Thursday, October 10, 2013

পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র : কাছ থেকে দেখা সালমান খুরশীদের সাথে সাক্ষাৎ


১৭ তারিখে দুপুরে হোটেল তাজমহলে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেছিলেন বিদেশ মন্ত্রকের যুগ্মসচিব। এতে অংশ নিয়েছিলেন বাংলাদেশে ভারতের তিনজন সাবেক হাই কমিশনার ও একজন ডেপুটি হাই কমিশনার। এঁরা হলেন দেব মুখার্জি, রজিত মিত্তির, পিনাক চক্রবর্তী এবং অমিতাভ ত্রিপাঠী। আর ছিলেন দিল্লিতে কর্মরত বেশ কয়েকজন সিনিয়র বাঙালি সাংবাদিক, জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রমুখ।
যেমনটা হয় প্রথমে ছোট ছোট জটলায় পরিচয়, আলাপ, পুরোনো পরিচয়ের সূত্রে টুকটাক কথাবার্তা চলল। দেব মুখার্জি মনে রেখেছেন আমাকে, নতুন বই কী লিখেছি জিজ্ঞেস করলেন, ভুললেন না পারিবারিক কুশলাদি জানতে। সাংবাদিক সৃঞ্জয় চৌধুরীর সাথে আলাপ করে বুঝলাম তিনি অভিনেতা বসন্ত চৌধুরীর ছেলে। তাঁকে জানালাম একজন মুদ্রা সংগ্রাহক ও মুদ্রা বিশারদ হিসেবে একাধিকবার চট্টগ্রাম সফরকালে তাঁর বাবার সাথে আমাদের বেশ ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।
চারদিক ঘিরে টেবিল। প্রথমে আলোচনার সূত্রপাত করেন দেব মুখার্জী। এক্ষেত্রে যা হয় দু’ দেশের ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক-সামাজিক সম্পর্কের কথা দিয়েই আলোচনা শুরু হয়। তবে তাঁর এবং ভারতীয় পক্ষের অন্যান্যদের আলোচনায় বোঝা গেল ভারত ইদানীং বাংলাদেশকে বিশেষ গুরুত্বের সাথেই গ্রহণ করে। বিশেষত বর্তমান সরকার পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীদের ঘাঁটি ও আইএসআইয়ের প্রশিক্ষণকেন্দ্র বন্ধ করায় তাঁরা এর ধারাবাহিকতা রক্ষায় আগ্রহী। প্রায় প্রত্যেকেই স্থল সীমান্ত চুক্তি ও তিস্তা চুক্তি সম্পাদিত হয়েও কার্যকর না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করতে শোনা যায়। ফেলানি হত্যাসহ সীমান্তের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার ব্যাপারে কার্যকর কিছু হওয়া উচিত বলেই সবাই মত দিয়েছেন। আমাদের দিক থেকে দলের বয়োজ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ডেইলি স্টারের সহযোগী সম্পাদক শাহ হোসেইন ইমাম কথা শুরু করেছিলেন। সীমান্ত চুক্তি, তিস্তা চুক্তি ও সীমান্তে বিএসএফের ভূমিকা নিয়ে আমাদের উদ্বেগের কথা তো ছিলই, সেই সাথে সদ্য সমাপ্ত লোকসভা অধিবেশনে স্থল সীমান্ত চুক্তি না ওঠায় হতাশা ব্যক্ত করতেও তিনি ভোলেন নি।
আমাদের দলের যারা কথা বলেছেন সবাই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই তিনটি বিষয় যে প্রভাব ফেলেছে তা বলতে ভোলেন নি। কেউ কেউ আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে সরকার পরিবর্তনের আভাস রয়েছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনোভাব কি একই থাকবে? তার সাথে কেউ বলেছেন ভারতেও আগামী বছর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির উত্থানের সম্ভাবনা আছে, তাতে কী ভারতের বাংলাদেশ নীতিতে পরিবর্তন ঘটবে?
বাংলাদেশের নির্বাচনকে কূটনীতিকরা অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবেই দেখতে চান, এবং আশা করেন সরকারে পরিবর্তন ঘটলেও বর্তমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। বোঝা যায় এটা একটা অফিসিয়াল প্রতিক্রিয়া এবং নিয়মরক্ষার আশাবাদ। আর সেদেশে বিজেপি ক্ষমতায় আসবেই এমনটা এখনই তাঁরা কেউ ভাবছেন না। তবে কেন্দ্রে যে সরকারই আসুক ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি খুবই পাল্টাবে বলে মনে করেন না কেউ।
অমিতাভ ত্রিপাঠী আলোচনায় একটু ঝাঁঝ আনলেন এই বলে যে, তিস্তার পানি বাংলাদেশের কতটুকু অঞ্চলকে প্রভাবিত করে? তাছাড়া চুক্তি হোক বা না হোক নদী দিয়ে পানি তো প্রবাহিত হচ্ছে, এবং বাংলাদেশ পানি কম পাচ্ছে না। তাঁর সাথে আরও একটু যোগ করলেন সাবেক হাই কমিশনার ও বর্তমানে অভ্যন্তরীণ সম্পদ সচিব পিনাক চক্রবর্তী। তিনি বলতে চাইলেন, সীমান্তে বিএসএফের তৎপরতা চলে অবৈধ অনুপ্রবেশের কারণে, সেটা ঠেকানোর জন্যে বাংলাদেশ সরকার কী করছেন? দ্রুত মাইক নিয়ে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সোহরাব হাসান দু’দেশের সম্পর্কের প্রেক্ষাপটেই বিষয়টিকে দেখতে বললেন। সীমান্ত পারাপার ও সীমান্ত হাটে যাতায়াত বহুকালের বিষয় ফলে এখানে সাধারণ মানুষের ওপর গুলি চালানোর আগে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। সকলেই অবশ্য গুলি চালানোর মত পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার পক্ষেই ছিলেন। সবার মত ছিল বাংলাদেশ সীমান্তে যারা দায়িত্ব পালন করবেন তাদের ভালোভাবে ব্রিফিং হওয়া দরকার।
আমি বলেছিলাম, দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক হয় বহুমাত্রিক এবং তার নানা স্তর থাকে। কখনও কখনও এতে টানাপোড়েন তৈরি হয়, কখনও অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু এর ভিতর দিয়ে সম্পর্ক ফলপ্রসূভাবে এগুচ্ছে কিনা সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে আমাদের দলগত মূল্যায়ন মনে হয় এই যে, গত পাঁচ বছরে এ সম্পর্কে ফলপ্রসূ অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু তাতে বাংলাদেশের যতটুকু অবদান ভারতের দিক থেকে, তিস্তা চুক্তি ও স্থলসীমান্ত চুক্তি লোকসভায় অনুমোদন বিলম্বিত হওয়ায় তার প্রত্যাশিত প্রতিদান মিলছে না। ভারতের বন্ধুরা স্বভাবতই ২৫টি ব্যতীত সকল পণ্য শুল্ক বাধা উঠিয়ে দেওয়া, এক বিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্যের প্রসঙ্গ তুলেছেন। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের দিক থেকে আমাদের মনে হয় রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে ওঠা বিষয় দুটি দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি।
ফলে সেদিনই বিকেলে সাউথ ব্লকে আমরা যখন সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হয়েছি ভারতের বিদেশমন্ত্রী সালমান খুরশীদের সাথে তখন আবারও এই প্রসঙ্গগুলো তুলেছি আমরা। তার আগে একটু বলে নিই সালমান খুরশীদ হলেন ভারতের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. জাকির হোসেনের দৌহিত্র। তাঁর বাবাও শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। আর তিনি নিজে আইনজীবী, লেখক, রাজনীতিবিদ। তাঁর একটি বই অ্যাট হোম ইন ইণ্ডিয়া আমার আগেই পড়া ছিল। সম্মেলন কক্ষে আমাদের অপেক্ষা যখন একটু দীর্ঘতর হচ্ছিল, আমরা একটু অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম, তখনই সুদর্শন মানুষটা ঘরে ঢুকে হাসিমুখে সম্ভাষণ জানাতেই বেশ উষ্ণ আন্তরিক পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল।
চেয়ারে বসতে বসতে রবীন্দ্রনাথের যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে এবং নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা স্মরণ করে বেশ কাছের মানুষটি হয়ে কথা শুরু করেছিলেন। বললেন তাঁর নানার ছোট ভাই ড. মাহমুদ হোসেনের কথা, যিনি পাকিস্তানের নাগরিক হিসেবে একসময় (১৯৬০-৬৩) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। বললেন, আমাদের মধ্যে মিল যত বেশি পার্থক্য তার চেয়ে অনেক কম। স্মরণ করলেন ছাত্রজীবনে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনি ও তার স্বামীর সাথে পরিচয়ের কথা।
তা সত্ত্বেও ভারতের সাথে জ্বলন্ত ইস্যুগুলো উঠে এলো। সালমান খুরশীদ ফেলানির হত্যাকাণ্ডে গভীর শোক প্রকাশ করলেন এবং বললেন সীমান্তে মৃত্যু বন্ধ করার উপায় বের করতেই হবে। এই প্রসঙ্গে বললেন, তাঁর স্বপ্ন হল, একদিন সীমান্ত থাকবে না, দু’দেশের মানুষ অনায়াসে চলাচল করতে পারবেন। তাঁর বিশ্বাস লোকসভার আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনে স্থল সীমান্ত চুক্তি উত্থাপিত হবে। এটি পাশ করতে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি প্রয়োজন হয় যা বর্তমান ইউপিএ সরকারের নেই। তাই সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে, বিজেপির সমর্থনের ব্যাপারেও তিনি আশাবাদী বলে জানালেন।
তিনিও তিস্তা চুক্তি না হলেও পানি প্রবাহ ঠিক আছে বলে জানান। সাথে এ প্রতিশ্রুতি দেন যে, পানি যেন কোনভাবে প্রত্যাহৃত না হয় সেটা দেখা হবে। ভবিষ্যতে উজানে কোন বাঁধ বা প্রকল্প করতে হলে বাংলাদেশকে সাথে নিয়েই তা করা হবে।
সালমান খুরশীদ জোর দিলেন যৌথ উদ্যোগের আরও নানান ক্ষেত্র খুঁজে নেওয়ার উপর- তা সরকারি এবং বেসরকারি উভয় খাতেই হতে পারে। বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অন্যান্য সেবা খাতের প্রসঙ্গ এসেছে এই সূত্রে।
তবে যৌথ উদ্যোগে যে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হতে যাচ্ছে রামপালে তা বাংলাদেশের ফুসফুস সুন্দরবনের বিপুল ক্ষতি করবে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এ কেন্দ্র থেকে ভারতে বিদ্যুৎ যাবে, ফলে এর মধ্যে ভারতের স্বার্থ এবং বাংলাদেশের সমস্যার দিকটি ফুটে উঠলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে অসমতা ও ক্ষেত্র বিশেষে অন্যায্যতার অভিযোগ প্রকট হয়ে ওঠে। বড় প্রতিবেশীকে এসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। এটাও আমরা বুঝছি না শেখ হাসিনা কেন তড়িঘড়ি করে বিশেষজ্ঞদের মতামত উপেক্ষা করে এটি বাস্তবায়নে এগিয়ে গেলেন যেখানে ভারত সব পক্ষকে সাথে না নিয়ে সীমান্ত চুক্তি বা তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নে অগ্রসর হচ্ছে না? সেদিনই সাউথ ব্লকে আরেকটু অপেক্ষা করে আমরা মিলিত হয়েছিলাম ভারতের বিদেশ সচিব শ্রীমতী সুজাতা সিংয়ের সাথে। সৌজন্য ও প্রীতি বিনিময় এবং কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সুন্দর অভিব্যক্তিসহ দিনের কর্মসূচি শেষ হয়েছিল।