Tuesday, March 4, 2014

গ্রামপতনের শব্দ আর কত শুনব?

আবুল মোমেন


১৯৭১-এ আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। ১৯৯১ তে গণতন্ত্র। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র এ দুটিই তো ছিল জাতির স্বপ্ন। দুটিই অর্জিত হয়েছে। প্রথমটির পরে ৪৩ বছর অতিবাহিত হল আর দ্বিতীয়টি অর্জনের পরে কেটে গেছে ২২টি বছর। মধ্যে দু’বছরের অনির্বাচিত সরকারকে হিসেব থেকে বাদ দিলেও দুই দশক তো পার হয়েছে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে। কিন্তু মানুষ কি স্বাধীনতা পেয়েছে? গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা, যেখানে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার দায় থাকে? যেখানে বিরোধী দল সংসদে,গণমাধ্যমে ও সমাজে গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে দায়িত্বশীল ভূমিকা নেয়? যেখানে ধর্ম-জাতি-লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিক তার অধিকার ভোগ ও প্রয়োগ করতে পারে?
এসব প্রশ্নের জবাব শিক্ষিত-শিক্ষাবঞ্চিত ধনী-নির্ধন নারী-পুরুষ সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু বড়-ছোট সকল নাগরিক মনে মনে বা প্রকাশ্যে বারবার যে ভাষায় উচ্চারণ করে তা বেশির ভাগ সময় প্রশ্নমুখর - নানা কেনর সমাহারে সে প্রশ্নমালা তৈরি হয়। এবং শেষে উচ্চারিত হয় অসহায় কাতরধ্বনিতে পাল্টা প্রশ্ন - কেন আমরা বারবার ব্যর্থ হচ্ছি? নাগরিকদের অনেকে কোনো কোনো সময়, আর কেউ কেউ স্থায়ীভাবেই হতাশ ও ক্ষুব্ধ। তাঁরা দেশ, রাজনীতি, প্রশাসন, ভবিষ্যতসহ সবতাতেই আস্থা হারিয়েছেন।
কিন্তু আমাদের শিক্ষিত শহুরে মানুষ সরকারের মুখাপেক্ষী হলেও সাধারণ মানুষ আবহমান কাল ধরেই কারও ভরসায় বসে না থেকে নিজের চেষ্টায় জীবনধারণ করে চলেছে। তাদের চাহিদা সামান্য, তারা শেখে দ্রুত, প্রয়োগে সফল। দেখা যায় মানুষের যেগুলো ন্যূনতম বস্তুগত চাহিদা সেগুলো অর্জনে আমাদের দেশ সফল। প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তার, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, জাতীয় টিকা কর্মসূচী সম্প্রসারণ, মাতৃস্বাস্থ্য, নারীর উপার্জন, দারিদ্র দূরীকরণ ইত্যাদিতে আমাদের সাফল্য প্রায়ই বিশেষজ্ঞদের চমকে দিয়ে থাকে। জনসংখ্যার গড় আয়ুও তারাই বাড়াতে পেরেছে। কিন্তু যেসব জায়গায় উন্নতি করা দরকার ছিল, যেসব জায়গায় অবস্থার গুণগত পরিবর্তন না হলে কোনো উন্নতিরই চূড়ান্ত ফল লাভ ও তা টেকসই করা সম্ভব নয় তার দায়িত্ব পড়েছে শিক্ষিত শহুরেদের ওপর। সেখানেই আমরা বরাবর হোঁচট খাচ্ছি, আর তাতে তলায় যে অগ্রগতি হচ্ছে তার চূড়ান্ত টেকসই ফল অধরা থেকে যাচ্ছে। সে কাজগুলো হল, যেমনÑশিক্ষার মানোন্নয়ন, পুষ্টি ও রোগ পরিচর্যা ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন, নারীর প্রকৃত সমানাধিকার ও ক্ষমতায়ন, কৃষিজাতপণ্যের বাজারজাতকরণ ও বিপণন, জীবন মানের উন্নয়ন, যোগাযোগে সড়ক ও গণ পরিবহনের উন্নয়ন ইত্যাদি। এসব কাজের দায়িত্ব রয়েছে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের ওপর। এরাই অদক্ষতা, দুর্নীতি, হীনম্মন্যতা, কোন্দলপ্রবণতা ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজের নিচের তলার মানুষের কঠিন পরিশ্রম ও বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সাফল্যকে ব্যক্তিস্বার্থের ভোগে লাগায় ও নষ্ট করে।
তাহলে একথা কি স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে না যে এ দেশে একদল খেটে খুটে সমাজ ও অর্থনীতির চাকা চালু রেখেছে আর আরেক দল বসে বসে তা ধ্বংস করছে? হয়ত এরকম সরলভাবে জাতিকে বিভক্ত করা উচিত নয়, আমার উদ্দেশ্যও তা নয়। মূল গোলমালটা বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের অসফলতা নামক রোগের মূল কারণ নির্ণয় করাই আমাদের লক্ষ্য। সবাই জানতে চান বারবার এগিয়ে আবার মুখ থুবড়ে পড়ার কারণটা কি? জাতি যদি একটি দেহ হয় তো মানবদেহের মতই তার মৌল উপাদান হাড়, কোষ, পেশি, রক্তনালী ইত্যাদি সবই সচল রয়েছে শ্রমজীবীদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফলে। কিন্তু এসব থেকে যথার্থ ফল লাভ ব্যাহত হচ্ছে। এসবই ঘটছে পরিচালনা ও রক্ষাণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত অংশের গাফিলতিতে। এরা শিক্ষিত সুবিধাভোগী শ্রেণি। কী কারণে এরা মাঠের মানুষদের শ্রমের উপার্জন ব্যর্থ করে দিচ্ছে? এদের এ অবস্থানে আসার পেছনে দায়ী যা তার নাম শিক্ষা। হ্যাঁ অপরাধীর নাম শিক্ষা। দেশে ও সমাজে গোলমালটা পাকাচ্ছে, ঘটাচ্ছে, জিইয়ে রাখছে শিক্ষিতরাই। শিক্ষার মূল ক্ষেত্র অবশ্যই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান - আপাতত আমরা স্কুল পর্যন্ত ধরেই  কথা বলব। কারণ এটুকুতেও যদি মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা যেত তাহলেই একটা যথার্থ শিক্ষিত জাতি আমরা পেতাম। তাহলে তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ, নৈতিক বিবেচনা শক্তি এবং সৃজনশীল ক্ষমতা এমন পর্যায়ে অর্জিত হতে পারত যা তাকে দুটি সম্পদে যথার্থ মানুষ ও দায়িত্বশীল নাগরিক হতে সাহায্য করত। সে দুটি সম্পদ হচ্ছে আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদাবোধ। হ্যাঁ স্কুলের পাশাপাশি পরিবার, ধর্ম, রাজনীতি, গণমাধ্যমও জনশিক্ষার প্রসার ও জনমানস গঠনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পরিবার ছাড়া উল্লিখিত সব প্রতিষ্ঠানই শিক্ষিত মানুষদের হাতেই রয়েছে। ফলে ভ্রান্ত ও অসম্পূর্ণ শিক্ষার দায় আমরা এড়াতে পারি না।
বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক জরীপে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে প্রাথমিক পর্যায়ে স্কুলে অন্তর্ভুক্তির পরিমাণ ছেলেমেয়ে মিলেই প্রায় শতভাগ হলেও অর্জন-লক্ষ্য পূরণে সাফল্য কেবল হতাশাজনক নয়, রীতিমত চমকে দেওয়ার মত দু:খজনক। গণিতে নির্ধারিত মান অর্জন করে মাত্র ৩০ ভাগ ছাত্র আর মাতৃভাষা বাংলায় তা শোচনীয়ভাবে ২৬ শতাংশ! অর্থাৎ অধিকাংশ শিশুর ৫/৬ বছরের প্রাথমিক শিক্ষা বিশেষ কোনো কাজে আসছে না। বর্তমান সরকার সংখ্যাগত সাফল্যের ওপর জোর দিতে গিয়ে পরীক্ষা বাড়িয়ে দেওয়ায় ফলাফল সর্বস্ব হয়ে পড়ছে শিক্ষা, বাড়ছে মুখস্থবিদ্যার ওপর নির্ভরতা যার ফলে শিক্ষা গুটিকয়েক প্রশ্নের উত্তর শেখার    নামান্তর হয়ে পড়েছে। ধর্ম চর্চার বিষয়টি দখল করে নিয়েছে ধর্মব্যবসায়ী, ধর্ম নিয়ে রাজনীতিবাজ এবং প্রাচীনপন্থী কট্টরপন্থীরা। এরা একটি মানবিক গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের মত পরিবেশ বিঘিœত করেই ক্ষান্ত হয় না, পাশাপাশি ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা ও মূল্যবোধ সঞ্চারে ব্যর্থ হয়ে ও মৌলবাদ-জঙ্গিবাদকে উস্কে দিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করছে। রাজনীতিবিদরা আপাতত গালভরা বুলির মুখোশ পরে ক্ষমতার মধু লুটে আখের গুছাতেই ব্যস্ত রয়েছেন। গণমাধ্যমে বৈদ্যুতিক চ্যানেলগুলো সঠিক চিন্তা, যোগ্য সৃজনশীলতা ও প্রজ্ঞার অভাবে বোকার বাক্সের অধিক কিছু হতে পারছে না। মুদ্রণ মাধ্যমে অস্বাভাবিক, অস্বাস্থ্যকর বিষ্ফোরণ ঘটে এখন বিকার ও বিভ্রান্তি চলছে, কেউবা বাণিজ্যিক সাফল্য নিয়েই মরিয়া। পরিবার প্রধানরা ভোগবাদিতার বাজারে নানামুখী চাপের মধ্যে পড়ে প্রকৃত অভিভাবকত্ব দিতে অক্ষম। কোনো সূত্র থেকেই জনশিক্ষা ও জনরুচি তথা সুস্থ জনমানস গঠনের কোনো উপাদান, আহার্য মিলছে না। ফলে সমাজের নিচের তলার মানুষ দিনরাত খেটে কোনো মতে কায়ক্লেশে বেঁচে আছে। আমরা তাদের উৎপাদন ব্যয় না মিটিয়ে উৎপাদনের সাফল্যের ভাগ লুটে নিচ্ছি। শিক্ষার নামে তাদের সাথে পরিহাস করছি, ধর্মের নামে তার সুস্থ বিনোদনের অধিকার কেড়ে নিয়ে তাকে নিক্ষেপ করছি অসুস্থ অন্ধকার জীবেনর দিকে। সাংবাদিক-শিক্ষক-চিকিৎসক-রাজনীতিবিদ, এমন কি জনসেবকের ভূমিকায় অভিনয় করে তাদের শ্রমের মূল্য না চুকিয়ে আখের গুছাচ্ছি।
এভাবে চলতে থাকলে দেশের সিংহভাগ মানুষের স্বাধীনতা আসবে কোত্থেকে? গণতন্ত্রে তাদের স্বার্থ কীভাবে রক্ষিত হবে?
আমাদের গণতন্ত্রের মানসকন্যারা অস্ত্রধারীদের বেষ্টনিতে বন্দিত্বের নিরাপত্তায় বাস করেন। আমাদের সবধরনের নেতারা-রাজনীতিক সাংবাদিক শিক্ষক চিকিৎসক প্রকৌশলী আইনজীবী সকল ক্ষেত্রে নেতারাই বিত্ত-ক্ষমতার বা নেতৃত্ব-তোষামুদির বৃত্তে বাঁধা পড়েছেন। শিক্ষিত বিবেকবান উন্নত চরিত্রের মুক্ত মানুষ কোথায়?
যে সমাজে এ ধরনের মুক্ত মানুষ বেশি থাকবেন কেবলমাত্র সেই সমাজই এগিয়ে যেতে পারবে। আমরা দূর থেকে হতাশা, বেদনা ও আক্ষেপ নিয়ে তাকিয়ে দেখি কীভাবে প্রতিনিয়ত আমাদের ভরসাস্থলগুলো উন্মত্ত ভয়ঙ্কর ঘোলাস্রোতে তলিয়ে যাচ্ছে। কবি জীবনানন্দের ভাষায় চারদিক থেকে প্রতিনিয়ত ‘গ্রামপতনের শব্দ শোনা যায়।’
আর কত জনপদ লোকালয় ভাঙলে বোধোদয় হবে আমাদের?