Thursday, December 4, 2014

তাঁর রেনেসাঁস-সত্তা

আবুল মোমেন

সত্যিকারের বড় মানুষ সত্যিই দুর্লভ। কারণ বড় হওয়া মানেই খ্যাতিমান হওয়া, প্রতিষ্ঠিতজন হওয়া, পুরস্কার-স্বীকৃতি-সম্মাননায় অভিষিক্ত হওয়া। গণমাধ্যমের নজরে থাকা, তাতে প্রায়ই হাজিরা দেওয়া। এতে গৌরব বাড়ে, গর্বিত হওয়ার অধিকার জন্মায়। এই অধিকারবোধ প্রায় সবার অগোচরে সন্তর্পণে দূরত্ব আর আড়ালগুলো তৈরি করতে থাকে। বড় মানুষ কখন যে চূড়ার ছোট্ট পরিসরে আটকে যান হারিয়ে যান তা তিনিও টের পান না। ভাবি, এটা কি তাঁদের পরাজয়? কাইয়ুমভাই কিন্তু প্রাপ্তির আড়ম্বরে  হারিয়ে যান নি, তাতে আটকা পড়েন নি। না, খ্যাতি-প্রতিষ্ঠার কাছে তাঁর পরাজয় ঘটে নি।
তিনি সবসময় সবারই থাকলেন। পরিবারের, শিল্পী ও ছাত্রদের, সমাজের, দেশের এবং ইতিহাসের একজন হয়েই থাকলেন। কেবল থাকা নয়, সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে থাকা। বড় কথা, সে ভূমিকা বৃহত্তর অর্থে কল্যাণকর, গঠনমূলক, যথাযথ।
বয়স, অভিজ্ঞতা, অর্জন তাঁকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে নি, মৌলিক মানুষটিকে বদলে দিতে পারে নি। তিনি থাকলেন বরাবরের কাইয়ুম চৌধুরী - স্বামী, পিতা, চাচা, ফুফা, খালু, ভাই, বন্ধু, শিক্ষক। তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক বৃহৎ পরিবার ও ক্রমসম্প্রসারমান সমাজের অভিভাবক। এ তিনি বয়স বা সম্পর্কের জোরে কাকতলীয়ভাবে পান নি, যোগ্যতার সাথে দায়িত্বের ভারবহন করেই পেয়েছেন।
তাঁর কাছে সবাই চেয়েছেন, আর তাঁর মতো করেই তিনি দিয়ে গেছেন। পরিবারের বাইরে অধিকাংশের আবদার তো শিল্পীর কাছে - শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর কাছে। কিন্তু তাঁদের চাওয়া পেইন্টিং নয়, কেউ চান সংগঠনের লোগো, কারও দাবি সম্মেলনের পোস্টার, কেউ আর্জি জানান আমন্ত্রণপত্রের নক্সার, আর বেশিরভাগের প্রত্যাশা নিজের বইয়ের জন্যে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর স্বাক্ষরিত একটি প্রচ্ছদ-চিত্র। বেশির ভাগ দাবিই পূরণ করতেন তিনি। অচেনা ব্যক্তি কৌশলের আশ্রয় নেন কাইয়ুমভাইয়ের কোনো প্রিয়জনকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে সবসময় চাপে থাকতে হয়েছে তাঁকে।
কাইয়ুমভাই জীবনের প্রায় সবটা সময় চারুকলায় শিক্ষকতার বাইরে কোনো-না-কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকেছেন। অনেক পত্রিকা ও সাময়িকীর অঙ্গসৌষ্ঠবের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি, শেষ দিন পর্যন্ত করে গেছেন। সংবাদ, চিত্রালী, ইংরেজি এক্সপ্রেস, সচিত্র সন্ধানী, টাপুরটুপুর, অন্তরঙ্গ এমনি আরও অনেক। সাম্প্রতিককালে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন দৈনিক প্রথম আলো আর বেঙ্গল ফাউণ্ডেশনের সাথে। ফাঁকে ফাঁকে কবিতা লিখেছেন, ছোটদের জন্যে ছড়াও। চাপের মধ্যে থেকেও কখনও তাঁর প্রসন্নতা হারান নি, এমনকী প্রফুল্লতাও। কাজে চাপ কিংবা তাড়াহুড়ার ছাপ থাকত না তাঁর কোনো কাজে কিংবা আচরণে-ব্যবহারে। হয়ত সময় নিতেন তিনি, কিন্তু কাজের মানে আপস করতেন না, নিজের কাজটিই করতেন।
তাঁর আগ্রহের ক্ষেত্রও ছিল ছড়ানো  পেইন্টিং এবং গ্রাফিক্স, ড্রয়িং এবং স্কেচে সমান পারদর্শী; আগ্রহ ছিল সঙ্গীতে   উচ্চাঙ্গ, পুরোনো বাংলাগান, রবীন্দ্র-নজরুলসহ পঞ্চভাষ্কর, কি নয়; চলচ্চিত্রের প্রতি কেবল আগ্রহ নয় ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনে ছিলেন, ছিলেন আগ্রহী চলচ্চিত্র তৈরিতেও; সাহিত্য পাঠের অভ্যাস শৈশব থেকেই, এবং তা কখনও ছাড়েন নি; বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের প্রতিও কৌতূহলী ছিলেন। পছন্দের বই কেনা কখনও ছাড়েন নি। রেখে গেছেন ঈর্ষণীয় গানের সংগ্রহ। বইয়ের সংগ্রহে আছে দুর্লভ অনেক বই। ভালো চলচ্চিত্রের সংগ্রহও গড়ে উঠেছিল তাঁর।
কাইয়ুমভাইয়ের পক্ষে নিজের আঁকা প্রচ্ছদের বইগুলোর হদিশ নেওয়া বা দেখে শেষ করা সম্ভব ছিল না - তা সংখ্যায় এত বেশি। আমন্ত্রণপত্র, পোস্টার, মোড়ক-নক্সা, লোগোর ক্ষেত্রেও একথা খাটে। এমন বিপুল কাজের মান বজায় রাখা কঠিন কাজ। কাইয়ুম চৌধুরী অনায়াসেই তা ধরে রেখেছিলেন।
এর মধ্যে পেইন্টিং, ড্রয়িং কম করেন নি। তাতেও নিজের স্বাক্ষর রেখেছেন, উচ্চমান ধরে রেখেছেন। অন্য পরিচয়ের আড়ালে সমকালে তাঁর চিত্রকর পরিচয় তেমনভাবে আলোচিত হয় নি। এবার দিন যত গড়াবে ততই তা বাড়বে, কারণ চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরীকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। তাঁর কবিতা কাব্যগুণ এবং বিশিষ্টতার কারণে পাঠকপ্রিয় হয়েছে, শিশুতোষ ছড়াও চমৎকার লিখেছেন। আজও অলঙ্করণে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁর হাতের বর্ণবিন্যাসের অসাধারণত্ব হাতছাড়া হয়নি কখনও।
এতসব কেজো আর কালিক গণ্ডিতে বাঁধা শিল্পকর্মে ব্যস্ত থেকেও তিনি আশ্চর্যরকম দক্ষতায় কাজোত্তীর্ণ ও কালোত্তীর্ণ চিরকালের ছোঁয়া দিতে পেরেছেন তাঁর অধিকাংশ সৃষ্টিতে। তাই মানুষটার মধ্যে প্রয়োজন-অপ্রয়োজন, ক্ষণকাল-চিরকাল, কাজ-বিরাম, শ্রম-উপভোগ একাকার হয়ে গিয়েছিল। মানুষের মধ্যে থেকেও তিনি একা, আবার খ্যাতি-প্রতিষ্ঠার গণ্ডিতে থেকেও বিচ্ছিন্ন বা একা হন নি, থেকেছেন সবার।
বহুসত্তার এক রেনেসাঁসকালের মানুষ ছিলেন তিনি। জীবন কাটিয়েছেন জাতীয় ইতিহাসের নানা দুঃসময়ের ভাঙাগড়ার মধ্যে। কিন্তু তাতে তাঁর রেনেসাঁস-সত্তার বৈচিত্র ও বিশালতা ক্ষুণœ হয় নি। কাল কিংবা দুঃসময় তাঁকে হজম করতে পারে নি, পরাভূত করতে পারে নি। কাইয়ুম চৌধুরী খ্যাতি-প্রতিষ্ঠার কাছে যেমন নিজেকে সঁপে দেন নি, তেমনি ক্ষয়িষ্ণু কালের কাছেও হার মানেন নি। এমন আলোকিত জীবনের যবনিকা তো আলোকিত মঞ্চে নায়কের ভূমিকায় সহস্র মানুষকে সাক্ষী রেখেই পড়বার কথা। তার অন্যথা হয় নি।

***