এ বছর ভারতবর্ষের
জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির সার্ধশত জয়ন্তী। ১৮৬৯ সনে গুজরাটের কাথিয়াওয়াড়ের
পোরবন্দরে তাঁর জন্ম। ১৯৪৭ এ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতবর্ষকে দু’ভাগ
করে যে স্বাধীনতা দিয়েছিল তাতে দুই দিকের প্রধান দুই মুখ গান্ধি ও জিন্নাহ। দু’জনেই
গুজরাটি, বণিক পরিবারের সন্তান, দু’জনেই বিলেত
থেকে ব্যারিস্টারি পাশ করেছিলেন। প্রথম জীবনে গান্ধি ছিলেন লাজুক কিন্তু নীতির প্রশ্নে
এবং দায়বোধে অটল। তাঁর রাজনীতি প্রায় জীবনসাধনারই অংশ। ভারতের স্বাধীনতার এক বছরের
মধ্যেই তিনি নিহত হন। অপর দিকে জিন্নাহর ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও নীতি-আদর্শের পরিচয় অনেকটা
ধোঁয়াশায় জড়ানো। তিনি ধর্ম পালনে ছিলেন উদাসীন, কৈশোরেই বোঝা গিয়েছিল তিনি কৌশলি এবং
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অটল। বিয়ে করেছিলেন অগ্নিউপাসক পার্সি পরিবারে। তাঁর কন্যা এবং
দৌহিত্র ও অধ:স্তন কেউই তাঁর সৃষ্ট দেশ পাকিস্তানে আসেননি, মাতৃভূমি হিসেবে ভারতকেই
তারা গ্রহণ করেছেন। জিন্নাহ পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছর পরেই মৃত্যুবরণ করেন। আর তাঁর
মৃত্যুর আগেই পাঞ্জাবি জেনারেল এবং আমলা ও রাজনীতিকরা তাঁর হাত থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে
তাঁর স্বপ্নের গণতান্ত্রিক দেশ নির্মাণের সম্ভাবনা অংকুরেই বিনাশ করে দেয়। জিন্নাহর
নাম পাকিস্তানের জনক হিসেবে পাঠ্যবই ও ইতিহাসের বইতে লেখা থাকলেও দেশটির গত বাহাত্তর
বছরের রাজনীতি পর্যালোচনা করলে তাঁকে পাকিস্তানের ট্র্যাজিক নায়কই আখ্যা দিতে হয়।
গান্ধি দেশভাগের
সময় ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিলেন, দাঙ্গা-বিধ্বস্ত জনপদে বিপর্যস্ত
মানুষের পাশে ছিলেন। তাঁকে যে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হত্যা করেছিল
স্বাধীনতার সত্তর বছর না হতেই তাদেরই নতুন ধারার প্রতিনিধি ভারতবর্ষের কেন্দ্রে শক্তিধর
শাসক। গান্ধির ভাবধারা তাঁর নির্বাচিত উত্তরসুরি জওহরলাল নেহেরুর পক্ষে মেনে চলা ছিল
কঠিন। তবে সামগ্রিক বিচারে নেহেরুর সমাজবাদী গণতান্ত্রিক চেতনায় গান্ধি-চেতনার মূল্যবোধ
মোটা দাগে রক্ষা পেয়েছিল।
মোদির নেতৃত্বাধীন
ভারতবর্ষ কি তাদের জাতির জনককে জন্মের সার্ধশত বর্ষের মত বিশেষ উপলক্ষে যথাযথ মর্যাদায়
স্মরণ করেছে? রাষ্ট্র, রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনেও তেমন মানানসই বড় অনুষ্ঠানের খবর
ভারতবর্ষ থেকে পাওয়া যায় নি।
তাতে কি বলা
যাবে মহাত্মা গান্ধি তামাদি মানুষ হয়ে গেলেন? ইতিহাসের পাতায় আবদ্ধ হয়ে থাকবেন - যেমনটা
জিন্নাহ হয়েছেন? মনে হয় উপমহাদেশ তাঁর প্রতি সুবিচার না করলেও ইতিহাসে তাঁর অবস্থান
দিনে দিনে পোক্ত ও উজ্জ্বলই হবে। প্রথম যৌবনে পেশায় ব্যর্থ মানুষটি সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায়
বর্ণবৈষম্যবাদী ভেদনীতির বিরুদ্ধে নিজস্ব পদ্ধতিতে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। স্থানীয়
কৃষ্ণাঙ্গ ও অভিবাসী ভারতীয়দের জন্যে তিনি শ্বেতাঙ্গ বর্ণবৈষম্যবাদী শাসকদের বিরুদ্ধে
যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন তা কেবল নাগরিক অধিকার আদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, তাঁর
আন্দোলনে ব্যক্তির নৈতিক এবং আন্দোলনের ইস্যুটির প্রতি সামষ্টিক অঙ্গীকার ছিল গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়। এতে ব্যক্তির নৈতিক প্রতিরোধ ছিল মূল হাতিয়ার। হয়ত একে রাজনৈতিক কৌশল বলা যাবে,
কিন্তু আদতে কৌশল এখানে মুখ্য নয়, ন্যায়ের প্রতি বিশ্বাসটাই প্রধান। সত্য ও ন্যায়ের
জন্যে মানুষ যে প্রতিরোধে নামবে তাতে ব্যক্তিগত পর্যায়ে লাঞ্ছনা, শারীরিক নিপীড়ন সইতে
প্রস্তুত থাকতে হয়। কারণ বিপুল ত্যাগের বিনিময়ে যে সংগ্রাম তাতে নিছক আন্দোলনকারী থাকেন
না কেউ আর, হয়ে ওঠেন সত্যাগ্রহী। রাজনীতিতে প্রায় ধর্মীয় চেতনার মত এই সাধনাকে যুক্ত
করলেন তিনি। আজকের সচেতন মানুষ তাঁর ধারার রাজনীতির গুরুত্ব অনুধাবন করছে, যদিও শাসকশ্রেণি
এবং রাজনীতিবিদরা এখনও তাঁকে এড়িয়ে চলছে। তাঁর নীতি অহিংস এবং আন্দোলনের মূল পদ্ধতি
অসহযোগ। তিনি স্বরাজ লাভে যে আত্মিক শক্তির ভিৎ চেয়েছেন তা তাঁর ভাষায় - ‘এই অস্ত্র প্রীতির, এই শক্তি সত্যের -
এটাই সত্যাগ্রহ।’
মহাত্মা গান্ধি
হিন্দুধর্মের একজন আচার পালনকারী ব্যক্তি হওয়ায় যারা রাজনীতিকে ধর্মনিরপেক্ষ রাখতে
চান তাদের পক্ষে তাঁর সঙ্গে চলায় সংকট হতে পারত। কিন্তু নেহেরুর মত একজন সচেতন আন্তরিক
সেক্যুলার রাষ্ট্রনায়ক আগাগোড়া গান্ধির শিষ্য থেকেই রাজনীতি করেছেন। কারণ গান্ধিজীর
ধর্মবোধ মানবিক ঔদার্যের চেতনাকে ধারণ করেছিল। সেখানে নেহেরু বা মৌলানা আজাদের মর্যাদাপূর্ণ
অবস্থানে কোনো অসুবিধা হয়নি। আজ ভারতবর্ষে নরেন্দ্র মোদির যে বিজয়রথ তা মহাত্মার শিক্ষা
ও আদর্শকে ক্ষুণ্ন করেই এগিয়ে চলছে। আজকের ভারতবর্ষও তাদের জাতির পিতাকে ট্র্যাজিক
হিরোয় পরিণত করেছে।
এঁদের তুলনায়
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব - বাংলাদেশের জাতির জনক - মর্মান্তিক নির্মম ট্র্যাজেডির শিকার
হয়েছেন। তাঁকে সপরিবারে হত্যার পরে তৎকালীন শাসকেরা অন্তত দুই দশক ধরে জাতীয় প্রেক্ষাপট
থেকে তাঁকে নির্বাসিত রেখেছিলেন। তবে ইতিহাসের উত্থানপতনের এক পর্যায়ে আত্মজার মাধ্যমে
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের ইতিহাসের মহানায়কের স্থান ফিরে পেয়েছেন। অবশ্য ইতিহাস চিরকাল
এক পথে চলে না। বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ও অবস্থান আদর্শিকভাবে এবং ইতিহাসের আলোকে এই জাতির,
বিশেষত নতুন প্রজন্মের মননে, কি সঠিকভাবে স্থান করে নিতে পারছে? সেটাই একটা মস্ত বড়
চ্যালেঞ্জ - যার উত্তর মিলবে আগামী দিনে, ভবিষ্যতে। আগামী বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী।
ক্ষমতায় আছে তাঁর দল এবং শাসনভার তাঁর কন্যার হাতে। আশা করা যাচ্ছে উপলক্ষটি যথাযথ
মর্যাদায় পালিত হবে। একটু সাবধানতার সুরে বলা যায়, যেন উপলক্ষের গুরুত্ব ও মর্যাদা
কারো কোনো আতিশয্যে ক্ষুণ্ন না হয়। তার পরের বছর আমাদের জন্যে রয়েছে আরও একটি স্মরণীয়
উপলক্ষ - স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী।
তবে এ লেখায়
আমরা মনোযোগ দেব মহাত্মা গান্ধির ওপর। গান্ধিজী নিজের জীবনদর্শন এবং জাতির রাজনৈতিক
দর্শনকে ঘনিষ্ঠসূত্রে বাঁধতে চেয়েছিলেন। তিনি মার্কিন দার্শনিক থরো এবং রুশ লেখক তলস্তয়ের
কাছে জীবনদর্শনের পাঠ নিয়েছিলেন। এঁদের প্রভাবে আদর্শ ও বিশ্বাসের প্রতি আস্থায় তিনি
এতটাই অটল ছিলেন যে তাকে গোঁড়ামি আখ্যা দেওয়া যায়। যে অহিংস আন্দোলনের নীতি থেকে তিনি
বিচ্যুত হতে চান নি তার উৎস তলস্তয় এবং এই মহান লেখকের জীবনের শেষ পর্বের রক্ষণশীল
খ্রিষ্টীয় নীতিবোধ মহাত্মা গান্ধির পরিচর্যায় উন্নীত হয়েছিল সত্যাগ্রহে।
তিনি রাজনীতিকে
কেবল নৈতিক আদর্শের শক্তি দেন নি, তা জীবনচর্যায় প্রায় ধর্মবিশ্বাসের পরিপূরক হয়ে উঠেছিল।
তবে গভীর বিবেচনায় বোঝা যায় তাঁর এই আদর্শ অন্য ধর্মের মানুষের জন্যেও সহনীয়। এ কারণেই
মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মত ইসলামি পণ্ডিতের পক্ষে শেষাবধি কংগ্রেসে থাকা সম্ভব হয়েছিল।
এমন দৃষ্টান্ত আরও অনেক দেওয়া যাবে। খান আবদুল গাফ্ফার খান একই আদর্শের পথিক হিসেবেই
সীমান্ত গান্ধি খেতাব পেয়েছিলেন।
কিন্তু উপনিবেশ
থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম সবসময় সরল ও একমাত্রিক থাকে নি, থাকা সম্ভব নয় বলেই থাকে নি।
তাছাড়া শিল্পবিপ্লবের বহুমুখী ফসলও উপেক্ষা করা যায় না বলেই গান্ধিজীকে একটু যেন পিছনে,
একটু আড়ালে রেখেই নেহেরুজীকে দেশশাসনে এগুতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত গান্ধির জীবদ্দশায়
তাঁর সকল সদিচ্ছা উপেক্ষা করেই দেশভাগ ও দাঙ্গার মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে ভারত। কোটি মানুষের সেই অপরিসীম কষ্টভোগের দীর্ঘশ্বাস
এবং দু:খদীর্ণ বেদনার ওপর আজও যবনিকা পড়ে নি। তাতে গান্ধির রাজনীতিকে দোষারোপ করা যায়
না। কেবল বলা যাবে তাঁর অহিংসা ও সত্যাগ্রহ এবং হরিজনসহ সর্বস্তরের মানুষকে সাথে নিয়ে
পথচলার আদর্শও বাস্তবে ফলপ্রসূ হয় নি। শাসকবর্গের সাথে তাঁর আদর্শের দূরত্ব বেড়েছে,
ইতিহাসের নি:সঙ্গ নায়ক যেন আজ তিনি।
মানতেই হবে
তাঁর সব ভাবনা ও জেদ মেনে নেওয়া কঠিন। তিনি নগরায়ন ও শিল্পায়নের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে
ছিলেন। প্রায় রুশোর মত প্রকৃতির আপন সরল বাতাবরণে বসবাসের স্বপ্ন বুনেছেন। চরকা তাঁর
কাছে তাই এক প্রতীক, স্বাবলম্বনের সরল ও সুলভ পথের দিশা। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে
তাঁর মতপার্থক্য সবার জানা। হয়ত শিল্পায়ন, নগরায়ন বা অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসার ব্যাপারে
তাঁর সাথে সহমত হওয়া যাবে না। কিন্তু আজ ক্ষমতামত্ত রাজনীতির মধ্যাহ্নবেলায় যুদ্ধবাজ
আগ্রাসী নেতাদের অমানবিক বিকারের সাক্ষী হতে হতে, মানুষের অবিমৃষ্যকারিতার ফলস্বরূপ
পৃথিবীর অনিশ্চিত ভষ্যিতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ইতিহাসের পাতা থেকে যেসব মানুষের ছবি সবার
আগে ভেসে ওঠে তাতে দন্তহীন মুখের নির্মল হাসি, গোল চশমার ভিতর থেকে চেয়ে থাকা মায়াবি
চোখের সরল কিন্তু সর্বজনীন আশ্বাসের বারতাবাহী মুখটি আলাদা করে চেনা যায়। কেন এমনটা
মনে হয়? কারণ তাঁর জীবন কেটেছে কাজে, যার সবটাই ছিল গণমানুষের কল্যাণে নিবেদিত, আর
কাজের পেছনে সক্রিয় ছিল যে ভাবনা তা পার্থিব বিজয় কিংবা বৈষয়িক অর্জনের কৌশল নিয়ে মাথা
ঘামায় নি, তা মহৎ আদর্শ ও মহানুভবতাকে বাস্তবের দরকষাকষির মধ্যে জড়ায় নি। এখানে রবীন্দ্রনাথের
সাথে তাঁর মিল কবি আত্মশক্তির কথা বলেছেন,
জননেতার ভাবনাও প্রায় তাই - ‘অহিংসার অর্থ হল আত্মার সকল তেজ দিয়ে অত্যাচারীর ইচ্ছার প্রতিরোধ করা।’ আজ হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, ভারতবর্ষেও
তারই ঘনঘটা। এই বিপর্যস্ত সময়ে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধি এবং তাঁর জীবন ও কর্ম একটা সম্ভাবনাময়
বিকল্প পথের ইশারা হয়ে ভাস্বর হয়ে উঠতে থাকে।
***