Wednesday, February 19, 2014

বিভ্রান্তির নাম আল-কায়দা

আবুল মোমেন

বাংলাদেশকে নিয়ে আল-কায়েদার শীর্ষ নেতার বক্তব্য নি:সন্দেহে সরকার ও সচেতন নাগরিকদের জন্যে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। তবে এ ঘোষণার পিছনে আল-কায়েদার সক্রিয় ভূমিকা কতটা তা এখনও পরিস্কার নয়। দেখা যাচ্ছে আয়মান আল জাওয়াহিরির এই বক্তব্য সম্পর্কে গত ২৪ জানুয়ারি মার্কিন গবেষণা সংস্থা জেমসটাউন ফাউন্ডেশনের সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত নিয়মিত প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়েছিল। ইউটিউবে দেখা যাচ্ছে জাওয়াহিরির স্থিরচিত্রের সাথে উর্দুতে ২৯ মিনিটের একটি ভাষণ প্রচারিত হয়েছে। আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়, কণ্ঠস্বরটি কি জাওয়াহিরির নাকি অন্য কারো। সেই সাথে পুরো বিষয়টি খাঁটি নাকি সাজানো সে প্রশ্নও উঠবে।
আমাদের জন্য এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এর পেছনে বাংলাদেশের কারা বা কোন-কোন সংগঠন যুক্ত আছে তা জানা। আল-কায়েদা একটি স্বঘোষিত জঙ্গি সংগঠন। এ কথাও ঠিক বাংলাদেশের বেশ কিছু সংগঠন সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসী। এ ধরনের কিছু সংগঠনের বেশ কিছু হিংসাত্মক তৎপরতার কথা আমরা জানি। বিশেষভাবে বিএনপির ২০০১-২০০৬ আমলে এ ধরনের তৎপরতা অনেক বেড়েছিল। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা, উদীচী সম্মেলন, সিপিবির সভা, ছায়ানটের বর্ষবরণ, নেত্রকোণায় প্রেক্ষাগৃহ এবং একইদিনে সব জেলা শহরে বোমা বিস্ফোরণ, বিচারক হত্যা ইত্যাদি অনেগুলো ভয়ানক ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। দুর্ভাগ্যের বিষয় সেই সময়ের সরকার ঘটনাগুলোর হোতাদের বিচারে আন্তরিকতার পরিচয় দেয় নি, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের আড়াল করার চেষ্টা করেছিল। পরবর্তীকালে মহাজোট সরকারের আমলে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা হয়েছে। তখনই তদন্তে জানা গেল এদের অনেকেরই সম্পর্ক রয়েছে দেশে জামায়াতে ইসলামির সাথে এবং আন্তর্জাতিকভাবে কোনো কোনো জঙ্গি সংগঠনের সাথে।
 ২০০৮ সনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর যখন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের বেশ ক’জন শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার ও বিচারের সম্মুখীন হলেন তখন দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধ, সরকার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও এর প্রক্রিয়া নিয়ে বিদেশে ব্যাপক নেতিবাচক প্রচারণা চালানো শুরু হয়। প্রচারণার জন্যে একদিকে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশ এবং অন্যদিকে ব্রিটেনসহ শক্তিধর কিছু পশ্চিমা দেশকে বেছে নেওয়া হয়। গত বছর  ৫ মে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা-সমাবেশকে কেন্দ্র করেও এসব দেশে একইরকমের প্রচারণা চালানো হয়। আর মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের রায় ঘোষিত হওয়ার পরও এ ধরনের প্রচারণা জোরদার করা হয়।
দেখা যাচ্ছে জামায়াত তাদের নেতাদের বিচারকে কেন্দ্র করে যেসব প্রচারণা চালিয়েছে এবং হেফাজতের সমাবেশ ভাঙাকে কেন্দ্র করে পুলিশি তৎপরতা নিয়ে যেসব প্রচারণা চালানো হয় তার সাথে বর্তমানে আল-কায়েদা প্রধানের নামে যে ভিডিও বার্তা প্রচারিত হয়েছে তার বক্তব্য প্রায় হুবহু মিলে যায়। সে সময়ও এ সরকারকে ইসলামবিরোধী ও ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং সরকারের কর্মকাণ্ডকে ইসলামের নবী ও মুসলিম উম্মার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হিসেবে প্রচার করা হয়। তাছাড়া সরকারকে ভারতপন্থী এবং তাদের হাতে দেশ ভারতের কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে বলে যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তাও খুবই পরিচিত ভাষ্য। আল-জাওয়াহিরি এমন কথাও বলেছেন, ‘বাংলাদেশের রাজপথে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। তাদের অপরাধ ছিল একটাই, ইসলামবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের সঙ্গে কতিপয় বিপথগামী নাস্তিক্যবাদীর যোগসাজশের প্রতিবাদে তারা রাস্তায় নেমেছিল।’ বোঝা যাচ্ছে ইঙ্গিতটা হেফাজতে ইসলামের ৫ মে’র সমাবেশের ওপর পুলিশি অ্যাকশনের দিকেই। এ ধরনের কথা ঐ সময়ও হেফাজতের পক্ষ থেকে এবং জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী কোনো কোনো গোষ্ঠীর তরফ থেকে চালানো হয়েছিল। মাঠ পর্যায়ে কথাবার্তা বলে দেখা গেছে সরলপ্রাণ মাদ্রাসা-ছাত্রসহ অনেক ধর্মভীরু সাধারণ মানুষ হাজার
হাজার মানুষ হত্যার এই তথ্য বিশ্বাস করেন। আমরা বুঝতে পারি দেশের বিপুল সংখ্যক সরলবিশ্বাসী সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে দলে টানার জন্যে এ ধরনের প্রচারণার কৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে।
এখন দেখা যাচ্ছে আয়মান আল-জাওয়াহিরির বক্তব্যের সাথে জামায়াতে ইসলামি এবং হেফাজতে ইসলামের সমর্থকদের বক্তব্য ও প্রচারণায় মিল রয়েছে। ফলে আল-কায়েদাকে এ কাজে লাগানোর পেছনে এ দুই সংগঠনের কিছু ভূমিকা থাকাই স্বাভাবিক। অবশ্য এ তথ্য প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথেই হেফাজতে ইসলামের শীর্ষ দুই নেতা বিবৃতির মাধ্যমে এর সাথে তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন। যাই হোক, এ ব্যাপারে তদন্ত করেই সত্য পাওয়া যাবে।
আমরা জানি, আমাদের দেশে সেই ১৯৪৭ সালের পর থেকেই ইসলাম-বিপন্ন এই ধুয়া তুলে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়, যাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা ধর্মান্ধ শক্তির হাতেই থাকে। অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তিকে বরাবরই এরা ধর্মহীন ও ভারতের সেবাদাস ইত্যাদি সমালোচনার মাধ্যমে ঘায়েল করতে চেয়েছে। আমাদের আশা ছিল গত ষাট বছরের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে মানুষ এ ধরনের যুক্তির ভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। গণতান্ত্রিক ধারার প্রধান দল আওয়ামী লীগও তার এই বিরুদ্ধ সমালোচনার বাধা অনেকটাই অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের জনসংখ্যার প্রায় সমান মুসলিম জনসংখ্যা সম্বলিত দেশ ভারত সম্পর্কেও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এখনও বেশ কিছু মানুষ পুরোনো ধ্যান-ধারণা আকড়ে রয়েছেন।
তবে এখানে আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়। পশ্চিমের উন্নত বিশ্বের ঔপনিবেশিক ও সা¤্রাজ্যবাদী ভূমিকার অবসান আজও হয় নি। গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকে এশিয়া-আফ্রিকার পরাধীন দেশগুলো মুক্তি পেয়েছে, এরপরে সত্তর-আশির দশকে বিপ্লবী সংগ্রাম চালিয়ে ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোও উন্নত বিশ্বের অর্থনৈতিক শোষণের শৃঙ্খল থেকে অনেকটাই মুক্ত হয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এ সত্ত্বেও সা¤্রাজ্যবাদ নতুন কায়দায়, বিশেষত বিশ্বায়ন ও মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্পদ ও বাজারের ওপর তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছে। তারা এই আধিপত্য ধরে রাখার জন্য চাতুরি, বঞ্চনা এবং সর্বোপরি নির্মম অত্যাচার ও ধক্ষংসযজ্ঞ চালিয়ে যেতে কসুর করে না। আমরা দেখেছি জ্বালানি তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তেল সম্পদের ওপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব চালিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমের বড় বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো। তাদের এই স্বার্থের পথে তারা ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার গাদ্দাফিকে বাধা হিসেবে দেখেছে এবং অত্যন্ত কৌশলে, নির্মম ছলনার মাধ্যমে এবং নিষ্ঠুর সামরিক অভিযানের ভেতর দিয়ে তাঁদের হত্যা করে সরকারের পতন ঘটিয়ে নিজেদের পছন্দের পুতুল সরকার বানিয়েছে। ইরান ও সিরিয়াকে সা¤্রাজ্যবাদ তাদের স্বার্থ হাসিলের পথে বাধা হিসেবে গণ্য করছে বলেই এ দুই সরকারের পতনের জন্যে নানা ছলচাতুরির আশ্রয় নিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে তাদের গালভরা গণতন্ত্রের বুলির পরিণতিতে ইরাক ও লিবিয়া আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, দুই দেশেই হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং দু’টি দেশই দীর্ঘমেয়াদী অরাজকতার সম্মুখীন হয়েছে। গণতন্ত্র কেবল পশ্চিমাদের ছলনার মুখোশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। একইভাবে মিশর, তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্রের পক্ষে গণজাগরণ ঘটলে তাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে ব্যর্থ করে দেওয়ার চেষ্টায় রয়েছে এই অপশক্তি।
ভুক্তভোগী এসব দেশের অধিবাসীরা মুসলমান এবং অপরদিকে সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসী দেশগুলোর অধিকাংশ মানুষ ধর্মে খ্রিষ্টান। ফলে ধর্মীয় বিবেচনায় এটি মুসলমানদের ওপর খ্রিষ্টানদের আগ্রাসন বলা যায়। কিন্তু তলিয়ে দেখলে আমরা দেখব এই সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাদের কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে পুরো ল্যাটিন আমেরিকায়ও আগ্রাসন চালাচ্ছে, যারা ধর্মে খ্রিষ্টান। বিষয়টি তাই রাজনৈতিকভাবে বুঝতে হবে। ওদের মূল লক্ষ্য হল বাজার ধরা এবং সম্পদ লুণ্ঠন করা - ধর্ম যার যা-ই হোক না কেন। আফ্রিকায় আদিবাসীদের তারা নির্মমভাবে হত্যা, নির্যাতন ও লুণ্ঠন করেছে যারা মুসলিম ছিল না, খ্রিষ্টানও ছিল না।
আজকের বাস্তবতায় বাংলাদেশে দুটি বিষয় বিবেচনায় রাখা দরকার। প্রথমত, আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী একটি উপাদান থাকা জরুরি, নয়ত এই গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলনটিকে কেন্দ্র করে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ মাথাচাড়া দেবে এবং তাতে সা¤্রাজ্যবাদ ঠেকানো মুশকিল হবে। আমাদের স্মরণ রাখা দরকার  কি বিন লাদেন কি মোল্লা ওমর কি আফগানিস্তানের তালিবান এরা সবই সা¤্রাজ্যবাদেরই সৃষ্টি। কারণ তারা সবচেয়ে ভয় পায় উন্নযনশীল দেশের জাতীয়তাবাদী প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তিকে। তাই তারা একাত্তরে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, ঠিক যেমনভাবে ধর্মান্ধ মৌলবাদী শক্তিও সেদিন করেছিল তাই আজ গণতান্ত্রিক শক্তিকে যুগপৎ মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে হবে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই ধর্মভীরু, আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগসহ এদেশের গণতান্ত্রিক শক্তি ধর্ম পালন বা ইসলামি মূল্যবোধ রক্ষা করার ব্যাপারে কারো চেয়ে পিছিয়ে নেই। এ আমলে মসজিদ-মাদ্রাসার কোনো ক্ষতি হয়নি, হজ্ব-রোজা পালন বা ইজতেমা আয়োজনে কোনো সমস্যা হয় না। ফলে বুঝতে হবে যারা ইসলাম বিপন্ন হওয়ার ধুয়া তোলে তারা অন্য কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করছে। বাংলাদেশের মূল সমস্যা দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাব, কিন্তু ধর্মান্ধ শক্তিকে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দিতে তো দেখা যায় না।
আল-কায়দা কি বলল বা পশ্চিমা প্রচারমাধ্যমে কি বলা হল তাতে বিভ্রান্ত না হয়ে আমাদের উচিত হবে নিজেদের কল্যাণে বাস্তব বুদ্ধি প্রয়োগ করে কাজ করা।

No comments:

Post a Comment