রকাশ্যে দোষারোপ করে বলতে থাকে-দাদাদের এক পা তো ভারতে। জ্ঞানের পরিচয় দিতে অনেকে উচ্চকণ্ঠে বলেন, হিন্দুরা হাজার কোটি টাকার পুঁজি পাচার করে চলেছে ইত্যাদি।
কিন্তু এ সমালোচনা যে-ভয়ঙ্কর অন্যায়, মারাত্মক অবিচার, ক্ষমার অযোগ্য পাপের ওপর নির্মিত হচ্ছে সে বিবেচনা আমাদের থাকছে না। সংখ্যাগুরুর যথাযথ উপলব্ধি ছাড়া রক্তপাতহীন নীরব সাম্প্রদায়িকতা ক্রমেই সহিংস, ব্যাপক হয়ে উঠবে, এমনকি রক্তপাতও ঘটবে যাতে বাকি ৯ ভাগ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। ২০০১ বা ২০১৪ সালের সাম্প্রদায়িক হিংসাত্মক ঘটনাবলী এরই আলামত। এর পেছনে কতটা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা, কতটা সম্পদের লোভ আর কতটা রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষপাত তার চুলচেরা হিসেব ততটা প্রয়োজনীয় নয়, কারণ এ তিনের যোগফলই বর্তমান সহিংস সাম্প্রদায়িকতার মূলে কাজ করছে।
আর আক্রমণকারীদের দলগত পরিচয় খুঁজলে দেখা যাবে ধর্মীয় উপাদানের জোগান আসে জামায়াত ও এ ধরনের হিংসাত্মক ধর্মবাদী দলের কাছ থেকে, আর দখলের বিচারে এক সময় মুসলিম লীগের আধিপত্য থাকলেও পরে আওয়ামী লীগ শূন্যস্থান পূরণ করেছে, আর এখন বিএনপিও পিছিয়ে নেই।
এর মূলোৎপাটন করার কাজটি একেবারেই একতরফা সংখ্যাগুরুর দায়িত্ব, সেকথা আমাদের বুঝতে হবে। ষাট বছরের অন্যায়, অবিচার ও অমানবিকতার কী মূল্য সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় এবং এ দেশ দিচ্ছে সে হিসেব আরেক দিন হবে। কিন্তু দেশকে সঠিক পথে আনতে হলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে উদ্যোগী হতে হবে। রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সমাজ সংগঠনে নামতে হবে, আর সমাজের সংবেদনশীল শিক্ষিতজনদের সরব ও সক্রিয় হতে হবে। তাঁরা কেবল সহিংসতার বিস্ফোরণের প্রতিধ্বনির ভূমিকা নিলে হবে না। নিজেদের ধ্বনিটিকে উদার মানবতার বাণীর রূপ দিয়ে সমাজে প্রভাব বিস্তারের মত দক্ষতায় বরাবর বজায় রাখতে হবে।
মনে রাখতে হবে ১-২ নয় ৬০ বছরের ভেঙে-যাওয়া মন জোড়া লাগানো সহজ কাজ নয়। হারানো আশা, লুপ্ত আস্থা ফিরে পাওয়া নির্ভর করবে সংখ্যাগুরু সে কাজে কতটা আন্তরিক হবেন, কতটা ধৈর্য ধরবেন, কতটা উদার হবেন তার ওপর এ হবে মনুষ্যত্বের পথে সংখ্যাগুরুর বিনীত দায়িত্বশীল দূরদর্শী এক অভিযাত্রা। সে অভিযাত্রায় সকলকে আহ্বান জানাই।

Sunday, January 12, 2014

পাঁচ অংকের নাটক

আবুল মোমেন

এই নির্বাচন অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু প্রশ্ন হল এই দায় জাতির ঘাড়ে চাপল কীভাবে? এ কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, আমাদের চোখের সামনেই ধাপে ধাপে এই নাটকীয় প্রশ্নবিদ্ধ দায়টি তৈরি হয়েছে। প্রেক্ষাপটটা বিচার করলে কারণ, দায়ি এবং সমাধান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া  যেতে পারে। মনে হচ্ছে ঠিক পাঁচ অংকের নাটকের মতই আমরা এটা সাজাতে পারব। প্রতি অ্যাক্ট বা অংকে অনেক দৃশ্য আছে, কিন্তু কলামের স্বল্প পরিসরে অত খুঁটিনাটিতে আমরা যাব না।
১.
নাটকের গোড়া পত্তন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের মাধ্যমে। এ ব্যবস্থা নিয়ে দ্বিমত থাকাই স্বাভাবিক, আমি নিজেও গোড়া থেকে এর বিরোধী ছিলাম কারণ এটি রাজনীতিবিদদের সততাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। এবং এটি পরে রাজনীতিবিদদের আরও চতুর অসততার পথে নিয়েছে ও নতুনতর সংকট সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু এ নিয়ে প্রধান বিরোধী দল ও প্রাসঙ্গিক অন্যান্যদের সাথে আলোচনা করে তাদের মতামত বিবেচনায় নিয়ে তারপর সিদ্ধান্তে আসাই সঙ্গত ছিল। বলা যায় প্রধানমন্ত্রী একাই এ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছেন।
না নাটকটি এত সরল নয় যে প্রথম অংকেই কারণ, দায়ি ও সমাধান খুঁজে পাব। আর একটু এগুতে হবে। বিএনপি অবশ্য পরাজয়ের পর জনতার দরবারে বৃহৎ দল হলেও সংসদে ক্ষুদ্র শক্তির বিরোধী দল হিসেবে নিজেদের ভূমিকা নির্ধারণে ব্যর্থ হয়েছে। বর্জন যে মূলমঞ্চেও অনুপস্থিতিজনিত শূন্যতা সৃষ্টি করে তা দলের নেতৃত্ব ভেবে দেখেনি। বিএনপি নেত্রী এবং সিনিয়র নেতৃবৃন্দ মাঠপর্যায়ের আন্দোলন পরিচালনায় দক্ষ না হওয়ায় তাঁরা সরকারি বাধার মুখে ঠিক মত প্রতিরোধ আন্দোলন গড়তে পারেন নি। ফলে তাদের একটা এলেবেলে অবস্থায় নির্বাচনের সময় এসে পড়েছে। ততক্ষণে নাটকের দ্বিতীয় অংকের পর্দা উঠে গেছে, আমরা তাতে প্রবেশ করব।
২.
দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার দেশের নাগরিকসমাজের বহুদিনের দাবি পূরণ করে মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে। বিচার শুরু হওয়ার পর স্বভাবতই বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামের সব বড় নেতা এবং দলটি যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত হল। বিএনপির দু’জন নেতাও অভিযুক্ত হলেন। জামায়াত বরাবর তাদের পূর্ব অবস্থানেই থেকেছে। এখনও সে অবস্থানে থেকেই মামলা নিয়ে দেশেবিদেশে সরকারবিরোধী রাজনীতি করে চলেছে। বিএনপি ট্রাইব্যুনাল ও এর কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিষয়টা প্রশ্নবিদ্ধ করতে গিয়ে সহোদর জামায়াতের সমব্যথীর ভূমিকা নিয়ে নিজের অবস্থানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ট্রাইব্যুনালের কিছু কিছু মামলার রায় ঘোষণার পর থেকে জামায়াত পুরোপুরি ধ্বংসাত্মক ভূমিকায় ফিরে যায়। নির্বাচনী সহিংসতা পর্যন্ত তাদের ভূমিকার সাথে একাত্তরের ভূমিকার সামঞ্জস্য পাওয়া যায়। একই কায়দায় হিন্দু সম্প্রদায় ও তাদের বসতভিটা এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক ও তাদের বাড়িঘর জামায়াত-শিবির কর্মীদের টার্গেট হয়ে পড়ে। একইভাবে খুন, ধর্ষণ, জখম, অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ইত্যাদি চালিয়ে যাচ্ছে। এবারে এর সাথে যুক্ত হয়েছে নির্বিচারে বৃক্ষ কর্তন। বিএনপি বরাবর জামায়াতকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে, এমনকি সর্বশেষ নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বেগম জিয়া সমর্থনের সাফাই গাইলেন। এই অবস্থা ইতিহাসের মুখ খুলে দেয়।
ফলে নাটকের তৃতীয় অংকের পর্দা উঠেছে আমাদেরকে নিকট ও অনতিনিকট ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে।
৩.
পচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করে জেনারেল জিয়া আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতি দাঁড় করাতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও জাতির আকাক্সক্ষা মূল্যায়ন না করে প্রায় প্রত্যাখ্যাত পরাজিত পাকিস্তানি ধারার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শুরু করলেন। তাঁর দলে যেমন পথহারা চিনপন্থী বামরা যোগ দিয়েছিলেন তেমনি দলে এসেছেন মুসলিম লীগ ও সেই মানসিকতার লোকজন। দলের অবস্থান শক্ত করার জন্যে তিনি জামায়াতে ইসলামি ও ধর্মান্ধ দলগুলোকে পুনর্বাসিত করলেন। ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত দুই দশক ধরে এই রাজনীতি চলেছে। একাত্তরের মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচার যেমন তেমনি পচাত্তরের আত্মস্বীকৃত হত্যাকারীদের বিচারের পথ রুদ্ধ ছিল এই দীর্ঘ দুই দশক। কিন্তু দেশের বিবেকবান মানুষদের বিবেচনায় এসব ঘটনা জাতির জীবনে কলঙ্ক এবং এগুলোর বিচার হওয়া আবশ্যিক। এ নিয়ে দীর্ঘকাল ধরে নাগরিকসমাজ আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন। এসব অপরাধের বিচার জাতির জন্যে ঐতিহাসিক, নৈতিক, আইনগত দায় হিসেবে বিবেকের বোঝা হয়েছিল। কুড়ি বছর পরে ক্ষমতায় ফিরে আওয়ামী লীগ সরকার সে দায় পূরণের বাধাগুলো সরিয়ে পচাত্তরের খুনের বিচার শুরু করেন। কিন্তু পরের নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে বিএনপি অসমাপ্ত বিচার কাজ বন্ধ করে এবং একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও শেখ হাসিনাকে হত্যার ঘৃণ্য অপচেষ্টার প্রকৃত আসামীদের আড়াল করার দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের ভূমিকাকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। এখনও দলটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে দায়িত্ব-এড়ানো কৌশলি উত্তর দিয়ে গা-বাঁচানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রথম থেকে যুদ্ধাপরাধী, দালালদের নিয়ে দল গড়া, পাকিস্তানপ্রীতি, ভারতবিরোধিতা, সরকারি কাজে সাম্প্রদায়িক বিবেচনায় চলা, মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে ঔদাসীন্য, বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি বিরূপতা, একাত্তর ও পচাত্তরের অপরাধীদের দায়মুক্ত করার কৌশল, জামায়াতের সাথে জোটবদ্ধ রাজনীতির ধারাবাহিকতায় সমাজের শিল্পী-সাহিত্যিক ছাত্র-তরুণসহ সচেতন অংশের চোখে বিএনপি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। এই পটভূমিতে নাটকের চতুর্থ অঙ্কের পর্দা উঠলে আমরা বর্তমান আন্দোলনের সম্মুখীন হব।
৪.
চতুর্থ অংকে দেখা যাচ্ছে মঞ্চে শুধু তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুই একমাত্র বিষয় নয়, বরং সরকারবিরোধী আন্দোলন যে ধ্বংসাত্মক রূপ নিয়ে মঞ্চ কাঁপাচ্ছে তার মূল কার্যকারণ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার জরুরি বিবেচ্য ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা ১৯৭১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৮ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের এবং প্রতীক্ষার ফসল হিসেবে জাতির দায় মেটানোর এই উদ্যোগ সচেতন সকলকে স্বস্তি এনে দিয়েছে। দেখা গেল দেশের তরুণ সমাজ এ বিষয়ে অত্যন্ত উৎসাহী এবং কোনোরূপ ছাড় দেওয়ার বিপক্ষে। জনগণ, বিশেষত তরুণ সমাজের এই ইচ্ছার গুরুত্ব অসীম। বিএনপি ঘটনাবলীর এই গতিপ্রকৃতি উপলব্ধি করেছে বলে মনে হয় না। তারা নাটকে নতুন চরিত্রের জোরালো আবির্ভাব (তরুণ সমাজ) এবং এর গতিপ্রকৃতির মোড় ঘোরানোর বিষয়টি বিবেচনায় নেয় নি। বরং পুরোনো অভ্যাসগত জেদ, বিরোধিতা ও বর্জনের লাইনেই থেকে দলের ভূমিকাকে জামায়াতের সাথে একাকার করে ফেলেছে। এই পরিস্থিতি আমাদের নিয়ে যাচ্ছে নাটকের পঞ্চম ও শেষ অঙ্কে।
৫.
নাটকের সব পাত্র মঞ্চে এসেছেন, সব ঘটনা মঞ্চে ঘটেছে। দেখা যাচ্ছে সমস্যাটা একমাত্রিক নয়, অন্তত দ্বিমাত্রিক। বর্তমান ইস্যু তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর বকেয়া ইস্যু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে ঘিরে নাটক জমে উঠেছে। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুটি মূলত দুই বড় দলের ক্ষমতার লড়াইয়ের অংশ, আর যুদ্ধাপরাধের বিচারের ইস্যুটি জাতির ঐতিহাসিক নৈতিক দায়মুক্তির বিষয়। মানতেই হবে পরের ইস্যুটি এ নাটকে আবেগ ও বিবেকি বিবেচনার যে দুয়ার খুলে দিয়েছে তা আগেরটিকে বিষয়ের গুরুত্ব ও ব্যঞ্জনায় ছাপিয়ে যায়। কেননা শেখ হাসিনা দ্বিদলীয় দ্বন্দ্বে বিষয়টি সীমাবদ্ধ রাখেন নি, তাকে জাতীয় রূপ দিতে পেরেছেন। বর্তমান বাস্তবতায় নিছক একটি নির্বাচন যতটা গুরুত্বপূর্ণ তার চেয়ে অধিকতর গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে জাতির যাত্রাপথ ঠিক করা ও রাখা। ফলে একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মূল্য গুণে জাতি যদি তার দীর্ঘকালের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা শোধরাতে পারে তবে তার মূল্য অবশ্যই বেশি হবে। নির্বাচনের ইস্যুতে আওয়ামী লীগ যদি খলনায়ক হয় তো জাতীয় ইস্যুতে সে-ই নায়ক। দুর্ভাগ্যের বিষয় বিএনপির ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টোও দাঁড়াচ্ছে না। কারণ তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু আদায় করতে গিয়ে তারা যে ধ্বংসাত্মক আন্দোলন চালু করেছে তাকে কোনোভাবেই নায়কোচিত কাজ বলা যাবে না।
৬.
এবার দর্শকদের মতামত দেওয়ার পালা। যারা অন্ধ আওয়ামীপন্থী তারা এই সুযোগে বিএনপিকে ধ্বংস করতে চাইতে পারে। যারা অন্ধ বিএনপিপন্থী বা আওয়ামী-বিরোধী তারা আবার একাত্তর বা একুশে আগষ্টের কায়দায় হত্যা ও ধ্বংসাত্মক পথে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে চাইতে পারে। গণতন্ত্রের স্বার্থে এর কোনোটাই ঠিক হবে না।
তাহলে পথ কোনটি? পথ হল, বিএনপিকে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা মেনে তারপর আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করার রাজনীতি সাজাতে হবে। এটি দেশের শান্তি, স্থিতি, সমৃদ্ধি এবং গণতন্ত্রের স্বার্থে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়া বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগের একটি যোগ্য প্রতিপক্ষ দল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আর আওয়ামী লীগকে গণতন্ত্রের স্বার্থে সবধরণের গা-জোয়ারি দখলদারি মানসিকতা ছেড়ে বিরুদ্ধশক্তিকে জায়গা দিয়ে গণতন্ত্র চর্চার মানসিকতা দেখাতে হবে। আর যে নাগরিকগণ অনর্গল কথা বলছেন, সমাধান বাতলাচ্ছেন তাঁদের উচিত হবে বাগাড়ম্বর ছেড়ে দুই বড় দলের মধ্যে সমঝোতার আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া, এ কাজে দূতিয়ালী করা। তা না হলে দেশ, জনগণ, গণতন্ত্র, ভবিষ্যত এবং ইতিহাসের কাছে তাঁরা সবচেয়ে বেশি দায়ি থাকবেন।


Monday, January 6, 2014

এবার নির্বাচনের পরিণতির পরিণতি নিয়ে ভাবতে হবে

আবুল মোমেন


নির্বাচনের আগের দিনের জন্যে যখন লিখছিলাম তখন জানা ছিল যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বন্ধ করার আর উপায় নেই। তাই বলেছিলাম ক্ষমতাসীন দলের জন্যে নির্বাচনের ফলাফল আর গুরুত্বপূর্ণ নয়, তারও চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলানো। এও বলেছি তার বর্তমান একলা-চলো নীতি বজায় রেখে সেটা প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু আওয়ামী লীগ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে যা করল তা তাদের অন্ধ সমর্থকদেরও বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। আমি বারবার লিখেছি যে বর্তমান বাস্তবতায় নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে ব্যাপক কারচুপি ঘটিয়ে ফলাফলে গুণগত পরিবর্তন এনে পার পাওয়া সম্ভব নয়। সামরিক শাসকরা মূলত সামরিক বাহিনীর সমর্থনে-সহযোগিতায় এ কাজ করেছে। কিন্তু তা-ও শেষ রক্ষ হয় নি, তাদের দুই দলকেই সেই কালিমা বহন করে যেতে হচ্ছে, হবে। তখন তো পর্যবেক্ষক আর গণমাধ্যমের ভূমিকা এত প্রসারিত ও শক্তিশালী ছিল না। এখনকার বাস্তবতায় রাষ্ট্রযন্ত্রকে এভাবে ব্যবহার করা এক প্রকার অসম্ভব।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ যদি দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে চায় তাহলে তা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির ধারায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাবে বলে আমার ধারণা। প্রথমত, পাকিস্তান আমল থেকেই আওয়ামী লীগ গড়ে উঠেছিল পূর্ব বাংলার আপামর জনগণের রাজনৈতিক মুখপাত্র হিসেবে। আমি এ নিয়ে দীর্ঘ ব্যাখ্যায় যাব না এখানে। তবে বলতে পারি এ নির্বাচনের ফলে তার সেই ভাবমূর্তি ক্ষুণণ হল এবং ভূমিকা ব্যাহত হবে। কারণ যে আওয়ামী লীগকে মানুষ জানত জনসম্পৃক্ত দল হিসেবে তারা আজ জনগণকে তোয়াক্কাই করল না, তাদের ভোটাধিকারকে করল অমর্যাদা। বোঝা গেল, দলের সমর্থকেদের নির্বাচনে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করাও হয়নি, কারণ যেকোনো হিসেবে এ দলের অন্তত ৩৫% সমর্থক-ভোটার আছে। তারা যে ভোটাধিকার প্রয়োগ করল না সে দায় তো নেতৃত্বকেই নিতে হবে। তাছাড়া খোলামেলাভাবে একথাও বলা যায়, দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জন্যে আওয়ামী লীগ ভিন্ন অন্য দল পছন্দের সুযোগ না থাকায় এরা এ দলের ভোটব্যাংক হিসেবেই পরিচিত হয়েছে। কেন্দ্রভেদে দেশে সংখ্যালঘু ভোটার শতকরা ১৫ থেকে ৫০ ভাগ পর্যন্ত আছে। প্রকৃত ভোট বলে দিচ্ছে ভীতসন্ত্রস্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ভোটাধিকার প্রয়োগের ঝুঁকি নেয় নি। অর্থাৎ সরকার ও সরকারি দল তাঁদের মধ্যে ভয়-কাটানোর মত নিরাপত্তার আস্থা সৃষ্টি করতে পারে নি। সরকারে থাকলেই যে বাস্তবের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, এটি তারই প্রমাণ।
রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ক্ষমতা দখলে রাখার যে রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি দেশে চালু রয়েছে আওয়ামী লীগ ছিল এতকাল তার বাইরে গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির প্রধান অবলম্বন। এখন থেকে আওয়ামী লীগও বিএনপি-জাপার মত প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে জনগণের রাজনৈতিক শক্তির অবলম্বন হিসেবে দুর্বল হয়ে গেল। এই সূত্রে দ্বিতীয় বিষয়টি হল নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত রাখার জন্যে আওয়ামী লীগ বিএনপিকে নির্বাচনকালীন চলমান পরিস্থিতির কোনো পর্যায়েই ন্যূনতম আস্থায় নেয় নি বলে আগামী দিনগুলোতে - অন্তত আওয়ামী লীগ যতদিন ক্ষমতায় থাকবে - বিএনপি ও জামায়াতের জোট অব্যাহত থাকবে। এটি গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ ক্ষুণœ করবে কিন্তু তার দায় বহুলাংশে পড়বে আওয়ামী লীগের ওপর। তৃতীয়ত, এখন যদি আওয়ামী লীগ দ্রুত বিএনপির সাথে আলোচনার পথ খুলতে না পারে তবে ক্রমবর্ধমান বিরোধিতার তপ্ত রাজনীতি উভয় পক্ষেই মধ্যপন্থী নমনীয় গোষ্ঠীকে কোনঠাসা ও নিষ্ক্রিয় করে দেবে এবং উভয় দিকে অগণতান্ত্রিক অরাজনৈতিক শক্তির প্রাধান্য বাড়বে। আর তাতে জামায়াতের জন্যে নতুনভাবে রাজনীতির পথ খুলে যাবে। অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান হারে রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গের নিপীড়ক ভূমিকায় নির্ভরশীল হয়ে আওয়ামী লীগেরও রাজনৈতিক সাংগঠনিক শক্তি কমতে থাকবে।
এরকম বাস্তবতার পটভূমিতে যদি কোনোভাবে জোটবদ্ধ বিএনপি ক্ষমতায় আসে তবে জামায়াত বা জামায়াতি প্রতিক্রিয়া ও প্রতিহিংসা সামাল দেওয়া বিএনপির পক্ষেও কঠিন হবে বলে আশংকা করি। তাতে দেশ বিপর্যয়ের কোনদিকে যাবে, হানাহানি কোন পর্যায়ে গড়াবে তা আন্দাজ করাও মুশকিল।
ফলে ভাবতে হবে কীভাবে এই সম্ভাব্য নৈরাজ্যের পরিণতি ঠেকানো / এড়ানো যায়।
বলা বাহুল্য একতরফা নির্বাচনের ট্রেনে চেপে - স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে - যে গন্তব্যে আওয়ামী লীগ ও দেশ পৌঁছেছে তার প্রায় সবটা দায় ট্রেনের চালক হিসেবে আওয়ামী লীগের ওপরই এসে পড়বে। নিশ্চয় বিরোধী পক্ষে নৃশংসতা ও হিংসার নেতিবাচক রাজনীতির সমালোচনা হবে, কিন্তু তা যেহেতু মূলত প্রতিক্রিয়ারই প্রকাশ তাই রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চের সক্রিয় অংশের দিকে আঙ্গুল উঠবেই।
তবে বিএনপিও দেশের বড় ও বিকল্প গণতান্ত্রিক দল হিসেবে সমালোচনা এড়াতে পারবে না। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর সময় থেকে রাজনৈতিক অঙ্গন পুরোটাই দখল করে নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। আমার ধারণা কীভাবে এই প্রতিকূলতার মধ্যেও মাঠে উপস্থিত ও সক্রিয় থেকে খেলার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া যায় তা নিয়ে বিএনপি-নেতৃত্ব বিশেষ ভাবনাচিন্তা করে নি। তারা আড়াল থেকে চোরাগোপ্তা আক্রমণের পথ ধরল, যা তাদের স্বাভাবিক খেলা নয়। আওয়ামী লীগ তাদের মাঠ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে বারবার মূল যে অস্ত্রটি ব্যবহার করেছে তা হল বিএনপিকে উত্তেজিত করে তোলা। আর এই ফাঁদে বারবারই পা দিয়েছে বিএনপি নেতৃবৃন্দ, বিশেষত দলীয় সাংসদরা। এভাবে তারা নিজেদের অপরিপক্কতারই পরিচয় দিয়েছেন। তাদের জন্যে শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারত আইয়ুবের জাতীয় সংসদে মুষ্টিমেয় বিরোধী সাংসদদের ভূমিকা। মাত্র অল্প কয়েকজন মানুষ কীভাবে তাঁদের তুখোড় সমালোচনামূলক বিশ্লেষণধর্মী বক্তব্যের মাধ্যমে আইয়ুব সরকারের স্বরূপ উন্মোচন ও সরকারকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়তেন তা সে আমলের পত্রিকায় এখনও ধরা আছে। বিভিন্ন মতাদর্শের এই মানুষগুলো, যেমন শাহ আজিজ, মিজান চৌধুরী, ফরিদ আহমদ, মাহবুবুল হক প্রমুখ এ কাজে দারুণ দক্ষতার পরিচয় দিতেন। বস্তুত মুষ্টিমেয় এই কজন মানুষের বক্তব্যই পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হত। আইয়ুববিরোধী রাজনৈতিক চেতনা বিস্তারে তা বড় ভূমিকা রেখেছিল। অবশ্য আজকাল সাংসদদের মান যে জায়গায় নেমেছে তাতে এ ভূমিকা পালন কঠিন। কিন্তু তার দায়ও তো তাদের দলেরই।
পরেও আলোচনার সুযোগগুলো বিএনপিরই লুফে নেওয়া উচিত ছিল। কারণ যেকোনো বিচারে যে কোনো অবস্থায় এবার বিএনপিরই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু গণমাধ্যমের সামনে নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরার কোনো সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেন নি বিরোধী নেত্রী বা তাঁর নেতৃবৃন্দ। তারা এর পরিবর্তে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতকে রক্ষা করার পথ গ্রহণ করেছে। তাতে দেশের বিরোধী রাজনীতি আর নিয়মতান্ত্রিক থাকল না, প্রধানত জামায়াত-শিবিরের নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়ে সন্ত্রাস ও নাশকতার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এটি গণতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির দায়িত্বহীনতা কিংবা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা প্রমাণ করে। তারই পরিণতিতে মূলত দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জনবিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে।
সাধারণত সরকারি দল ক্ষমতা ভোগে ব্যস্ত থাকে বলে তার এক ধরনের জনবিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়ে যায়। জনগণকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা ও রাখার দায় মূলত বিরোধী দলই পালন করে থাকে। বস্তুত দীর্ঘকাল বিরোধী অবস্থানে রাজনীতি করার কারণেই আওয়ামী লীগ দেশের জনসম্পৃক্ত বড় দলে পরিণত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে প্রায় আট বছরের ব্যবধানে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা ভোগ করে দলটি তার জনসম্পৃক্ততার বৈশিষ্ট্য হারাতে বসেছে এবং ১৯৪৭ পরবর্তী অন্যান্য সব সরকারের মতই কর্তৃত্বপরায়ন হয়ে উঠেছে। মনে রাখতে হবে ৭২-৭৫ আমলেও আওয়ামী লীগ তার ভ্রান্ত রাজনৈতিক কৌশলের কারণে কর্তৃত্বপরায়ন হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তাতে শেষরক্ষা হয়নি। নৃশংসতা, অরাজকতা ও দীর্ঘমেয়াদী অপশাসনের কবলে পড়েছিল দেশ। আমাদের আশংকা আবারও যদি আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতে থাকে তার পরিণতি দেশের জন্যে শুভ হবে না।
দেশ সত্যিই একটি বিপজ্জনক বাঁকে আছে এখন, এ থেকে কীভাবে বিচক্ষণতা ও দূরদশিতার সাথে সন্তর্পণে একে নিরাপদ অবস্থানে নেওয়া যাবে আজ আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের সেটাই অগ্রাধিকারের সাথে ভাবতে হবে।

Saturday, January 4, 2014

নির্বাচন, অতঃপর পরিণতি?

আবুল মোমেন


জাতীয় সংসদের যে নির্বাচন আগামীকাল অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেটি নিয়ে বর্তমান সরকারঅর্থাত্ আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র দলের জোটকেন একগুঁয়েমির বিপজ্জনক পথেই চলল, তা অনুদ্্ঘাটিত থেকে যাচ্ছেদেশটি একা আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের নয়যে ইস্যু মাথায় নিয়ে তাদের এই অবস্থান, সেটিও তাদের একার নয় বরং ইস্যুটি এত দিনেও চাপা পড়তে না দেওয়ার মূল কারিগর তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, শিল্পী-সাহিত্যিক প্রমুখ তাদের সঙ্গে ধীরে-ধীরে যোগ দিয়েছেন ছাত্র-তরুণরা
গত শতকের আশির দশক থেকে এদের সব আন্দোলন-সংগ্রামের মূল অঙ্গীকার ছিল পরাজিত পাকিস্তানি ধারার ধর্মান্ধতার রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় নীতির বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রতিএ আন্দোলনকে সরাসরি লক্ষ্যাভিমুখী করে তুলেছিল শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালালবিরোধী আন্দোলনতিনি যখন একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ে গণতদন্ত কমিশন ও গণআদালত গঠন করলেন, তখন তাতে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেওয়ায় এটি সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা ও বৈধতা পেয়ে যায়আর এর বিরোধিতা করে দেশের বরেণ্য ২৪ বুদ্ধিজীবীকে দেশদ্রোহের মামলায় জড়িয়ে বেগম জিয়া তার দলের বিপরীত অবস্থান পরিষ্কার করে তোলেনতখনই দেশে আদর্শিক সংঘাতের রাজনীতি সূচিত হতে পারত, কিন্তু আওয়ামী লীগ সে ঝুঁকি তখন নেয়নিসে কারণে তখন আওয়ামী লীগ দেশের মূলধারার বুদ্ধিজীবী ও বামদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছিল
দুই দলের আদর্শিক দ্বন্দ্ব জিয়ার আমল থেকেই তৈরি হয়েছিল, তা এতকাল সরাসরি সংঘাতে গড়ায়নিকারণ সামরিক শাসক এরশাদের আমল থেকে দুটি দলই মূলত ক্ষমতায় ফেরার চেষ্টা চালিয়েছেক্ষমতা মূল বিবেচ্য বিষয় হওয়ায় আদর্শ এবং আদর্শের দ্বন্দ্ব সমস্যাসৃষ্টি করেনিফলে আমরা লক্ষ করি, ক্ষমতার সংগ্রামে লিপ্ত থেকে কৌশলী আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময় সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন (যেমন রাষ্ট্রধর্ম বা বিসমিল্লাহর সংযোজন) নিয়ে নিশ্চুপ থেকে কিংবা জামায়াতের সঙ্গে মেলামেশা করে বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মী, বাম রাজনৈতিক দলের সমালোচনার পাত্র হয়েছিলআমরা এ-ও লক্ষ করি, সমাজবাস্তবতা মাথায় রেখে ক্ষমতায় ফেরা ও থাকার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ দলটির বিরুদ্ধে বিরোধীদের পরিচালিত ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামবিরোধিতার মতো মূল সমালোচনাটি অকার্যকর করে দেওয়ার কাজ যত্ন নিয়েই করেছেআবার যেহেতু দেশের দুই বড় দল ক্ষমতা নিয়েই মগ্ন ছিল ফলে তার জের ধরে সারা দেশে সুবিধাভোগী শ্রেণীর মধ্যে (বিশেষত পেশাজীবীদের মধ্যে) দুই বড় দলকে কেন্দ্র করে বিভাজন ছড়িয়ে পড়েছেএতে আদর্শের অজুহাত থাকলেও স্বার্থের বিবেচনাই ছিল মুখ্যফলে ক্ষমতাকেন্দ্রিক দুই দলের প্রভাব ও প্রশ্রয়ে সমাজে একদিকে দুর্নীতি লালিত হয়েছে ও ছড়িয়েছে আর অন্যদিকে প্রশাসনের দক্ষতা ও কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে এ নিয়ে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ হতাশ, সমালোচনামুখরতা সত্ত্বেও কোনও রকম তৃতীয় সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তির উত্থান দেশে হয়নিগণতান্ত্রিক আমলে এ দুটি দলের মধ্যেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছেবিরক্ত ও হতাশ হলেও মানুষের সামনে অন্য বিকল্প ছিল না, আজও নেই
নাগরিকসমাজ ক্ষমতার দূষিত রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসার কোনও পথ দেখাতে বা তৈরি করতে পারেনিএটি এ সমাজেরই সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতাএ ক্ষেত্রে দুটি বিষয় বিবেচনায় নিতেই হয়প্রথমত, নাগরিকদের সব স্তরেই বর্তমান রাজনীতির আদর্শহীনতা আর তা থেকে সৃষ্ট দুর্নীতি, দখলদারি, মাস্তানির আধিপত্য নিয়ে উদ্বেগ ও সমালোচনা আছে দ্বিতীয়ত, নাগরিকসমাজ এবং ছাত্র-তরুণদের বড় অংশ দীর্ঘকাল ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে এসেছে আমাদের দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনতেতাদের সেই নিরন্তর প্রয়াসের কিছু ফল সমাজে তো দেখা দেবেইএবং তা ঘটেছে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপক হারে, প্রায় গণহারে, অবশেষে এর বিস্ফোরকতুল্য প্রকাশ ঘটেছিল গণজাগরণ মঞ্চের অভ্যুদয়ে
গণতান্ত্রিক আমলেও আমাদের নির্বাচনকালীন রাজনীতিতে বড় দুই দলের তীব্র টানাপড়েন আমরা দেখেছিসত্যিই তো এখন আদর্শের চেয়ে ক্ষমতাই  বেশি কাঙ্ক্ষিততাতে সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি দখলদারি ও লুণ্ঠনের বেপরোয়া মত্ততায় মানুষ অতিষ্ঠআর যত অতিষ্ঠ ও বিরক্ত হয়েছি আমরা, ততই আদর্শের কথা, নীতির কথা বলে আফসোস করেছি এটা পরিষ্কার যেআজকের দিনে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে চাইছেন নাতার সব চেষ্টা নিয়োজিত ছিল বিএনপিকে কেবল ক্ষমতা থেকে দূরে নয়, ক্ষমতার দৌড় থেকেও বিরত রাখতেতার ফাঁদে বিএনপি পা দিয়েছেএমনটা ভাবার কারণযে-কোনও, এমনকী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিয়েও এবার বিএনপিরই জেতার সম্ভাবনা ছিল বেশিআমার ধারণা, বিএনপির মূল নেতৃত্বখালেদা জিয়া ও তারেকআদর্শিক দ্বন্দ্বের ওপর জোর দিয়ে জামায়াতকে রক্ষার দায় গ্রহণ করেছে কেননা এবারও যদি নিছক ক্ষমতাই দুই বড় দলের একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হত, তাহলে পারস্পরিক বিরোধকে এত চরম অবস্থায় তারা নিত নাকারণ ক্ষমতা বা ক্ষমতার প্রলোভন কাউকেই স্বার্থবুদ্ধির বাইরে নেয় না, অর্থাত্ দুই পক্ষের মধ্যে শেষ পর্যন্ত একটা আপসরফা হতকিন্তু এখন উভয় পক্ষ ক্ষমতার গণ্ডি ডিঙিয়ে স্ব-স্ব নীতি-আদর্শের জায়গায় চলে এসেছেজামায়াত নীতি-আদর্শভিত্তিক দল, বিএনপি তার বিপদের দিনে সমর্থন দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেআর আওয়ামী লীগ বুঝতে পারছে নীতি-আদর্শ ঠিক অর্থবিত্ত-ক্ষমতার মতো আন্দোলনের বিষয় নয়এখন একবার যে কাজ শুরু করেছে, তা অসমাপ্ত রেখে তারই বিপরীত আদর্শের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে কেবল যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়াই ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে তা-ই নয়, দল ও সমমনাদের ওপর প্রত্যাঘাত আসবে মারাত্মক হিংস্রতা নিয়েশেখ হাসিনার পক্ষে পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ড ও এর ভয়াবহ পরিণতি এবং একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার ভয়াবহতা আর এর পেছনের শক্তির কথা ভুলে যাওয়া কি সম্ভব? দুই পক্ষই নিজ-নিজ আদর্শিক অবস্থান স্পষ্ট করে খুলে ধরার পর যে বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তার প্রতিবিধান হিসেবে জাতিসংঘ, পশ্চিমা কূটনীতিকরা বা আমাদের নাগরিকসমাজ যে সমাধানের পথ দেখাচ্ছেন তা কি সমস্যা-সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য পর্যাপ্ত হচ্ছে? আমার মনে হয়, তারা সংকটের গভীরতাই উপলব্ধি করতে পারছেন নাঅথচ তারা যদি সংকটের মূলে যেতেন তাহলে অন্তত বুদ্ধিজীবী ও বামদলগুলো তাদের নিজেদের ভূমিকার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বর্তমান সংঘাতে স্বীয় অবস্থান ও পক্ষপাত পরিষ্কার করতেনআর তখন বিএনপির পক্ষে জামায়াতকে ছেড়ে আসা সহজ হতঅন্তত বিএনপির ভেতরে যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আগ্রহী, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী বা আধুনিক চিন্তার অনুসারী, তারা দলের ভেতরে একটা চাপ তৈরি করতে পারতেন অথবা দল থেকে বেরিয়ে এসে ভূমিকা নেওয়ার তাগিদ বোধ করতেন
ফলে এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগও সমালোচনা থেকে রেহাই পাবে নাসমাজে যারা সহজাতভাবে আদর্শিক সহযাত্রী, তাদের কীভাবে কাছে টানতে হবেসেটা রাজনীতির আবশ্যিক কৌশলের একটিকিন্তু অতি আত্মবিশ্বাস, দলীয় অহংকার এবং হয়তো দীর্ঘদিন একক ক্ষমতা ভোগের ফলে হাসিনা-নেতৃত্ব সংকট উত্তরণে জাতীয় জীবনে বৃহত্তর ঐক্যের ও সমঝোতার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননিফলে উভয় পক্ষেরনাগরিকসমাজ ও আওয়ামী লীগেরবিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার অভাবে সহজে সমাধানযোগ্য সংকট অযথা গভীর ও দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে এবং অনিশ্চিত ক্ষয়ক্ষতির দিকে গড়াচ্ছে
আমি বলব, এখনও সময় আছে, প্রধানমন্ত্রীর উচিত হবে সমমনা নাগরিকসমাজের সঙ্গে সংলাপে বসা, এই দুঃসময়ে জাতীয় প্রয়োজনে তাদের আদর্শিক বিশ্বাসের কার্যকর প্রতিফলন কামনা করা বৃহত্তর জাতীয় জাগরণ ও ঐক্য ব্যতীত কোনও জাতি তার নীতি-আদর্শের বিরোধ ও সংঘাতে জয়ী হতে পারে নাএর অর্থ নির্বাচনের পরেও অনিশ্চয়তা ও সংঘাত বহাল থাকা
আমার ধারণা, আগামীকালের নির্বাচনটি স্থগিত করার ও যে-কোনও মূল্যে সমঝোতা সৃষ্টির জন্য নাগরিকসমাজের দিক থেকে চাপ তৈরি হওয়ার কারণ এটিইআর তাতে আন্তর্জাতিক মহলের চাপও বাড়ছেমনে রাখতে হবে, জনগণ যদি সম্পৃক্ত না হয়, তাহলে ন্যায্য ইস্যুও সুবিচার পায় নাকারণ প্রতিপক্ষের সৃষ্ট সহিংসতা নিরপেক্ষ নাগরিকসমাজ বহন করতে রাজি হয় নাআর জনসম্পৃক্তি না ঘটলে পক্ষের মানুষও ভোগান্তি সহ্য করার উদ্দীপনা পায় নাসে রকম লক্ষণ সমাজে তীব্রভাবে ফুটে উঠছে, যা আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে দীর্ঘদিনের জন্য ভোগাতে পারেফলে ৫ তারিখের নির্বাচনের চেয়েও তাই শেখ হাসিনার জন্য তার সম ও কাছাকাছি মতাদর্শের মানুষদের এখনকার প্রত্যাশার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া বেশি গুরুত্বপূর্ণসে জন্য সময় নিয়ে তাদের সঙ্গে ঐক্যের সংলাপ করা ও জাতীয় জাগরণ ঘটানোই তার জন্য এ মুহূর্তের বড় কাজ ছিলনয়তো এ নির্বাচন-পরবর্তী পরিণতি আওয়ামী লীগের (সরকারের) পক্ষে এককভাবে সামলে ওঠা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে