Monday, August 5, 2013

গণতান্ত্রিক রাজনীতি কি সন্ত্রাসের কাছে হার মানবে?

আবুল মোমেন 

বড় রাজনৈতিক দলের ছাত্র-যুবনেতাদের পারস্পরিক খুনোখুনির ঘটনা নতুন নয়। দেশের নানান অঞ্চল থেকে এমন খবর প্রায়ই আসে। ঢাকায় মিল্কি হত্যার ঘটনাটি সংলগ্ন মার্কেটের সিসিটিভির ক্যামেরার কল্যাণে বাড়তি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। গণমাধ্যমের ভাষায় ফিল্মি কায়দায় মাত্র ১৪ সেকেণ্ডে ঘটা হত্যাকাণ্ড! গুলি করে মানুষ মারতে হয়ত এক সেকেণ্ডই যথেষ্ট।
বিপরীতে মিল্কির কথিত হত্যাকারী তারেকের হত্যাকাণ্ডটি লোকচক্ষুর আড়ালে হওয়ায় এটি হয়ে থাকল কেবল একটি তথ্য।
কিন্তু মিল্কি বা তারেকের হত্যাকাণ্ড নয়, ফিরে যাব প্রথম কথাটিতে। যে দুটি দল এদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যায় সে দুই দলেই ছাত্র-যুব নেতাদের অন্তর্দলীয় কোন্দল এখন চরম আকার নিয়েছে। কখনও কখনও দ্বিদলীয় সংঘর্ষে তারা জড়িয়ে পড়ে। তবে উপদলীয় কোন্দলের ঘটনাই বেশি ঘটছে।
এই প্রাণঘাতি কোন্দলের পিছনে কাজ করে ক্ষমতার ভাগ, দলে ও এলাকায় আধিপত্য, অবৈধ উপার্জনের বখরা নিয়ে দ্বন্দ্ব। এ পর্যায়ে প্রথমত রাজনীতির সাথে সন্ত্রাসের সংযোগ ঘটে, দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক কর্মী ও অপরাধীর মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হয়। এক সময় রাজনীতিকরা ক্ষমতা ও বিত্তের আধিপত্য বজায় রাখার জন্যে কর্মীদের মাধ্যমে পেশাদার সন্ত্রাসী জোগাড় করতেন। এখন সন্ত্রাসীরা আর ভাড়া খাটে না - একদিকে তারা রাজনৈতিক দলে ঢুকে পড়েছে আর অন্যদিকে দলীয় কর্মীদের অনেকেই এদের সংস্পর্শে এসে সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়েছে।
সোমালিয়া-আফগানিস্তানে ওয়ারলর্ডদের কথা শুনেছি। তারা দেশ ধর্ম জাতি স্বাধীনতা এইসব বড় বড় লক্ষ্যের কথা বলে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। আমাদের দেশে ছোটমাপের ওয়ারলর্ড তৈরি হয়েছে, যাদের লক্ষ্যও ছোট - নিজের জন্যে দলে ভালো পদ, একটু ক্ষমতার ভাগ, অর্থবিত্তের নিত্য যোগান। ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তার এই মানুষগুলোর কিছু অনুসারীও থাকে যারা তাদের অবৈধ উপার্জনের সহায়ক শক্তি এবং সে উপার্জনের উচ্ছিষ্টের ওপর জীবন ধারণ করে। হয়ত গোপনে লক্ষ্য থাকে একদিন নিজেও তার বসের মত ক্ষমতা অর্জন করবে, রোয়াব দেখাবে।
কখন থেকে রাজনীতিতে এই পেশিশক্তি ও কালোটাকা-নির্ভর নেতাদের আবির্ভাব হল? এটা জানা দরকার।
মুক্তিযুদ্ধ সর্বপ্রথম আমাদের তরুণদের ব্যাপকহারে অস্ত্রের সাথে পরিচয় ঘটিয়েছে, বাড়ি ছেড়ে তারা রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতা পেয়েছে, তখনই যুদ্ধ, হত্যা, রক্ত, মৃত্যুর সাথে পরিচয় ঘটেছে। মানবজীবনের এ কোন স্বাভাবিক অভিজ্ঞতা নয়। স্বাধীনতার পরে অনেকেই অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলেও অনেক মুক্তিযোদ্ধা তা পারে নি। তখনই রাজনীতিতে অস্ত্র ও অস্ত্রবাজদের ব্যবহার কিছু কিছু ঘটতে শুরু করে। আমাদের নেতৃবৃন্দ এই অস্থির উচ্চাভিলাষী তরুণদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর বা সংশোধনের পথ দেখায় নি।
তবে পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে পঁচাত্তরের পরে, যখন বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে জেনারেল জিয়া সেনাতন্ত্র চালু করলেন। তাঁর ও এরশাদের আমলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার প্রক্রিয়ায় রাজনীতিতে কালোটাকা, অবৈধ অস্ত্র এবং অনিয়মের পথ খুলে যায়।
দুই আমলেই সর্বোচ্চ চাপ ছিল আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও ব্যবস্থা সবই আক্রান্ত হয়েছিল এ সময় প্রায় দেড় দশক ধরে। পাশাপাশি নিজেদের রাজনৈতিক উত্থান নিশ্চিত করার জন্যে তারা জামায়াত ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছে, যুদ্ধাপরাধ থেকে দায়মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার করেছে। কিন্তু এটুকুতেই তাদের রাজনৈতিক অপকর্ম শেষ হয় নি। রাজনীতিতে কালোটাকা, সামরিক হস্তক্ষেপ, নির্বাচন কমিশনসহ প্রশাসনকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার, রাজনীতিতে ঘুষ-দুর্নীতি ও ক্ষমতার সর্বোচ্চ অপব্যবহার এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্যে প্রয়োজনে সশস্ত্র ক্যাডার সৃষ্টিসহ গণতান্ত্রিক রাজনীতির পথকে কলুষিত-কদর্মাক্ত করেছে।
এর সাথে পাল্লা দিয়ে অস্তিত্ব রক্ষা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগে জেলায় জেলায় জন্ম নিয়েছে বিতর্কিত ব্যক্তিরা। স্বৈরাচারের পতন হয়েছে, দেশে গণতন্ত্র এসেছে, কিন্তু সামরিক স্বৈরাচারের সৃষ্ট রাজনৈতিক ব্যাধির সংক্রমণ, ক্ষত, পুঁজ আমরা এখনও বহন করে চলেছি। তারই সর্বশেষ নমুনা যুবলীগের মিল্কি বা তারেকের মৃত্যু।
নিষিদ্ধ ঘোষিত জেএমবি, হরকতুল জিহাদের মত দলগুলো বিএনপি-জাপার রাজনীতির ধারাবাহিকতাতেই উঠে এসেছিল। কেবল এরা নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায়ে বারবার বর্ণিত হয়েছে জামায়াতে ইসলামি একটি সন্ত্রাস-নির্ভর দল যারা কিনা বিএনপির প্রধান মিত্র।
১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত রাজাকার ও আলবদরের মত ঘাতক বাহিনী গঠন করে, শান্তি কমিটির মত দালাল সংগঠন গড়ে তুলে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, জবরদস্তি চালিয়ে এবং হিন্দুদের মুসলমান বানানোর মত জঘন্য সব যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত হয়েছিল। ১৯৭১-এর পত্রপত্রিকার খবরে এবং জামায়াত নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতিতেই তাদের এসব অপরাধের সাক্ষ্য রয়েছে। তারা এদেশে রাজনীতি করতে চায় কিন্তু দেশ ও দেশবাসীর বিরুদ্ধে কৃত অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাইতে রাজি নয়, ভুল স্বীকারে আগ্রহী নয়। তারা মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে বাংলাদেশকেই অস্বীকার করে, তারা সংবিধানের নীতিমালার প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। এদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নস্যাৎ করে তালেবানি বিপ্লব ঘটাতে চায়। তাদেরকে দীর্ঘকাল পোষণ করার পরিণতিতে দেশে হেফাজতিদের মত ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান ঘটেছে যারা কেবল নারীবিদ্বেষ নয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ (পবিত্র কোরান পোড়ানোসহ) নারী নির্যাতনের মত সন্ত্রাসে জড়িয়ে যাচ্ছে। আর ক্ষমতার লোভে বিএনপি এইসব অপশক্তির সাথে আঁতাত করেছে।
দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সন্ত্রাসমুক্ত করার পথে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধর করার দাবি অনেক দিনের। আপাতত নির্বাচন কমিশনে দলের নিবন্ধন বাতিল হল।  কিন্তু আজ জামায়াত নিষিদ্ধ হলেও রাজনীতি সন্ত্রাসমুক্ত হবে না। দুর্নীতি ও সন্ত্রাস হাত-ধরাধরি করে প্রশাসন ও সমাজের সবখানে ছড়িয়ে পড়েছে। তা আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে গণতান্ত্রিক রাজনীতি থেকেও। সেটা বন্ধ করতে হবে।
স্বৈারাচার বিরোধী আন্দোলনের অধ্যায় নব্বইতে শেষ হয়েছে। সেই দেড়দশকে যেসব সশস্ত্র ক্যাডারদের উত্থান হয়েছে তাদের গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আত্মস্থ করার চেষ্টা সুফল দেয়নি। বরং গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সেটি একটি ধারা হয়ে বসেছে। বড় দলের ছাত্র-যুব সংগঠনে এ ধরনের নেতা-পাতিনেতার উদ্ভব অহরহ হয়ে চলেছে। তারাই মিল্কি, তারাই তারেক, তারাই তাদের ঊর্ধতন নেতা। দেখা যাচ্ছে ওয়ার্ড পর্যায়ের রাজনীতি এভাবে কলুষিত-বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। তার প্রভাব ক্রমেই উপরের স্তরেও ছড়িয়ে পড়ছে।
দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে জামায়াতের মত সন্ত্রাস-নির্ভর সংগঠন নিষিদ্ধ হতে পারে, কিন্তু সেই সাথে গণতান্ত্রিক দলগুলোর সন্ত্রাস-নির্ভরতা বন্ধ করতে না পারলে লাভ হবে না। এ দুটোই আজ সময়ের চাহিদা।