Wednesday, May 17, 2017

কোন্ চেতনায় দেশের প্রকৃত উন্নয়ন ঘটবে?

আবুল মোমেন

জেনারেল এরশাদ কি বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারবেন? তাঁর বয়সের কথা - সম্ভবত এখন ৮৫-৮৬ চলছে - একেবারে বাদ দেওয়া যাবে না। তাছাড়া দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মামলাগুলো থেকে তাঁর নিস্কৃতির ব্যবস্থা হলেও এরশাদ কি স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ফিরে পাবেন? বাংলাদেশের ইতিহাসে দুই সামরিক শাসকের মধ্যে এরশাদের জন্যেই এ কাজটা কঠিন বেশি। এর বাইরে থাকল সাম্প্রতিক রাজনীতিতে তাঁর সুবিধাবাদ ও অস্থিরমতিত্বের নানা কা-। জনমনে এরও প্রভাব রয়েছে এবং তাঁকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে কোনো মহলই নিতে চাইবে না, যেমন চায় নি ও নেয় নি খোদ আওয়ামী লীগও। তাঁকে তারা ব্যবহার করেছে, করছে।
আদতে ক্ষমতাসীন দলের মতির ওপরই এরশাদের ভাগ্য নির্ভর করে। ফলে তাঁর জোট গঠন এবং সরকারের কাছ থেকে দূরে সরে স্বাধীন অবস্থান গ্রহণের প্রক্রিয়াকে মানুষ - অন্তত অনেকেই  - পাতানো খেলা হিসেবেই নেবে। এরশাদ নিজেও ক্ষমতাসীন অবস্থায় আ স ম  আবদুর রবকে দিয়ে বহুদলীয় জোট গঠন করিয়ে তাঁর নির্ভরযোগ্য বিরোধী দল বানাতে চেয়েছিলেন। লোকে এ জোটকে গৃহপালিত বিরোধী দল বলত এবং এই প্রক্রিয়ার সাথেই আ স ম রবের রাজনৈতিক জীবনের কার্যকারিতারও ইতি ঘটে।
এরশাদের রাজনৈতিক জীবন টিকে আছে বস্তুত ক্ষমতার প্রসাদেই। উত্তরবঙ্গে তাঁর যে নিজস্ব ভোটবলয় ছিল তা অস্তায়মান। তাঁর ও তাঁদের পরিবারের প্রতি সেখানকার মানুষের মায়া থাকলেও তাতে এমন জোয়ার থাকবে না যে তাঁরা ছাড়াও দলের অন্য প্রার্থীরাও বিজয়ী হবেন।
এরশাদ ও তাঁর জোট বস্তুত ফুটো বেলুন, তালি দিয়ে তা খুব বেশি দূর ওড়ানো যাবে না। এরশাদ যেমন আবদুর রবকে খাড়া করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে বাদ দিয়ে ভোটের গণতন্ত্র চালু রাখতে চেয়েছিলেন সম্ভবত আওয়ামী লীগ এবার তাঁকে সামনে এনে একই পন্থায় বিএনপিকে মাইনাস অথবা সাইজ করতে চাইছে। এটা ক্ষমতাসীনদের একটি পরীক্ষামূলক পদক্ষেপ নিশ্চয় - কদ্দুর কাজে লাগে তা দেখতে চাইছেন তাঁরা। এর মধ্যে আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্যে মুখিয়ে থাকা বিএনপিকে বিরক্ত করা হবে এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণের লাভালাভ নিয়ে চরম সংশয়ে তথা সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যেও রাখা হবে। এতে নির্বাচনে অংশ নিলেও বিএনপির পক্ষে সর্বশক্তি ও সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হবে না। প্রধান প্রতিপক্ষকে অপ্রস্তুত বা দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে রেখে নির্বাচনে আনতে পারলে তা আওয়ামী লীগের মন:পুত হবে।
এরশাদ বিএনপির বিকল্প শক্তি হিসেবে জনগণের আস্থা পাবেন না। অর্থাৎ চলমান এই প্রক্রিয়ার সুফল সরাসরি আসার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু পরোক্ষ ফল যে আওয়ামী লীগ পাবে না তা নয়। বিএনপির মূল অনুপ্রেরণা - বেগম জিয়া ও তারেক জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যত ও ভূমিকাকে চাপে রাখার অস্ত্র হাতে রেখেছে ক্ষমতাসীন দল। তাঁদের মামলার গতিপ্রকৃতি থেকে মানুষ এটা বুঝতে পারে। এর চরম পদক্ষেপ হতে পারে তাঁরা দুজনই মামলায় শাস্তি পেয়ে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষিত হতে পারেন। বর্তমান বাস্তবতায় দলে এর ফল হতে পারে সেনাপতির অনুপস্থিতিতে হতোদ্যম সৈন্য বাহিনির মত।
এইখানে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এরকম অবস্থায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা কখনো মাঠ ছাড়ে নি, বরং আন্দোলনকে প্রায় নৈরাজ্যের পথে নিয়ে দাবি আদায়ে সক্ষমতা দেখিয়েছে। কিন্তু যে দল ক্ষমতার প্রসাদ পাওয়ার জন্যে ভীড় করে আসা নানা মত-পথের মানুষের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে তার পক্ষে জিয়ার উত্তরসুরী ব্যতীত অন্য কারো নেতৃত্বে দলে ঐক্য রক্ষা ও সে দলকে নিয়ে জানবাজী রেখে লড়াই চালানো সম্ভব নয়। এটা গত দশ বছরে ভালোভাবে প্রমাণিত হয়েছে যদিও নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনেও মাঠের লড়াইয়ে মূল ভূমিকা পালন করেছিল আওয়ামী লীগই। বিএনপি তাতে শরিক থেকে লাভবান হয়েছিল।
বিএনপর এই অন্তর্নিহিত দুর্বলতা আওয়ামী লীগ ভালোভাবেই জানে। আর মামলা-মোকদ্দমা ও পুলিশি অ্যাকশানে তাদের কাবু করে রেখে এর প্রমাণও তারা পেয়েছে।
বর্তমান বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ আরো কিছু বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে। আঞ্চলিক রাজনীতি, বিশেষত ভারতের সমর্থন এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় দুই প্রধান দলের মধ্যে আওয়ামী লীগই সবার অপেক্ষাকৃত পছন্দের দল। এমনকি হেফাজতের প্রতি সরকারের সাম্প্রতিক পক্ষপাতমূলক ভূমিকা এই সমর্থনকে আরো জোরদার করবে। এর বিরুদ্ধে দেশে যে প্রগতিচেতনার রাজনীতি ও সমাজভাবনা আছে তাকে বিএনপি প্রতিনিধিত্ব করে না, এবং করবেও না। এ অবস্থায় তারা চাইবে ধর্মীয় কার্ডটি আরো ভালোভাবে খেলে ও খেলিয়ে ভোটারদের পক্ষে টানতে। অর্থাৎ আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে ইসলামি রাজনীতি ও ইসলামি দলগুলোর পোয়াবারো হবে। এরশাদের জোটের ৫৮ দলের মধ্যে পঞ্চাশের অধিক হল নামসর্বস্ব ইসলামি দল, বিএনপি জোটেও তারাই সংখ্যায় বেশি। আওয়ামী লীগও এধারার বাইরে থাকল না, তারা খোদ হেফাজতের সাথে মৈত্রী করে নিয়েছে।
রাজনীতির এই সাম্প্রতিক গতিধারায় আওয়ামী লীগের জন্য ক্ষমতায় থাকা সহজ হবে মনে হলেও এর মূল্য গুণতে হবে অনেক। আওয়ামী লীগই এতকাল এদেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, তাই তার সাথেই চলেছে এদেশের প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি-সংস্কৃতিধারা। কিন্তু ক্রমে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর জন্য আওয়ামী লীগের দরজা খুলে যাওয়ায়  সে ধারায় বিশ্বাসী লোকজন লীগে ঢুকে পড়ছে। আবার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা, এবং আগামীতেও ক্ষমতায় থাকার সম্ভাবনা উজ্জ্বল বলে ক্ষমতার প্রসাদলোভী সুবিধাবাদী রাজনীতিকরাও এ দলে ভীড় করছে। দলের ক্ষমতায় টিকে থাকার এজেণ্ডাটির অগ্রাধিকার বরাবর এদের জন্যে প্রশ্রয় হিসেবে থাকবে এবং দিনে দিনে দলের অভ্যন্তরে অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল চেতনার অংশ কোণঠাসা ও দুর্বল হতে থাকবে। এতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির যে রূপান্তর ঘটছে তা বাংলাদেশকে তার গৌরবময় সহনশীল মানবিক সমাজের ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারে। বস্তুত এই বিচ্যুতি শুরু হয়ে গেছে। তার জোরালো আলামত সমাজে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় উগ্রতা ও তা পালনের বাহ্য আড়ম্বর সমাজজীবনে সংখ্যালঘুদের অবস্থানকে অনিশ্চিত, অনিরাপদ করছে ও তাদের দৈনন্দিন জীবনে অস্বস্তি সৃষ্টি করছে। সংখ্যালঘুদের অব্যাহত দেশত্যাগে এটা বোঝা যায়। এ অবস্থায় সমাজে মুক্তচিন্তাই যে কেবল চাপে পড়ছে তা নয় প্রকৃত জ্ঞানচর্চার পরিবেশও বিনষ্ট হচ্ছে। সমাজে অন্ধবিশ্বাস, সংস্কার ও মূঢ়তা এবং ক্ষমতা, অর্থ ও পেশিশক্তির দাপট বাড়ছে। এসবের আলামতও অস্পষ্ট নয়।
এখন প্রশ্ন হল, স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক পরে দেশের এই পরিণতিই কি কাম্য ছিল, কাম্য হতে পারে? মুশকিল হল, এসব নিয়ে আওয়ামী লীগের ভাবনা কি তা জানারও উপায় নেই, কারণ সেখানে একক সিদ্ধান্তেই সব চলছে। শেখ হাসিনা আপাতত বুদ্ধিজীবী, শিল্পীসাহিত্যিক, নাগরিকসমাজকে দূরে ঠেলে রেখেছেন। হতে পারে আমলাদের হাতে ক্ষমতা বেশি, ধর্মীয় নেতাদের পিছনে সমর্থক বেশি, কিন্তু সমাজকে এগিয়ে নিতে ক্ষমতাবান ও অন্ধ সমর্থকের চেয়ে বেশি প্রয়োজন চিন্তাশীল সৃজনশীল মানুষের ভূমিকা। তাদের মধ্যেও সুবিধাবাদী তোষামুদে প্রকৃতির লোক থাকতে পারে, আছেও, কিন্তু ছদ্মাবরণ ভেদ করে খাঁটি মানুষদের খুঁজে নেওয়া ও তাদের পরামর্শ নেওয়াই তো নেতৃত্বের বড় কাজ। অতীতের দিকে তাকালে বাংলাদেশের গড়ে ওঠার কালে গত শতকের পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীদের এ ধরনের সংযোগ এবং তার ফলাফল জাতি দেখেছে, তাতে উপকৃত হয়েছে।
বাংলাদেশের জন্যে বর্তমান সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রশ্ন হল - দেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগুবে নাকি মুসলিম জাতীয়তার কট্টরপন্থার সাথে আপসের রাজনীতির খেসারত দেবে? অর্থনৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতির মধ্যেও একটি দেশ ও তার জনগণ চেতনায় পিছিয়ে যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের ধনী উন্নত দেশগুলো মানবসভ্যতায় কোনো অবদান রাখতে পারছে না। বাংলাদেশ আজ সেই রকম এক অন্ত:সারহীন উন্নয়ন বা শুভঙ্করের ফাঁকির সামনে পড়ছে। এই ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে এখন থেকেই দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ও সচেতন নাগরিকদের ভাবা উচিত।
***

Sunday, May 14, 2017

শিক্ষায় সংস্কৃতির পাঠ জরুরি

আবুল মোমেন

আমাদের দেশে শিশুমাত্রই উপেক্ষিত, সুস্থ শৈশব থেকে তারা বঞ্চিত। হতদরিদ্র-দরিদ্র পরিবারের শিশুর বঞ্চনার বাস্তবতা আমরা জানি, কিন্তু ধনীর সন্তানও কি আদর্শ শৈশব কাটাতে পারে? তাদের হয়ত ভোগ-আস্বাদনের সুযোগ সীমাহীন, কিন্তু শিশুর আনন্দের প্রধান উৎস তো অংশগ্রহণমূলক কাজে (বা খেলায়)। সেখানে অধিকাংশের জীবনই কাটে বন্দিদশায়, একাকীত্বে। সচরাচর শিশু খেলনার অপেক্ষায় থাকে না, কিন্তু খেলনা পেতে নিশ্চয় তার ভালো লাগে। অনেক বাবা-মা শিশুর এই দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে তার সাথে খেলার বদলে তাকে খেলনার প্রলোভন দেখিয়ে তার কাছ থেকে শৃঙ্খলা আদায় করেন (চুপ করে বসে থাকা, দ্রুত খাওয়া ইত্যাদি)। বড়রা শিশুর 'দুর্বলতা'কে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে নিজের কার্যসিদ্ধি করলেও পরিণামে শিশুর মধ্যে কাক্সিক্ষত জিনিস আদায়ের দরকষাকষির মনোবৃত্তি উশকে তোলেন। তাতে  সম্পর্কের সারল্য ও স্বতস্ফূর্ততা চোট খায়, এর মধ্যে উভয় পক্ষে চালাকির প্রবণতা ঢুকতে থাকে।
শিশুর মনোজগৎ সরল বলেই সৎ, সততার সারল্যেই ফোটে তার সৌন্দর্য। তুলনায় বড়দের জগৎ অনেক জটিল এবং বিস্তর কৌশল, বহুতর দায়, বিচিত্র সব ভাবনা এবং নানান বিবেচনার প্রভাবে সেটা নিছক সাদা-কালোয় তৈরি নয়। সে জন্যে শিশুর সাথে চলা ও খেলার সময় বড়দের একটু সতর্ক অর্থাৎ বাড়তি বিবেচনা মাথায় রাখতে হবে। বাঙালি সমাজ তা করে না। বাঙালি সমাজমানসের কিছু মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য আছে যা শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের জন্যে নেতিবাচক - যেমন, সমাজটা কপটতায় অভ্যস্ত, নৈতিক মূল্যবোধের বিষয়ে উদাসীন (মুখে খুব বলে, কিন্তু আচরণে সম্পূর্ণ উদাসীন), এ সমাজ পক্ষপাতদুষ্ট, সহজাত ঔদার্য ও সহিষ্ণুতার শক্তি হারিয়ে ফেলছে। শিশুর প্রতি চরম নিষ্ঠুরতার অনেক দৃষ্টান্ত আমরা সম্প্রতি দেখেছি।
আমরা দৈনন্দিন জীবনে ভুলে যাই যে শিশু এমন এক অসীম সম্ভাবনাময় পাত্র যার আধেয়সমূহ কেবল সরল নয়, কাঁচা, সুপ্ত, উন্মুখ অর্থাৎ গ্রহণ ও বিকাশের জন্যে হন্যে হয়ে আছে। এ সময় তার নিজের বিচারক্ষমতা দুর্বল, দূরদর্শিতাও তার কাছে কাম্য হতে পারে না। কিন্তু হস্তক্ষেপমুক্ত থেকে শিশু যদি কেবল সঠিক জিনিস পায়, ন্যায্য কথাটাই শুনতে পায় তাহলে বিচারবোধ, দূরদর্শিতাসহ তার সব দক্ষতা ও মূল্যবোধই বিকশিত হবে।
সেটাই পথ, সেই পথে চলার আয়োজনটাই জরুরি। হয়ত এখান থেকে আমরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে শিশুর জন্যে সমতাভিত্তিক সুষ্ঠুবিকাশের মানবিক স্বর্গীয় বাস্তবতা তৈরি করা সম্ভব ( যা বাস্তবে ঘটেছিল) তার কথা টানতে পারি। কিন্তু সে আলোচনা শিশুর বিকাশের প্রসঙ্গ ছাড়িয়ে রাজনৈতিক দিকেই মোড় নেবে। আজকে আমরা সেদিকে যাব না।
আমাদের ধারণা বর্তমান বাস্তবতাতেও শিশুর বিকাশে কাক্সিক্ষত ফল পাওয়া সম্ভব। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের চ্যালেঞ্জটাও আমাদের জন্যে কম বড় ছিল না। সীমাবদ্ধ জমি ও পুঁজির স্বল্পতার বিপরীতে ক্রমবর্ধমান মানুষের যে চ্যালেঞ্জ তা আমরা ভালোভাবে উৎরেছি, কেবল যে চালে উদ্বৃত্ত হয়েছি তা নয়, সব্জি, মাছ, ফলেও প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছি। এ বিপ্লব ঘটেছে নিজেদের অর্থায়নে, পরিশ্রমে, দক্ষতায় ও প্রযুক্তির ব্যবহারে। কৃষিবিপ্লবের মতই শিক্ষাবিপ্লব দরকার।
খাদ্যের চাহিদা যেহেতু জৈবিক তাই প্রাণিমাত্রই তা বোঝে। জ্ঞান খাদ্যের মত বস্তু নয়, বিমূর্ত বিষয়, এর পরিমাপের ব্যবস্থাটি কৃত্রিম, জ্ঞানের নিজস্ব প্রকৃতি হল এর অব্যাহত বিকাশ। তাই জ্ঞান হল চর্চার বিষয়, এর উদ্ভাবন নবায়ন, নিত্য পরিমার্জন অপরিহার্য। এর নিছক চর্চার আনন্দই হল মৌলিক, তা যদি পরীক্ষার ফলের অর্থাৎ পরিমাপের কৃত্রিম ব্যবস্থার ফাঁদে আটকে পড়ে তবে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়।
আর তার খেসারত দিতে হচ্ছে সমাজকে  - এটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ হয়ে উঠছে না। জ্ঞানের বিচারে এ সমাজ অনেকাংশে তামাদি - অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষ বেশির ভাগ বিষয়ে পুরোনো ধ্যানধারণা, বিশ্বাস আঁকড়ে আছেন। সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিলেও এটিই বাস্তবতা। জ্ঞান হল অসীম এবং জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হবে নানা আলোচনা ও তর্কবিতর্কের মাধ্যমে প্রাণবন্ত, মুক্ত, বিকাশমান। কিন্তু আমাদের সমাজমানসে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার এখনো দৃঢ়মূল শুধু নয়, যেটুকু জ্ঞানচর্চা হয় তা পদ্ধতির কারণে কার্যত বিশ্বাসে, কখনো অন্ধবিশ্বাসে রূপান্তরিত হয়। এভাবে বলা যায় সমাজটা অনুসন্ধিৎসায়, যুক্তিতে তথা জ্ঞানের অজানা নতুন পথে দু:সাহসী অভিযানের জন্যে একেবারেই প্রস্তুত নয়। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ও তাতে ছাত্র-শিক্ষকের সংখ্যা বাড়লেও সমাজ বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চার অনুকূল নয়। আর নয় বলেই এখানে যে কোনো স্তর থেকে যে কোনো  শিক্ষার্থী যে কোনো অন্ধবিশ্বাসে দীক্ষিত হতে পারে। ধর্মীয় চরমপন্থা যা সম্প্রতি জঙ্গিবাদে প্রকাশ পাচ্ছে তার প্রচারণাকে প্রতিরোধের মত পাল্টা যুক্তি-ভাবনা বর্তমান বিদ্যায় কুলাবে না।
জ্ঞানের দিক থেকে এটি স্থবির, এবং যেহেতু স্থবিরতা প্রাণজ বস্তুকে পচন ও ক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়, তাই এ সমাজের অবস্থাও সেরকমই হচ্ছে। দালানকোঠা নির্মাণকেই গুরুত্ব দিচ্ছি, আরাম ও ভোগ, বিলাস ও বিনোদন গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রাণের বিকাশ, জ্ঞানের আনন্দ মোটেও পাত্তা পাচ্ছে না। এটা সংস্কৃতির সংকট, যা শিশুকাল থেকেই শিক্ষার মাধ্যমে পাওয়ার কথা।
শিক্ষার একটা সংস্কৃতি আছে যেমন সব বিষয়ের থাকে। শিক্ষার সংস্কৃতির নিহিত চাহিদা হল মুক্ত পরিবেশ, অংশগ্রহণের অবাধ সুযোগ, প্রকাশের স্বাধীনতা।
তাই স্কুল বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র ভাবলে তার অনুকূল সাংস্কৃতিক পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্যে শিক্ষার দুটি দিক নিয়ে ভাবা জরুরি -
১.       প্রশ্নের উত্তর-নির্ভর পরীক্ষাকেন্দ্রিক বিদ্যাচর্চার স্থলে জ্ঞানচর্চার জন্যে ভাষা (বাংলা ও ইংরেজি) ও গণিতে দক্ষতা ও পাঠ্যসূচি অনুযায়ী নানা বিষয়ে জ্ঞানার্জন হবে শিক্ষার মূল লক্ষ্য।
২.       সেই লক্ষ্য অর্জনে সাফল্যের জন্যে চাই জ্ঞানচর্চার সাথে সাথে আত্মপরিচয়ের শিকড়ের সাথে শিশুমনের সংযোগ ঘটা। সে লক্ষ্যে চাই -
  ক.   দেশ ও জনগোষ্ঠীর ইতিহাস-জ্ঞান, বিশ্বসভ্যতার ইতিহাস, মানুষের অর্জন ও অবদান সম্পর্কে ধারণা;
   খ.     নিজের দেশজ সংস্কৃতির সাথে সম্যক পরিচয় এবং বিশ্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা;
  গ.   সৃজনশীলতার চর্চা এবং নিজের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলাচর্চা ও এসবের রসাস্বাদনের দক্ষতা অর্জন;
   ঘ.    চর্চার মাধ্যমে যুক্তি, বিচার, বিবেচনা, বিশ্লেষণের সক্ষমতা অর্জন;
   ঙ.    মানবিক গুণাবলি এবং নাগরিকের অধিকার, দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা।
সবিনয়ে বলব, দ্বিতীয় ধারার কাজকে সহশিক্ষামূলক কাজ বলে দূরে ঠেলে রাখলে চলবে না। এসব শিক্ষার প্রান্তিক বিষয় নয়, শিক্ষার অনুষঙ্গী নয়, প্রাসঙ্গিক বিষয় এবং জরুরি ও অন্তর্গত বিষয়। এ পর্যায়ে শিশুরা দল বেঁধে নানা কাজে অংশগ্রহণ করবে, যেমন  - খেলা, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিজ্ঞান প্রকল্প, দেয়াল পত্রিকা, প্রকৃতিপাঠ, বিতর্ক ইত্যাদি। এসব চর্চা হলে শিক্ষার সংস্কৃতি ধীরে ধীরে অর্জিত হবে। লক্ষ্য ঠিক থাকলে কাজ বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়। কৃষক যদি দ্বিগুণ ও ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য জোগান দিয়ে যেতে পারে তাহলে শিক্ষিত তরুণরা মিলে কেন পারবে না শিক্ষায় গুণগত রূপান্তর ঘটাতে?
আমরা জানি ঠিক যেমন জমির স্বল্পতার বিপরীতে জনসংখ্যার আধিক্য ছিল বড় সংকট তেমনি ছাত্রের তুলনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মানসম্পন্ন শিক্ষকের রয়েছে সংকট। আমরা বুঝি রাতারাতি পরিবর্তন আনা সম্ভব নয় । তবে শিক্ষাকে কৃষির সাথে সবটা মেলানো না গেলেও এক ফসলা জমিকে যেমন তিনফসলা করা গেছে তেমনি এক স্কুলকে তিন শিফ্টে চালানো যায় - দুটি শিফ্টে নিয়মিত লেখাপড়া হবে আর বিকেল-সন্ধ্যার শিফ্টে সংস্কৃতির পাঠ চলবে। সংস্কৃতি শব্দটা এখানে আমরা এর ব্যাপকার্থে প্রয়োগ করছি যা মানুষের মন-মানসিকতা, রুচি, নীতিবোধ উন্নত করে জীবনকে আলোকিত করবে।
এ পাঠ হয়ত শিক্ষকরা দিতে পারবেন না। এর জন্যে প্রয়োজন হবে শিক্ষাকর্মীর। আমরা যেন ভুলে না যাই, ষাটের দশকে ছাত্রকর্মী, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক কর্মীরাই ছিলেন পরিবর্তনের মূল শক্তি। আজ যদি উন্নত দেশ গঠনে শিক্ষিত জাতির প্রয়োজনে শিক্ষায় বিপ্লব ঘটাতে হয় তবে চাই উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক দক্ষ শিক্ষাকর্মীর দল। তারা হবেন পরিবর্তনের কারিগর ও রূপকার। আর এই সংস্কৃতিপাঠের জন্যে আমাদের থাকবে কর্মপরিকল্পনা, পাঠক্রম ও পুস্তিকাসহ উপকরণ।
এভাবে চর্চার উপকার এই যে শিশুর মন ও মনন অনেক রকম বিষয় এবং শিল্পকলার সাথে পরিচিত হবে ও তা উপভোগের জন্যে তৈরি হতে থাকবে। বড় হতে হতে তাদের মানসে অনেক অবলম্বন তৈরি হবে ভিতর-বাইরের কু-প্রবৃত্তির তাড়না ও প্রলোভন প্রতিরোধের জন্যে। মৌলবাদ, নেশার হাতছানি প্রতিরোধে কিংবা যৌবনের উন্মেষকালে মানবজীবনের বৃহত্তর পরিসরে নিজেকে খাপখাইয়ে নেওয়ার কাজটিও তাদের জন্যে অনেক সহজ হবে। শিক্ষার সাথে সংস্কৃতির পাঠ যুক্ত হলে এভাবে মানুষ তার জৈব তাড়না ও মনের অন্ধ সংস্কারের জাল ছিন্ন করার মত আলোর অস্ত্র হাতে পায়।
তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবেই শিক্ষায় সাংস্কৃতিক পাঠের বিষয় অন্তর্ভুক্তির কথা জরুরিভিত্তিতে ভাবতে হবে।
সরকার শিক্ষা নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছেন। বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর চিন্তাভাবনাও চলছে।  আমরা আশা করব বর্তমান বাজেটে অন্তত ইউনিসেফ-নির্ধারিত জিডিপির ২০% এবং বার্ষিক বাজেটের ৬% ভাগ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হবে। এর বাইরে আশা করি সরকারি অর্থায়নে এবং আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থার সহায়তায় শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নয়নে আরো প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।


***