Monday, February 24, 2014

একুশের বিকাশ কোন্ পথে ঘটছে?

আবুল মোমেন

১.
একুশে উদযাপনের ধরণ ও তাৎপর্য উভয়ই যেন বদলে গেছে। গোড়ায় লক্ষ্যটা কেন্দ্রীভূত ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অধিকার আদায়ে। সেই সংগ্রামের চেতনার উৎস ছিল এই দিনটি যা তখনও শহীদ দিবস হিসেবেই অভিহিত হত। কিছুদিনের মধ্যে ভাষা থেকে সাহিত্য এবং সাহিত্য থেকে সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে পড়ল এ চেতনার প্রভাব। কারণ সাংস্কৃতিক অধিকার আদায়ের প্রশ্ন জরুরি হয়ে দেখা দিলে একুশেই হল সেই চেতনার প্রতীক। ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির সম্মিলনে জনমনে জোরদার হল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা। বলাই বাহুল্য, এই চেতনারও অনুপ্রেরণা এলো একুশে ফেব্র“য়ারি থেকেই। ফলে কালক্রমে স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সকল উদ্দীপনার উৎস হল একুশ যার প্রতীক ছিল শহীদ মিনার। এভাবে একুশে ফেব্র“য়ারি হয়ে উঠল আমাদের জাতীয় দিবস এবং জাতীয় জীবনে তাৎপর্যবাহী দিন আর শহীদ মিনার তারই প্রতীক।
গোড়া থেকেই একুশে পালনের মূল অনুষঙ্গ ছিল দেশপ্রেম ও উদ্দীপনার গান আর জাতীয় চেতনা লালন ও বিকাশের উপযোগী সাহিত্য। এক সময় একুশের স্মরণিকা প্রকাশ আর প্রভাতফেরী ও বৈকালিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন ছিল আবশ্যিক কাজ। জাতির মননের প্রতীক বাংলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠা একুশের চেতনারই সম্প্রসারণ। এ প্রতিষ্ঠান তাই বরাবর দিনটি সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালন করে এসেছে। স্বাধীনতার পরে এর পরিসর ও ব্যাপ্তি বেড়েছে। ক্রমে একুশের সাথে বইমেলা এবং বইমেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশনার যোগ ঘটে গেল। এখন একুশের মাস জুড়ে বাংলা একাডেমীর বইমেলা, সেমিনার আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রভাব দেশব্যাপী ছড়িয়ে গেছে। এটিই জাতীয়ভাবে একুশের মুখ্য অনুষ্ঠান হয়ে উঠেছে। এর প্রভাব সারা দেশে পড়েছে, প্রায় সব জেলাশহরে আজ ছোট আঙ্গিকে হলেও বইমেলা আয়োজিত হচ্ছে, সর্বত্র কিছু কিছু প্রকাশনাও হয়ে চলেছে।
আজকে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, একুশে ফেব্র“য়ারিকে কেন্দ্র করে দেশে প্রকাশনা শিল্পের এতটাই বিস্তার ঘটেছে যে একে প্রকাশনা শিল্পের বিপ্লবও বলা যাবে। প্রতিদিন বাংলা একাডেমীর বই মেলায় ১০/১২টা নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়, সারা মাসে অন্তত হাজার তিনেক নতুন বই প্রকাশিত হয়। দেশে প্রকাশনার সংখ্যাও বেড়েছে, কেবল বাংলা একাডেমীর মেলাতেই পাঁচ শতাধিক সংস্থা তাদের বই নিয়ে অংশ নেয়, এর মধ্যে শ’খানেকের ব্যবসাও খারাপ নয়। প্রকাশকবৃন্দ প্রায় সারা বছরই এই মেলাকে কেন্দ্র করেই তাঁদের প্রকাশনার পরিকল্পনা করেন। আমাদের প্রকাশনা-শিল্প মূলত একুশে-কেন্দ্রিক।
বাংলা একাডেমীর পাশাপাশি শিল্পকলা একাডেমী, শিশু একাডেমী, জাতীয় জাদুঘর, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ জাতীয় ও আঞ্চলিক নানা সংগঠন ব্যাপক আয়োজনে একুশে উদযাপন করে থাকে। বিভিন্ন  নগরে কর্পোরেশন কিংবা নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী সম্প্রদায়গুলো একুশে উদযাপনে সোৎসাহে অংশ নিচ্ছে, নিজেদের স্বতন্ত্র আয়োজনও করছে। এমনকি সাহেবিয়ানায় অভ্যস্ত ক্লাবগুলো কিংবা ইংরেজিমাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সাড়ম্বরে একুশে উদযাপনে মেতে উঠছে!
২.
ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণে দেশব্যাপী নানা আয়োজনে উদযাপনের মাধ্যমে একুশে আজ যেন জাতীয় উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে। একুশেকে কেন্দ্র করে দেশের প্রকাশনা শিল্পের বিস্তার যেমন ঘটেছে তেমনি এর ব্যবসায়িক দিকটি মূলত একুশের  ওপর নির্ভরশীল। একুশে এখন মূলত উৎসব এবং বাণিজ্যের ভিত্তিতেই মূল্যায়িত হচ্ছে। প্রকাশকরা বলছেন এ বছর ব্যবসায় ভালো হয়েছে কিংবা বলেন ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দিয়েছে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনও বাদ নেই, এখানেও ব্যবসায়ের প্রভাব বাড়ছে। এছাড়া বুটিক, তৈরি পোশাক, খাবারদাবারসহ আনুষঙ্গিক আরও ব্যবসায়ের আওতা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে।
নিশ্চিন্তে বলা যায়, যেহেতু বাণিজ্য প্রসারিত হচ্ছে, লক্ষ্মীর স্পর্শে ধন্য হয়েছে একুশে তাই এর বাড়বাড়ন্ত অব্যাহত থাকবে। আশার কথা, এই বাণিজ্যের মূল ভিত্তি এখনও সারস্বত সাধনা। লক্ষ্মী-সরস্বতীর যুগল সম্মিলনে একুশের অগ্রযাত্রা ভালোভাবে চলবে এ আশাবাদকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
হয়ত প্রশ্ন উঠতে পারে লক্ষ্মী না সরস্বতী কার প্রভাব বাড়ছে বেশি? তাছাড়া একুশে কেবল সরস্বতীর সাধনার বিষয়ও ছিল না, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংগ্রামের সাথে সাথে এতে ধ্বংস ও সৃষ্টির ব্যাপারটা হয়ে উঠেছিল মুখ্য। সেই শৈবশক্তির ভূমিকা কি আজ বিনোদন ও বাণিজ্যের আগ্রাসনে একেবারেই বাদ চলে যাচ্ছে?
৩.
একুশে উদযাপনের ব্যাপ্তি এখন বিশ্বময়, অন্তত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে দিনটির স্বীকৃতি আসার পর থেকে। কিন্তু এ দেশে মাতৃভাষা বাংলা তো আজ কাক্সিক্ষত আদৃত ভাষা নয়। সবাই তো ছুটছেন ইংরেজির পেছনে, ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের রমরমা বাড়ছে, ব্যবসাসফল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যাচর্চার বাহন ইংরেজি, সেদিকেই ঝুঁকছে বেশির ভাগ তরুণ-তরুণী। কম্প্যুটার আর মোবাইলেও ভাঙাচোরা ক্ষতবিক্ষত ইংরেজির চর্চা হচ্ছে। একসময় রোমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল এ জাতি, আজ তাদের উত্তরসুরীরা স্বেচ্ছায় সাগ্রহে বাংলা লিখছে সেভাবে কিংবা তারই সাঁটভাষ্যে আলাপচারিতা চালাচ্ছে। রেস্তোঁরা, ক্যাম্পাস, মিলনায়তন, বাজার, পথঘাটে কান পাতলে তরুণ ও কিশোর, এমনকি শিশুদের কণ্ঠে ইংরেজি অথবা বাংলিশ কথোকথন কানে আসবে। যেটুকু বাংলা বলছে তাও আঞ্চলিক কিংবা আঞ্চলিকের খিচুড়ি ভাষা। খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাদের মধ্যেই রয়েছে একুশের মেলায় প্রকাশিত বইয়ের গর্বিত লেখক, একুশে উপলক্ষে পুরস্কৃত কবি, টকশো মাতানো কথাকার, সেমিনারের চিন্তাশীল বক্তার সন্তান বা পৌত্র-দৌহিত্র, পৌত্রী-দোহিত্রীরাই যারা ইংরেজি-বাংলিশে বাৎচিৎ করে কান ঝালাপালা  করছে।
যদি প্রকাশিত বইগুলো ভালোভাবে মনোযোগ দিয়ে পড়ি বা পড়ার চেষ্টা করি তাহলে প্রথম ঘা খেতে হবে অধিকাংশ লেখকের ভাষাগত দুর্বলতায়, তারপর অতৃপ্তির কারণ হবে লেখায় চিন্তার মৌলিকত্বের অভাব। মাতৃভাষার ব্যবহারে এক ধরনের অরাজক অবস্থা চলছে, অপরিণত বুদ্ধির ছাপ যত্রতত্র।
এদেশে সাহিত্যচর্চার দিকে ঝোঁক বেড়েছে, বই প্রকাশের হিড়িক পড়েছে, কবিতা ও উপন্যাসের কমতি নেই। নব্য লেখকদের অনেকেরই প্রথম লেখাই বই আকারে বেরুচ্ছে, কোনো কোনো নব্য লেখক একসাথে এক ডজন বইও প্রকাশ করছেন। একুশে উপলক্ষে যত বই বেরুচ্ছে তার অর্ধেকের বেশি লেখক নিজের টাকায় বের করেন। এতে নৈরাজ্যের নদে কূলপ্লাবী জোয়ার বইছে। দুটি কারণে এই নৈরাজ্য ঘটে চলেছে-দেশে লেখক বাড়লেও প্রকৃত সম্পাদক ও সমালোচক তৈরি হচ্ছে না। কিংবা লেখকদের দাপটে সম্পাদক ও সমালোচকরা হাল ছেড়ে দিয়েছেন। এঁরা তো হলেন ভাষা ও সাহিত্যের অভিভাবক ও পাহারাদার। এ সমাজ সবক্ষেত্রেই মুক্তকচ্ছ থাকতে চাইছে, নব্যধনী যেমন আইন-আদালতের তোয়াক্কা করে না, সবই নিজের কব্জায় রাখতে চায়, তেমনি নব্য লেখককূলও প্রশংসা-স্বীকৃতির দায় নিজেদেরই আওতায় রাখতে চান। এ প্রভাব ক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক পুরস্কার-স্বীকৃতি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে।
এ অবস্থায় বাংলাদেশে আজ বাংলা ভাষার  ও সাহিত্যের খাঁটি অভিভাবক এবং যোগ্য পাহারাদার নেই। ভাষার প্রতি সুবিচার করতে পারছি না আমরা, ভাষা চর্চায় কোনো নীতি মানছি না। যখন আমাদের পূর্বসুরীরা ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তখন কেবল বাংলার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির অভাব ছিল, কিন্তু কি শিক্ষা কি গণমাধ্যম কি সমাজজীবন সবখানে বাংলারই রাজ্যপাট ছিল রমরমা। আজ সাংবিধানিক স্বীকৃতি আছে বাংলার, এমনকি একুশের কপালে বৈশ্বিকে স্বীকৃতিও জুটেছে, কিন্তু এ ভাষা শিক্ষাসহ সমাজ-জীবনের সবখানে দুয়োরানি হয়ে আছে।
ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়ে ওঠায় একুশে উদযাপন নিয়ে আর ভয় নেই, কোনো শক্তিই এই টাকার টঙকারের প্রতি বধির হবে না। কিন্তু সরস্বতীর কী হবে? সারস্বতসাধনাই যদি সংকটে থাকে তাহলে একুশের আর থাকে কি?

###

Wednesday, February 19, 2014

বিভ্রান্তির নাম আল-কায়দা

আবুল মোমেন

বাংলাদেশকে নিয়ে আল-কায়েদার শীর্ষ নেতার বক্তব্য নি:সন্দেহে সরকার ও সচেতন নাগরিকদের জন্যে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তবে এ ঘোষণার পিছনে আল-কায়েদার সক্রিয় ভূমিকা কতটা তা এখনও পরিস্কার নয়। দেখা যাচ্ছে আয়মান আল জাওয়াহিরির এই বক্তব্য সম্পর্কে গত ২৪ জানুয়ারি মার্কিন গবেষণা সংস্থা জেমসটাউন ফাউন্ডেশনের সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত নিয়মিত প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়েছিল। ইউটিউবে দেখা যাচ্ছে জাওয়াহিরির স্থিরচিত্রের সাথে উর্দুতে ২৯ মিনিটের একটি ভাষণ প্রচারিত হয়েছে। আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়, কণ্ঠস্বরটি কি জাওয়াহিরির নাকি অন্য কারো। সেই সাথে পুরো বিষয়টি খাঁটি নাকি সাজানো সে প্রশ্নও উঠবে।
আমাদের জন্য এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এর পেছনে বাংলাদেশের কারা বা কোন-কোন সংগঠন যুক্ত আছে তা জানা। আল-কায়েদা একটি স্বঘোষিত জঙ্গি সংগঠন। এ কথাও ঠিক বাংলাদেশের বেশ কিছু সংগঠন সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসী। এ ধরনের কিছু সংগঠনের বেশ কিছু হিংসাত্মক তৎপরতার কথা আমরা জানি। বিশেষভাবে বিএনপির ২০০১-২০০৬ আমলে এ ধরনের তৎপরতা অনেক বেড়েছিল। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা, উদীচী সম্মেলন, সিপিবির সভা, ছায়ানটের বর্ষবরণ, নেত্রকোণায় প্রেক্ষাগৃহ এবং একইদিনে সব জেলা শহরে বোমা বিস্ফোরণ, বিচারক হত্যা ইত্যাদি অনেগুলো ভয়ানক ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। দুর্ভাগ্যের বিষয় সেই সময়ের সরকার ঘটনাগুলোর হোতাদের বিচারে আন্তরিকতার পরিচয় দেয় নি, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের আড়াল করার চেষ্টা করেছিল। পরবর্তীকালে মহাজোট সরকারের আমলে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা হয়েছে। তখনই তদন্তে জানা গেল এদের অনেকেরই সম্পর্ক রয়েছে দেশে জামায়াতে ইসলামির সাথে এবং আন্তর্জাতিকভাবে কোনো কোনো জঙ্গি সংগঠনের সাথে।
 ২০০৮ সনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর যখন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের বেশ ক’জন শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার ও বিচারের সম্মুখীন হলেন তখন দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধ, সরকার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও এর প্রক্রিয়া নিয়ে বিদেশে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারণা চালানো শুরু হয়। প্রচারণার জন্যে একদিকে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ এবং অন্যদিকে ব্রিটেনসহ শক্তিধর কিছু পশ্চিমা দেশকে বেছে নেওয়া হয়। গত বছর  ৫ মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা-সমাবেশকে কেন্দ্র করেও এসব দেশে একইরকমের প্রচারণা চালানো হয়। আর মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের রায় ঘোষিত হওয়ার পরও এ ধরনের প্রচারণা জোরদার করা হয়।
দেখা যাচ্ছে জামায়াত তাদের নেতাদের বিচারকে কেন্দ্র করে যেসব প্রচারণা চালিয়েছে এবং হেফাজতের সমাবেশ ভাঙাকে কেন্দ্র করে পুলিশি তৎপরতা নিয়ে যেসব প্রচারণা চালানো হয় তার সাথে বর্তমানে আল-কায়েদা প্রধানের নামে যে ভিডিও বার্তা প্রচারিত হয়েছে তার বক্তব্য প্রায় হুবহু মিলে যায়। সে সময়ও এ সরকারকে ইসলামবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং সরকারের কর্মকাণ্ডকে ইসলামের নবী ও মুসলিম উম্মার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করা হয়। তাছাড়া সরকারকে ভারতপন্থী এবং তাদের হাতে দেশ ভারতের কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে বলে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তাও খুবই পরিচিত ভাষ্য। আল-জাওয়াহিরি এমন কথাও বলেছেন, ‘বাংলাদেশের রাজপথে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। তাদের অপরাধ ছিল একটাই, ইসলামবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের সঙ্গে কতিপয় বিপথগামী নাস্তিক্যবাদীর যোগসাজশের প্রতিবাদে তারা রাস্তায় নেমেছিল।’ বোঝা যাচ্ছে ইঙ্গিতটা হেফাজতে ইসলামের ৫ মে’র সমাবেশের ওপর পুলিশি অ্যাকশনের দিকেই। এ ধরনের কথা ঐ সময়ও হেফাজতের পক্ষ থেকে এবং জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী কোনো কোনো গোষ্ঠীর তরফ থেকে চালানো হয়েছিল। মাঠ পর্যায়ে কথাবার্তা বলে দেখা গেছে সরলপ্রাণ মাদ্রাসা-ছাত্রসহ অনেক ধর্মভীরু সাধারণ মানুষ হাজার
হাজার মানুষ হত্যার এই তথ্য বিশ্বাস করেন। আমরা বুঝতে পারি দেশের বিপুল সংখ্যক সরলবিশ্বাসী সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে দলে টানার জন্যে এ ধরনের প্রচারণার কৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে।
এখন দেখা যাচ্ছে আয়মান আল-জাওয়াহিরির বক্তব্যের সাথে জামায়াতে ইসলামি এবং হেফাজতে ইসলামের সমর্থকদের বক্তব্য ও প্রচারণায় মিল রয়েছে। ফলে আল-কায়েদাকে এ কাজে লাগানোর পেছনে এ দুই সংগঠনের কিছু ভূমিকা থাকাই স্বাভাবিক। অবশ্য এ তথ্য প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথেই হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ দুই নেতা বিবৃতির মাধ্যমে এর সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন। যাই হোক, এ ব্যাপারে তদন্ত করেই সত্য পাওয়া যাবে।
আমরা জানি, আমাদের দেশে সেই ১৯৪৭ সালের পর থেকেই ইসলাম-বিপন্ন এই ধুয়া তুলে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়, যাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ধর্মান্ধ শক্তির হাতেই থাকে। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিকে বরাবরই এরা ধর্মহীন ও ভারতের সেবাদাস ইত্যাদি সমালোচনার মাধ্যমে ঘায়েল করতে চেয়েছে। আমাদের আশা ছিল গত ষাট বছরের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে মানুষ এ ধরনের যুক্তির ভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। গণতান্ত্রিক ধারার প্রধান দল আওয়ামী লীগও তার এই বিরুদ্ধ সমালোচনার বাধা অনেকটাই অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের জনসংখ্যার প্রায় সমান মুসলিম জনসংখ্যা সম্বলিত দেশ ভারত সম্পর্কেও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এখনও বেশ কিছু মানুষ পুরোনো ধ্যান-ধারণা আকড়ে রয়েছেন।
তবে এখানে আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। পশ্চিমের উন্নত বিশ্বের ঔপনিবেশিক ও সা¤্রাজ্যবাদী ভূমিকার অবসান আজও হয় নি। গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকে এশিয়া-আফ্রিকার পরাধীন দেশগুলো মুক্তি পেয়েছে, এরপরে সত্তর-আশির দশকে বিপ্লবী সংগ্রাম চালিয়ে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোও উন্নত বিশ্বের অর্থনৈতিক শোষণের শৃঙ্খল থেকে অনেকটাই মুক্ত হয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এ সত্ত্বেও সা¤্রাজ্যবাদ নতুন কায়দায়, বিশেষত বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্পদ ও বাজারের ওপর তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছে। তারা এই আধিপত্য ধরে রাখার জন্য চাতুরি, বঞ্চনা এবং সর্বোপরি নির্মম অত্যাচার ও ধক্ষংসযজ্ঞ চালিয়ে যেতে কসুর করে না। আমরা দেখেছি জ্বালানি তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তেল সম্পদের ওপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব চালিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমের বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো। তাদের এই স্বার্থের পথে তারা ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার গাদ্দাফিকে বাধা হিসেবে দেখেছে এবং অত্যন্ত কৌশলে, নির্মম ছলনার মাধ্যমে এবং নিষ্ঠুর সামরিক অভিযানের ভেতর দিয়ে তাঁদের হত্যা করে সরকারের পতন ঘটিয়ে নিজেদের পছন্দের পুতুল সরকার বানিয়েছে। ইরান ও সিরিয়াকে সা¤্রাজ্যবাদ তাদের স্বার্থ হাসিলের পথে বাধা হিসেবে গণ্য করছে বলেই এ দুই সরকারের পতনের জন্যে নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে তাদের গালভরা গণতন্ত্রের বুলির পরিণতিতে ইরাক ও লিবিয়া আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, দুই দেশেই হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং দু’টি দেশই দীর্ঘমেয়াদী অরাজকতার সম্মুখীন হয়েছে। গণতন্ত্র কেবল পশ্চিমাদের ছলনার মুখোশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। একইভাবে মিশর, তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্রের পক্ষে গণজাগরণ ঘটলে তাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে ব্যর্থ করে দেওয়ার চেষ্টায় রয়েছে এই অপশক্তি।
ভুক্তভোগী এসব দেশের অধিবাসীরা মুসলমান এবং অপরদিকে সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসী দেশগুলোর অধিকাংশ মানুষ ধর্মে খ্রিষ্টান। ফলে ধর্মীয় বিবেচনায় এটি মুসলমানদের ওপর খ্রিষ্টানদের আগ্রাসন বলা যায়। কিন্তু তলিয়ে দেখলে আমরা দেখব এই সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাদের কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে পুরো ল্যাটিন আমেরিকায়ও আগ্রাসন চালাচ্ছে, যারা ধর্মে খ্রিষ্টান। বিষয়টি তাই রাজনৈতিকভাবে বুঝতে হবে। ওদের মূল লক্ষ্য হল বাজার ধরা এবং সম্পদ লুণ্ঠন করা - ধর্ম যার যা-ই হোক না কেন। আফ্রিকায় আদিবাসীদের তারা নির্মমভাবে হত্যা, নির্যাতন ও লুণ্ঠন করেছে যারা মুসলিম ছিল না, খ্রিষ্টানও ছিল না।
আজকের বাস্তবতায় বাংলাদেশে দুটি বিষয় বিবেচনায় রাখা দরকার। প্রথমত, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী একটি উপাদান থাকা জরুরি, নয়ত এই গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনটিকে কেন্দ্র করে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ মাথাচাড়া দেবে এবং তাতে সা¤্রাজ্যবাদ ঠেকানো মুশকিল হবে। আমাদের স্মরণ রাখা দরকার  কি বিন লাদেন কি মোল্লা ওমর কি আফগানিস্তানের তালিবান এরা সবই সা¤্রাজ্যবাদেরই সৃষ্টি। কারণ তারা সবচেয়ে ভয় পায় উন্নযনশীল দেশের জাতীয়তাবাদী প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তিকে। তাই তারা একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, ঠিক যেমনভাবে ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তিও সেদিন করেছিল তাই আজ গণতান্ত্রিক শক্তিকে যুগপৎ মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই ধর্মভীরু, আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগসহ এদেশের গণতান্ত্রিক শক্তি ধর্ম পালন বা ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষা করার ব্যাপারে কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই। এ আমলে মসজিদ-মাদ্রাসার কোনো ক্ষতি হয়নি, হজ্ব-রোজা পালন বা ইজতেমা আয়োজনে কোনো সমস্যা হয় না। ফলে বুঝতে হবে যারা ইসলাম বিপন্ন হওয়ার ধুয়া তোলে তারা অন্য কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে। বাংলাদেশের মূল সমস্যা দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাব, কিন্তু ধর্মান্ধ শক্তিকে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দিতে তো দেখা যায় না।
আল-কায়দা কি বলল বা পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমে কি বলা হল তাতে বিভ্রান্ত না হয়ে আমাদের উচিত হবে নিজেদের কল্যাণে বাস্তব বুদ্ধি প্রয়োগ করে কাজ করা।

Monday, February 10, 2014

বিশ্ববিদ্যালয়: উচ্চশিক্ষার অভিমান ও আত্মপ্রতারণা

আবুল মোমেন

বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা, খুব সাধারণ বিচারেও, বর্তমানে মানহীন ও উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়েছে। আমাদের চোখের সামনেই এই পতন ঘটে চলেছে। ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয় চালু হওয়ার পর অবক্ষয় চূড়ান্ত রূপ পেয়ে চলেছে। এ পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে তাতে একথা স্পষ্টভাবেই বলা যায়, ব্যক্তিমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মূল লক্ষ্য ডিগ্রি ও সনদপত্র বিক্রয়ের বাণিজ্য। এই খাতের সফল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাফল্য এসেছে মূলত ব্যবসায়িকভাবেই, অ্যাকাডেমিক সাফল্য এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথচ এর নেতিবাচক প্রভাব এড়াতে পারেনি আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এগুলোতেও আয়-উপার্জন বাড়ানোর প্রবণতা ক্রমেই মুখ্য হয়ে উঠছে-শিক্ষক এবং প্রাতিষ্ঠানিক উভয়ভাবেই। এ নিয়ে মাঝে মাঝে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র-অসন্তোষ চরম আকার ধারণ করে থাকে, যার অনিবার্য পরিণতি দীর্ঘকালের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়া। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এই একই নাটকের পুনরাবৃত্তি হয়ে গেল।
একটু বলা দরকার, যদি সমাজে কোনো বিষয় নিয়ে সঠিক পথে মুক্ত আলোচনা, যথার্থ কিংবা সুস্থ বিতর্ক না হয় তাহলে নানা রকম উড়ো/উটকো ধারণা/সিদ্ধান্তের ফলে সে বিষয়ে করণীয় ও সমাজের প্রত্যাশায় ফারাক হয়ে যায়। আমার ধারণা উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের প্রত্যাশায় বিস্তর পার্থক্য তৈরি হয়েছে। আমাদের রাষ্ট্র এবং সমাজ সত্যিই উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে ডিগ্রিধারী চাকুরের প্রত্যাশাই করে থাকে। এছাড়া ডিগ্রি, কাগুজে ভালো ফল ও সনদপত্রের প্রতি মোহগ্রস্ত  এ সমাজ। ফলে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক সকলে মিলে নিষ্ঠার সাথে পরীক্ষা-ডিগ্রি-সনদের কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। কোর্সের পড়া, প্রয়োজনীয় টিউটরিয়াল, লাইব্রেরিসহ ছাত্রের প্রয়োজনীয় পঠনপাঠন মানসম্পন্নভাবে শেষ হয়েছে কিনা তা মোটেও বিবেচ্য বিষয় নয়। কয়েকটি বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে ক্লাস করার বিশেষ গুরুত্ব নেই, আসন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্ন পাওয়া ও তার উত্তর সংগ্রহ করে শেখার ওপরই ছাত্রের ভাগ্য ও ভবিষ্যত নির্ভর করে। কিন্তু প্রশ্ন হল উচ্চশিক্ষায় করণীয় কি এবং উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্য কি?
২০০৯ সনের বহুল প্রশংসিত জাতীয় শিক্ষা নীতিতে এসব বিষয়ে কী বলা আছে তা দেখে নিতে পারি আমরা। এতে অন্যান্য বিষয়ের সাথে বলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল -
* কার্যকরভাবে বিশ্বমানের শিক্ষাদান, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা জাগানো এবং মানবিক গুণাবলী অর্জনে সহায়তা দান।
* নিরলস জ্ঞানচর্চা ও নিত্য নতুন বহুমুখী মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার ভেতর দিয়ে জ্ঞানের দিগন্তের ক্রমপ্রসারণ।
* জ্ঞানচর্চা, গবেষণা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী হতে জ্ঞানের নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি।
* মেধার বিকাশ এবং সৃজনশীল নতুন নতুন পথ ও পদ্ধতির উদ্ভাবন।
* জ্ঞান সৃজনশীলতা এবং মানবিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ নাগরিক সৃষ্টি।
যে ল্যাটিন শব্দ থেকে ইউনিভার্সিটি শব্দটির উৎপত্তি তার সম্পূর্ণ অর্থ হল ‘শিক্ষা ও গবেষক সম্প্রদায়’। পরে শব্দটির আধুনিক ব্যবহার সম্পর্কে অভিধান বলছে: স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দানের ক্ষমতাসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান যেখানে প্রধানত ‘ non-vocational subjects’ এর চর্চা হয়।
এসব কথা বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে চাই চার ধরনের সম্পদের সমাহার -গবেষণায় আগ্রহী চিন্তাশীল জ্ঞানীর সমন্বয়ে শিক্ষকসমাজ, জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় উৎসাহী ছাত্রসমাজ ইন্টারনেট সুবিধাসহ সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, আধুনিক উন্নত সরঞ্জামসহ গবেষণাগার। এ কথা বলা বাহুল্য তরুণদের চাই শরীরে মনে সুস্থজীবন। তাই জিমনেশিয়াম ও খেলার মাঠ, সুইমিং পুলসহ শরীরচর্চার ব্যবস্থা, নিয়মিত অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতামূলক ক্রীড়া
অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ হল সৃজনশীল সুকুমার কলা চর্চার উপযোগী পরিবেশ, ব্যবস্থা, অবকাঠামো, সরঞ্জাম ইত্যাদির আয়োজন। আমার জানা মতে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব কিছুই ঠিকভাবে নেই, আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এ সবই আজ ধুলো-জমা স্মৃতির বিষয়।
এসব ক্ষেত্রে পরিস্থিতি গুণগত পরিবর্তনের জন্যে দ্রুত সংস্কার কাজে হাত না দিলে বিশ্ববিদ্যালয় - সব বিশ্ববিদ্যালয় - পতনের শেষ সীমায় পৌঁছাবে, উচ্চশিক্ষা তলিয়ে যাবে চরম নৈরাজ্যে।
সংস্কার বলতে আয় বাড়ানোর কৌশল নয়, দরকার বিশ্ববিদ্যালয়কে অর্থবহভাবে কার্যকর করা। উচ্চ শিক্ষার মূল লক্ষ্য তিনটি - কোনো বিষয়ে উচ্চতর ও বিশেষজ্ঞীয় জ্ঞান অর্জন, শিক্ষানীতি ও প্রচলিত ধারণার ভিত্তিতে বলা যায়, সে বিষয়ে গবেষণা ও উচ্চতর ভাবনার ক্ষমতা ও দক্ষতা অর্জন ও নতুনতর জ্ঞান সৃজন, এবং অর্জিত ও সঞ্চিত জ্ঞানের মাধ্যমে মানবসমাজের কল্যাণে অবদান রাখার যোগ্যতা অর্জন। এই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের উক্তিটি স্মরণীয়। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তাঁর মতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞা কি ? কবি ছোট্ট উত্তরে বলেছিলেন - যেখানে বিদ্যা উৎপন্ন হয়। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি চেয়েছেন নানা দেশের নানা বিষয়ের প-িতদের সমবেত করতে যাঁরা নিজনিজ গবেষণা চালিয়ে যাবেন আর ছাত্ররা সহযোগী হিসেবে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করবে। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় ব্যক্তিমালিকানাধীন বাণিজ্যিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটিই এ ধরনের লক্ষ্য ও করণীয় নিয়ে মাথা ঘামায় না। আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়টি বিভাগে কত ছাত্র (এবং শিক্ষক) এই লক্ষ্য-করণীয় পূরণ করেন তা আনুবীক্ষণিক অনুসন্ধানের বিষয় হতে পারে। তবে একদম হয় না একথা আমি বলব না। দেশে এখনও প-িত ব্যক্তি আছেন, ভালো গবেষকও আছেন, সত্যিকারের জ্ঞানী শিক্ষকও আছেন। ছাত্রদের মধ্যে গবেষণায় আগ্রহী, মৌলিক ভাবনায় পারদর্শী এবং প্রকৃত দেশপ্রেমিক মানবহিতৈষী মেধাবী তরুণ-তরুণীর দেখা পাই এখনও। দুর্ভাগ্যের বিষয় এরকম শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্যে আমাদের সব বিশ্ববিদ্যালয়ই কেবল একরাশ হতাশাই তৈরি করে থাকে।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং করণীয় যদি আমরা বুঝে থাকি তাহলে আমাদের বাস্তবতা ও প্রবণতাকে কী বলব? প্রথমেই আমাদের জানা এবং মানা দরকার শিক্ষা অধিকার বটে কিন্তু উচ্চশিক্ষা সংরক্ষিত থাকে শুধুমাত্র অধিকারীর জন্যে। অর্থাৎ যে উচ্চশিক্ষার অধিকার অর্জন করে তার জন্যে। এ কেবল মেধার বিষয় নয়, জীবনভর জ্ঞানার্জন, জ্ঞান অনুশীলনের এবং সেই সাথে ছাত্রদেরকে জ্ঞানচর্চার পথে উদ্বুদ্ধ করা ও পথনির্দেশ দানের মানসিকতা থাকা আবশ্যিক।
যে কোনো দেশের মত আমাদেরও উদীয়মান তরুণ জনগোষ্ঠীর ৯০ ভাগ চাকুরি-প্রত্যাশী। কিন্তু একে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে খুব ধীরে এবং তার ওপর কর্মবাজারের চাহিদার কোনো নিয়মিত হালনাগাদ তথ্য কারও হাতে নেই, ফলে কোনো ভবিষ্যত চিন্তা ও কৌশল ছাড়াই সবাই গড্ডলিকায় গা ভাসিয়ে দেয়। এদিকে চাকুরির অনিশ্চয়তা আর এখনও বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রির সামাজিক মূল্য থাকার ফলে যে কোনো তরুণ উচ্চ মাধ্যমিক বা ডিগ্রি শেষ করে ¯স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পর্যন্ত পড়াশুনা চালিয়ে যেতে চায়। লক্ষ্য করার বিষয় হল এভাবে অধিকাংশ ছাত্রের লক্ষ্যের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠনের লক্ষ্যের কোনো সঙ্গতি থাকে না। অথচ তাদের জন্যে অন্য কোনো উপযুক্ত আকর্ষণীয় বিকল্প না থাকায় অনিশ্চিত বেকার জীবনের গ্লানি বহনের চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্বকে অন্তত একটি সম্মানজনক বিকল্প পরিচয় ভাবে ছাত্র ও তার অভিভাবকরা। এভাবে আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রমাগত এমন ছাত্রের চাপ বেড়ে চলেছে যাদের নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন ও চর্চার কোনো আগ্রহ থাকে না। তদুপরি বাজারের চাহিদা ও সামাজিক মূল্য বিবেচনায় নিয়ে যোগ্যতা-আগ্রহ-নির্বিশেষে ছাত্ররা নির্দিষ্ট কোনো কোনো বিষয়ে ভর্তি হতে চায়। স্বভাবতই সবার জন্যে সে সুযোগ থাকে না। ফলে সত্য হল, আজ পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্র তার অপছন্দের বিষয়ে পড়াশুনা করে! এই বাস্তবতার কারণে যে কোনো বিশ্ববিদালয়ে অনিচ্ছুক ছাত্ররাই সংখ্যাগুরু হওয়ায় এদের প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক পরিবেশ ক্ষুণœ হতে বাধ্য। আর শ্রেণিকক্ষে অনাগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি হওয়ায় ক্রমে শিক্ষকও আন্তরিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ, ভালোভাবে ক্লাস নেওয়ার প্রণোদনা হারিয়ে ফেলেন। এ পরিস্থিতি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকায় বা চলতে দেওয়ায় দেশের পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক পরিবেশ ও অর্জনে মারাত্মক অবনতি ঘটে গেছে। আজ আমাদের দেশের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ই বিশ্বের মান-নির্ধারণী তালিকায় একশতের মধ্যেও নেই। এখানকার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিই আর বিশ্বের উচ্চ মানের বিশ্ববিদ্যালয়ে সমমর্যাদায় স্বীকৃত নয়। এ পরিণতি কি আমরা চেয়েছিলাম?
যদি তা না চেয়ে থাকি তাহলে এ হযবরল অবস্থা চলতে দেওয়া কি উচিত? উচ্চশিক্ষার নামে কেবল ডিগ্রি ও সনদপত্রের বাণিজ্য বা এগুলো বিতরণ করার জন্যে কেন বিশ্ববিদ্যালয়?
আমরা লক্ষ্য করছি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেশের কর্ম বাজারের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে কেবলমাত্র বিবিএ, এমবিএ, আইন, কম্প্যুটার প্রকৌশল মূলত এই ক’টি বিষয়ে মনোযোগ দিচ্ছে। এর পাশাপাশি উন্নয়ন, পরিবেশের মত সম্ভাবনাময় কিছু বিষয়ও চালু করছে। কিন্তু কোথাও মৌলিক বিদ্যা অর্থাৎ দর্শন, গণিত, বিভিন্ন শাখার ভৌত বিজ্ঞান, বিভিন্ন শাখার প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস, ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চতর জ্ঞান চর্চা ও ডিগ্রির কোনো আয়োজন নেই। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয় থাকলেও ভালো ছাত্রদের আগ্রহ এতে কম। ফলে কোথাও নতুন জ্ঞান সৃষ্টি বা রবীন্দ্রনাথের  ভাষায় বিদ্যা উৎপাদনের কোনো পরিবেশ নেই। অনেক শিক্ষক এবং ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন যোগ দিয়ে আর অনেক শিক্ষক বিদেশ থেকে জ্ঞানে ও উদ্দীপনায় সমৃদ্ধ হয়ে ফিরে এলে সত্যিই কিছু করতে চেয়ে বিরূপ পরিবেশে শেষ পর্যন্ত হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেন। এভাবে আজ একদিকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হল হাল ভাঙা জাহাজ আর অন্যদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেন বাণিজ্যপোত। পরিণতিতে দেশে মেধাবী তরুণ প্রচুর থাকলেও মেধা লালনের অভাবে, আর লক্ষ্যহীন গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে সকলেই চলেছে হতাশার শেষ প্রান্তে।
সরকারি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা ও রাজশাহীতে ছাত্রসংখ্যা ত্রিশ হাজার ছাড়িয়েছে, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগরে পনের হাজারের মত। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা কুড়ি হাজারের বেশি। এমন বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজের কথাও শুনেছি যেখানে ছাত্র সংখ্যা অর্ধলক্ষের বেশি! আমাদের কেন্দ্রীভূত প্রশাসন ব্যবস্থায় এত ছাত্রের (এবং শিক্ষক-কর্মচারীর) প্রশাসনিক সকল দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করা কিছুতেই সম্ভব নয়। খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবাসের যেসব কক্ষ একজন ছাত্রের জন্যে নির্ধারিত ছিল সেগুলোতে ৪/৫জন থাকছে, বারান্দায় বিছানা পেতে থাকছে, কমনরুমও ছাত্রদের দখলে চলে গেছে। যুদ্ধাবস্থায় সাময়িকভাবে গাদাগাদি করে দু:সময় পার করা যায়, কিন্তু সেটাই যদি স্থায়ী ব্যবস্থা হয় তাহলে এই অস্বাভাবিক জীবনের প্রভাব তো ছাত্রের শরীর-মনে পড়বেই। পড়ছেও। অধিকাংশের লক্ষ্য হয়ে পড়েছে কোনো মতে একটি ডিগ্রি ও সনদ জোগাড় করা। পড়াশুনার বাস্তব কোনো পরিবেশ না থাকায় এর জন্যে সহজ উপায় তাদের খুঁজতে হয়েছে, শিক্ষকদেরও এতে শরিক হতে হচ্ছে। ফলে অর্থহীন উদ্দেশ্যহীন কার্যক্রমের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত ‘তারুণ্যের অপচয়’ মঞ্চে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ কোনো খেলাধুলা নেই, লাইব্রেরির ব্যবহার নেই, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নেই, এমনকি ছাত্র-শিক্ষক মিলে সত্যিকারের শিক্ষা-সফরও হয় না (পিকনিক হয়)। কোনো একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে ঘাস গজিয়েছিল।
মানতে হবে রাতারাতি অবস্থা পাল্টানো যাবে না। তবে অদূর ভবিষ্যতে এই নৈরাজ্য ও অপচয় রোধ করে সঠিক অবস্থায় ফেরার কাজ এখন থেকেই শুরু করতে হবে। তবে একটি সহজ কথা হল,গুণগত পরিবর্তনের কাজটি শীর্ষ থেকে শুরু করার নয়, নিচের থেকে ধাপে ধাপেই তা হতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষা সবার অধিকার এবং এ বিষয়ে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সরকার ভর্তির বিবেচনায় তা পূরণ করেছেন, এখন মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে অন্তত অষ্টম শ্রেণি
পর্যন্ত ভর্তি হওয়া সব ছাত্রছাত্রীকে ধরে রাখা যাতে একসময় এটুকু শিক্ষিত একটি জাতি তৈরি হয়। নবম শ্রেণি থেকে বিদ্যাচর্চার বিভিন্ন শাখায় ভাগ হয়ে যায় ছাত্ররা। আমার মনে হয় বাংলা-ইংরেজি-সাধারণ বিজ্ঞানের  মত অবশ্য পাঠ্য বিষয়ের সাথে সব শাখার বিষয়গুলো উন্মুক্ত রেখে তা থেকে ৪/৫টি বিষয় বেছে নিয়ে ছাত্ররা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়লে ভালো হয়। ততদিনে তারা ভালোভাবে বুঝতে পারবে জীবিকা এবং আগ্রহের বিচারে কার জন্যে কোন ধারায় শিক্ষাগ্রহণ ঠিক হবে। এভাবে এক সময় সমমানের উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত জাতি গঠন সম্ভব হবে। এরপরে বৃত্তিমূলক ও পেশাগত বিদ্যা এবং বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়ে ডিপ্লোমা ও স্নাতক ডিগ্রির জন্যে কলেজ, ইন্সটিটিউট থাকবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের অধীনে এ ধরনের ডিগ্রি প্রদানের  কলেজ, ইন্সটিটিউট চালু করতে পারে। ধীরে ধীরে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারণ করতে হবে যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শর্ত, চাহিদা পূরণ করবে। এই উচ্চতর জ্ঞানচর্চার প্রতিষ্ঠানের  ছাত্র সংখ্যা হবে কম, শিক্ষকদের বেতন হবে দেশে সর্বোচ্চ মানের।
আশা করি একে কেউ উচ্চশিক্ষা সংকোচনের দূরভিষন্ধি মনে করবেন না। আমার বিনীত নিবেদন হল উচ্চ শিক্ষার নামে যা চলছে তা বাস্তবে কোনা শিক্ষাই নয়, শিক্ষার পরিহাস। একটি জাতি এভাবে উচ্চশিক্ষার অভিমান পুষে বছরের পর বছর আত্মপ্রতারণা চালিয়ে যেতে পারে না। জাতীয় স্বার্থেই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া উচিত।

Saturday, February 1, 2014

শেখ হাসিনা একাই খেললেন, তারপর?

আবুল মোমেন

তত্ত্বাবধায়ক সরকার-সংক্রান্ত সংসদীয় উপ-কমিটির সুপারিশ অগ্রাহ্য করে নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বস্তুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ক্ষমতার রাজনীতির নিয়ন্ত্রণভার এককভাবে নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন। এটি কি বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বড় কোনও পরিবর্তনের মাইলফলক হতে যাচ্ছে? পরিবর্তনটা কোনদিকে হবে - উত্তরণের, নাকি অধঃপাতের? এ প্রশ্নটা এখন অনেকের মনে ঘুরপাক খাবেই।
সমাজের নীরব সংখ্যাগুরু মানুষ সম্ভবত খারাপ কিছুর আশঙ্কা করেছে। কারণ শেখ হাসিনা সেই সিদ্ধান্ত ও পরবর্তী ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির সব ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এককভাবে, দলীয়ভাবে তা ছিল একতরফা, এসব বাস্তবায়নের পথ ছিল জবরদস্তিমূলক ও এসবের চূড়ান্ত পরিণতিতে যে নির্বাচন- তা ছিল বস্তুত প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন, মোটামুটি ভোটারবিহীন। এসব ঘটনাবলিতে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো উপেক্ষিত, এমনকী পদদলিত হয়েছে, সাধারণ নৈতিকতা লঙ্ঘিত হয়েছে। তাই নির্বাচন এবং দশম সংসদ ও নতুন সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। সরকার ও ক্ষমতাসীন জোটের দিকে নৈতিকতা ও বৈধতার প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া যায়, মিথ্যাচার ও কর্তৃত্ববাদী জবরদস্তি শাসকের অপবাদ দেওয়া যায়। এসবই বিরোধীদলীয় নেতাদের মুখে, জনগণের আলাপে, গণমাধ্যমে এখনও ব্যাপকভাবে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এতসব নেতিবাচক সমালোচনা কুড়িয়েও বর্তমান সরকারের নিজেকে দুর্বল ভাবার বাস্তব কোনও কারণ ঘটেনি। বরং যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্র দেশগুলো- যারা সারা বিশ্বে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়নে সদা উৎসুক ও তৎপর থাকে এবং বাংলাদেশেও বরাবর সেভাবেই ভূমিকা পালন করে এসেছে ও বিশেষভাবে দশম সংসদের নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট সংঘাত এবং অচলাবস্থার সময় সোচ্চার ও সক্রিয় ছিল, তারাও দেখা যাচ্ছে, এখন আলোচনা-সমঝোতা ও নতুন নির্বাচনের কথা নামমাত্র বলে বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার কথাই দ্ব্যর্থহীনভাবে জানাতে উৎসুক। এভাবে তাদের মূল ভরসার দেশগুলোর পিছু হটা দেখতে নিশ্চয় বিএনপি নেতৃত্ব প্রস্তুত ছিল না। তাছাড়া বাংলাদেশের জনগণের রাজনীতি-সচেতনতা নিয়েও সবার ভরসা অনেক বলে বিরোধীপক্ষ তাদের মোটামুটি জনসমর্থিত দাবিতে সরকারবিরোধী আন্দোলনে জনগণের ব্যাপক সাড়া প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু তারা সেভাবে সাড়া দিচ্ছে না, নিজ-নিজ নিরাপদ অবস্থানে থেকে মতামত দিলেও বিএনপির ডাকে পথে নামছে না। এখন প্রশ্ন হল, কেন এমন ঘটছে বা ঘটেছে?
সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার এতসব মোক্ষম ইস্যু থাকা সত্ত্বেও তা দানা না বাঁধার দায় তো প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকেই নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্রদের মন প্রথম পর্যায়ে জামায়াত সম্পর্কে নমনীয় থাকলেও শেষ পর্যন্ত তাদের পক্ষে আনতে শেখ হাসিনা ও তার জোট সক্ষম হয়েছে। অথচ বিএনপি এদের মুখাপেক্ষী হয়েও শেষ পর্যন্ত জামায়াতের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার নীতিই বহাল রেখেছে। তাতে এ ইস্যুটা কোনওভাবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক রাখার পাশাপাশি জামায়াতের নেতিকরণের কাজটি অনেকটাই সফল হয়েছে। তবে এ সাফল্যের কৃতিত্ব ততটা আওয়ামী লীগের নয়, যতটা একদিকে তরুণসমাজ ও সুশীলসমাজের এবং অন্যদিকে খোদ জামায়াতের। নাগরিকসমাজের মনোভাবকে আন্তর্জাতিক মহল উপেক্ষা করতে পারে না। আর সর্বশেষ আন্দোলনে প্রধানত জামায়াতের ক্যাডারদের ভূমিকা নির্মমভাবে গণবিরোধী ও ধ্বংসাÍক হওয়ায় এবং এর ধর্মীয় সংখ্যালঘুবিরোধী সাম্প্রদায়িক ভূমিকা প্রকট হওয়ায় পশ্চিমা বিশ্বের জন্য তাকে সমর্থন করা মুশকিল ছিল। জামায়াত এ ধরনের হিংসাÍক ধ্বংসাÍক রাজনীতি পরিহারের কোনও ইশারা দেয়নি, আর বিএনপি তাদের ত্যাগ করার পরামর্শে কান দেয়নি। ফলে অন্তত সাময়িকভাবে বিএনপি তার সম্ভাব্য মিত্রদের সমর্থন থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
এদিকে জনগণের জন্যও একইভাবে যেমন পেট্রলবোমার মর্মান্তিক পরিণতি মেনে নেওয়া কঠিন ছিল, তেমনি কঠিন হয়েছে অবরোধের ফলাফলের ভোগান্তি দীর্ঘদিন সহ্য করা। সম্ভবত জনগণের সচেতন অংশটির মনোভাবও জামায়াত সম্পর্কে নমনীয় নেই আর। তাদের বিএনপির প্রতি অনীহা নেই। কিন্তু ভরসাও নেই দলটির ওপর। ভরসা দুর্বল হয়েছে নানাভাবে। বিএনপির আন্দোলন চলে গেছে জামায়াতের হাতে- যারা জেহাদি জোশের প্রচারণা চালিয়ে একশ্রেণীর তরুণকে নিরীহ মানুষ মারতে উস্কে দিয়ে কসুর করে না। এর দায় মানুষ নেবে না। দ্বিতীয়ত, বিএনপি রাজপথে জঙ্গি আন্দোলনের ডাক দিয়ে তাতে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়নি- হয় শান্তভাবে কারাবরণ করেছে, নয়তো আÍগোপন করে আÍরক্ষা করেছে। ফলে একদিকে সংসদ ও নির্বাচন বর্জন করে, অন্যদিকে কারাবরণ ও পলাতক হয়ে বস্তুত তারা রাজনীতির রঙ্গমঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে বহু আগে থেকেই। এতে সমর্থক ও ক্ষমতায় পরিবর্তনপ্রত্যাশীদের কাছে বারতাটি এসেছে যে, নিজ দলের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের প্রতি বিএনপি নেতৃত্বের বিশ্বাস এবং অঙ্গীকার আদতে দৃঢ় নয়। এই একটি ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা দুঃসময়ের পরীক্ষায় একেবারে শতভাগ উত্তীর্ণ। আর খালেদা জিয়া থেকে বিএনপির জেলা নেতা- সবাই তাদের সমর্থকদের আশাহত করেছেন। কথায় বলে- দৌড়ে যে ঘোড়াটি পিছিয়ে পড়ে, তার থেকে সমর্থন তুলে জয়ী ঘোড়ার ওপরই বাজি ধরতে চায় মানুষ।
শেখ হাসিনা যেভাবে বিজয় অর্জন করে চলেছেন, তার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে- সে কথা আগেই বলেছি। কিন্তু যেনতেন প্রকারের বিজয়ও টিকে যায় যদি উপযুক্ত কোনও স্থান থেকে চ্যালেঞ্জ না আসে। বিএনপি এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে, আর জামায়াত হচ্ছে সেই কার্যকারণ- যা দ্বিধারী ছুরির মতো নিজের ও সঙ্গী বিএনপির সমর্থনের ওপর কোপ দিয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে- স্যামসনের যেমন শক্তির উৎস ছিল তার চুল, বিএনপির হল ক্ষমতা। ক্ষমতা হারিয়ে দলটি শক্তিহীন হয়ে সরকারের ওপর রাগ করে জনগণকে দুর্ভোগে ফেলে স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছে। এতে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সরকারকে দুর্ভোগে ফেলার বা অচল করে দেওয়ার ভাবনা সম্পূর্ণ বাদ গেছে। আর এর ফলে জনদুর্ভোগ কমাতে সরকার শক্ত হাতে বিএনপিকে দমনের সুযোগ পেয়ে গেছে। সুযোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে জামায়াত সম্পূর্ণ নাশকতানির্ভর রাজনীতি করতে গিয়ে। এর জের ধরে পুলিশ-র‌্যাবের ‘বন্দুকযুদ্ধ’ পর্ব এখনও চলছে। এ নিয়ে মানবাধিকারকর্মীদের কণ্ঠ শোনা গেলেও জনগণের উদ্বেগ নেই।
নাগরিকসমাজের বড় একটি অংশ ১৯৭৫ সালের পর থেকেই পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের ভিত্তিতে অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠন ও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ-পরিচালনার গুরুত্ব অনুধাবন করে আসছে। তারা কখনও মাঠ ছাড়েননি। তাদের জেদেই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক এবং নাগরিকসমাজ এই আদর্শের প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। তার প্রকাশ হিসেবে আমরা দেখছি বিএনপি-আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দলকে এই আদর্শের ভিত্তিতে দুটি জোটে বিভক্ত করেছে, আর সব পেশাজীবী সংগঠনে বিভক্তি ঘটিয়েছে। এসব সংগঠনের জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন বহুকাল ধরেই এ বিভক্তির ভিত্তিতে হয়ে এখন কোনও-কোনওটি স্থায়ীভাবে পৃথক সংগঠনের রূপ নিয়ে আর নির্বাচনেও একে অন্যের মোকাবিলা করতে রাজি নয়। জাতীয় রাজনীতি যেহেতু পুরো দেশ নিয়ে এবং দেশের একটি সরকার গঠন নিয়ে- সেহেতু এখানে সে সুযোগ হচ্ছে না, মুখোমুখি হতেই হচ্ছে। কিন্তু নির্বাচনের পর ঠিকই সংসদ বর্জনের মাধ্যমে মোকাবিলা না করার সংস্কৃতি চালিয়ে গেছে দলগুলো।
সম্প্রতি গণজাগরণ মঞ্চের উত্থানের পর দেশের নবপ্রজšে§র মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি আস্থার প্রকাশ ঘটেছে। বিএনপি এই উদীয়মান শক্তিকে একেবারেই পাত্তা দেয়নি, বিপরীতে ঘনিষ্ঠ হয়েছে জামায়াত-হেফাজত প্রভৃতি ধর্মব্যবসায়ী প্রতিক্রিয়াশীল দলের সঙ্গে। সমাজের প্রায় সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়া এ বিভক্তির চর্চা ক্রমেই রাজনীতিকে সহিংস করে তুলেছে, নাগরিক জীবনকে করে রেখেছে অস্থির। এ পরিণতি থেকে এটা পরিষ্কার- যদি আমাদের সমাজ এই অস্থিতিশীলতা ও সহিংস রাজনীতির অবসান চায়, তাহলে সমাজের বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা ও তর্ক উš§ুক্ত রাখতে হত। কিন্তু সেটি প্রায় তিন যুগেও হল না। শেখ হাসিনা গতবার বিপুল বিজয়ের পর ক্ষমতায় থেকেই বিষয়টির নিষ্পত্তি চাপিয়ে দিতে চেয়েছেন। বিরোধী দলের ভ্রান্ত রাজনীতি ও সাংগঠনিক দুর্বলতায় তাতে আপাতত সফলও হয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, চাপিয়ে দেওয়া হলেও এই সমাধান তেমন দুর্বল হয়নি। দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে গণজোয়ার না হলেও সমর্থনের ভিত বেশ ব্যাপক, তারা শেখ হাসিনার সমাধানকে মন্দের ভালো ও সাময়িক সমাধান হিসেবে গ্রহণ করেছে। দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মহলও একইভাবে এ সমাধান মেনে নিয়েছে।
তবুও বিরোধী দলের জন্য সুযোগ রয়েছে। তা রয়েছে মানুষের মনের ‘মন্দের ভালো’ বোধের ভাবাবেগ ও বিগত নির্বাচনটিকে সাময়িক সমাধান ভাবার মধ্যে। এ সত্ত্বেও এদের আন্দোলনে টানতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে, সময় নিয়ে ধাপে-ধাপে আন্দোলন তুঙ্গে তুলতে হবে। আর আওয়ামী লীগকে শেষ রক্ষা করতে হলে একচেটিয়া ক্ষমতার সর্বনাশা পরিণতি রোধ করতে ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের বেপরোয়া নেতাকর্মীদের সামলাতে হবে, সুশাসনের পথ উš§ুক্ত করতে হবে, দুর্নীতিরোধে সর্বাÍক ব্যবস্থা নিতে হবে এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯-দলীয় জোটের সঙ্গে অর্থপূর্ণ সংলাপ চালাতে হবে। সম্ভবত, এসব কাজে শেখ হাসিনাকে একক কেন্দ্রীভূত হুকুমদারির নেতৃত্ব থেকে সরে অংশীদারী নেতৃত্বের পথে হাঁটতে হবে। কেননা তা না হলে নেতৃত্ববঞ্চিত বিভিন্ন স্তরের নেতাদের উপদলীয় কোন্দল আর দায়িত্বমুক্ত থেকে ক্ষমতার প্রসাদ লুণ্ঠনে মত্ত হওয়া থেকে বিরত রাখা কঠিন হবে। তাই শেখ হাসিনার জন্য কাজটা কঠিন সন্দেহ নেই। তবে সে পথেই টেকসই ও সুদূরপ্রসারী সমাধান মিলবে।