Monday, January 16, 2017

কথায় না হয়ে কাজে বড় হওয়ার শিক্ষা কতদূর?

আবুল মোমেন

২০১৭ সনের পাঠ্য বইয়ে বেশ কিছু ভুল পাওয়া গেছে, এ নিয়ে দৈনিক পত্রিকা, বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোরগোল উঠেছে। এ থেকে ভাবা যেতে পারে যে, জাতি শিক্ষা নিয়ে বেশ সচেতন হয়ে উঠেছে। তবে সমালোচনার ঝড় এমনভাবে বইছে যে, এতে সাম্প্রতিককালে সাধারণভাবে পাঠ্যবইয়ের আধেয় এবং মুদ্রণের মান যে বেড়েছে এবং তার কৃতিত্ব যে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেই তথ্য চাপা পড়ে যাচ্ছে। সবাই মিলে গেল-গেল রব তুলে দায়িত্বরত কর্তৃপক্ষকে নার্ভাস করে দিলে ত্রুুটি সংশোধনের সহজ স্বাভাবিক পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তখন আমাদের দেশে সাধারণত নামিদামিদের নিয়ে বড়সড় কমিটি গড়ে তার আড়াল নেওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয় নি, ভারি নামের দুদুটি কমিটি গঠন করে আপাতত গণ-অসন্তোষ ও গণমাধ্যমকে শান্ত করার চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে এনসিটিবির দুজনকে ওএসডিও করা হয়েছে, একজন চিত্রকরের ওপর কোপ পড়েছে। তবে আমরা তো জানি এ ধরনের কমিটি কর্তৃপক্ষকে সাময়িক সুরক্ষা দিতে পারে বটে, কিন্তু পাঠ্য পুস্তক রচনা বা সংশোধন তাঁদের সভা ও সিদ্ধান্তে সুসম্পন্ন হওয়ার নয়। এর একটি স্থায়ী সুদক্ষ ব্যবস্থাপনা থাকা দরকার, যার অভাব রয়েছে বলে মনে হয়।
যেসব ভুল নিয়ে হৈ চৈ উঠেছে তার সবই এক মাত্রার নয়। মানসিক আঘাত বোঝাতে যঁৎঃ-এর স্থলে যবধৎঃ শব্দের প্রয়োগ নেহায়েৎ লেখার (স্লিপ অব পেন) বা প্রুফের প্রমাদ, যে কোনো স্কুলের শিক্ষকই যা দেখামাত্র শুদ্ধ করে দেবেন। এমন ঘটনা ৬০-৫৫ বছর আগে আমাদের কালেও দেখেছি। বোর্ডও নিজস্ব ব্যবস্থায় এ নিয়ে স্কুলে নির্দেশনা পাঠাতে পারে।
পত্রপত্রিকার মাধ্যমে যেসব ভুল সম্পর্কে জানতে পারলাম তাতে মনে হয় ভুলের উৎস বা কারণ মূলত তিনটি - ১. শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে বিপুল বই প্রস্তুত করে বিতরণের চাপ, ২. লেখক ও বিশেষজ্ঞদের সময়-সংকট এবং তাঁদের মধ্যে অনেকের দক্ষতা ও আন্তরিকতার অভাব এবং ৩. সমাজমানসে পুঞ্জিভূত সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় রাজনীতির চাপ ও কৌশলী পদক্ষেপ ।
এবারে আমরা সমস্যাগুলোর সমাধানে কিছু পরামর্শ দিতে পারি কিনা দেখি, যদিও তা শোনার সম্ভাবনা কম।
১. ফি-বছর স্কুল ছাত্র বৃদ্ধির সাথে সাথে বইয়ের কপির সংখ্যাও বাড়তে থাকবে। গত কয়েক বছরের ধরণ দেখে মনে হয় বছরে গড়ে ২ কোটি করে কপির সংখ্যা বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে আমার দুটি বিনীত নিবেদন আছে - প্রথমত, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরকে দুই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সার্বিকভাবেই ভাগ করে দেওয়া উচিত। সেভাবে এনসিটিবিরও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই ভাগ হওয়া বাঞ্ছনীয়। দ্বিতীয়ত, আমাদের মত দরিদ্র দেশে কেন সক্ষম ও অক্ষম উভয় ধরনের পরিবারকে বিনামূল্যে বই দেওয়া অপরিহার্য ভাবছে সরকার? এটা আমার বোধগম্য নয়। শুধুমাত্র সরকারি প্রাথমিক স্কুলে ঢালাওভাবে বিনামূল্যে বই দেওয়া যায়, অন্যত্র তার প্রয়োজন নেই। স্কুল কর্তৃপক্ষ মেধাবী ও দরিদ্র ছাত্রের বৃত্তির যোগ্যতা যেভাবে নির্ধারণ করেন এক্ষেত্রেও সেভাবেই বিনামূল্যে বই পাওয়ার উপযুক্ত ছাত্রদের নির্বাচন করবেন। তারপরেও এতে যেটুকু সমস্যা হবে তা নীতিগত নয়, ব্যবস্থাপনার। আমার ধারণা এ কাজে দক্ষ ব্যবস্থাপনার বুদ্ধি যোগ্য ব্যক্তিরা দিতে পারবেন। কিন্তু এভাবে যে বিপুল অর্থ সাশ্রয় ও আয় হবে তা স্কুলশিক্ষায় ব্যয় করা হলে শিক্ষার মান বাড়ানোর জন্যে অনেক কাজ করা যাবে। শিক্ষক সংকট, পাঠাগার ও গ্রন্থাগারিকের অভাব, বিজ্ঞান গবেষণাগার ও সহায়ক কর্মীর সংকট, খেলাধূলার অভাব ইত্যাদি স্কুল শিক্ষার বহু জরুরি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংযোজন করা যাবে।
২. পাঠ্যবইয়ের রচয়িতা ও সম্পাদক নির্বাচনের মাপকাঠি সম্পর্কে আমি জানি না। তবে স্কুলশিক্ষার সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থেকে জানি আমাদের পাঠ্যবইয়ের ভাষা বড্ড গতানুগতিক, প্রাণহীন, শিশুমনকে উদ্দীপ্ত করার মত সমৃদ্ধ নয়। যাও বা সাহিত্যের বইগুলো থেকে শিশুরা উদ্দীপনা পেতে পারত তাতেও বাদ সেধেছে দিনে দিনে এমন সৃজনশীল লেখার সংখ্যা কমতে থাকায়। আমাদের বিবেচনায় থাকা দরকার কোন ভাষা প্রাণবন্ত কোনটি নিষ্প্রাণ, কার ভাষা সরস কারটি নীরস, কোনটিতে আছে কল্পনাকে মুক্তি দেওয়ার রসদ কোনটি বদ্ধ ভাষা ইত্যাদি। কারো কারো ভাষা বন্ধ্যা, আড়ষ্ট, তাই শিশুর কল্পনা ও ভাবনাকে জাগাতে পারে না। ভাষাবোধের এই সংবেদনশীলতা ছাড়া কীভাবে শিশুদের জন্যে যথার্থ শৈলীর লেখা নির্বাচন বা প্রণয়ন করা যাবে?
যে কোনো শিক্ষার্থীর বিদ্যাচর্চায় অগ্রগতি অনেকাংশে নির্ভর করে তার গদ্যের ওপর - তা প্রাঞ্জল গতিশীল হওয়া জরুরি। এমন গদ্য লেখার যোগ্যতা অর্জন শিক্ষার একটি বড় কাজ। প্রমিত ভাষায় নিজের ভাব-বক্তব্য প্রকাশের দুর্বলতা যে কোনো জাতিকে মেধাচর্চায় পিছিয়ে দেবে - এটা মনে রাখা উচিত।
এটুকু বাড়তি কথার পরে বলতে চাই যে, লেখক ও সম্পাদক নির্বাচনে আরো মনোযোগী হতে হবে। আর বছরের শুরুতেই পরবর্তী বছরের বই রচনা (যদি প্রয়োজন থাকে), পরিমার্জন, সম্পাদনার কাজ শুরু করে দেওয়া উচিত। যাঁরা বাইরে থেকে যুক্ত হবেন তাঁদের অবশ্যই অন্তত ৬ মাসের ছুটি নিয়ে সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েই কাজ করতে হবে। তাঁদের মূল চাকুরি ও আর্থিক সুবিধাদির বিষয় সরকারকে দেখতে হবে।
৩. আমরা সকলেই জানি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভূত মুক্তিযুদ্ধও জাতির মনস্তত্ত্ব থেকে সম্পূর্ণ ছাড়াতে পারে নি, বরং সাম্প্রতিক কালে ইসলামি জঙ্গিবাদের প্রভাব বাড়ায় এ সংকট বেড়েছে। তাই কীভাবে শিক্ষায় সাম্প্রদায়িক মনোভাব ও ধর্মান্ধতা ছড়ায় তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানা উচিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। তারপর সে অনুযায়ী শিক্ষা থেকে ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলের কৌশল ও ব্যবস্থাপত্র নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। সেই সচেতনতার অভাব যে প্রকট তা বোঝা যায় যখন হেফাজতের দাবি মেনে পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত রচনা ও লেখকের রদবদল হয়। এই মনস্তত্ত্বের যে দীর্ঘ ইতিহাস আছে তা-ও জানা দরকার। ১৯৬৭ সন থেকে ফাংশনাল ইংরেজির অত্যন্ত চালু একটি বই হল অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কলিমদাদ খানের অ ইড়ড়শ ড়ভ এৎধসসধৎ, ঞৎধহংষধঃরড়হ ্ ঈড়সঢ়ড়ংরঃরড়হ। এর ১১০ পৃষ্ঠায় ট্রান্সলেশনে পরপর কয়েকটি বাক্য এরকম - বাংলাদেশীরা সাহসী, ইংরেজরা পরিশ্রমী, মুসলমানরা সত্যবাদী, হিন্দুরা মূর্তি পূজক। এতে সাহস, শ্রমশীলতা, সত্যবাদিতার মত গুণবাচক বিশেষণগুলো যেভাবে বসানো হয়েছে তাতে একদিকে শিশুদের বুঝতে কষ্ট হবে যে কেউ কেউ যুগপৎ কয়েকটিগুণের অধিকারী হতে পারে। আবার অন্যদিকে হিন্দুর বেলায় যে পরিচিতি দেওয়া হয়েছে তা কোনো গুণ প্রকাশ করে না। এতে সামাজিকভাবে তাদের অবনমন ঘটে যা পরিস্কার সাম্প্রদায়িক কাজ।
শিক্ষামন্ত্রী এ বিষয়ে অবগত ও সচেতন বলেই জানি। কিন্তু এ মানসিকতা তো কেবল প্রশাসনিক ও বিভাগীয়ভাবে মোকাবিলা করা যাবে না। রাজনীতি ও সমাজের পশ্চাদাপসরণ ও ব্যর্থতার দায় কেবল পাঠ্যবই প্রণেতা ও আমলার কাঁধে চাপালে চলবে কেন? তবে এ বিষয়ে তাদের অসচেতন থাকলেও চলবে না, আর বর্ণচোরা অনুপ্রবেশকারীদের না চিনলেও হবে না।
এখানেই বলে রাখব আমাদের বড় এক দুর্বলতার কথা - বইয়ের অলঙ্করণ। আমাদের চারুকলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অলঙ্করণ, বৈজ্ঞানিক ড্রয়িং-স্কেচ, অক্ষরবিন্যাস ইত্যাদি উচ্চমানে শেখানো হয় না। বিদেশি বইয়ের তুলনায় এক্ষেত্রে আমরা অত্যন্ত দুর্বল, বিপুলভাবে পিছিয়ে আছি। কিন্তু শিশুদের বইয়ে ভালো মানের ছবি থাকা আবশ্যক। যেহেতু এটি একটি সাংবাৎসরিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ তাই যোগ্য লোকবল তৈরির জন্যে আগ্রহী চারুশিল্পীর অন্তত ১০ জনের একটি দলকে দক্ষতা অর্জনের জন্যে বিদেশে পাঠানো হোক। পরে তাঁরাই দেশে প্রশিক্ষণ দিতে পারবেন।
মূল তিনটি পর্যবেক্ষণের বাইরে আর দু’একটি সাধারণ কথা বলতে চাই। আমাদের শিক্ষায় বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চা, উপভোগ, সৃজন, মৌলিক চিন্তা ও বিশ্লেষণের অবকাশ নেই বললেই চলে, পরীক্ষার চাপে ও আধিক্যে শিক্ষার আসল লক্ষ্য অনর্জিত থেকে যাচ্ছে। আমরা এমন উচ্চডিগ্রিধারীদের পাচ্ছি যারা চিন্তা করতে, গুছিয়ে কোনো বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে, শুদ্ধভাবে লিখে বক্তব্য প্রকাশ করতে পারে না। তাই দেশে নয় বিদেশে গিয়েই আমাদের মেধাবীরা নিজ নিজ মেধার প্রকাশ ঘটাতে পারছে। এদেশের অদম্য মেধাবীরা কেবল জিপিএ-৫ পেতে পারে। সমাজে জ্ঞানের সত্যিকারের চাহিদাই তৈরি হয় নি - এটা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মস্ত দুর্বলতা।
এই দুর্বলতার সূত্র ধরে এ ব্যবস্থায় পাঠ্যবই (এবং জ্ঞানার্জন ও নির্মল আনন্দের জন্যে বই পড়া) এবং শ্রেণিকক্ষের পঠনপাঠন, এবং সেই সূত্রে স্কুল ক্রমেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে প্রশ্ন ও উত্তর সম্বলিত গাইডবই, পরীক্ষায় দক্ষ হয়ে ওঠার কোচিং সেন্টার এবং মুখস্থবিদ্যা।
আরেকটা কথা বলতে চাই, আমাদের দেশে নাকি ছাত্রের ওপর বইয়ের বোঝা বেশি। কথাটা সত্য হলেও বাস্তবে পঠনপাঠন কম, আজকালকার ছাত্ররা লুকিয়ে নভেল-নাটক পড়ে না, স্কুলে লাইব্রেরির চলও উঠে গেছে। তাহলে? বোঝা বাড়ল কীভাবে? না, এ হল পরীক্ষার বোঝা, পাঠ্যবইয়ের চেয়ে গাইডবই ভারি, এক ছাত্রের একটি স্কুল হলেও এক ছাত্রের কোচিং সেন্টার হয় একাধিক, পড়া-শুনার চেয়ে পরীক্ষার জন্যে খাতার বোঝা অনেক বেশি। ছাত্ররা সেগুলো টানে।
উন্নত বিশ্বে স্কুল পর্যায়েই কিন্তু স্ব স্ব ভাষার ধ্রুপদী সাহিত্যের সাথে ছাত্ররা পরিচিত হয়। প্রচুর বই পড়ে তারা। দশ বারো বছর স্কুলে পড়ে আমাদের ছাত্ররা বাংলাসাহিত্যের কটা বই পড়ে? বঙ্কিম তো বহু আগেই তামাদি হয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র-নজরুলরাও বাসি হয়ে পড়েছেন। সম্প্রতি পাঠ্যবই বহির্ভূত সাহিত্য পাঠের জন্যে সরকার বিদেশি সাহায্য নিয়ে বড় কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। কিন্তু পরীক্ষাময় শিক্ষায় তা সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারবে বলে বিশ্বাস হয় না।
সব শেষে বলতেই হবে, আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে, এবং তাই শিক্ষা জীবনেও, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তি তাদের প্রভাব এখনও বহাল রেখেছে, বরং দিনে দিনে আরো জোরালোভাবে তা ছড়াচ্ছে। হেফাজতে ইসলাম পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তনের জন্যে যেমন সরকারকে ধন্যবাদ দিয়েছে তেমনি আবার ভবিষ্যতে আরো দাবি তোলার হুঁশিয়ারিও জানাচ্ছে। হায় স্বাধীন বাংলাদেশে, শেখ হাসিনার বাংলাদেশে, শেষ পর্যন্ত মূলধারার শিক্ষা কওমি মাদ্রাসার আদর্শেই বুঝি ঢেলে সাজানোর কাল আসছে।
লক্ষ লক্ষ জিপিএ-৫ তারকার মরীচিকার আলোয় আমরা বুঝি আসল ক্ষেত্রে পথ হারাতে বসেছি। একদিকে পরীক্ষার ফল নিয়ে উৎসবে মেতে উঠছে জাতি আর অন্যদিকে শিক্ষার যাত্রাপথ ভুলভ্রান্তি ও ধর্মান্ধতার আঁধিতে ঢেকে যাচ্ছে। এভাবে চললে আমাদের দেশে কবে সেই ছেলে হবে (এবং অবশ্যই মেয়ে), যে কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হবে?


****