Thursday, November 3, 2016

জেলহত্যার প্রেক্ষাপটে

আবুল মোমেন


কাল সারাদেশে জেলহত্যা দিবস পালিত হবে। এদিন বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের হাতে জেলে বন্দী চার জাতীয় নেতা নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। এক রাতে একই বর্বর আক্রমণের শিকার তাঁরা। মৃত্যুর এই ঘটনা যেন তাঁদের এক সূত্রে গেঁথে দিয়েছে। তাঁরা চারজনই বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ও সহকর্মী, জীবনের শেষপর্বে খুনী মোশতাকের সকল হুমকি অগ্রাহ্য করায় তাঁরা খুনীদের কাছ থেকে একই রকম ঘৃণা ও ভীতি অর্জন করেছিলেন। আর তাদের হাতে একই ভাগ্য তাঁরা অর্জন করেছিলেন। ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডির পর যখন অনেক প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা মোশতাকের সহকর্মী হয়েছেন তখন তাঁরা কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের মর্যাদা রক্ষা করেছেন। যারা আপোস করেননি তাদের নেতা হিসেবে এই চারজন খুনীদের লক্ষ্যস্থলে পরিণত হলেন। এটা বীরত্ব ও ত্যাগের মহান উদাহরণ। সেদিক থেকে সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনুসর আলী ও কামরুজ্জামান আমাদের জাতীয় নেতাই শুধু নন, জাতীয় ইতিহাসের চার নায়কও বটে। বঙ্গবন্ধু যদি মহানায়ক হয়ে থাকেন তাহলে এঁরা নায়ক।
’৭৫-এর হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সরকার পরিবর্তন ও সেই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় আদর্শের পরিবর্তন হলেও দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা নিশ্চিহ্ন করা যায় নি। আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক অঙ্গনে বরাবর সক্রিয় ছিল, ‘৮১ তে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা দলের হাল ধরার পর ধীরে ধীরে এই রাজনীতি তার ভিত্তি ফিরে পেতে থাকে। সেই সঙ্গে পেশাজীবী এবং শিল্প-বুদ্ধিজীবীগণ একযোগে মাঠে নামার পর পরিস্থিতি পুনরায় অনুকূল হয়। আজ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় রয়েছে। এ সময় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার যেমন হয়েছে তেমনি জেলহত্যার বিচারও কাম্য। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সরকারও সুস্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। এটা খুবই আশার কথা।
দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর দলের নেতৃত্ব দিয়ে আর তিন দফা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে শেখ হাসিনা আজ অনেক পরিণত, আত্মবিশ্বাসী। তিনি যেমন একদিকে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন তেমনি অন্যদিকে ইতিহাসের যাত্রাপথ কলঙ্ক মুক্তও করে চলেছেন। ফলে জাতি তাঁর কাছ থেকে রাষ্ট্রনেতা হিসেবে অনেক চমকপ্রদ সাহসী ভূমিকার পাশাপাশি ঐতিহাসিক ভূমিকা প্রত্যাশা করে।
আইনগত বিচারের পাশাপাশি এই ঘটনা ও এতে শহীদ চার নেতার রাজনৈতিক মূল্যায়নও একান্ত প্রয়োজনীয়। ৩ নভেম্বর জেলহত্যা দিবসটি মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বদানকারী চার নেতার মৃত্যু দিবস হিসেবে জাতীয়ভাবে পালিত হওয়া উচিত। বস্তুতপক্ষে সাত নভেম্বর নয় ৩ নভেম্বরই ছুটি থাকা উচিত, এবং দিনটি জাতীয় নেতা হত্যার দিবস হিসাবে পালিত হওয়া উচিত। সাতই নভেম্বর বরং মুক্তিযোদ্ধা হত্যা দিবস হিসেবে পালিত হতে পারে আলোচনা সভা, সেমিনার ইত্যাদির মাধ্যমে।
১৯৭১-এর দিনগুলোর কথা স্মরণ করে আমরা প্রবাসী সরকারের প্রাণপুরুষ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকে বিশেষভাবে শ্রদ্ধা জানাব।
সেই সঙ্গে বলবো, বিশাল ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের জন্যে তাজউদ্দিন আহমেদ বিশেষভাবে স্মরণীয় ব্যক্তি। বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা, স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা ও অনুপস্থিত থেকেও তাঁর দৃঢ়তা, সাহস ও ত্যাগের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক, আর তাজউদ্দিন আহমদ আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের রূপকার। এই মেধাবী সাহসী স্থিতধী দেশপ্রেমিকের আরো ব্যাপক মূল্যায়ন ও স্পষ্ট স্বীকৃতি পাওয়া উচিত ছিল। এ কথা দূর থেকে বলা ঠিক হবে কিনা জানি না, কিন্তু তবু মনে হয়, দীর্ঘদিন খুব কাছাকাছি থেকে দেখার ফলে মনে হয় যে, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী স্তরেও বিষয়টি যেন পরিষ্কার নয়। তাজউদ্দিন আহমেদের নাম আওয়ামী লীগ অঙ্গনে সাধারণত জেলহত্যা প্রসঙ্গেই উঠে থাকে ও আলোচিত হয়। চার জাতীয় নেতার কাউকে ছোট না করেও বলব কেবলমাত্র তাঁদের একজন হিসেবেই তাজউদ্দিনের নাম উচ্চারিত হলে তাঁর প্রতি সুবিচার হয় না। এখন মৃত্যুর প্রসঙ্গেই যেন তিনি একমাত্র স্মরণীয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের কথা ভেবে আমরা কি বলবো না মৃত্যুর চেয়ে তাঁর জীবন অনেক বড়ো ও সার্থক। যে মানুষটা প্রায় এককভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের, তাঁর সে মূল্যায়ন আজও বাকি রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীদের তরফ থেকে কিছু কিছু কাজ যে একদম হয়নি তা নয়, কিন্তু আওয়ামী লীগকেও তো নেতৃবৃন্দের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। স্থানান্তরের পর আজ ৩ নভেম্বরের জেলহত্যা স্মরণে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সেই কক্ষকে জাতীয় স্মারক হিসেবে গণ্য করে রক্ষাণাবেক্ষণ করার ব্যবস্থা হয়েছে। তবে এর বাইরে জেলহত্যায় নিহত নেতাদের স্মরণে একটি স্মৃতি স্তম্ভ হতে পারে ঢাকার কোথাও। আর মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্বদানের জন্য তাজউদ্দিনের নামে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান ও কোনো স্মারক নির্মিত হতে পারে। 
আরেকটি কথা এই প্রসঙ্গে বলতে চাই বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর নামে বিশ্বশান্তি ও সমঝোতার ক্ষেত্রে অবদানের জন্য একটি দ্বিবার্ষিক আন্তর্জাতিক পদক প্রবর্তন করতে পারেন। সেই সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমেদের নামে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিসংগ্রামে অবদানের জন্য সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে একটি আঞ্চলিক পদক প্রবর্তন করা যায়।
আর, সকল রকম ধোঁয়াটে অবস্থা ও বিভ্রান্তি থেকে সকলের ভাবমূর্তি, বিশেষত তাজউদ্দিন আহমেদের ভাবমূর্তি, স্পষ্ট করে তোলা দরকার - যে কাজ আওয়াগী লীগের বর্তমান নেতৃত্ব স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করলে ভালো হয়।


***