Monday, September 14, 2015

মিলানেও উচ্চারিত হল সংস্কৃতির গুরুত্বের কথা

আবুল মোমেন

আরব বিশ্বে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের যোদ্ধাদের হাতে একের পর এক প্রাচীন সাংস্কৃতিক নিদর্শন ধ্বংস হওয়ার পর রণাঙ্গনের বাইরেও প্রতিকার নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক যে সংস্থাটি মানবসভ্যতার এসব মূল্যবান প্রত্নসম্পদ রক্ষার কাজে নিয়োজিত সেই ইউনেস্কো সঙ্গতভাবেই এগিয়ে এসেছে। এরই রেশ ধরে ইতালির সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রী বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন ডেকেছিলেন মিলানে। মিলান এক্সপো ২০১৫-এর সম্মেলন কক্ষে এটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে আমাদের সংস্কৃতি সচিবের সাথে আমারও যোগ দেওয়ার সুযোগ হয়েছিল।
এতকাল সাংস্কৃতিক নিদর্শন রক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ ছিল প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা দুর্ঘটনা অথবা পাচারকারীদল। কিন্তু এরকম স্বেচ্ছাপ্রণোদিত পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ এক অভাবিত ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। এরকম পরিস্থিতি অভিনব, এরকম প্রতিপক্ষও কল্পনাতীত ছিল সকলের। মিলানে আলোচনার একটি মোদ্দা শিরোনাম ছিল : জাতিসমূহের মধ্যে সংলাপের উপকরণ হিসেবে সংস্কৃতি। এতে উপস্থিত ৮৫টি দেশের মন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের মধ্যে দু’দিনে (৩১ জুলাই ও ১ আগস্ট) ৫৭ জন কথা বলেছেন। প্রত্যেকের জন্য বরাদ্দ সময় ছিল ৪ মিনিট করে। ইতালির সংস্কৃতি ও পর্যটন বিষয়ক মন্ত্রী ও লেখক দারিও ফ্রান্সেসচিনি এতসব কেউকেটা ব্যক্তিদের সামলেছেন ভালোভাবেই। মিনিটখানেকের বেশি বাড়তি সময় কেউ নিতে পারেন নি। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রীকে বরাদ্দ সময়ের মধ্যেই কথা শেষ করতে হয়েছে। মাইক্রোফোনে কলম বেশ জোরেই ঠুকে সময়-সচেতন করেছেন সকলকে। বক্তৃতায় প্রত্যেকেই নিজ নিজ সংস্কৃতির মানবিক ঐতিহ্যের দিক তুলে ধরেছেন, পাশাপাশি সংস্কৃতি আদানপ্রদানের গুরুত্বও স্বীকার করেছেন। বাঙালি সংস্কৃতির মানবিক ঐতিহ্যের ধারা এবং বর্তমান সরকারের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী কঠোর ভূমিকার কথা আমাদের দিক থেকে সংস্কৃতি সচিব ভালোভাবে তুলে ধরেছেন।
মানবিক সংস্কৃতির ধারা ও সাংস্কৃতিক সম্পদ রক্ষা যে যুদ্ধের মাধ্যমে সম্ভব নয় তা সকলেই বুঝতে পারছেন। এটি কেবল স্থানীয় কিছু মানুষের সচেতনতাতেও সম্ভব হচ্ছে না। এর জন্যে সকলের চিন্তার নৈকট্য দরকার এবং তাই সব দেশ মিলে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলা জরুরি। এভাবে একটি সম্মিলিত বৈশ্বিক প্রয়াস দ্রুত প্রণীত ও বাস্তবায়িত হওয়া দরকার। সেই তাগিদ থেকেই মিলানের এ সম্মেলন।
বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের এ উপলব্ধি উপস্থিত নগণ্য আমাকে বিশেষভাবে নাড়া দিয়েছে। এর একটি বিশেষ কারণ আছে। ১৯৭৫-এর পট-পরিবর্তনের পর দেশে যখন আমাদের জন্যে দমবন্ধ-করা পরিবেশ তখন তেমন কিছু না ভেবে শিশুদের আনন্দে-সৃজনে মাতিয়ে রাখার যে কাজ শুরু করেছিলাম তা পাঁচ বছরের মধ্যে শিশুশিক্ষার কাজে টেনে নিয়েছিল আমাদের। কাজটার প্রাথমিক তাড়না এসেছে প্রতিষ্ঠান রক্ষার প্রয়োজনে। তার সাথে ছিল শিশুদের মানসগঠনে বুনিয়াদ তৈরিতে ভূমিকা রাখার তাগিদ। বুঝতে পারছিলাম শিক্ষা হল মূল জায়গা, সেখানে কাজ না হলে তাদের মনে স্থায়ী প্রভাব ফেলা যাবে না।
কাজ শুরু করে বুঝতে পারলাম প্রথাগত শিক্ষার ধারা আমাদের কাজে আসবে না। নিজেদের পথ নিজেদেরই তৈরি করতে হবে। মাটি তৈরি না করেই শিশু-চারার কাছে ফল চাওয়ার যে প্রচলিত ধারা তা আমাদের অন্যায় এবং নিষ্ঠুরতা বলে মনে হয়। আমরা দুটো বক্তব্যের ওপর জোর দিয়েছিলাম - ভয়হীন আনন্দময় পরিবেশে শিক্ষা এবং পরোৎকর্ষ (perfection) নয় অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি। অভিভাবকদের ডেকে বললাম আমাদের ওপর আস্থা রাখতে, ব্যক্তিগতভাবে আমি ও অধ্যক্ষা তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের জিম্মাদার হতে চাইলাম। আমাদের কথা ছিল - এ বয়সে অন্তত তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ওরা কেবল গ্রহণ, সংগ্রহ ও সঞ্চয় করবে - এর পরিমাপের দায়িত্ব থাকবে কেবল স্কুলের। স্কুলই দেখবে তাদের ভাণ্ডারে কতটা ছড়া, কবিতা, গল্প, নানা তথ্য, বিভিন্ন ধারণা, জ্ঞানের কথাবার্তা জমা পড়ছে এবং যা জমছে তার মান কেমন। এ পর্যায়ে তাদের গোগ্রাসে নিতে দিন - সব ইন্দ্রিয় পূর্ণ সত্তায় নিতে থাকুক। আমরা বলেছিলাম, একটু চ্যালেঞ্জ দিয়েই, ওদের ভিত্তির পরিসরটা আমরা অনেক বড় ও গভীর করে দেব, তাতে বড় হয়ে কোনো পর্যায়েই আর তাদের ঠেকতে হবে না। তারা নিজের শক্তিতেই এগিয়ে যাবে। প্রথম বছরে আমাদের ওপর আস্থা রাখলেন ১৫ জন অভিভাবক। তারা নানা রকম পরিবার থেকে এসেছেন - উচ্চশিক্ষিত চাকুরে, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, মাঝারি দোকানদার, তবে বেশির ভাগ ছিল নিম্নমধ্যবিত্ত চাকুরে পরিবারের ছেলেমেয়ে। বলাই বাহুল্য, অভিভাবকরা নিশ্চিন্ত ছিলেন না, এরকম নিরীক্ষাপ্রবণতার ঝুঁকিটা তাঁদের সবসময় ভাবিত রাখত। অধ্যক্ষা হিসেবে শীলা মাঠে থেকে অভিভাবকদের প্রাত্যহিক চাপ সামলে গেছে। সবার কথা ছোট্ট পরিসরে বলা যাবে না, প্রথম যে ছাত্রটি ভর্তি হয়েছিল, টিঅ্যাণ্ডটির সীমিত আয়ের চাকুরে পিতার সন্তান, সে এখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের প্রধান। এভাবেই আমরা চলেছি, এবং চেয়েছি চালিয়ে যেতে। 
আমরা চেয়েছি ওদের মনের সবকটা জানালা সবসময় খোলা রাখতে। পরীক্ষা এক ধরনের কপাট, আবদ্ধতা তৈরি করে। একে বড় করে তুলে বাধার প্রাচীর বানিয়ে কোনো চাপ তৈরি করতে চাই নি। প্রত্যেক ছাত্র গাইতে পারত, আবৃত্তি পারত, গল্পবলা, বিতর্ক - সবই পারত (এখনও স্কুলে ছাত্রসংখ্যা অনেক বাড়ার পরও বেশিরভাগই পারে)। পঁচিশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে প্রাক্তনীদের স্বতস্ফূর্ত ও সপ্রতিভ সব পরিবেশনা দেখে উপস্থিত বহুজাতিক কোম্পানির এক প্রধান কর্তাকে এদের এই সপ্রতিভতা ও পারঙ্গমতা চমকে দিয়েছিল।
এসবই শিশুদেরই কৃতিত্ব। আমরা কেবল তাদের সুপ্ত ক্ষমতাগুলো জাগিয়ে তুলতে ও রাখতে চেয়েছি, চেষ্টা করেছি অনাহুত অন্যায্য চাপের কারণে এসব যেন নষ্ট না হয়।
আশির দশকের মাঝামাঝি থেকেই আমরা বাইরেও একটু বলতে থাকলাম - শিশুশিক্ষা মূলত একটি সাংস্কৃতিক কাজ। গানবাজনা বা কলা (art) অর্থে নয়, সৃজনশীলতা, সুরুচি, সৌন্দর্য এবং মাত্রাজ্ঞানের মত গুণের চর্চা ও তা আয়ত্ত্ব করাই সংস্কৃতি চর্চা। নীতিবোধ ও মানবিকতার বিষয়ে সংবেদনশীলতাও এতে তৈরি হয়ে যায়। এই শেখার নৈপুণ্য মেলে কেবল যথার্থ সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে। তাই শিক্ষার সুফল পাওয়ার শর্ত হল উপযুক্ত মানবিক সাংস্কৃতিক বাতাবরণ নির্মাণ। ফুলকিতে আমরা এই চেষ্টাই করেছি। প্রাথমিকে এভাবে তৈরি হলে তারা পরবর্তী উচ্চতর ধাপগুলো যোগ্যতার সাথে পেরুতে পারে।
যত দিন গেছে, দেশের অর্থনৈতিক বা মানুষের বৈষয়িক উন্নতি হলেও, সামাজিক সংকট ঘনীভূত হয়েছে। সামরিক ও ছদ্ম সামরিক শাসন তো বটেই এমনকি গণতান্ত্রিক আমলেও এ সংকট কেবল ঘনিয়েছে। এর প্রতিষেধক যে যথার্থ শিক্ষা তা কেউই তেমন ভাবেন নি। এক সময় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ, মাদক ও অপরাধ মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে অনেককেই ভাবিত করেছে। প্রচলিত শিক্ষার সীমাবদ্ধতা নজরে পড়ল এবং মানসম্পন্ন আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা একটি বড় কাজ বলে মনে করলেন অনেকেই। এ ধারায় দেশের অগ্রণী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট প্রতিষ্ঠা করল নালন্দা ২০০১ সনে। এ স্কুল এখন শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অনেকেরই মনোযোগ পাচ্ছে। এটা আশার কথা। কিন্তু এ দেশে যে স্কুলগামী ছাত্রের সংখ্যা চার কোটির অধিক। তাদের পরীক্ষামুখী মুখস্থ বিদ্যার দু:স্বপ্নের (আইনস্টাইনের ভাষায়) মধ্যে ফেলে রেখে বিচ্ছিন্ন কয়েকটি উদ্যোগ কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারবে সমাজে!
তবে আশার কথা সরকারের ভিতরেই অনেকেই বিষয়টা নিয়ে ভাবছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সচেতন, সংস্কৃতিমন্ত্রী বিষয়টা বোঝেন ও কিছু করতে আগ্রহী, এবং শিক্ষামন্ত্রীসহ মন্ত্রি-পরিষদের আরও অনেকেই হয়ত এ নিয়ে ভাবেন। সচিবালয়েও কর্মকর্তাদের অনেকের মধ্যে ইতিবাচক ভাবনা রয়েছে। আমরা বুঝি অভ্যস্ত ধারা থেকে নতুন একটি ধারায় আসার ঝুঁকি নিয়েও তাঁদের ভাবনা-দুর্ভাবনা রয়েছে। এটা আদতে আলাপ-আলোচনা ও মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষামূলক কাজ করে ক্রমে সর্বত্র বাস্তবায়নের বিষয়। তবে কোনো অবস্থাতেই সময়ক্ষেপণের সুযোগ নেই। মাত্রাতিরিক্ত পরীক্ষার অব্যাহত মুখস্থের প্রবণতাই কেবল বাড়ছে না চাপের মধ্যে থাকা ছাত্রদের মাদক ও ধর্মান্ধতাসহ অন্যান্য ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। নিজেদের জানাবোঝার ঘাটতি সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই হচ্ছে না এবং পুঞ্জিভূত ঘাটতির বিপুল ফাঁক নিয়ে তারা সর্বোচ্চ শিক্ষার দুয়ারে এসে রীতিমত হোঁচট খাচ্ছে। সেখানে তৈরি হয়েছে জ্ঞানের দুর্ভিক্ষের ভয়াবহ এক বাস্তবতা।
মিলানের সম্মেলন থেকে কেন ফুলকির কথায় এসেছি সেটা আশা করি পরিষ্কার হয়েছে। পচাত্তরের পটপরিবর্তন এবং পরবর্তী অবক্ষয়ের মুখে ত্রিশ বছর আগে যে কথাটি ফুলকি বলেছিল, আজ দ্যাখা যাচ্ছে তা অন্য এক ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে বিশ্বনেতৃবৃন্দের চিন্তায়ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।
আসলে একজন মানুষ যতটা সামাজিক জীব ততটাই সাংস্কৃতিক প্রাণী। শিক্ষা, ধর্ম, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, খাদ্য, সজ্জা, ভাষা, শিল্প - মানুষের চর্চিত ও আচরিত এবং সৃষ্ট ও কৃত সকল কর্ম মিলে তৈরি হয় তার সংস্কৃতি। এর গোড়াপত্তন শৈশবে না হলে সর্বনাশ, কারণ এসময়ই মনোজগতের ভিৎ তৈরি হয়ে যায়। বিষয়টা ফ্যাল্না নয়, জাতির ভবিষ্যত এবং দেশের অগ্রগতির সাথেই এটি যুক্ত।

***