Monday, September 8, 2014

কোন্ পথে চলবে বিএনপি

আবুল মোমেন

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাধারণত বিরোধী দলের মূল কাজ হল জনগণের পাশে থেকে দেশ ও জনস্বার্থে বিভিন্ন ইস্যুতে অবস্থান গ্রহণ। বক্তব্য প্রকাশ এবং নানা মাত্রার আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে তা করাই রেওয়াজ। এছাড়া জনগণের কোনো ভোগান্তির সময়ও তাদের পাশে দাঁড়ানো রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব।
বর্তমানে উত্তরবঙ্গে বন্যা হচ্ছে। বন্যা বেশ ভালো মতই হচ্ছে এবং বহু মানুষ জলবন্দি হয়ে পড়েছেন। পত্রপত্রিকার খবরে বোঝা যাচ্ছে ত্রাণ কাজ এখনও অপ্রতুল। তাছাড়া এসব অঞ্চলে বিপুল দরিদ্র মানুষ এমনিতেই যে কষ্টে থাকে তা জানা থাকলে এ সুযোগে তাদের ঘরবসতি ও জীবনমানের উন্নতির জন্যে কিছু মানবিক কাজ করে রাজনৈতিক দল লাভবান হতে পারে। এছাড়া গার্মেন্টস কারখানাকে ঘিরেও মানবিক তৎপরতা চালানোর সুযোগ রয়েছে।
সারাদেশে রাস্তাঘাটের বেহাল দশায় যোগাযোগ খাতে জনদুর্ভোগ চরম পর্যায়ে রয়েছে। কয়েকটি লঞ্চডুবি ও প্রচুর প্রাণহানিতে  এ খাতের ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি ধরা পড়েছে। এভাবে তালিকা দীর্ঘ করা সম্ভব।
বিএনপি এরকম কোনো ইস্যু নিয়েই আন্দোলনে নামছে না। সব সময় সব ইস্যুতে তাদের সুচিন্তিত বক্তব্য থাকে না। ভুক্তভোগী মানুষের পাশে দলটিকে দেখাও যাচ্ছে না। বলা যায়, প্রত্যক্ষভাবে মাঠ-পর্যায়ে জনসেবার রেওয়াজ যেন এ দলটির মধ্যেই নেই।
বিএনপি নেতা-কর্মীরা জানেন কোনো মতে সাধারণ নির্বাচনের সুযোগ তৈরি করা গেলে তাদের জয়লাভের সম্ভাবনাই বেশি। হয়ত তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে পরবর্তী নির্বাচনে বিএনপির জয় অবধারিত। ফলে দেখা যাচ্ছে তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য ও কর্মকা- মূলত সরকার পতন ও দ্রুত মধ্যবর্তী নির্বাচনকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে।  মনোভাবটা হয়ত এরকম, একবার নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ফিরে পেলে সব কাজই করা সম্ভব, করা হবে।
এই মনোভোবের কারণে দলের রাজনীতির জন্যেই কতকগুলো সমস্যা তৈরি হচ্ছে। প্রথমত, বিএনপি যে সরকারের বাইরে থাকলেও প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের ভূমিকা পালনে অসচেতন ও অক্ষম এ সমালোচনা সমর্থিত হয়। দ্বিতীয়ত, বিএনপির রাজনীতি একমাত্র এই দাবিকে ঘিরে আবর্তিত হওয়ায় একে অগ্রাহ্য করা কিংবা এটি আদায়ে সম্ভাব্য আন্দোলন ঠেকানোর জন্যে আওয়ামী লীগকে দল হিসেবে মাঠে না নেমে সরকারি নানা ব্যবস্থা ও বাহিনীর সহায়তার মাধ্যমেই কাজ সম্পন্ন করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে দেশের নানা অঞ্চলে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন গড়ে ওঠা ও দানা বাঁধানোর কোনো সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। তৃতীয়ত, সরকার পরিবর্তন ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জনকল্যাণের জন্যে যদি করাও হয়ে থাকে তা মূলত একটি আইন ও সাংবিধানিক বা বলা যায় আদর্শিক বিষয় কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে জনদুর্ভোগ ও জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় বলে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে না। তারা বোঝে এটা দলের নীতি-নির্ধারকদের এজে-া, এতে যুক্তি বা বক্তব্য হাজির করা তাদের এক্তিয়ারের বিষয় নয়। চতুর্থত, এভাবে চলতে থাকায় জেলা পর্যায়ের নেতা ও সারাদেশের কর্মীদের মধ্যে যথার্থ রাজনৈতিক কর্মসূচি ও আন্দোলন দাঁড় করাতে না পারার হতাশা ছড়াচ্ছে। ফলে দিনে দিনে দল ও দলীয় কাজকর্মে স্থবিরতা নামছে। সরকার শাসনদ- আরও শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণে রাখার ও চালানোর সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে।
নি:সন্দেহে এটি বিএনপির রাজনীতির জন্যে কঠিন সময়। এ সময় নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, সৃজনশীলতা এবং অঙ্গীকার ও সাহসী ভূমিকা প্রয়োজন ছিল। মানতেই হবে নেতৃত্ব এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। এ সূত্রে বলা দরকার বর্তমান সময়ে মুসলিম জাতীয়তাবাদের পুরোনো ধরণ ও ভাবনা নিয়ে রাজনীতিতে এগুনো যাবে না। সময়োপযোগী পরিবর্তনের তাগিদ বোঝার জন্যে নেতৃত্বে দূরদর্শিতা প্রয়োজন, আর তা সম্পাদন করার জন্যে প্রয়োজন সৃজনশীল হওয়ার ক্ষমতা। তারপর চাই কর্মীদের নিয়ে সরকারি দল ও বাহিনীর প্রতিবন্ধকতা ভেঙে মাঠে নামার সাহস। এ তিন ক্ষেত্রেই এখনও পর্যন্ত খালেদা জিয়া বা তারেক রহমান দলকে যথাযথ নেতৃত্ব দিতে পারেন নি।
বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতির বিবেচনায় আওয়ামী লীগের একটি বড় সাফল্য হল জামায়াতে ইসলামির গায়ে ভালোভাবে যুদ্ধাপরাধীর ছাপ মেরে দিতে পারা। তার ওপর, বর্তমান মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি এবং ইসলামি জঙ্গিবাদ উত্থানের সমস্যার আলোকে ওয়াহাবিপন্থাসহ সুন্নিধারা থেকে উদ্ভূত নানান কট্টরপন্থা সম্পর্কে মুসলমানদের মধ্যেও সচেতনতা ও সতর্কতা তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় জামায়াতে ইসলামকে রাজনৈতিক সঙ্গী রাখা এবং রাজনৈতিক কর্মকা-ে তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকা রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিচ্ছে বলে মনে হয়  না।
একটি খাঁটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপির উচিত ছিল ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠা বর্তমান সরকারের ভূমিকায় ধীরে ধীরে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হতে থাকা নাগরিকসমাজের বিভিন্ন ফোরামের সাথে সংযোগ বাড়ানো। এটি ফলপ্রসূ করতে হলে অবশ্য মুক্তিযুদ্ধ ও জামায়াত সম্পর্কে তাদের বক্তব্য পরিষ্কার করে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। অতি সম্প্রতি দলে ক্রমেই সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠতে থাকা সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তারেক রহমান ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বললেও দলীয় অবস্থান ও ভূমিকায় তার প্রতিফলন দেখা না গেলে এ কেবল সাময়িক রাজনৈতিক চাল বলেই গণ্য হবে। জনমনে কোনো গুরুত্ব পাবে না।
মনে রাখা দরকার, রাজনৈতিক অঙ্গনে কঠিন সময় ও প্রতিকূল চ্যালেঞ্জ একটি রাজনৈতিক দলের সামনে দলীয় ভাবমূর্তি, দলের প্রভাব এবং দল ও নেতৃত্বের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর বিরাট সুযোগ তৈরি করে। বস্তুত এভাবেই ষাটের দশকে পাকিস্তানের কর্তৃত্ববাদী শাসকের দমনপীড়নের মুখেই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বাঙালির জনপ্রিয় সর্ববৃহৎ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। বিপরীতে ক্ষমতায় থেকে সামরিক এজেন্সির সহযোগিতায় বিভিন্ন দলমতের মানুষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা দলের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক দুর্বলতা আজ প্রকট হয়ে ধরা পড়ছে। এতকাল বিএনপির নেতা-কর্মীরা দলের এই সংকটের সাথে পরিচিত হন নি, কারণ তেমন বাস্তবতা তৈরি ছিল  না। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আজ তা প্রকাশ হওয়ার পরে দলের নেতৃত্বকে পরিবর্তন-সংশোধনের বিষয় উপলব্ধি করতে দেখা যাচ্ছে না। বরং সরকারের চাপের মুখে তাদের আচরণ ও ভূমিকা দিশাহীন শিক্ষানবীশ রাজনীতিকের মত মনে হচ্ছে। ফলে কর্মসূচিগুলো যে নামকাওয়াস্তে দায়সারাগোছের কাজ তা বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না। নিজেরাসহ কেউই এগুলোর ব্যাপারে এখনও সিরিয়াস নন। এভাবে চললে আগামী নির্বাচনে আপনা-আপনি বিজয় এসে ধরা দেবে বলে নিশ্চিত থাকার সুযোগ বিএনপির জন্যে আর থাকবে না। আর কর্মীদের ছাপিয়ে ততদিনে হতাশার ছোঁয়া জনমনেও পৌঁছাবে।
বিএনপির ভবিষ্যত বর্তমানে নিহিত রয়েছে। বলা যায় বর্তমান সময় বিএনপির জন্যে ক্রান্তিকাল হিসেবে এসেছে। দেখা যাক তারা কি আওয়ামী লীগের মত সকল প্রতিকূলতা পেরিয়ে টিকে থাকতে পারবে নাকি মুসলিম লীগের মত বড় ধরনের পরাজয়ের ধাক্কায় ধীরে ধীরে কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে।