আবুল
মোমেন
বাংলাদেশের
সমাজে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছাপ আজ সহজেই বোঝা যায়। রাস্তায় গাড়ি বেড়েছে ও বাড়ছেই, ঝকমকে
বিপণি বিতানের সংখ্যা রাজধানী ছাড়িয়ে অন্যান্য শহরেও বাড়ছে, নানা ধরনের অভিজাত খাবারের
দোকান যেমন তেমনি তাতে খদ্দেরের ভীড়ও বেড়ে চলেছে। উচ্চ শিক্ষাঙ্গনেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা
অনেক। বেকারত্ব বাড়লেও সেইসব তরুণদের বড় একটি অংশ রোজগার ও ব্যয় করছে। বলা বাহুল্য
তারা প্রধানত সরকারি দলের পরিচয়ে অবৈধ রোজগারে লিপ্ত হচ্ছে। সরকারি দলের ছত্রছায়ায়,
প্রায়ই স্থানীয় থানা বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায়, ছোট ছোট দল সারাদেশেই অবৈধ রোজগার
করছে। সংবাদপত্রের খবরে জানা যাচ্ছে মিরপুরে ভস্মিভূত রূপগঞ্জ বস্তি থেকে এ ধরনের আয়ের
পরিমাণ ছিল মাসে শতকোটি টাকার বেশি। বাড়ি ভাড়া এবং গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল বাবদ
এই রোজগার। এর কিছু কি সরকারের ঘরে যেত? পরিবহন খাতে চাঁদার অংক শোনা যায় হাজার কোটি
টাকা ছাড়িয়ে যায়। বড় বড় হকার মার্কেট, বাজার, হাট ইত্যাদিও অবৈধ আয়ের উৎস। এভাবে বড়
উন্নয়ন প্রকল্প থেকেও চাঁদাবাজির মাধ্যমে নিয়মিত বড় অংকের অর্থ আয় করে থাকে ওরা। বর্তমানে
দেশে উন্নয়নের জোয়ার বইছে বলে এমন আয় নিয়মিতই হচ্ছে এবং এর পরিমাণ বাড়ছে। এ ধরনের দাঁও-মারা
রোজগারের টাকা মূলত ভোগেই খরচ হয় - তার দাপটে
সমাজের সম্ভ্রম ও মর্যাদা রক্ষা কঠিন হচ্ছে।
দেশে
শিক্ষিতের হার বেড়ে ৭০-এর কাছাকাছি গেছে, গড় আয়ু ৭২-৭৩ এ পৌঁছেছে, আয়, সঞ্চয়, ব্যয়
সবই বাড়ছে। সামাজিক অনুষ্ঠানের বাজেট বহু গুণ বেড়েছে, খাওয়া ছাড়াও সজ্জা ও অন্যান্য
ক্ষেত্রেও বাহুল্য বাড়িয়ে চলেছে মানুষ। ব্যয়বহুল চিকিৎসার দিকে ঝোঁক বাড়ছে, অনেকে
দেশের বাইরে পাড়ি দিচ্ছেন চিকিৎসা এবং বিয়ে ও উৎসবের বাজারের জন্যে। ছেলেমেয়ের শিক্ষার
ক্ষেত্রেও বিদেশমুখিতা বাড়ছে। নতুন নতুন কম্পানি ব্যয়বহুল কর্পোরেট কালচার গ্রহণ করছে।
আমি
জানি এরাই দেশের সব মানুষ নন। এখনও দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২০ শতাংশের মত, পুষ্টি ও
বিশুদ্ধ পানীয় জলের অভাবে ভুগছে অনেক পরিবার, বেকারত্ব প্রায় ২৬ শতাংশ। তাছাড়া দেশে
ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান ক্রমবর্ধমান। কিন্তু এসবের মধ্যেই সমাজে একটা বড় রূপান্তর ঘটতে
দেখা যাচ্ছে।
বাঙালি
সম্পর্কে বলা হত যে এটি কবিতার দেশ, গানের দেশ। বাঙালি-জীবনে সুখের যে চিত্র আঁকা হত
তাতে মাছভাতের পরেই গলায় গলায় গানের কথা বলা হয়েছে। জেলে, মাঝি, চাষি, তাঁতি কেউ পেশাগত
কাজে থেকে কেউ অবসরে বসে গান বেঁধেছেন, গেয়েছেন। ভাষা আন্দোলন থেকে যে নাগরিক জাগরণের
ফসল বাংলাদেশ তাতে রাজনীতির হাত-ধরে সহযাত্রী ছিল সাহিত্য-সংস্কৃতি। একুশে ফেব্রুয়ারির
রাজনৈতিক তাৎপর্য ক্রমেই প্রসারিত হয়ে একটি উদীয়মান জাতির সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতির
স্বরূপ তুলে ধরেছিল। সব উপলক্ষকে ঘিরেই গান-কবিতা মিলিয়ে এ ছিল সাংস্কৃতিক জাগরণ। এতে
সাহিত্যিক, সঙ্গীতশিল্পী, চারুশিল্পী, নাট্যশিল্পীসহ সকলেই যুক্ত হয়েছেন। সব শহরে অনেকগুলো
সাংস্কৃতিক সংগঠন, গানের স্কুল এবং ব্যক্তিকে ঘিরে সঙ্গীতশিক্ষা, সাহিত্য আসর সক্রিয়
ছিল। বছরব্যাপী তারা নানা উপলক্ষে অনুষ্ঠান করত, জমায়েত হত। এভাবে একটি নগরের মানুষ
সুর, রঙ, তাল এবং ভাব ও বিষয় মিলিয়ে সুস্থ বিনোদনের মাধ্যমে মনের খোরাক পেত। আজ এমন
মানুষজন রাজধানীসহ সব শহরে সংখ্যায় অনেক কমে গেছেন, মনে হয় রাজধানীর বাইরে জেলাশহরগুলোয়
গড়ে সর্বোচ্চ শ’পঁচেক মানুষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শরিক হয়ে থাকেন। গ্রামের অবস্থা
আরও করুণ - একসময় প্রায় সব গাঁয়েই বছরে দু’তিনটি নাটক হত, যাত্রা ও সঙ্গীতানুষ্ঠান
হত বেশ কয়েকটি। এখন এসব সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। এক সময় যাযাবরের বিখ্যাত দৃষ্টিপাত
বইয়ের একটি লাইন মুখে মুখে ফিরত - বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। আবেগ বলতে
লেখক হয়ত মানুষের রসানুভূতি, শিল্পবোধসহ সুকুমার বৃত্তির প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন। কিন্তু
এ কথা মানতেই হবে আজকের শিক্ষিত উন্নত মানুষের সাংস্কৃতিক বোধ, নান্দনিক রুচিবোধ এবং
জীবনবোধসহ মানবিক গুণাবলি ও মূল্যবোধে বিরাট ধস নেমেছে। সমাজে রুচিশীল ভালো মানুষের
আকাল বাড়ছে - যেন উন্নয়নের সাথে পাল্লা দিয়েই নি:স্বতা বেড়ে চলেছে।
কেন
এমনটা হয়েছে? কারণ হিসেবে কয়েকটা বিষয় চোখে পড়ছে। প্রথমত, শিক্ষা কেবল পরীক্ষার ফলাফল
ও ডিগ্রি-সার্টিফিকেটমুখী হয়ে পড়ায় শিক্ষাঙ্গনে শিল্প-সংস্কৃতির চর্চা বন্ধ হয়ে গেছে;
দ্বিতীয়ত, ঐ একই কারণে শৈশব থেকে সঙ্গীত, আবৃত্তি,
চারুশিল্প, অভিনয় ইত্যাদি কলাচর্চা ব্যাহত হওয়ায় পরীক্ষার চাপের মধ্যে বেড়ে-ওঠা প্রজন্ম
সাহিত্য পড়ছে না, গান গাইছে না শুনছে না; তাদের মধ্যে শিল্পের প্রতি আগ্রহও তৈরি হচ্ছে
না। এখানে একটু বলা দরকার, শিল্পী হয় দু’চারজন, কিন্তু তাদের হওয়া ও হয়ে টিকে থাকার
জন্যে সমাজে গাইতে-আঁকতে-আবৃত্তি ও অভিনয়ে সক্ষম প্রচুর মানুষ থাকা দরকার। তারাই হল
শিল্পরসিক সমঝদার মানুষ। তবেই সমাজে শিল্পবোধ বহমান থাকে, সমাজমানস উন্নত হয়। তৃতীয়
কারণটি সম্ভবত একশ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী রাজনীতিকদের সৃষ্ট। তাঁরা ধর্মের দোহাই দিয়ে
সমাজে সঙ্গীত, চারুকলাসহ বিভিন্ন কলাচর্চার বিরুদ্ধে ক্রমাগত প্রচারণা চালিয়ে এক পর্যায়ে
সফল হয়েছেন। আজ আম মুসলিমসমাজ শিল্পসংস্কৃতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। চতুর্থত, দেশের
মূলধারার রাজনীতির প্রধান ধারক-বাহক আওয়ামী লীগ ইসলামি ভাবধারার মানুষ ও সংগঠনের ভোট
আদায়ের জন্যে সচেতনভাবে সংস্কৃতিচর্চা থেকে দূরে সরে এসেছে। ফলে একসময় রাজনীতি-সংস্কৃতির
যে মেলবন্ধন ঘটে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উদ্বোধন ঘটেছিল তা স্তিমিত হয়ে যায়। এখন বরং দেশে
এমন একটা মুসলিম জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছে যেটি চরিত্রে পাকিস্তান আন্দোলনের চেয়েও
রক্ষণশীল। পঞ্চমত, বাজার অর্থনীতি যে ভোগবাদিতার সংস্কৃতিকে পুষ্ট করছে তাতে সমাজ ও
গণমাধ্যম গা ভাসিয়েছে। ফলে মানুষ ব্যক্তিগত সাজসজ্জা, খাবারদাবার এবং জাঁকজমকের দিকে
ঝুঁকেছে। সূক্ষ্ম রুচি ও বিচারবোধ আর কাজে আসছে না। এ থেকে বিবেকবোধের সংকটও দেখা দিচ্ছে।
আমরা
যেন শিক্ষা ও সংস্কৃতি, ধর্ম ও সংস্কৃতি, বিত্ত ও সংস্কৃতির সহাবস্থান চর্চা ভুলে গেলাম।
ফলে দেশে ও সমাজে রুচির সংকট, মূল্যবোধের অবক্ষয়
এবং মানবিক বোধের নি:স্বতা প্রকট হয়ে উঠছে। আয়, আয়ু, ব্যয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, জীবনে গতি,
চাকচিক্য, জৌলুস বৃদ্ধি এবং জাগতিক বৈষয়িক সাফল্য সত্ত্বেও সমাজ কিন্তু মানবিক মানদণ্ডে
হেরে যাচ্ছে। সমাজে চোখ রাখলে এবং কান পাতলে সব ধরনের মানুষের মধ্যে হতাশা, অস্থিরতা,
অস্বস্তির নানা অভিব্যক্তিই ধরা পড়বে। বাংলাদেশে আজ নিরাপত্তা প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে,
কারণ বাঙালি আজ আদিম জিঘাংসা বৃত্তিতে বদলা নেওয়ার (হত্যার বদলে হত্যা) সংস্কৃতিতে
জড়িয়ে যাচ্ছে।
আজকে
অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য হল এত উন্নয়ন ও চাকচিক্য, এত ভোগবিলাস ও আড়ম্বরের মধ্যেও
বাংলাদেশের সমাজ-জীবন প্রাণশক্তি হারাচ্ছে। ব্যক্তিগত অর্জন কিছু কিছু ঘটছে কিন্তু
সামগ্রিকভাবে সমাজটা মনে ও প্রাণে হেরে যাচ্ছে। কারণ সংস্কৃতি চর্চাহীন সমাজ কখনও উন্নত
ও প্রাণবন্ত হতে পারবে না। এরই সূত্র ধরে রবীন্দ্রনাথের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করব।
সংস্কৃতিচর্চা
বাদ দিয়ে, রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘চিত্তের ঐশ্বর্যকে অবজ্ঞা করে আমরা জীবনযাত্রার সিদ্ধিলাভকেই
একমাত্র প্রাধান্য দিয়েছি।’ তাঁর প্রশ্ন - ‘সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে এই সিদ্ধিলাভ কি কখনো
যথার্থভাবে সম্পূর্ণ হতে পারে?’ পারে না। তার কারণও তিনি বলেছেন, ‘সংস্কৃতি সমগ্র মানুষের
চিত্তবৃত্তিকে গভীরতর স্তর থেকে সফল করতে থাকে।’ সংস্কৃতিবোধ মানুষকে কিভাবে উন্নত
চেতনায় সক্ষম করে তোলে সেকথা তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন - ‘সংস্কৃতিবান মানুষ নিজের
ক্ষতি করতে পারে, কিন্তু নিজেকে হেয় করতে পারে না। সে আড়ম্বরপূর্বক নিজেকে প্রচার করতে
বা স্বার্থপরভাবে সবাইকে ঠেলে নিজেকে অগ্রসর
করতে লজ্জাবোধ করে। যা-কিছু ইতর বা কপট তার গ্লানি তাকে বেদনা দেয়। শিল্পে সাহিত্যে
মানুষের ইতিহাসে যা-কিছু শ্রেষ্ঠ তার সঙ্গে আন্তরিক পরিচয় থাকাতে সকল প্রকার শ্রেষ্ঠতাকে
সম্মান করতে সে আনন্দ পায়। সে বিচার করতে পারে, ক্ষমা করতে পারে, মতবিরোধের বাধা ভেদ
করেও যেখানে যেটুকু ভালো আছে সে তা দেখতে পায়, অন্যের সফলতাকে ঈর্ষা করাকে সে নিজের
লাঘব বলেই জানে।’ (শিক্ষা ও সংস্কৃতি)
আমাদের
সমাজে মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পদের কী প্রকট দৈন্য তা নিত্যদিন অহরহ প্রকটভাবে
ধরা পড়ছে। এ অবস্থায় অর্থনৈতিক মানদণ্ডে ধনী দেশ হওয়া সম্ভব হলেও প্রকৃত মানবিক মানদণ্ডে
দেউলিয়াত্ব ঢাকা যাবে না।
***