Saturday, July 4, 2015

৬৬ বছরের আওয়ামী লীগ

আবুল মোমেন

দেশের বৃহত্তম ও প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সম্প্রতি দলের ৬৬ বছর পূর্তি উদযাপন করল। এ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠনে শেখ হাসিনা বলেছেন দেশে দুটি রাজনৈতিক ধারাই আছে - আওয়ামী লীগ ও এন্টি আওয়ামী লীগ। এ কথা তিনি আগেও বলেছেন, নাগরিকসমাজেরও কেউ কেউ একই কথা বলে থাকেন। কথাটা ভুল বা মিথ্যা নয় বলেই মনে হয়।
মুসলিম লীগের বিকল্প হিসেবেই আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের চিন্তা মাথায় এসেছিল মওলানা ভাসানি, শামসুল হক, শেখ মুজিবের। সেজন্যেই তাঁরা মুসলিম লীগ নামটির আগে বিশেষণ হিসেবে আওয়াম বা সাধারণ জনের কথাটা যুক্ত করেছিলেন। মুসলিম লীগে ভীড় করেছিলেন ভারতবর্ষের মুসলমান অভিজাতরা। বাঙালি মুসলিম সমাজে তখন বংশগত অভিজাত পরিবার কম। এখানে কৃষক পরিবারের শিক্ষিত সন্তানরাই মুসলিম লীগে যোগ দিয়ে অভিজাত্য গৌরব বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানভুক্ত অন্যান্য অঞ্চলে জনবিচ্ছিন্ন ছিল মুসলিম লীগ। তাই অবিভক্ত ভারতে বাংলা-ভিন্ন পাকিস্তানে যুক্ত হওয়া অন্য কোনো প্রদেশে মুসলিম লীগ বিজয়ী হতে পারে নি।
মুসলিম লীগ সমাজ থেকে উঠে আসা দল নয়। মুসলমানদের সেরকম সংগঠনও ছিল, যেমন জমিয়তে উলেমায়ে হিন্দ, তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া, মুসলিম সাহিত্য সমাজ, রেনেসাঁ সোসাইটি ইত্যাদি। কিন্তু এদের শেষের দুটি অরাজনৈতিক সংগঠন, অন্য দুটির রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রধান এজেণ্ড ছিল ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম। ফলে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার হিন্দু মুসলিম উভয় স্বাধীনতাকামীর বিপক্ষে দাঁড় করানোর লক্ষ্যেই সৃষ্টি করেছিল মুসলিম লীগ। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় সৃষ্ট দল ক্ষমতা বা ক্ষমতার প্রসাদ ভিন্ন টিকে থাকতে পারে না। তদুপরি পড়ে পাওয়া ক্ষমতার ভাগাভাগি নিয়ে কামড়া-কামড়ি হওয়াই স্বাভাবিক। এ হল অভিজাতদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব। তাতে রাজনীতিতে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, স্বার্থের চক্রান্ত, আপোসকামিতা, লেজুড়বৃত্তি, রাজনীতিকদের ডিগবাজি খাওয়া ইত্যাদি নিত্যকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই এসব খেলা শুরু হয়ে যায়। তাতে অন্তত তরুণ শেখ মুজিব বুঝেছিলেন এসব নেতাদের নিয়ে সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার রাজনীতি হবে না। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে খেদের সাথে এই উপলব্ধির কথা তিনি লিখেছেন - ‘অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই। তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশই বেশি হয়।’ (পৃ. ২৭৩) তাঁর এ উপলব্ধি অবশ্য আরও পরের, চুয়ান্ন সনে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে কেন্দ্রীয় সরকার এদেশে ৯২/ক ধারা জারি করার পর নেতাদের ভীরুতা, আপোসকামিতার পরিপ্রেক্ষিতে।
কিন্তু সংবেদনশীল, সাহসী, জনদরদী এই রাজনৈতিক কর্মী গোড়া থেকেই নেতৃত্বের এই দোদল্যমানতা ও স্বার্থকামিতা খেয়াল করেছেন। ফলে মুসলিম লীগের বিকল্প দল গঠন অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল তাঁর জন্যে। সেভাবে দলটি আওয়াম মুসলমান বা আমমুসলমান অর্থাৎ মুসলিম জনগণের দল হিসেবে গড়ে উঠেছিল। পরে ভাষা আন্দোলন এবং যুক্তফ্রন্টের অভিজ্ঞতায় তিনি উপলব্ধি করেন পূর্ব বাংলাকে ঘিরেই তাঁর রাজনীতি আবর্তিত হবে। ফলে তার রাজনীতির জন্য মুসলমান পরিচয় নয় বাঙালি পরিচয়ই হল প্রধান বিষয়। এভাবে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ পড়ল। এ দলটি হয়ে উঠল ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে আম বাঙালির দল। রাজনীতির হাল ধরেই শেখ মুজিব একজন রাজনৈতিক কর্মী থেকে জাতির নায়ক ও পিতা হয়েছেন। আওয়ামী লীগ প্রতিপক্ষ মুসলিম লীগের বিকল্প দল থেকে বাঙালিমাত্রের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছিল।
তবে ইতিহাসের পথ অনেক দূর পাড়ি দিয়েও বাঙালি মুসলমান তার আত্মপরিচয়ের সংকট আজও কাটাতে পারে নি। এই মুসলিম আইডেন্টিটি আর তার সাথে ক্ষমতার ষড়যন্ত্র বরাবর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকিয়েছে। নানা নামে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ বা এই মুসলিম আইডেন্টিটির রাজনীতি পাকিস্তান আমল জুড়ে এ কাজ করেছে।
বাংলাদেশেও এর পুনরাবৃত্তি রোধ করা যায় নি। ১৯৭৫ এর পরে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের মত ঠিক এই কাজটি করেছেন জিয়াউর রহমান। ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারের গর্ভেই যেমন  আইউবের কনভেনশন লীগের জন্ম তেমনিভাবে জন্ম জিয়ার বিএনপির। আইউব যেমন দল গঠনের আগে রাজনীতিবিদদের জন্যে রাজনীতি নিষিদ্ধ করে এবডো (ইলেকশন বডিজ ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার) জারি করেছিলেন জিয়াও তাঁর দল গুছানোর সময় নেওয়ার জন্যে সরাসরি রাজনীতিই নিষিদ্ধ করেছিলেন। উভয় সরকার-প্রধানই প্রগতিশীল শক্তির জন্যে জেলজুলুমের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, উভয় জেনারেলেরই মূল টার্গেট ছিল আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করা। একজন বিশেষভাবে জীবিত শেখ মুজিবকে নানাভাবে বিনাশের চেষ্টা করেছেন। আরেকজন নিহত বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে সন্দেহভাজন থেকে গেলেন, আর অনুপস্থিত নেতার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। কিন্তু প্রতিবারই আওয়ামী লীগ সকল বাধা ডিঙিয়ে অস্তিত্ব টিকিয়েছে, পরিস্থিতি সামলেছে।
বর্তমান বাস্তবতায়ও আমরা দেখছি ক্ষমতায় বসে জেনারেলরা যে দুটি দল তৈরি করেছেন তাদের পক্ষে কোনো কালে নিজস্ব রাজনীতি এবং রাজনৈতিক সংগঠন দাঁড় করানো সম্ভব হয় নি। মুসলিম লীগ যেমন ১৯৫৪ সনে প্রদেশে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জায়মান বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সামনে দাঁড়াতে পারেনি কখনও, বর্তমানে ক্ষমতাচ্যুত বিএনপিও সরকারি চাপে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক বিপর্যয়ে পড়েছে। এ বিপর্যয় দলটি কাটাতে পারবে কিনা বলা মুশকিল। আর এরশাদের জাতীয় পার্টিকে সরকারের লেজুড় হয়েই টিকে থাকতে হচ্ছে।
তবে মনে রাখতে হবে এটি একদিকে একটি প্রতারক ফাঁদ আর অন্যদিকে বিপজ্জনক পরিস্থিতি। প্রতারক এ জন্যে যে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তার এ দলগুলো দুর্বল হওয়ার অর্থ কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পথ নিরঙ্কুশ হওয়া নয়। কারণ রাজনীতির এত চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এবং সর্বস্তরে বিশ্বায়ন-আধুনিকায়নের প্রভাব পড়া সত্ত্বেও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান এখনও আত্মপরিচয়ের বিভ্রান্তি কাটাতে পারে নি এবং তাই এদেশের রাজনীতিতে ইসলাম ও ধর্মান্ধতার ভূমিকা থেকে যাচ্ছে। ফলে এর মধ্যে ভুল বোঝার সম্ভাবনা থেকে যায়। আর এর বিপজ্জনক দিক হল, যদি প্রতিপক্ষ-শক্তি দুর্বল ও অকেজো হয়ে পড়ে, তবে ক্ষমতাসীন দলের হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা পুঞ্জিভূত হয় এবং তাতে তাদের ফ্যাসিবাদী রূপ ধারনের সমূহ সম্ভাবনা থাকে। বলা বাহুল্য, এতে গণতন্ত্র সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে, দেশের ভবিষ্যতও অনিশ্চিত হয়ে যায়। তাই যেকোনো অবস্থাতেই দেশের সচেতন নাগরিক সমাজকে আজ অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। তাঁদেরই গণতন্ত্র রক্ষা ও এর বিকাশে সক্রিয় এবং সোচ্চার হতে হবে।

***