আবুল মোমেন
সরকার কোচিং-টিউশনি
এবং নোটবইয়ের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান থেকে পিছু হটে এলো। শিক্ষামন্ত্রী এ নিয়ে প্রায়
জেহাদে নেমেছিলেন, কিন্তু বাস্তবতা, বা তারও চেয়ে বেশি, নোটবই ও কোচিং ব্যবসায়ীদের
চাপের মুখে, নমনীয় হতে বাধ্য হলেন। বর্তমানে
সংশোধিত যে খসড়া আইনটি মন্ত্রীপরিষদে গেছে তার যেটুকু পত্রিকায় পড়েছি (প্রথম আলো, ৭
নভেম্বর ২০১৬) তাতে বোঝা গেল এ আইনের আওতায় কোচিং, টিউশনি, নোটবই সবই বহাল থাকবে। অর্থাৎ
কঠোর আইন করে এবং জেহাদ ঘোষণা করেও এগুলো বন্ধ করা যায় নি। যেসব কারণে আইন ও প্রচারণা
সত্ত্বেও এসব বন্ধ করা যায় নি তা বিবেচনায় নিয়েই ব্যবস্থা নিলে ভালো হত।
সাধারণভাবে
এ প্রশ্ন ওঠাই স্বাভবিক যে, একজন ছাত্রকে কেন তার পাঠের বিষয়গুলো বুঝতে পাঠ্যবই, শ্রেণিকক্ষের
পাঠ ও বিদ্যায়তনের শিক্ষকের সহযোগিতার বাইরে আরও বাড়তি সাহায্যের ওপর নির্ভর করতে হবে?
এটা স্বাভাবিক নয়। কিন্তু আমাদের দেশে স্কুল-শিক্ষা প্রবর্তনের আদিকাল থেকেই গৃহশিক্ষকের
ব্যবস্থা ছিল। রবীন্দ্রনাথ ‘ছেলেবেলা’ বইতে তাঁর
সেজদা ছাড়াও এন্তার গৃহশিক্ষকের বর্ণনা দিয়েছেন। গল্প-উপন্যাসেও আমরা গৃহশিক্ষকদের
কথা পাই। এঁরা সাধারণত গ্রাম থেকে শহরে উচ্চ
শিক্ষার জন্যে এসে সম্পন্ন গৃহস্থবাড়িতে থেকে সে বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়ানোর বিনিময়ে
থাকা-খাওয়ার সংস্থান করতেন ও নিজের পড়াশুনা চালিয়ে যেতেন যা জায়গির নামে পরিচিত। ঊনবিংশ
শতাব্দীতে হিন্দুসমাজে আর বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে মুসলিমসমাজে এই ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
প্রশ্ন তোলা যায়, গৃহশিক্ষকের প্রয়োজন হত কেন? শুরুতে সমস্যাটা ছিল এ ধরনের আনুষ্ঠানিক
অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে অভিভাবকদের প্রত্যক্ষ পরিচয়ের অভাব। ফলে উচ্চতর
শ্রেণির ছাত্ররা একাজে সহায়ক হতো, এবং বিনিময়ে তাদেরও আবাসন ও আহার্যের সংস্থান হত।
তাছাড়া বিংশশতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত শহরে খুব সীমিত সংখ্যক পরিবারের বসবাস ছিল,
কর্তারা মেসে বাস করে জীবিকা নির্বাহে অথবা জীবন উপভোগে সময় ব্যয় করতেন। তাই গ্রাম
থেকে এনে সন্তানকে কোনো গৃহস্থ বাড়িতে থাকতে দিতেন। গ্রামীণ পরিবারে বহুকাল ধরেই স্কুলগামী
শিশুরা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম প্রজন্ম। বাবা-মা তাদের দেখভালে অক্ষম ছিলেন
এবং উপযুক্ত কাউকে, প্রায়ই নবীন কোনো শিক্ষককে, বাড়িতে থাকতে দিয়ে বা টাকার বিনিময়ে
গৃহশিক্ষক হিসেবে রাখতেন।
গৃহশিক্ষকতা
ব্যক্তির জন্যে সাময়িক পেশা হলেও এরকম কর্মপ্রার্থীর নিত্য চাহিদা ও জোগান থাকায় এর
একটা ধারাবাহিকতা এ সমাজে বরাবর ছিল। বলা যায় এ পেশা আমাদের সামাজিক সংস্কৃতির সাথে
গভীরভাবে যুক্ত।
বিষয়টা আমাদের
দেশের ক্ষেত্রে জটিল এবং বিশিষ্ট হয়ে উঠল এ কারণে যে আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার
দুশত বছর অতিক্রান্ত হলেও আমাদের সমাজ শিক্ষা বা লেখাপড়া বা পঠনপাঠন কিংবা জ্ঞানার্জনকে
এর - অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও এতদ্সংশ্লিষ্ট ডিগ্রি, সনদপত্র ইত্যাদির - বাইরে
জীবনের সাথে যুক্ত বা জীবনে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারে নি। শিক্ষা এক জীবনবিযুক্ত প্রক্রিয়া,
এর একমাত্র লক্ষ্য ও মোক্ষ হল ডিগ্রি ও সনদপত্র, জীবনকে তাৎপর্যময়, আনন্দময় করে তোলার
রসদও যে এখান থেকেই আসবে; এখান থেকেই মানুষটার ভাবনার জগৎ, বিবেচনার বোধ ও ক্ষমতা,
ধৈর্য, মমতা, সহিষ্ণুতা, ঔদার্য, সহানুভূতি, সেবাপরায়নতা ইত্যাদি মানবিক গুণাবলী অর্জিত
হবে তার ভাবনা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে আর নেই। একসময় শিক্ষা মহৎ আদর্শ লালন করত,
শিক্ষকরা সে আদর্শের প্রতিভূ ছিলেন। এখন তাকে আমরা বেশিরকম বৈষয়িক বিবেচনায় বেঁধে ফেললাম।
এদিকে ছাত্রত্ব
শেষ করার পর কাউকে তো আর বিষয়ভিত্তিক পরীক্ষা দিতে হয় না, কিন্তু জীবনে পদে পদে বুদ্ধিমত্তা,
বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, মানবিকতাসহ বিভিন্ন দক্ষতা ও মূল্যবোধের পরীক্ষা দিয়ে যেতে
হয়। সেসব পরীক্ষায় যে আমরা ভালো করছি না তা সমাজের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এর দায় শিক্ষা
ও শিক্ষাব্যবস্থা এড়াতে পারে না।
পরীক্ষা, পাঠ্যবই
ও সিলেবাস এবং জিপিএ-৫ কেন্দ্রিক যে শিক্ষা তাতে কারো শিক্ষার্থী সত্তার কোনো গুরুত্ব
নেই, সমস্ত জোরটা গিয়ে পড়ে পরীক্ষার্থী হিসেবে তার দক্ষতার ওপর। স্কুল (এবং অন্যান্য
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান) পরীক্ষা ও পাঠ্যবইয়ের বাইরেও আরো নানা বিষয়ে ছাত্রকে অবহিত, আগ্রহী
ও দক্ষ করে তোলার কথা। সেখানে সে খেলবে, মিশবে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি করবে, এবং স্কাউট-গাইড
করবে, দেশ এবং বিদেশের কথাও জানবে, কোনো কাজে
যুক্ত হবে ইত্যাদি।
কিন্তু কী এক
জাতিগত তাড়নায় সকলেই বুঝেছেন যে, শিক্ষার লক্ষ্য হল পরীক্ষায় ভালো ফল করা, ক্রমে তা-ই
একমাত্র লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে! সেদিক থেকে স্কুলকে টেক্কা দিয়ে পরীক্ষার ফলার্জনের আর্থিক
বাজারটি দখলে নিয়েছে কোচিং সেন্টার। স্কুল শিক্ষকরা স্কুলে মনোযোগ না দিয়ে ব্যাচ পড়ানোর
দিকে মন দিয়ে শিক্ষাবাজার থেকে মুনাফা নিচ্ছেন। আর জায়গির ও গৃহশিক্ষকতা যাদের গতি
হত তারা দল বেঁধে কোচিং সেন্টার দিয়ে শিক্ষাবাজারের সবচেয়ে সফল বণিকে পরিণত হয়েছে।
এখানে শিক্ষার্থীরা কেবল পরীক্ষা দেয়, ওরা বলে মডেল টেস্ট। এভাবে ছাত্ররা দক্ষ দুরন্ত
পরীক্ষার্থীতে রূপান্তরিত হয়।
এভাবে তারা
ভালো ফলও করে, কিন্তু বিনিময়ে অর্থ ছাড়াও আরো মূল্য দেয়, তাহল তার পড়াশুনার ইচ্ছা,
জ্ঞানার্জনের আগ্রহ, সেটা আদতে অংকুরেই ঝরে যায়, অবিকশিত থেকে যায়। সে সংবাদপত্র বা
প্রচারপত্র ছাড়া আর কিছুই পড়তে পারে না। বই-পুস্তক পাঠে মনোযোগও দিতে পারে না, আনন্দও
পায় না। আমরা এভাবে পাঠ্যবইয়ের বাছাই করা অংশের (কেননা দক্ষ কোচ নির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ
অংশটুকুর প্রশ্নের উত্তর শেখান) ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে শিক্ষিত জাতি গঠন করছি! আখেরে
দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চকচকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েও অধূনা তরুণরা না পারে শুদ্ধ
বাংলা শুদ্ধ ইংরেজি লিখতে, না পারে জাতির শ্রেষ্ঠ কৃতি সম্পর্কে বলতে কিংবা পারে না
বিখ্যাত মনীষীদের কথা বা জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা
দিতে ।
আমাদেরই ব্যবস্থার
কারণে ছাত্র-অভিভাবক উভয়ের কাছেই স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টারের গুরুত্ব বেড়ে গেছে।
যেসব স্কুল ভালো ফল করছে খোঁজ নিলে দেখা যাবে তারাও কোচিং-এর অনুকরণে সাপ্তাহিক, মাসিক,
বিষয়ভিত্তিক, অধ্যায়ভিত্তিক হরেক পরীক্ষার জালে ছাত্রদের বেঁধে রেখেছে। আইন দিয়ে এ
ফলের লোভ আর পরীক্ষার মড়ক ঠেকানো যাবে না এবং এদের জ্বালানি নোটবইও বন্ধ হবে না। যদি
শিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য হয় পরীক্ষা তাহলে কেবল যে শিক্ষার উদ্দেশ্য খণ্ডিত সীমিত হয়ে
পড়ল তা নয়, এই সংকীর্ণ কিন্তু লোভনীয় উদ্দেশ্যকে ঘিরে বাণিজ্য তৈরি হওয়া স্বাভাবিক,
তৈরি করা সহজ। যদি ছাত্রের অন্যান্য বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানবিক গুণাবলী-দক্ষতা অর্জনের
দায়ও শিক্ষার ওপর থাকত তবে কোচিং সেন্টার বা গৃহশিক্ষক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে টেক্কা
দিতে পারত না।
আমি যে বিষয়টি
এখানে বলতে চাইছি তা কেবল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবেচ্য নয়, এটি হল জাতি গঠনের প্রশ্ন।
আমরা কি পরীক্ষা পাশের সংকীর্ণ মাপকাঠির ভিত্তিতেই জাতিগঠন করব নাকি আরও ব্যাপ্ত পরিসরে
মানুষকে বিবেচনায় নেব সেটি আগে ঠিক করতে হবে। পরীক্ষা পাশই যদি মাপকাঠি হয় তবে কোচিং-নোট
বই ব্যবসা কখনো বন্ধ করা যাবে না। এটি জাতির জন্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়।
আমরা কি লক্ষ্য
করছি শিশুরা পালে পালে যেসব কোচিং সেন্টারে ছুটছে সেগুলো একজাতের কারাগার, স্কুলগুলো
হল বন্দিশালা আর বাড়িগুলো বহুতল ভবনে খাঁচার মত ঝুলে থাকে। আর মাঠ, অবসর, বন্ধুবান্ধব,
যোগ্য নেতা, শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা ছাড়া শিশুরা কেবল পরীক্ষার ঘানি টানছে। শৈশবের জন্যে
বড়দের কাছ থেকে একটু মায়া একটু সহানুভূতি দরকার, ভাবনা দরকার, পরিকল্পনা চাই। সেটা
দিতে আমরা বড় কার্পণ্য করছি। সোনার ডিম পাড়ার জন্যে তৈরি হওয়ার আগেই হাঁসগুলোকে বন্ধ্যা
করে দিচ্ছি।
প্রত্যেকের
বাড়ির পরিবেশ ঠিক করা রাষ্ট্রের কাজ নয়, কিন্তু স্কুলের ভূমিকা ঠিক করা সম্ভব। তবে
তার আগে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক করতে হবে। জাতিগতভাবে আমাদের বুঝতে হবে যে পাঠ্যবইয়ের
বাছাই অংশের নোট পড়ে শিক্ষিত জাতি গঠন এবং যথার্থ মানুষ তৈরি করা সম্ভব নয়। বরং এই
খণ্ডিত বিকৃত শিক্ষার বাইরে থেকে হয়ত মানুষ হওয়া সম্ভব।
মূল জায়গাটা
ঠিক করে স্কুলকে সেভাবে গড়ে তুললে আপনিই মানুষ কোচিং-নোট বইয়ের পিছনে কড়ি ঢালবে না,
শ্রম দেবে না। আর তারপরে শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যটা শিশুদের জন্যে আরও সৃজনশীল সব উপকরণ
ও কাজের চ্যালেঞ্জ ভিত্তিক হয়ে উঠবে, তাতে মেধাবীরা অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারবে। জাতি
ও শিক্ষার নাভিশ্বাস থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।
***