Wednesday, August 12, 2015

রাজন রাকিব রবিউল আর হন্তারক সমাজ

আবুল মোমেন

রাজন, রাকিব, রবিউল - তিনটি শিশুরই নামের অদ্যাক্ষর -র। প্রথম জনের খুঁটিতে বাঁধা করুণ কাতর চাহনির মর্মান্তিক ছবিটি মন থেকে তাড়ানো সম্ভব নয়। রাজন আর রাকিবের ছবি দেখেছি, রবিউলের মুখটা অদেখা হলেও কল্পনা করে নিতে পারি। পত্রিকায় মুদ্রিত রাজন-রাকিবের চেহারা দুটি বড় মায়াবী, বড়ই নিষ্পাপ কমনীয়তায় পবিত্র। ভাবি বয়সোচিত দুষ্টুমির সময় কেমন প্রাণবন্ত দেখাত ছেলেদুটিকে। প্রাণচাঞ্চল্য তো এ বয়সেরই ধর্ম। রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের সূত্রে দুষ্টুছেলে ফটিকের সাথে আমরা গভীরভাবে পরিচিত। ফটিক, বলাই, আশু - তাঁর এসব বালক চরিত্রের কাকে ছেড়ে কার কথা ভাবি। এই নিষ্কলুষ বালকেরা সকলেই যেন ছিল এই কলুষ-তামস-ভারাক্রান্ত জগতে অতিথিমাত্র। বড়দের নিষ্ঠুরতায় অকালে ছুটি হয়ে গেছে রাজন, রাকিব, রবিউলের। তবে এ ছুটি ফটিক বা বলাইয়ের পথে হয় নি।
গল্পে বালক দুটির মৃত্যুর পেছনে সমাজ এবং সংসারের উপেক্ষা আর অবহেলা-অনাদরের ভূমিকাই মুখ্য। গিন্নি গল্পে অবোধ নিষ্পাপ প্রাণচঞ্চল বালক আশুর প্রতি সমাজের অভিভাবকদের নিষ্ঠুর পীড়নের দৃষ্টান্ত পাই। এ সমাজে বালক বয়সের দুরবস্থার কথা রবীন্দ্রনাথ সরাসরিই বলেছেন। হঠাৎ শরীরে বেড়ে ওঠে তারা, গলার স্বর পাল্টাতে শুরু করে - ছোটর দলেও পড়ে না বড়র দলেও মানায় না। এদিকে শরীরের অভ্যন্তরে তো হরমোনের রূপান্তর ঘটতে থাকে। বালক শৈশব ছাপিয়ে পৌঁছে যায় বয়:সন্ধিতে। স্বয়ং সন্ত অগাস্টিন তাঁর স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছেন কী এক অজানা তাড়নার অস্থিরতায় কতই না ভুগেছেন তখন। বাধ্য হয়ে নিজেকে সংযত করতে কত কা-ই না তাঁকে করতে হয়েছে। রুশ ভাষার শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক তলস্তোয়ের নামের আগে ঋষি অভিধা প্রয়োগ করা হয়। ঋষি তলস্তোয় তাঁর বালক বয়সের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বয়:সন্ধির তাড়নায় কীসব অপকীর্তি ঘটাতেন সেসব কথা অকপটেই লিখে গেছেন। বালকমাত্রই অনুসন্ধিৎসু, কৌতূহল তার বয়সোচিত স্বভাবধর্ম। বিধাতা তাকে এভাবে তৈরি করেছেন বলেই সে কিছু অনাসৃষ্টি ঘটিয়ে তবেই সৃষ্টির অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে। মার্কিন কথাসাহিত্যিক মার্ক টোয়েন ডানপিটে দূর্ধর্ষ হাকল্কে সাহিত্যে অমর করে গেছেন। সাহিত্যে ডানপিটেদের রাজা হল অলিভার - হতদরিদ্র পরিবারের রাস্তায় বেড়ে ওঠা ছেলে অলিভার টুইস্ট। এসবই বাস্তব থেকে নেওয়া চরিত্র।
বড়রা চিরকালই ছোটদের দুষ্টুমির জন্যে একটু-আধটু শাসন করতেন, তাঁদের এই অধিকার সবাই মেনেই নেয়, এ নিয়ে বালকরাও বিশেষ মাথা ঘামায় না। শিশুদের - মনে রাখতে হবে বালকরাও শিশু - শারীরিক শাস্তি দেওয়া বা অপমানসূচক তিরস্কার করা তাদের মানসিক  (অনেক ক্ষেত্রে শারীরিকও) স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে এবং তা মাত্রা ছাড়ালে ক্ষতি গভীর, এমনকি স্থায়ীও হতে পারে। তাই আধুনিক কালে শিশুদের প্রতি এ ধরনের শাস্তিমূলক আচরণকে দণ্ডনীয় অপরাধ ঘোষণা করা হয়েছে।
কিন্তু সমাজমানস সহজে পাল্টায় না। বাবা-মা, শিক্ষক এবং দুর্ভাগা শিশু শ্রমজীবীদের নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে মনিবগণের দিক থেকে শিশুর অপরাধের জন্যে শাস্তিই - যা প্রায় ক্ষেত্রে চরম অপমানসূচক তিরস্কার দিয়ে শুরু হয়ে তাতেও গায়ের ও মনের ঝাল না মিটলে পিটুনির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয় - বরাদ্দ এ সমাজে। এ যেন সমাজ-সংস্কৃতির অচ্ছেদ্য ঐতিহ! শুনেছি প্রায় সব স্কুলেই মার অব্যাহত রয়েছে, পরিবারেও প্রহার-সংস্কৃতির প্রতাপ থামে নি।
রাজন, রাকিব বা রবিউলের ওপর প্রযুক্ত শাস্তি কোনো ব্যক্তি রাগের মাথায় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আকস্মিকভাবে ঘটান নি। তিন ক্ষেত্রেই শাস্তি দেওয়া হয়েছে পরিকল্পিতভাবে, অনেকক্ষণ সময় নিয়ে এবং মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া পর্যন্ত। মনস্তাত্ত্বিক হয়ত বলবেন, ক্রোধের সাথে অহঙের যোগে এসব মাত্রাছাড়া নৃশংসতা ঘটছে। হত্যাকারীরা এই শিশুগুলোর ওপর চরম নির্যাতন চালিয়ে তিলেতিলে অসীম যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে খুন করেছে। তাদের কৃতকর্মে এও বোঝা যায় যে এই পৈশাচিকতা তারা উপভোগ করেছিল। হত্যার মূল অভিপ্রায় হয়ত একজনেরই ছিল, কিন্তু অপরাধীর শাস্তি বিধানে ‘দায়িত্বশীল’ আরও ‘অভিভাবক’ প্রতিটি ঘটনাতেই স্বত:প্রণোদিত হয়ে জুটে গিয়েছিল। ফলে বোঝা যায় এ সমাজে নিষ্ঠুরতা, অপরাধপ্রবণতা এবং বিবেকহীনতার এক মারাত্মক অমানবিক সংস্কৃতি বহমান রয়েছে। এসব ঘটনা এমনি ঘটছে না, আমাদের প্রশ্রয়ে, আমাদেরই সাহচর্যে-সহযোগিতায়, সবার সমন্বিত যোগসাজশে একাত্তরের বীর বাঙালির অপমৃত্যু ঘটিয়েছি আমরা। কারণ প্রকৃত কাপুরুষই পারে শিশুর ওপর নিষ্ঠুর প্রতিশোধ চরিতার্থ করতে। আজ শিশু-নারী, আদিবাসী, দরিদ্র, দুর্বলমাত্রই এ সমাজে সবলের শাসন-শোষণের শিকার হচ্ছে। আমরা সমাজ হিসেবেই মনুষ্যত্বের গভীর সংকটে তলিয়ে যাচ্ছি।
বিচারহীনতা ও অপরাধীর শাস্তি না হওয়ার একটা পরিণতি এক্ষেত্রে অবশ্যই যুক্ত হচ্ছে। রাজন, রাকিব, রবিউলদের হত্যাকারীদের বিচার ও কঠিন শাস্তি অবশ্যই হতে হবে। এটি রাষ্ট্রের করণীয়। রাষ্ট্র অবশ্য সমাজেরই সৃষ্টি এবং তারই প্রতিফলন মাত্র। ফলে বিবেকহীনতা ও অপরাধের সাথে সহবাস এরও মজ্জাগত রোগ।
সমাজে পচন ব্যাপক ও গভীর সে কথা আমরা সকলেই জানি। তবুও একদম বসে পড়ছে না তার কারণ দুটি - এত কিছুর মধ্যেও শুভবোধসম্পন্ন মানুষ, তা যত অঙ্গুলিমেয়ই হোক, সমাজে টিকে আছেন। তাঁরা সংখ্যালঘু হলেও বিবেকের কণ্ঠস্বর ও সচ্চরিত্রের মহিমা কাপুরুষ বিবেকহীনদের কিছুটা হলেও দমাতে পারে। দ্বিতীয় কারণ হল, এ সমাজে তথাকথিত বিবেকহীন অভিভাবকদের চেয়ে ভুক্তভোগী রাজন-রাকিব-রবিউলরাই সংখ্যায় বেশি। তাদের চেয়ে একটু বড় বালক ও তরুণরাও সমাজে বিবেকহীনদের চেয়ে বেশি পরিমাণেই রয়েছে। নষ্ট সমাজ এদের পীড়ন করলেও এবং বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট করার সব আয়োজন চালিয়ে গেলেও, মনে হয়, প্রাণশক্তিতে ভরপুর সজীব প্রাণ এত সহজে পরাজিত হয় না।
আজ প্রয়োজন শুভশক্তির কাছ থেকে সমাজের শুভবোধকে জাগানোর জন্যে নিরন্তর উচ্চারণ এবং ধারাবাহিক কাজ। সে কাজের শ্রেষ্ঠ উপায় হল বালক-বালিকা, তরুণ-তরুণীদের সাথে সেতুবন্ধন রচনা। অর্থাৎ তাদের সাথে কথা বলার অসংখ্য সুযোগ তৈরি করা এবং তা অব্যাহত রাখা। এ কাজে বাহন হতে পারে শিল্পকলা ও সংস্কৃতিচর্চা। ধরা যাক, পাঠচক্র তৈরি করলেন বড়রা, তাতে সেরা সাহিত্যের সাথে লিঙ্গ-নির্বিশেষে শিশু-কিশোর-বালকদের পরিচয় ঘটানো হবে। তাদের পরিচয় ঘটাতে হবে জীবনের বিচিত্র সব সম্ভারের সাথে। বুঝতে হবে জীবন কেবল সংগ্রাম এবং যাপনের বিষয় নয়, নয়  কেবল ভোগ ও প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার মঞ্চ, এ হল উপভোগ এবং উদযাপনের  ক্ষেত্র। উপভোগ করতে হলে সে কেবল নিষ্ক্রিয় শ্রোতা বা পাঠক থাকলেও হবে না, তাতে কিছু উপকার নিশ্চয় হবে, কিন্তু সবচেয়ে ফলপ্রসূ পথ হচ্ছে শিশুরা যদি সক্রিয় অংশীদার হয়ে চর্চা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জীবনকে উপভোগ ও উদযাপন করতে শেখে। তাই প্রয়োজন সাহিত্য পাঠকে অগ্রাধিকার দিয়ে আবৃত্তি, নাটক, গান, নাচ ইত্যাদি যার যার সামর্থ্য ও অভিরুচি অনুযায়ী চর্চার সুযোগ করে দেওয়া। এতেও শেষ নয়, কারণ বড়দের ভুলে গেলে চলবে না, শৈশব-কৈশোরে তাঁদের মনেও ছিল অফুরন্ত বিস্ময়বোধ - যা সামান্যের ছোঁয়ায় সাড়া দিতে সক্ষম, ছিল অসীম কৌতূহল - যা তুচ্ছকেও জানতে চায়। আর এ বয়সে নগণ্যের মধ্যেও আনন্দ খুঁজে পায় শিশু। সে ভালোবাসে অভিযান, রোমাঞ্চ এবং নানা রকম চ্যালেঞ্জ। ফলে কেবল ঘরবন্দী জীবন তার নয়। প্রাসঙ্গিক হতে পারে ভেবে জানাই, একবার চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা আমাকে বলেছিল - মানুষ আসলে অন্যান্য প্রাণীদের মতই বহিরঙ্গন (ওরা বলেছিল আউটডোর) প্রাণী, ভুল করে ঘরে ঢুকে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন বিশ্বপ্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে বিশ্বশিশুর নিত্য খেলা চলে। ‘আবরণ’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি শৈশবে দিগম্বর শিশুকে ধূলোবালিতে ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। কবির দু:সাহস অনেক, লিখেছেন সাত বছর পর্যন্ত পোশাকের বালাই দিয়ে ওকে কষ্ট না দিলেও চলে। হায়, যেদেশে দু-তিন বছরের শিশুকন্যাও ধর্ষিতা হয় সেখানে এ সৎসাহস কবে বিদায় নিয়েছে, কবি কীভাবে বুঝবেন!
সমাজের অঙ্গনে আমাদের অনেক কাজ। নারীদের মধ্যেও শিশু উৎপীড়ক ও নির্যাতক বেড়ে চললেও মূলত পুরুষ সম্প্রদায়ের মধ্যে সত্যিকারে পৌরুষের অভাব থেকেই সমস্যা বাড়ছে। সৎসাহস হারিয়ে কে-ই বা পুরুষ থাকতে পারে? রবীন্দ্রনাথ অবিস্মরণীয় বাঙালি বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলেছিলেন, তাঁর চরিত্রের প্রধান গৌরব ‘তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব’।
হ্যাঁ অজেয় পৌরুষ ও অক্ষয় মনুষ্যত্বের সাধনাই করতে হবে - নারীমাত্র দর্শনেই যে পৌরুষ লালসা কাতর হয়, অন্যের আত্মসম্মানবোধে যে মনুষ্যত্ব ক্ষয় পায় তার হাত থেকে সমাজকে উদ্ধার করতে হবে।
এ কাজে প্রথমে আমাদেরই দোষ স্বীকার করতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে রাজন-রাকিব-রবিউল কিংবা ত্বকীদের অপমৃত্যুর দায় সমাজের অংশ হিসেবে আমরা কেউ এড়াতে পারি না। আমরা সকলেই শিশুহত্যার অংশীদার! ব্যক্তি পর্যায়ে এই উপলব্ধি ঘটলে পরিবর্তনের কাজ কিছুটা সহজ হবে। কাজ হতে হবে দুই ক্ষেত্রে - পরিবারে এবং স্কুলে। আপাতত এক্ষুনি সরকার স্কুলে স্কুলে মূল শিক্ষাক্রমের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক শিক্ষা চালু করে দিতে পারেন।
সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা ও সাংস্কৃতিক পাঠ নিয়ে সত্তর বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা রইল। এখন এ মুহূর্তে চাই রাজন-রাকিব-রবিউলসহ গত সাড়ে তিন বছরে যে প্রায় এক হাজার শিশুহত্যার ঘটনা ঘটেছে এ সম্পর্কে একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হোক, প্রত্যেকটি মামলা পরিচালনার দায়িত্ব রাষ্ট্র নিক এবং দ্রুতবিচার আইনে অভিযুক্তদের অপরাধ প্রমাণ ও শাস্তির বিধান করা হোক।

***