Wednesday, April 26, 2017

অস্বীকৃতি বা আপসে সমস্যার সমাধান মিলবে কি?

আবুল মোমেন

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন সভায় দাঁড়িয়ে কওমি মাদ্রাসার জঙ্গি-সম্পৃক্ততার অভিযোগ খারিজ করে সাফাই বক্তব্য দেন তখন সরকারি মনোভাবের বার্তা পাওয়া যায়। তাঁর ভাষণের দুদিন আগেই যাঁকে সবচেয়ে দূর্ধষ জঙ্গি নেতা হিসেবে ফাঁসি দেওয়া হল তিনি দেশে আলিয়া মাদ্রাসায় পড়লেও উচ্চ শিক্ষা নিয়েছেন কওমি মাদ্রাসার পীঠস্থান দেওবন্দে। পরবর্তীকালে জঙ্গি হামলায় ও জঙ্গি আস্তানায় নিহত কয়েকজনেরও কওমি মাদ্রাসার ছাত্র/সাবেক ছাত্র পরিচয় উঠে এসেছিল। এদের গ্রেফতার, নিহত হওয়া, বিচার সব কাজেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্ত ছিল।
কেউ বলে না যে কওমি মাদ্রাসামাত্রই জঙ্গি তৈরির আস্তানা। কিন্তু সুস্থ সংস্কৃতিচর্চাবিহীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইংরেজিমাধ্যম স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়ের মতই মাদ্রাসাগুলো ধর্মীয় জঙ্গিবাদ চর্চার ক্ষেত্র হয়ে পড়ার শংকাই বেশি। ইদানীং মূলধারার বাংলামাধ্যম স্কুলেও পরীক্ষা ও মুখস্থবিদ্যাকেন্দ্রিক শিক্ষার দাপটে সহশিক্ষামূলক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখান থেকেও বিভ্রান্ত তরুণ তৈরি হতে পারে যাদের কেউ কেউ জঙ্গিবাদে দীক্ষা নিচ্ছে না তা-ও নয়।
সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শূন্য-সহিষ্ণুতা বা জিরো টলারেন্স নীতি পালনের অঙ্গীকার করেছে। কিছু জঙ্গি বিচারে সর্বোচ্চ শাস্তি পেয়েছে, বেশ কিছু জঙ্গি আইনশৃঙ্খলা বাহিনির অভিযানে প্রাণ হারিয়েছে। কিন্তু বাস্তবতার আলোকে বলা যায় তাতে জঙ্গি হয়ে ওঠার প্রবণতা বন্ধ হয় নি। গত দুমাসে দেশের আনাচে-কানাচে অনেক জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেছে, সকল জঙ্গি নির্মূল হয় নি, ধরা পড়ে নি। বোঝা যায় দেশের ভিতরে সক্রিয় রয়েছে এক বা একাধিক জঙ্গি গোষ্ঠী। এক দল তরুণ বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী, বিশেষত আইএসের সাথে যুক্ত হতে চাইছে।
সরকার জঙ্গি দমনে কড়া লাইনে থাকলেও দেশে জঙ্গি সৃষ্টির বাস্তবতা মোকাবেলায় দুএকটি ভালো উদ্যোগ নিলেও তা ছিল সীমিত এবং সাময়িক। লক্ষাধিক মওলানার জঙ্গি-বিরোধী ফতোয়া বা শুক্রবারে সব মসজিদে ধর্মের উদার মানবিক সম্প্রীতির বাণী তুলে ধরে খুৎবা পাঠের উদ্যোগ ভালোই ছিল। কিন্তু তা যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয়নি, অব্যাহত থাকে নি। তাছাড়া এও এক ধরনের নিবারণমূলক কাজ - পরোক্ষ বুদ্ধিবৃত্তিক এ বারতার গুরুত্ব স্বীকার করেও বলতে হবে যে-তরুণরা জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট হচ্ছে এটুকু তাদের আত্মঘাতী ধ্বংসাত্মক পথ থেকে নিবৃত্ত করার জন্যে যথেষ্ট নয়।
আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে এবং কখন কেউ চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে। এমন নয় যে আমাদের দেশে চরমপন্থীদের জঙ্গি তৎপরতা আগেও ঘটে নি। কট্টর বাম রাজনৈতিক দর্শন থেকে সৃষ্ট এসব জঙ্গিবাদ কখনো উপদলীয় কোন্দলে এবং বেশির ভাগ সময় সরকারি বাহিনির নিষ্ঠুর দমনপীড়নে এক পর্যায়ে নি:শেষিত হয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় জঙ্গিবাদ তা নয়, এর ভিত্তি যে বিশ্বাস তাতে আল্লাহ ও নবীকে টানা যায়, পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অনুমোদন দেখানো যায়, ইসলামের ইতিহাস থেকে দৃষ্টান্ত নেওয়া যায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পুঁজিবাদী (খ্রিস্টান) পশ্চিমের ভূমিকার (মূলত মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে) দোহাই দেওয়া যায়, বর্তমান কালের ভোগবাদিতার যে উৎকট রূপ মানুষের জীবনকে অমানবিক করে তুলছে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর যাথার্থ্যও তুলে ধরা যায়, তদুপরি এ ভূমিকা ইহকাল ছাপিয়ে পরকাল অবধি বিস্তৃত - পৃথিবী ছাড়িয়ে বেহেস্ত পর্যন্ত। ফলে কেবল তাদের কৃতকর্ম - মানুষ খুন করা - বা অপরাধের গণ্ডিতে  ও মানদণ্ডে এদের বিচার করলেই হবে না। এভাবে ঘটনা ঘটানোর পরে অর্থাৎ অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পরে কাউকে কাউকে ধরা যাবে বা নির্মূল করা হবে। কিন্তু এতে এসব তরুণদের - তাদের মত আরো লাখো তরুণের - মনের ক্ষোভ, ক্রোধ, প্রতিজ্ঞা, প্রত্যয়, অভীপ্সা অর্থাৎ দেশের বিরাট তরুণমানসের একটি বড় ধারাকে বোঝার এবং তাদের সন্তুষ্ট করার জরুরি কাজটা আরব্ধ থেকে যাবে। পুলিশি ব্যবস্থা, আইনি প্রক্রিয়া বা নিছক অস্বীকৃতি এ ইস্যুটি মোকাবিলার মূল পথ নয়।
আমরা দেখছি সমাজের অনেকের কাছেই এটি ধর্মীয় ইস্যু, অনেকেই ভাবছেন সাংস্কৃতিক ইস্যু, কেউ কেউ গণ্য করছেন রাজনৈতিক ইস্যু হিসেবে। ইস্যুটি জটিল, কারণ এটি উপরে উল্লিখিত সব বিষয়েরই সমাহার। ধর্ম যদি হয় এর উৎস, তবে রাজনীতি প্রায়োগিক অবলম্বন, আর সংস্কৃতি সঠিকভাবে চর্চা না হলে এই মানসের আদলেই রূপান্তরিত হবে। বাঙালি সমাজে কোনো ধর্মই শাস্ত্রীয় রক্ষণশীলতার ধারায় বিকশিত হয় নি, যে কারণে দুশত বছরের বেশি চর্চা সত্ত্বেও ওয়াহাবি পন্থা, কওমি মাদ্রাসার প্রভাব সমাজে ব্যাপক বিস্তৃতি পায় নি। হিন্দু সমাজেও ব্রাহ্মণ্যবাদের চেয়ে  গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধারার প্রেম ও ভক্তিবাদের প্রভাব হয়েছে  বেশি।
এ বাস্তবতায় ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র বাংলার মানুষকে টানে নি, ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তান ভেঙে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের উদ্ভব ঘটেছিল। গত চার দশকে দেশে এবং বিদেশে অনেক পরিবর্তন হয়েছে - তা হয়েছে ধর্মীয় চেতনায়, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও কৌশলে এবং শিল্প ও সংস্কৃতিচর্চা ও এর সমঝদারিতে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকেই পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্বের জড়বাদী বা বস্তুবাদী সমাজে মতাদর্শের অবসান হয়। তারা সব ধরনের মতাদর্শিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যেন বস্তুবাদ-ভোগবাদের বিশ্বায়ন ঘটিয়েছে। এর প্রথম প্রকাশ ঘটে ইরানের ইসলামি বিপ্লবের পরপর কট্টরপন্থী সুন্নিদের দিয়ে একদিকে শিয়া ইসলামের বিপ্লবযাত্রা রুদ্ধ করা এবং সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের অগ্রযাত্রা ব্যাহত করার প্রয়াসে - ইরানে তাদের প্রয়াস ব্যর্থ হলেও আফগানিস্তানে সফল হয়েছে। সামরিক-রাজনৈতিক তথা জঙ্গি কূটনীতির মাধ্যমে তারা আফগানিস্তান থেকে  পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত মুসলিমপ্রধান দেশগুলিতে কট্টরপন্থীদের উত্থানে অস্ত্র-অর্থ দিয়ে সহায়তা করে এমন এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যাতে এসব দেশের তরুণরা বিভ্রান্তির মধ্যে থাকে। বিভ্রান্তির ক্ষোভ কট্টর জঙ্গিবাদে মুক্তি খোঁজে, আর তখন তাদের থেকে সৃষ্ট জঙ্গি যোদ্ধাদের তাদেরই প্রথম স্রষ্টা ও মদতদাতা পশ্চিম প্রকাশ্যে হত্যা করতে পারে।
পশ্চিমের দ্বিতীয় আগ্রাসনের পথ হল অর্থনীতি। বিশ্ব অর্থনীতির কর্তৃত্ব ধরে রাখার জন্যে তারা যে কোনো ছলের আশ্রয় নিতে পারে। বাজার অর্থনীতি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নতুন কানুন, বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের চাতুরিপূর্ণ ভূমিকা - যা কিছুটা পদ্মাসেতুর সূত্রে সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে - এবং ভোগবাদিতা, পণ্যাসক্তি ও কাম-ক্রোধ-সন্ত্রাস-নির্ভর এক বিনোদন-বাণিজ্যের পসরা সাজিয়ে এ যেন গ্রিক পুরানের কুহকিনী সার্সির বিস্তৃত জাল। সবই এর মধ্যে ধরা পড়েছে। আগেই উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশের সাধারণের মধ্যে যথেষ্ট ক্ষোভ, ক্ষুধা, কামনা, ক্রোধ, লোভের তাড়নার পারদ চড়ানো হয়েছে। এদের অনেকেই জঙ্গিবাদের আশ্রয় নিচ্ছে, কেউ নেশার ফাঁদে পা দিচ্ছে, কারো কাছে নিজ ধর্ম পালনের চেয়ে বিধর্মী’ নিধন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কেউ স্থূল ভোগে তলিয়ে যাচ্ছে । এটা স্বাভাবিক মানুষের কাজ নয়।
হ্যাঁ, আমাদের সমস্যাগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে হবে, চিন্তা বিনিময় করতে হবে এবং সবশেষে সবদিক বিবেচনায় নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
প্রথমেই আমাদের মানতে হবে সমাজমানসে, বিশেষত তরুণদের মানসে নানা বিষয়ে ক্ষোভ, কিছু ক্রোধ ও হতাশা এবং অনেক বিষয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। এর পেছনে মূল দায়ি হল বর্তমান  শিক্ষাব্যবস্থা আর আদর্শ ও নীতিহীন রাজনীতি।
কিশোর-তরুণদের মূল ভূমিকা শিক্ষার্থীর। সেই শিশু-কিশোর-তরুণের জীবনের মূল প্রবণতা হল সক্রিয়তা - মস্তিষ্কে ও শরীরে - যা ঘটে অংশগ্রহণ ও অংশীদারিত্বের মাধ্যমে উদ্ভাবনে, সৃজনে, উপভোগের আনন্দে। আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের জন্যে বরাদ্দ হলে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা, তারা কেবল অন্যের লেখা (সৃজন করা) উত্তর মুখস্থ করবে, অন্যের প্রশ্নের জবাব হিসেবে তা লিখবে এবং জিপিএ৫ পাবে। এটা মোটেও সৃজনশীল আনন্দময় প্রক্রিয়া নয়। শিশু-কিশোরদের সাফল্য উদযাপনে বড়রা যে উৎসব ও আনন্দের আবহ তৈরি করেছেন তাতে শিশু-কিশোর-তরুণরাও অংশ নেয়। কিন্তু এ হল সাফল্যের নেশা, কারণ প্রকৃত সাফল্য আসে নিজের কল্পনা, পরিশ্রম, কর্ম সম্পাদনের অভিজ্ঞতা থেকে। তার সুযোগ এ ব্যবস্থায় নেই। শিক্ষা কেবল টেক্সটবইয়ে আবদ্ধ থাকলেও চলবে না, একজন ছাত্রকে তার নানামুখী প্রবণতা ও সম্ভাবনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া, সেগুলো চর্চা করার সামর্থ্য সম্পর্কে তাকে আত্মবিশ্বাসী করা এবং তারপর এই সাফল্যের মূল্যায়ন ও উদযাপন তাকে আনন্দের মাধ্যমে এক টেকসই ইতিবাচক ও বহুমুখী মানসের সন্ধান দেবে। ব্যক্তিমানসের সংকোচনে ব্যবহার করলে ধর্মের প্রতিও অবিচার করা হয়। ব্যক্তিমানসকে উন্মোচন, সৃজনশীল, আনন্দময় ও ইতিবাচক করে তোলা ধর্মেরও কাজ। ধর্মের নামে অনেকেই মানুষের এই সার্বিক বিকাশের পথ রোধ করে দাঁড়াতে চান। অবদমন মানুষের জন্যে মনস্তাত্ত্বিক সংকট তৈরি করে থাকে। তাতে সমাজে অতৃপ্ত বাসনা ও নানা রূপ অবদমনজাত বিকারের প্রকাশ দেখা যায়। আজ রাজনীতি ধর্মকে ব্যবহার করছে আবার কেবলমাত্র জাগতিক তথা সংকীর্ণ স্বার্থেই রাজনীতির ব্যবহার ঘটছে। তাতে সমাজমানসে সত্য ও অসত্যের ধারণা, ভালো ও মন্দ মানুষের ফারাক, পাপ ও পুণ্যের চেতনা অস্পষ্ট হয়ে পড়ছে। সমাজ দিব্যি অপরাধের সাথে আপস করছে, অপরাধীকে নিয়ে বসবাস করছে। এমন বিভ্রান্ত মানুষের সমাজে রাজনীতি যেমন তেমনি ধর্মও  নানা ক্ষুদ্র স্বার্থে ব্যবহৃত হতে থাকে।
সংস্কৃতি শব্দটা নিয়ে আমাদের মনে ব্যাপক বিভ্রান্তি আছে। সংস্কৃতি আমাদের জীবনযাপন প্রণালীর সাথেই সম্পৃক্ত - পোশাক-খাবার-ভাষা-আচরণ-অনুষ্ঠান সবকিছু নিয়েই সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এসবই ঠিকভাবে শিখতে হয়। সবসময় বলে বলে হয় না, নিজে করে গড়ে আয়ত্ব করলে তা-ই হয় টেকসই। বাসায় জীবনযাপনের মাঝে ব্যক্তিসত্তা আর স্কুলে অনেকের সাথে মিলে সামাজিক সত্তা তৈরি হবে সংস্কৃতিবোধে ও রুচিতে সম্পন্ন হয়ে। বাসায় জীবনযাপনের সৌন্দর্য তৈরি হবে, স্কুলে জীবন উদযাপনের দক্ষতা আয়ত্ব হবে। এ বিষয়টা আরেকটু বিস্তারে লিখতে হবে স্বতন্ত্র একটি লেখায়।


***