Thursday, December 17, 2015

স্বাধীনতা ও বিজয়

আবুল মোমেন

প্রথমে আমাদের দাবি ছিল পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দির নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের সাথে সাথে জনগণের এ দাবিরও বিজয় হল। কিন্তু নয় মাসের মাথায় ৯২-ক ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিয়ে প্রদেশের জনমত উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় সরকারের একতরফা শাসন চাপিয়ে দেওয়ায় রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেই বুঝলেন গণতন্ত্রের দাবি জোরালো করা ছাড়া জনগণের মুক্তি সম্ভব হবে না। ১৯৫৬ সনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করলে এ পথেই যেন আমাদের অগ্রগতি শুরু হল। কিন্তু একদিকে সে সরকার টানাপোড়েনের সমস্যায় ভুগেছে আর অন্যদিকে কেন্দ্রে চলছিল পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের বা কেন্দ্রের তাঁবেদার  সরকার ফিরিয়ে আনার ষড়যন্ত্র। ১৯৫৮ সনের অক্টোবরে জেনারেল আইয়ুব ক্ষমতা দখল করে নিলে সারা দেশে কেন্দ্রের একনায়কী শাসনের সূচনা হয়। সেই থেকে শুরু হল আমাদের গণতন্ত্রের সংগ্রাম।
১৯৬২-র আগে আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন শুরু করা যায় নি। বাষট্টির সেপ্টেম্বরে ছাত্রদের শিক্ষা আন্দোলনের মাধ্যমে এর সূচনা। আইয়ুব কিন্তু যে কোনো সামরিক শাসকের মতই দীর্ঘ মেয়াদে বা আজীবন ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলেন। সেভাবেই তিনি ক্ষমতা সংহত করার চেষ্টা করলেন এবং নিজের ব্যক্তিগত ও পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত ক্ষমতা-বলয়ের মধ্যে দেশ শাসনের সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করার প্রয়াস চালালেন। ইতোমধ্যে পাকিস্তান সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানের কর্তা ব্যক্তিদের সাথে বাঙালিদের নানা স্তরে যোগাযোগ ও টানাপোড়েনের অভিজ্ঞতা প্রদেশের সচেতন মহলকে একটা স্পষ্ট বারতা জোরালোভাবেই দিতে পেরেছে। তা হল, পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাঙালির প্রকৃত মুক্তি ও আত্মবিকাশ সম্ভব নয়।
এই প্রেক্ষাপটে স্বায়ত্বশাসনের দাবি চলে এলো সামনে। শেখ মুজিবের ৬ দফাই হয়ে গেল বাঙালির প্রাণের দাবি। এ নিয়ে শেখ মুজিব ও বাঙালি নেতাদের বিরুদ্ধে আইয়ুবের দমনপীড়ন বাড়ল। হুমকির ভাষায় কথা বলতে থাকলেন আইয়ুব-মোনেম দুজনে। এর মধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করল।
ছাত্র, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে অনেকেই বুঝে গেলেন স্বাধীনতার কমে বাঙালির চলবে না। এই উপলব্ধি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করে তুলেছিল। ফলে জনগণের প্রাণের নেতা শেখ মুজিবের মুক্তি এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে স্বতস্ফূর্ত আন্দোলন রূপ নেয় গণ-অভ্যুত্থানে। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান আইয়ুবের পতন ত্বরান্বিত করে।
আইয়ুবের পরে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় ঘোষণা করে পাকিস্তানের ক্ষমতায় এসেছিলেন আরেক সেনা কর্মকর্তা - জেনারেল ইয়াহিয়া। কিন্তু ততদিনে পূর্ব পাকিস্তানবাসী শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধুরূপে ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে বরণ করে প্রস্তুত হয়েছে স্বাধীনতার লক্ষ্যে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্যে। ফলে জেনারেল ইয়াহিয়া, জুলফিকার ভুট্টো এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের সকল ধারণা নস্যাৎ করে এদেশে আওয়ামী লীগ দুটি ছাড়া সব আসনেই বিজয়ী হল। এ বিজয় দলকে দিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসক হওয়ার অধিকার। কিংকর্তব্যবিমূঢ় পাক-সরকার, রাজনীতিবিদ ও আমলাতন্ত্র আবারও ষড়যন্ত্রের রাস্তা ধরল। কিন্তু তার আগেই তো এখানকার মানুষ স্বাধীনতার জন্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জানবাজি রেখে লড়তে প্রস্তুত হয়ে আছে। পাকিস্তানের জন্যে সংঘাত এড়ানোর একমাত্র পথ ছিল নির্বাচনী ফলাফল অর্থাৎ জনগণের গণতান্ত্রিক অভিমতকে সম্মান জানানো।
তারা তা করতে চায় নি। ভুট্টো, পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা এবং বেসামরিক আমলাতন্ত্র এ ব্যাপারে আন্তরিক ছিল না।
ছাত্র-জনতা-বুদ্ধিজীবীসহ সমাজের প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষা যে জায়গায় পৌঁছেছিল তাতে পাকিস্তান সরকারের জন্যে সর্বনিম্ন করণীয় হতে পারত নির্বাচনের ফলাফল মেনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে ছয়দফার ভিত্তিকে প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন দেওয়া। আর পাকিস্তান এ দাবি না মানলে ঐক্যবদ্ধ নবজাগ্রত বাঙালির সামনেও একমাত্র পথ ছিল - স্বাধীনতা। পাকিস্তানি শাসকদের একগুঁয়েমি, অদূরদর্শিতা এবং বাঙালি-বিদ্বেষের কারণেই শেষ পর্যন্ত বাঙালিকে স্বাধীনতার পথেই হাঁটতে হয়েছে।
ফলে সাতই মার্চ যখন বঙ্গবন্ধু তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ জনতার সামনে ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন তাঁর ভাষণে স্বাধীনতার ঘোষণা আসতেই হত। প্রাজ্ঞ জনদরদী নেতা কেবল উন্মত্ত পাক-সেনাদের সম্ভাব্য বর্বরতা এড়ানোর পথ খোলা রেখেছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক এবং বাঙালি জনতা উভয়ের মনোভাব সেদিন যেখানে ছিল তাতে স্বাধীনতার পথে হাঁটা ছাড়া অন্য পথ ছিল না বঙ্গবন্ধু ও এদেশের মানুষের।
আজ চুয়াল্লিশ বছর পরে পাকিস্তান সরকার আবারও প্রমাণ করল সেদিন বঙ্গবন্ধু এবং এদেশের জনগণ ঠিক কাজটিই করেছিল। কেবল পাকিস্তানি শাসকদের একগুঁয়েমি ও বর্বরতার শিকার হয়ে নয়মাসব্যাপী গণহত্যার সম্মুখীন হয়েছি আমরা। কিন্তু ততদিনে তো বাঙালি একতাবদ্ধ এবং বীর জাতিতে রূপান্তরিত। তাই প্রতিরোধও হল, যুদ্ধও চলল এবং ন্যায় ও সত্যের বিজয়ও হল।


***