Wednesday, November 9, 2016

শিক্ষাকে বলি দিয়ে শিক্ষার বিস্তার?

আবুল মোমেন

প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা থাকছে - শিক্ষামন্ত্রীর কথায় অন্তত তাই মনে হচ্ছে। শিক্ষাবিদদের চাপাচাপিতে সরকার  একবার এ পরীক্ষাটি বন্ধ করার কথা বলেও আবার মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তে তা বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বছরের জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা মাত্রই শেষ হয়েছে। এর পরে নিশ্চয় উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে।
সরকারকে শিক্ষায় ধনী-মধ্যবিত্ত-দরিদ্র, মহানগর-মফস্বল-গ্রাম-চরাঞ্চল-পার্বত্য এলাকাবাসী ইত্যাদি সকল পর্যায়ের নাগরিকের অন্তর্ভুক্তির বিষয় মাথায় রাখতে হয়। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় একবার আমাকে বলেছিলেন পরীক্ষাকে সরকার একটি উৎসবে রূপ দিতে পেরেছে এবং  দেখা যায় গ্রামাঞ্চল-চরাঞ্চলের শিশুরাও অভিভবকদের সাথে হেঁটে, ভ্যান বা রিকশায় দল বেঁধে সেজেগুজে পরীক্ষার হলে যায়। এই উৎসবের আমেজ তাদের উৎসাহ বাড়ায়, ভয় দূর করে এবং সব মিলে শিক্ষা বিস্তারে সহায়ক হয়। তাছাড়া এখনও অনেক ছেলেমেয়ে, বিশেষত মেয়েশিশু, প্রাথমিকেই ঝরে যায়। পরীক্ষা এবং সনদপত্র তাদের অন্তত এটুকু পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রমে ধরে রাখতে সহায়ক হবে।
তাঁর কথায় যে সত্যতা নেই তা নয়। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষার পরিবর্তে তারা একটি পাব্লিক পরীক্ষা দিচ্ছে এবং সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলের চেষ্টায় তাতে উৎসবমুখর পরিবেশও সৃষ্টি করা গেছে। তাহলে অসুবিধাটা কোথায়?
শিক্ষায় সনদপত্র একটি নগদপ্রাপ্তি, এর কিছু মূল্য হয়ত জীবনে কখনও মিলতেও পারে - যদিও ইদানীং কোনো প্রাতিষ্ঠানিক চাকুরি কেবল প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা পাশের সনদ দিয়ে জোটে না। তার জন্যে নিদেনপক্ষে জেএসসি সনদপত্র  লাগবে। দিনে দিনে সেটারও মূল্য থাকবে না। বাস্তবতা হল এখন ডিগ্রি পাস করেও অনেকে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকুরি করছেন। চাকুরির বাজার সম্প্রসারিত হলেও বাস্তবতা এরকমই থাকবে।
শিক্ষার মূল কাজ তো সনদপত্র অর্জন নয়, প্রাথমিক বা নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ে তা তো নয়ই। এমনিতেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বড় দুর্বলতা হল এর পরীক্ষাকেন্দ্রিকতা। পরীক্ষাকে ঘিরেই পড়াশুনার আয়োজন চলতে থাকায় ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক ত্রয়ী মিলে পরীক্ষা-উপযোগী বা পরীক্ষাবান্ধব একটা ব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছে। পিএসসি ও জেএসসি এই প্রবণতাকে জোরদার করেছে।
পরীক্ষার ভিত্তিতে পড়াশুনা চলতে থাকলে তার ফলাফল কী হয় সেটা আমরা বাস্তবেই হাতে হাতে পাচ্ছি। আমি দেশের বিভিন্ন পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান ভর্তি পরীক্ষার ভয়াবহ ফলের ওপর জোর দেব না। এটি একটি  চরম বাণিজ্যিক এবং অমানবিক ব্যবস্থা, এটি ভর্তিচ্ছুক ছাত্রের  মেধা ও যোগ্যতা যাচাইয়ের কার্যকর মাধ্যম নয়। এতে গোড়া থেকেই বাদ দেওয়ার কৌশল গুরুত্ব পায়, অবজেক্টিভ প্রশ্নের এক ঘণ্টার পরীক্ষায় উচ্চ শিক্ষার প্রস্তুতি বোঝাও মুশকিল।
তবে মাঠ পর্যায়ে জরীপের মাধ্যমে প্রাথমিকের অর্জন মান যাচাইয়ের যে কাজ ক্যাম্পে ও সরকারের উদ্যোগে হয়েছে তার ওপর নির্ভর করা যায়। এতে দেখা গেছে অর্জন মান সন্তোষজনক, ছাত্রদের বড় অংশ - শতকরা ২৫ ভাগ থেকে ৫০ ভাগ - মাতৃভাষা ও গণিতে দুর্বল, ইংরেজিতে তো বটেই। আমরা বাস্তবক্ষেত্রে পরীক্ষা করে দেখেছি সরকারি প্রাথমিকে অর্জন মানের অবস্থা শোচনীয় - ভাষা, গণিত এবং সাধারণ জ্ঞানে বয়সের তুলনায় মান অনেক কম।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করার মত। ইদানীং দেশের শিল্প ও বাণিজ্যিক উদ্যোক্তারা বিশেষজ্ঞ ছাড়াও ব্যবস্থাপক, তত্ত্বাবধায়ক হিসাবরক্ষকের মত মাঝারি স্তরে বিদেশিদের নিয়োগের দিকে ঝুঁকেছে। ভারত, শ্রীলঙ্কা, এমনকি পাকিস্তান থেকেও অনেকেই এ ধরনের চাকুরিতে আসছেন। অন্য একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার বাড়ছে।
শিক্ষার মান আসলেই যে কমেছে তা বোঝা যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানের অবনতিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের উচ্চ শিক্ষার মুখ্য প্রতিষ্ঠান। বিশ্বে এর অবস্থান পাঁচশ-র মধ্যেও নেই। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা - সম্ভবত একমাত্র বুয়েট ব্যতীত - আরও তলানিতে রয়েছে। গবেষণার সংখ্যা ও মান, গবেষণা পত্রিকার স্বীকৃতি ধরলেও আশাব্যঞ্জক কিছু পাওয়া যায় না।
এসব তথ্য ও বক্তব্যের অর্থ অবশ্য এ নয় যে আমাদের ছাত্রদের মেধা ও মান খারাপ। না তা নয়। তা যে নয় তার প্রমাণ আমাদের তরুণরা দেশে ও বিদেশে অহরহ দিচ্ছে। কিন্তু দেশের প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ক্রমেই সেই সুযোগ কমে আসছে।
মূলধারার উচ্চ শিক্ষা যেভাবে চলছে তাতে ছাত্রদের বড় অংশ নিজের পছন্দের বিষয় পড়ার সুযোগ পায় না। ফলে তারা গোড়া থেকেই অনিচ্ছুক ও উদাসীন ছাত্র। তাদের একমাত্র লক্ষ্য থাকে কোনোভাবে এম. এ. পাশ করে সর্বোচ্চ ডিগ্রির সনদ অর্জন। তাদের লেখাপড়া সীমাবদ্ধ থাকে আসন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য পাঁচ-ছটি প্রশ্ন জানা, তার উত্তর মুখস্থ করার মধ্যে। এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে উচ্চ শিক্ষার যে উদ্দেশ্য - পুঙ্খানুপুঙ্খ জানা, বিশ্লেষণ করতে শেখা এবং নতুন ধারণা ও ভাবনা উপস্থাপন - তার কোনো অবকাশ এখানে থাকে না। পরীক্ষার বাইরে ছাত্রের তেমন কিছু করার নেই, জ্ঞান বা মনন চর্চার বিভিন্ন উপায়ের সাথে তাদের পরিচয় ঘটে না। ফলে আড্ডা, নেশা, অপরাজনীতি, মেয়েদের পেছেনে লাগা ইত্যাদি বিচিত্র ক্ষয়িষ্ণু কাজে তাদের তরুণ্য বয়ে যায়। এটি জাতীয় অপচয়।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয় - যা তিনি নিজের শিক্ষা সম্পর্কে বলেছিলেন - আমাদের শিক্ষার প্রায় সবটাই লোকসানি মাল। সরকার এবং বিশ্বব্যাংক-এডিবিসহ বিদেশি অনেক সংস্থা শিক্ষাখাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে বেশ অনেক বছর ধরে। তাতে স্কুলের ঘরবাড়ির উন্নতি হয়েছে, বিনামূল্যে উন্নত মুদ্রণের ভালো বই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে, ছাত্রীদের উপবৃত্তি  ও স্কুল পোশাক দেওয়া হচ্ছে, সীমিত আকারে দুপুরের খাবার চালু হয়েছে, বাথরুম-পানি সরবরাহের উন্নতি হচ্ছে, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত আগের চেয়ে ভালো, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণও বেড়েছে। কিন্তু এসব উন্নয়নের ফলাফল শিক্ষায় দৃশ্যমান হচ্ছেনা। আমি বলব, নিচের পর্যায় থেকেই শিক্ষাকে পরীক্ষা-কেন্দ্রিক করে রাখার ফলেই এই বিপুল আয়োজন, শ্রম  এবং ব্যয়ের যথার্থ সুফল আমরা পাচ্ছি না।
পরীক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে যে ব্যবস্থা তা চালু রেখে শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানোর প্রবণতা, কোচিং সেন্টারের দৌরাত্ম্য এবং নোটবইয়ের রমরমা ব্যবসা বন্ধ করা যাবে না। কারণ ছাত্রদের অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার দায়িত্ব নেন না, হয়ত বাস্তব কারণ আছে তার। প্রথমত, আমাদের প্রাথমিকের ছাত্রদের বড় অংশই শিক্ষাবঞ্চিত বা স্বল্পশিক্ষিত বাবা-মায়ের সন্তান যারা সন্তানের শিক্ষার প্রস্তুতিতে সাহায্য করতে পারেন না। তদুপরি শিক্ষিত-শিক্ষা বঞ্চিত সকল বাবা-মা বাড়তি উপার্জনের চাপে থাকেন নয়ত কর্মক্লান্ত হয়ে ফিরে আর সন্তানকে সময় দিতে চান না। গৃহ-শিক্ষক বা কোচ নিজের কৃতিত্ব প্রকাশের একমাত্র উপায় হিসেবে পান পরীক্ষার ফলাফলকে যা তাঁর যোগ্যতা-দক্ষতার জ্বলজ্বলে প্রমাণ হাজির করতে পারে। এ প্রক্রিয়া একদম প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু হয়ে উচ্চতর স্তরেও চলতে থাকে।
এটি বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এভাবে ছাত্রদের মৌলিক চিন্তার ক্ষমতা, সবরকম সৃজনশীলতা নষ্ট তো হয়ই উপরন্তু তাদের আত্মবিশ্বাস, যোগ্যতা দক্ষতারও ঘাটতি থেকে যায়।
কেন ঘাটতি থাকে তা বোঝাও কঠিন নয়। পরীক্ষার পড়া হয় প্রশ্নের ভিত্তিতে - সম্পূর্ণ একটি গল্প, অধ্যায় বা ধারণার সাথে পরিচয় এতে গুরুত্ব পায় না, গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ঐ পরীক্ষাটিতে নির্দিষ্ট গল্প বা অধ্যায় থেকে কোন প্রশ্নটি আসতে পারে সেটি। দক্ষ কোচরা বিভিন্ন বছরের প্রশ্ন ঘেঁটে সেটি বের করেন এবং সেই প্রশ্নের তাঁদের তৈরি উত্তরটি ছাত্রকে শেখান। পরীক্ষার ভালো ফলেই যেহেতু মোক্ষ তাই এ ধরনের সফল শিক্ষক ও কোচিং সেন্টারের ওপর অভিভাবকদের আস্থা বাড়ছে এবং তা এখন স্কুলের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষকরাও এতে আর্থিকভাবে লাভবান হন, ফলে তাঁরাও তাই চান। শিক্ষা বলতে ক্রমে পরীক্ষাই একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠেছে - কোচিং সেন্টারগুলো এবং তাদের সাথে পাল্লা দিয়ে সফল স্কুলগুলোও অনবরত বছর জুড়ে মডেল টেস্ট নিতে থাকে। এভাবে ছাত্ররা পরীক্ষা-দক্ষ হয়ে ওঠে।  যত অন্ধ আনুগত্যে ছাত্ররা এ প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে ততই তারা নিজের, বাবা-মার, স্কুলের মুখ উজ্জ্বল করবে। যদিও - আবারও রবীন্দ্রনাথের ভাষায় - শিক্ষার হদ্দমুদ্দ সারা হয় ততদিনে।
পরীক্ষাকে যতই উৎসবের রূপ দেওয়া হোক না কেন নিরন্তর পরীক্ষার ড্রিলের ভিতর দিয়ে জীবনের প্রস্তুতিপর্ব পার করে একজন তরুণ শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলে - সে শৈশব থেকেই একজন পরীক্ষার্থী, শিক্ষার্থী নয়। বরং যখন তার শিক্ষাজীবন শেষ হয় তখন দেখা যায় তার জ্ঞান ভাণ্ডারে তেমন সঞ্চয় জমে নি। কারণ চাপের মধ্যে সে মুখস্থ বা বারংবার অভ্যাস করে যে বিদ্যা আয়ত্ব করেছে তার সাথে আত্মবিকাশ-আত্মপ্রকাশের তেমন সম্পর্ক না হওয়ায় পরীক্ষার পর শেখা বিষয়গুলো তাদের কিছুই মনে থাকে না। আজকাল দেখা যায় প্রথম শ্রেণির পড়া দ্বিতীয় শ্রেণিতে আসতে আসতে অনেকটাই ভুলে যায় শিশুরা। জ্ঞান যে একদিকে পুঞ্জিভূত হয় আর অন্যদিকে তার ব্যবহারে জানা-বোঝা তথা আলোকনের একটি প্রক্রিয়ায় মানুষটা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে তা আর হতে পারে না। ছাত্রদের থুড়ি পরীক্ষার্থীদের জানার, পড়ার, বোঝার আগ্রহ নষ্ট হয়ে যায়, ফলে অধিকাংশ মানুষ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পরে কোনো বই পড়ার তাগিদ বোধ করেন না। অনেকে দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারেন না, অনেকে আবার বিষয়, ভাবনা বা ধারণার জটিলতায় খেই হারান, বিশ্লেষণের ঘূর্ণিপাকে অনেকেরই পড়ার আগ্রহ তলিয়ে যায়। আমাদের শিক্ষা তার ব্যবস্থার গুণে ছাত্রের পড়ার আগ্রহ অংকুরেই নষ্ট করে দেয়।
এভাবে সরকারের ঘোষণা ও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী মেধাভিত্তিক সমাজ তৈরি করা সম্ভব হবে না। এভাবে বিপুল অর্থ এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের শৈশব থেকে তারুণ্য এবং প্রতিভা ও মেধার অপচয় হতে দেওয়া কি ঠিক? শিক্ষার বিস্তার চলছে ঠিকই, তবে তার মূল্য শুধছি শিক্ষাকেই বলি দিয়ে।


****